“চমৎকার,” ক্যাথারিনের দিকে হেসে বললেন অ্যাবিস। “কিন্তু তোমাকে দেখার পর এই বুড়ো হাড়ে যে উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়েছে পৃথিবীর কোনো অসাধারন মদই তা করতে পারবে না, ফিগছেন।”
প্রাতো আর ভ্যালেরিয়ান একে অন্যের দিকে তাকালো। সম্রাজ্ঞি জন্মেছিলেন সোফিয়া অ্যানহল্ট-জার্বেস্ট নামে, তবে শৈশবে তার ডাক নাম ছিলো ‘ফিগচেন’। পাতো অবশ্য বিছানায় আদর করে তাকে ডাকে হৃদয়ের মক্ষিরাণী? বলে, তবে প্রকাশ্যে সব সময় হার ম্যাজেস্টি’ ছাড়া ডাকে না। এই নামে অবশ্য
সম্রাজ্ঞির সন্তানেরাও তাকে ডেকে থাকে। অবাক করা ব্যাপার হলো, সম্রাজ্ঞি কিন্তু অ্যাবিসের এমন আচরণে রুষ্ট হলেন না।
“এবার আমাকে বলো তুমি কেন এতোদিন ফ্রান্সে থেকে গেলে,” বললেন। ক্যাথারিন। “তুমি যখন অ্যাবিটা বন্ধ করে দিলে তখন আমি ভেবেছিলাম সঙ্গে সঙ্গেই রাশিয়ায় চলে আসবে। আমার রাজসভায় তোমাদের দেশের অসংখ্য স্বেচ্ছায় নির্বাসিত লোকজনে পূর্ণ। ফ্রান্স হলো বারো শ’ মাথার একটি হাইড্রা, অরাজকতার একটি দেশ। এই মুচির দেশটা প্রকৃতির নিয়মই পাল্টে দিয়েছে!”
একজন সম্রাজ্ঞির মুখ থেকে এরকম কথা শুনে অ্যাবিস অবাক হলেন। ফ্রান্স যে বিপজ্জনক জায়গা এটা নিয়ে অবশ্য দ্বিমত পোষণ করার কোনো কারণ নেই। তারপরও বলতে হয়, এই জারপত্মীই কি উদারমনা ভলতেয়ার আর দেনিস দিদেরোর সাথে সখ্যতা গড়ে তোলে নি? শ্রেণীসাম্য এবং নির্দিষ্ট সীমানার বিরোধী তত্ত্ব তো এরাই বলে বেড়াতো।
“আমি সঙ্গে সঙ্গে আসতে পারি নি,” জবাব দিলেন অ্যাবিস। “কিছু বিষয় নিয়ে দারুণ চিন্তিত ছিলাম-” পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা প্রাতো আর জুবোভের দিকে চট করে তাকালেন তিনি। প্রাতো চেয়ারের পেছনে দাঁড়িয়ে ক্যাথারিনের ঘাড়ে হাত বুলিয়ে যাচ্ছে। “তুমি ছাড়া আর কারো সামনে ব্যাপরটা নিয়ে কথা বলতে চাচ্ছি না।”
অ্যাবিসের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে ক্যাথারিন খুব সহজভাবেই বললেন, “ভ্যালেরিয়ান, তুমি আর পাতো আলেক্সান্দ্রোভিচ চলে যাও।”
“কিন্তু ইওর হাইনেস…” অনেকটা শিশুসুলভ চপলতায় বলে উঠলো পাতো জুবোভ।
“আমার নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত হয়ো না, ডার্লিং, আলতো করে পাতোর হাতে চাপড় মারলেন ক্যাথারিন। “হেলেনের সাথে আমার সখ্যতা প্রায় ষাট বছরের। আমরা কিছুক্ষণ একা থাকলে এমন কোনো ক্ষতি হবে না।”
“সে দেখতে খুব সুন্দর না?” দু’জন পুরুষ মানুষ ঘর থেকে চলে গেলে ক্যাথারিন জানতে চাইলেন অ্যাবিসের কাছে। “আমি জানি, তুমি আর আমি একই পথ বেছে নেই নি। তবে আশা করি আমি যখন তোমাকে বলবো ঠাণ্ডা শীতের পর সূর্যের নীচে দাঁড়ালে নিজেকে তুচ্ছ পোকামাকড়ের মতো হয় তখন আমাকে তুমি বুঝতে পারবে। বৃদ্ধগাছের পরিচর্যার জন্যে চাই তরুণ আর বলিষ্ঠ একজন মালি।”
অ্যাবিস চুপচাপ বসে থাকলেন। ভাবতে লাগলেন তার শুরুর দিকে পরিবল্পনাটি সঠিক ছিলো কিনা। তাদের মধ্যে প্রায়শই আন্তরিকমাখা চিঠি। চালাচালি হলেও শৈশবের এই বান্ধবীকে অনেক বছর দেখেন নি। তাহলে কি তার সম্পর্কে যেসব গুজব শোনা যায় তা সত্য? এই বয়স্ক নারী, যে এখনও কামার্ত আর ক্ষমতালোভী, তাকে কি আসন্ন গুরুদায়িত্বের জন্য বিশ্বাস করা যায়?
“আমি কি তোমাকে হতবাক করে দিয়েছি?” হেসে বললো ক্যাথারিন।
“মাই ডিয়ার সোফিয়া,” বললেন অ্যাবিস, “আমি বিশ্বাস করি তুমি মানুষকে ভড়কে দিতে খুব পছন্দ করো। তোমার মনে আছে, যখন চার বছর বয়স ছিলো, প্রুশিয়ার রাজার সামনে গিয়ে তুমি তার কোটের কাণায় চুমু খেতে অস্বীকার করেছিলে।”
“আমি তাকে বলেছিলাম দর্জি তার কোটটা একটু বেশি খাটো করে বানিয়েছে!” চোখে জল আসার আগপর্যন্ত হাসতে লাগলেন ক্যাথারিন। “আমার মা তো রেগেমেগে একাকার। রাজা তাকে বলেছিলেন, আমি নাকি একটু বেশিই সাহসী।”
অ্যাবিসও হেসে ফেললেন বান্ধবীর সাথে সাথে।
“তোমার কি মনে আছে ব্রুনউইকের গণক আমাদের হাত দেখে কি ভবিষ্যত্বাণী করেছিলেন?” আস্তে করে জানতে চাইলেন তিনি। “তোমার হাতে নাকি তিনটি রাজমুকুট আছে।”
“বেশ ভালোই মনে আছে আমার,” বললেন সম্রাজ্ঞি। “সেদিনের পর থেকে আমি কখনও সন্দেহ করি নি যে আমি বিশাল একটি সাম্রাজ্য শাসন করবো। আমার আকাঙ্খা পূর্ণ হলে আমি সব সময়ই ভবিষ্যত্বাণীতে বিশ্বাস করি।” এবার আর অ্যাবিস হাসলেন না।
“তোমার কি মনে আছে গণক আমার হাত দেখে কি বলেছিলেন?” জানতে চাইলেন অ্যাবিস।
কিছুক্ষণ চুপ মেরে রইলেন ক্যাথারিন। মনে আছে, যেনো কথাটা গতকালই বলা হয়েছে, অবশেষে বললেন তিনি। এজন্যেই আমি আকুল হয়ে তোমার আগমণের অপেক্ষায় ছিলাম। তুমি যখন আসতে দেরি করছিলে তখন। আমার কী মনে হচ্ছিলো সেটা কল্পনাও করতে পারবে না…” একটু দ্বিধার সাথেই থেমে গেলেন। “তোমার কাছে কি সেগুলো আছে?” শেষে বললেন ক্যাথারিন দি গ্রেট।
অ্যাবিস তার গাউনটা তুলে নিলেন, কোমরের সাথে চামড়ার একটা ছোট্ট ব্যাগ আটকে রাখা হয়েছে। একটা স্বর্ণখচিত জিনিস বের করলেন তিনি। জিনিসটা এমন একটা অবয়বের যেটা লম্বা গাউন পরে আছে, বসে আছে ছোট্ট একটা প্যাভিলিওনে। ক্যাথারিনের কাছে সেটা তুলে দিলেন অ্যাবিস। অবিশ্বাসের সাথে সম্রাজ্ঞি সেটা হাতে তুলে নিলেন। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে জিনিসটা অবলোকন করলেন তিনি।