এক ঘণ্টা খেলা চলার পর বারগুভির ডিউক লক্ষ্য করলেন রাজা অদ্ভুত আচরণ করছেন। তার ভুরু কুচকে আছে, দেখে মনে হচ্ছে একেবারেই উদভ্রান্ত। গরিয়াঁ নিজেও এক ধরণের অস্থিরতার মধ্যে আছে। চালচলনে অযথাই এক ধরণের অস্থিরতা আর কাঁপাকাপি দেখা গেলো। তার কপাল বেয়ে শীতল ঘাম ঝরে পড়ছে। দু’জন খেলোয়াড়ের চোখই দাবাবোর্ডে নিবদ্ধ, যেনো তারা অন্য দিকে তাকাতে পারছে না।
আচমকা চিৎকার করে রাজা উঠে দাঁড়ালেন, দাবাবোর্ডের খুঁটি ধাক্কা মেরে ফেলে দিলেন মেঝেতে। বৃত্তাকারে ঘিরে থাকা সভাসদেরা রাজাকে পথ করে দেয়ার জন্যে একটু সরে গেলো। রাগে কাঁপতে কাঁপতে নিজের মাথার চুল হাত দিয়ে খামচে ধরে উন্মাদ কোনো পশুর মতো বুক চাপড়াতে চাপড়াতে চলে গেলেন তিনি। গরিয়াঁ আর বারগুন্ডির ডিউক রাজার কাছে ছুটে যেতেই তিনি ধাক্কা মেরে তাদের দুজনকে সরিয়ে দিলেন। ছয়জন সভাসদ ছুটে এসে রাজাকে নিবৃত্ত করলো অবশেষে। রাজা ধাতস্থ হবার পর এমনভাবে মুখ তুলে তাকালেন। যেনো এইমাত্র লম্বা একটা ঘুম থেকে জেগে উঠেছেন।
“মাই লর্ড, নরম কণ্ঠে বললো গরিয়াঁ। মেঝে থেকে দাবার খুঁটিগুলো তুলে রাজার হাতে দিলো সে। “আমাদেরকে খেলা বাতিল করতে হবে মনে হচ্ছে। কোন্ খুঁটি কোথায় ছিলো সেটা তো আমার মনে নেই। আমি এই দাবার বোর্ডটাকে ভয় পাচ্ছি। আমার বিশ্বাস এটার মধ্যে অশুভ শক্তি আছে, এজন্যেই। আপনি আমার জীবন নিয়ে এমন বাজি ধরতে বাধ্য হয়েছেন।”
শার্লেমেইন একটা চেয়ারে আরাম করে বসলেন, এক হাত কপালে রাখলেও কিছু বললেন না।
“গরিয়াঁ,” সতকর্তার সাথে বললেন বারগুডির ডিউক, “তুমি ভালো করেই জানো আমাদের রাজা এ ধরণের কুসংস্কারে বিশ্বাস করেন না। উনার কাছে এগুলো প্যাগান আর বর্বরদের চিন্তাভাবনা। জাদুটোনা আর ভাগ্যগণনা এই রাজসভায় তিনিই নিষিদ্ধ করেছেন—”
কথার মাঝখানে শার্লেমেইন মুখ খুললেও তার কণ্ঠ ভঙ্গুর আর ক্লান্ত শোনালো। “আমার নিজের সৈনিকেরাই যেখানে এসব জাদুটোনায় বিশ্বাস করে সেখানে আমি কি করে খৃস্টিয় আলোকবর্তিকা ইউরোপে ছড়িয়ে দেবো?”
“প্রাচীনকাল হতেই এই জাদু আরব থেকে শুরু করে সমগ্র প্রাচ্যে চর্চা করা। হচ্ছে,” বললো গরিয়াঁ। “না আমি এসবে বিশ্বাস করি, না আমি নিজে এগুলো বুঝি। কিন্তু” গরিয়াঁ হাটু মুড়ে রাজার মুখের দিকে তাকালো। “-আপনি নিজে এটা অনুভব করেছেন।”
“আমাকে যেনো আগুনের হলকা গিলে ফেলেছিলো, শার্লেমেইন স্বীকার করলেন। “আমি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছিলাম না। মনে হচ্ছিলো যুদ্ধের ময়দানে সৈন্যবাহিনী আক্রমণ করছে। আমি আসলে বোঝাতে পারবো না ব্যাপারটা।”
“কিন্তু স্বর্গ-মতের মধ্যে যা কিছু ঘটে তার একটা কারণ থাকে,” গরিয়াঁর পেছন থেকে একটা কণ্ঠ বলে উঠলো। পেছন ফিরে তাকাতেই দেখতে পেলো দাবাবোর্ড বয়ে আনা আটজন কৃষ্ণাঙ্গ কৃতদাসদের একজনকে। মাথা নেড়ে কৃতদাসকে কথা বলতে ইশারা করলেন রাজা।
“আমাদের দেশে এক ধরণের লোক আছে, যাদেরকে আমরা বাদাওয়ি বলে ডাকি, মানে মরুভূমির বেদুইন। ঐসব লোকের মধ্যে রক্ত নিয়ে বাজি ধরাটাকে সবচাইতে সম্মানের বলে মনে করা হয়। বলা হয়ে থাকে একমাত্র রক্ত-বাজিই মানবমনের কালো পর্দা হাব’ দূর করতে পারে। জিব্রাইল ফেরেশতা এই কালো পর্দাই মুহাম্মদের বুক থেকে অপসারিত করেছিলো। মহামান্য রাজা দাবা খেলায় একজন মানুষের জীবন নিয়ে রক্ত-বাজি ধরেছেন, এটা ন্যায়বিচারের সর্বোত্তম প্রকাশ। মুহাম্মদ বলেছেন, কোনো সাম্রাজ্য কুফরি, নাস্তিকতা সহ্য করতে পারে কিন্তু জুলুম সহ্য করতে পারে না। এটা হলো অবিচার।”
“জীবন নিয়ে বাজি ধরাটা সব সময়ই শয়তানি কাজ, শার্লেমেইন বললেন। গরিয়াঁ এবং বারগুভির ডিউক অবাক হয়ে তাকালো রাজার দিকে। তিনি নিজেই
তো একটু আগে এ কাজ করেছেন, করেন নি?
“না!” কৃতদাস দৃঢ়তার সাথে বললো। “রক্ত-বাজির মাধ্যমেই বেহেস্ত লাভ করা সম্ভব। কেউ যদি শতরঞ্জ নিয়ে এরকম বাজি ধরে তাহলে শতরঞ্জ নিজেই সার’ বাস্তবায়ন করে!”
“দাবাকে এইসব আরবিয় কৃতদাস শতরঞ্জ বলে, মাই লর্ড,” গরিয়াঁ বললো।
“আর সার’?” শার্লেমেইন জানতে চাইলেন। আস্তে করে উঠে দাঁড়িয়ে চারপাশে ঘিরে থাকা সবার দিকে তাকালেন তিনি।
“এটা হলো প্রতিশোধ, নির্বিকারভাবে জবাব দিলো কৃতদাস। রাজাকে কুর্ণিশ করে পিছু হটলো সে।
“আমরা আবারো খেলবো,” রাজা ঘোষণা দিলেন। এবার কোনো বাজি ধরে খেলা হবে না। শুধুমাত্র খেলার প্রতি ভালোবাসা থেকে খেলবো। বর্বর আর ছেলেমানুষের মতো কোনো কুসংস্কারে বশবর্তী হয়ে খেলা হবে না।” সভাসদেরা পুণরায় দাবাবোর্ডে খুঁটি সাজাতে শুরু করলো। এক ধরণের স্বস্তি নেমে এলো পুরো কক্ষে। বারগুডির ডিউকের দিকে ফিরে তার হাতটা ধরলেন রাজা।
“আমি কি সত্যি ওরকম কোনো বাজি ধরেছিলাম?” আস্তে করে বললেন তিনি।
অবাক হলেন ডিউক। “হ্যাঁ, মাই লর্ড। আপনি কি মনে করতে পারছেন না?”
“না,” বিষণ্ণ কণ্ঠে জবাব দিলেন রাজা।
শার্লেমেইন আর গরিয়াঁ আবারো খেলতে বসলো। অসাধারণ এক যুদ্ধের পর বিজয়ী হলো গরিয়াঁ। রাজা বাস্ক-পিরেনিজের মন্তগ্লেইন রাজ্যটির মালিকানা দিয়ে গরিয়াঁ দ্য মন্তগ্লেইন উপাধিতে ভূষিত করলেন তাকে। দাবা খেলায় গরিয়াঁর অসাধারণ দক্ষতায় মুগ্ধ হয়ে রাজা তাকে তার সদ্য অর্জিত রাজ্য সুরক্ষিত করার জন্য একটি দূর্গ নির্মাণ করতে বললেন। অনেক বছর পর গরিয়াঁর কাছে রাজা মহামূল্যবান একটি উপহার পাঠান। যে দাবাবোর্ডে তারা বিখ্যাত খেলাটি