তাকে রাশিয়ার সিংহাসনে বসিয়েছে এই পটেমকিন, নিজের তলোয়াড় দান করেছে তাকে, ঘোড়া চালানোও শিখিয়েছে, এরফলে তিনি বিদ্রোহী সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিতে পেরেছেন। এই বিদ্রোহীরা তার স্বামী জারকে ক্ষমতাচ্যুত করেছিলো। পটেমকিন তার প্রেমিক ছিলো, ছিলো রাজ্যের মন্ত্রী, সেনাবাহিনীর জেনারেল আর সবথেকে বিশ্বস্ত একজন লোক, যাকে তিনি আমার একমাত্র স্বামী’ বলে ডাকতেন। পটেমকিনের কারণেই তার রাজত্বের সীমানা এক তৃতীয়াংশ বেড়ে কাসপিয়ান সাগর থেকে কৃষ্ণসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। নিকোলাইয়ে যাবার পথে কুকুরের মতোই মৃত্যুবরণ করেছে সে। ফিসান্ট আর প্যাটরিজ পাখির মাংস, শূকরের গোস্ত, লবন দেয়া গরুর মাংস ভক্ষণ আর সেইসাথে প্রচুর পরিমাণের মদ তার জন্যে কাল হয়ে দাঁড়ায়। অভিজাত রমণী তাকে পরিবেষ্টিত করে রাখতে সারাক্ষণ তার টেবিলের উচ্ছিষ্ট ভোগ করার জন্য। চমৎকার প্রাসাদ, দামি দামি গহনা আর ফরাশি শ্যাম্পেইনের জন্য পঞ্চাশ মিলিয়ন রুবল উড়িয়ে দিয়েছিলো সে। তবে, এই লোকই ক্যাথারিনকে এই বিশ্বের সবচাইতে ক্ষমতাধর নারীতে পরিণত করেছিলো।
চারপাশে তার পরিচারিকারা নিঃশব্দ প্রজাপতির মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে। কেউ তার চুলে পাউডার লাগিয়ে দিচ্ছে, কেউ পরিয়ে দিচ্ছে জুতো। তিনি উঠে দাঁড়ালে তারা ধূসর রঙের ভেলভেটের আলখেল্লাটা তার গায়ে চাপিয়ে দিলো। এই নক্সা করা আলখেল্লাটি পরেই তিনি সব সময় রাজসভায় হাজির হন। সেন্ট ক্যাথারিন, সেন্ট ভ্লাদিমির, সেন্ট আলেক্সান্ডার নেভস্কি, সেন্ট এডু এবং সেন্ট জর্জের নামে ক্রুশ আঁকলেন। অভিজাত ভঙ্গিতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন তিনি।
দশ দিন পর আজই রাজসভায় হাজির হচ্ছেন। শীতকালীন প্রাসাদের দীর্ঘ করিডোরের দু’পাশে দাঁড়িয়ে থাকা রক্ষীদলের মাঝখান দিয়ে দেহরক্ষিদের নিয়ে এগিয়ে গেলেন। আজ থেকে কয়েক বছর আগে, এই করিডোরের জানালা দিয়েই তিনি দেখেছিলেন কিভাবে তার সেনাবাহিনী সেন্ট পিটার্সবার্গ আক্রমণ করতে আসা সুইডিশ রণতরীগুলো নেভা নদীতে ডুবিয়ে দিচ্ছে। যেতে যেতে একটা ভাবনায় ডুবে জানালাগুলোর দিকে তাকালেন।
রাজসভায় অপেক্ষা করছে একদল বিষাক্ত সাপ, যারা নিজেদেরকে কূটনৈতিক আর সভাসদ হিসেবে পরিচয় দিয়ে থাকে। তারা তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে, তাকে ক্ষমতাচ্যুত করার ধান্দায় মশগুল। তার নিজের ছেলে পলও তাকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করছে। তবে পিটার্সবার্গে আরেকজন এসে পৌঁছেছে, যে তাকে রক্ষা করতে পারবে এই বিপদ থেকে। পোটেমকিন মারা যাবার পর তার যে ক্ষমতা হাতছাড়া হয়ে গেছে সেটা পূরণ করার মতো একটি শক্তি আছে এই মহিলার কাছে। আজ সকালেই তার শৈশবের পুরনো বন্ধু, মন্তগ্লেইনের অ্যাবিস, হেলেনে দ্য রকুয়ে সেন্ট পিটার্সবার্গে এসে পৌঁছেছে।
.
রাজসভায় কিছুক্ষণ থেকেই ক্লান্ত হয়ে গেলেন ক্যাথারিন, তারপর তার বর্তমান প্রেমিক প্রাতো জুভোভের হাত ধরে চলে গেলেন প্রাইভেট অডিয়েন্স কক্ষে। অ্যাবিস সেখানে অপেক্ষা করছে তোর ভাই ভ্যালেরিয়ানের সাহচার্যে। সম্রাজ্ঞিকে দেখেই অ্যাবিস উঠে দাঁড়ালেন, ছুটে এলেন তার কাছে।
এতোদিন পরও, হালকাঁপাতলা ক্যাথারিনের বিরাট শারিরীক পরিবর্তন সত্ত্বেও অ্যাবিস তাকে দেখামাত্রই চিনে ফেললেন। তারা একে অন্যের সাথে কোলাকুলি করার সময় ক্যাথারিন পাতো জুতভাভের দিকে তাকালেন। আকাশি নীল কোট আর কালচে প্যান্ট পরে আছে সে। তার পোশাকে এতো অসংখ্য মেডেল যে মনে হবে সেগুলোর ভারে বুঝি পরেই যাবে লোকটা। হালকা-পাতলা শরীরের প্রাতো বয়সে বেশ তরুণ। তার আর ক্যাথারিনের সম্পর্কের কথা রাজসভার সবাই জানে। অ্যাবিসের সাথে কথা বলার সময় আলতো করে পাতোর হাত বোলাতে লাগলেন ক্যাথারিন।
“হেলেনে,” একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন তিনি। “তোমাকে দেখার জন্যে কতোদিন ধরে যে মুখিয়ে আছি বলে বোঝাতে পারবো না। আমি বিশ্বাসই করতে পারছি না অবশেষে তুমি আমার কাছে এসেছো। আমি জানি, ঈশ্বর আমার হৃদয়ের কথা শুনেছেন, আমার শৈশবের বন্ধুকে তিনি আমার কাছে নিয়ে এসেছেন।”
পাশাপাশি দুটো চেয়ারের একটাতে অ্যাবিসকে তিনি বসার জন্য ইশারা করে নিজেও বসে পড়লেন। প্লাতো আর ভ্যালেরিয়ান তাদের পেছনে দাঁড়িয়ে রইলো চুপচাপ।
“তোমাকে দেখে খুব খুশি আমি, যদিও জানো আমি শোকে মুহ্যমান হয়ে আছি, তবে তোমার আগমণে সব শোক মুছে গেছে নিমেষে। আমার ব্যক্তিগত কক্ষে আজরাতে আমরা একসঙ্গে ডিনার করবো। হাসি-ঠাট্টা আর অনেক গল্পগুজব করবো, ভান করবো আমরা এখনও সেই তরুণীটিই আছি। ভ্যালেরিয়ান, তুমি কি আমার কথামতো ঐ মদের বোতলটা খুলে রেখেছিলে?”
মাথা নেড়ে সায় দিয়ে ভ্যালেরিয়ান চলে গেলো সাইডবোর্ডের দিকে।
“তোমার অবশ্যই এটা চেখে দেখা উচিত, মাই ডিয়ার। আমার রাজদরবারে যতো সম্পদ আছে এটা তারমধ্যে অন্যতম। অনেক বছর আগে দেনিস দিদেরো বর্দু থেকে এটা আমাকে এনে দিয়েছিলো। আমি তো এটাকে দামি হীরাজহরতের মতো মূল্য দিয়ে থাকি।”
ছোট্ট দুটো ক্রিস্টাল গ্লাসে লাল টকটকে মদ ঢেলে দিলো ভ্যালেরিয়ান। সেই মদে চুমুক দিলো ক্যাথারিন আর তার শৈশবের বান্ধবি।