আসল উৎসবটি ছিলো রাজার জন্মদিনের দিন। সেদিন সকালে রাজা তার আঠারো জন সন্তানসন্ততি, রাণী আর সভাসদদের নিয়ে হাজির হন রাজসভায়। শার্লেমেইন বেশ লম্বা ছিলেন, অনেকটা অশ্বারোহী আর সাঁতারুদের মতো। হালকাঁপাতলা গড়নের অধিকারী। তার গায়ে রঙ ছিলো রোদে পোড়া, চুল সোনালী রঙের, চমৎকার গোঁফও ছিলো মুখে। এ বিশ্বের সবচাইতে বৃহৎ সাম্রাজ্যের যোগ্য রাজা আর মহান যোদ্ধার মতোই দেখাতো তাকে।
এই দিনটিতে রাজা বিশেষ এক আয়োজন রেখেছিলেন। রণকৌশলের একজন মাস্টার হিসেবে একটা খেলার প্রতি তার ছিলো প্রচণ্ড আসক্তি। যুদ্ধ আর রাজাদের খেলা হিসেবে সেটা পরিচিত, আর সেই খেলাটা হলো দাবা। নিজের চল্লিশতম জন্মদিনে তার রাজ্যের সবচাইতে সেরা দাবা খেলোয়াড়ের সাথে খেলার আয়োজন করেন তিনি। সেই খেলোয়াড়টি ছিলো গরিয়াঁ দি ফ্রাঙ্ক নামের এক সৈনিক।
চারপাশে ট্রাম্পেটের বাজনার সাথে সাথে গরিয়াঁ প্রবেশ করে রাজসভায়। অ্যাক্রোবেটরা তার সামনে ডিগবাজি খেতে থাকে, মহিলারা তার পায়ের নীচে বিছিয়ে দেয় পাম গাছের পাতা আর গোলাপের পাপড়ি। গরিয়াঁ ছিলো বেশ শক্তসামর্থ, গায়ের রঙ ধবধবে সাদা। বয়সে বেশ তরুণ। চোখ দুটো গভীর আর ধূসর বর্ণের। পশ্চিমাঞ্চলের সেনাবাহিনীতে ছিলো সে। রাজা যখন তাকে অভ্যর্থনা জানাতে উঠে দাঁড়ালেন তখন সেও হাটু মুড়ে রাজাকে সম্ভাষণ জানায়।
দাবার বোর্ডটি আটজন কৃষ্ণাঙ্গ মুর দাস কাঁধে করে বিশাল এক হলরুম। থেকে নিয়ে আসে। এইসব দাস আর দাবাবোর্ডটি চার বছর আগে পিরেনিজ বাস্কদের সাথে যুদ্ধের সময় সাহায্য করার জন্যে উপহার হিসেবে পাঠিয়েছিলেন স্পেনের বার্সেলোনার মুসলিম শাসক ইবনে আল আরাবি। তবে এরপর রাজার প্রাণপ্রিয় সৈনিক, চাসোয়া দ্য রোল্যা নাভায়েরের যুদ্ধে নিহত হবার পর থেকে অসুখি শার্লেমেইন আর দাবা খেলেন নি, এমনকি জনসম্মুখে দাবাবোর্ডটিও প্রদর্শন করা হয় নি।
রাজসভার বিশাল টেবিলের উপর দাবাবোর্ডটি এনে রাখার পর উপস্থিত সবাই মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখতে থাকে। আরবিয় কারুশিল্পীরা এটা নির্মাণ করলেও দাবার খুঁটিগুলোতে ভারতীয় আর পারস্য ঐতিহ্য বহাল ছিলো। অনেকেই বিশ্বাস করে এই দাবা খেলাটি জিশুর জন্মেরও চারশ’ বছর আগে ভারতের মাটিতে জন্ম নেয়। ভারতীয়দের কাছ থেকে পারস্যবাসীর কাছে খেলাটি প্রচলন হয়। আর আরবরা ৬৪০ খৃস্টাব্দে পারস্য জয় করলে তখন থেকে সেটা তাদের ঐতিহ্যে চলে আসে।
দাবাবোর্ডটি সোনা-রূপা দিয়ে তৈরি করা, প্রতিটি দিক এক মিটার করে দীর্ঘ। দাবার ঘুটিগুলো মূল্যবান ধাতুতে তৈরি, আর তাতে খচিত মহামূল্যবান হীরা-জহরত। পালিশ করা রত্মগুলোর একেকটার আকার মুরগীর ডিমের মতো। রাজসভার উজ্জ্বল বাতির আলোয় ঝিকিমিকি করছিলো সেগুলো। মনে হচ্ছিলো ওগুলো ভেতর থেকে আলো উদগীরিত করছে আর মোহাবিষ্ট করে রেখেছে উপস্থিত সবাইকে।
দাবার যে খুঁটিটাকে শাহ্ অর্থাৎ রাজা বলে সেটা লম্বায় পনেরো সেন্টিমিটার, মাথায় মুকুট পরিহিত এক রাজা হাতির পিঠে সওয়ার হওয়ার একটি চমৎকার ভাস্কর্যের আকৃতির। ফার্জ অর্থাৎ রাণী খুঁটিটি সিংহাসনে বসা মুকুট পরা রাণী। বিশপগুলো হাতির অবয়বের। নাইটগুলো উদ্দাম আরবিয় ঘোড়া। রুকগুলো পিঠে আসন বসানো উটের আকৃতি। পন অর্থাৎ সৈন্যগুলো সাত সেন্টিমিটার উচ্চতাবিশিষ্ট পদাতিক সৈন্য। তাদের চোখ আর তলোয়াড় থেকে ছোটো ছোটো জহরত চিক চিক করছে।
দু’পাশ থেকে শার্লেমেইন আর গরিয়াঁ দাবাবোর্ডের দিকে এগিয়ে গেলো। তারপর রাজা হাত তুলে এমন একটা কথা উচ্চারণ করলেন যা শুনে বিস্মিত হলো উপস্থিত সভাসদেরা। তারা তাকে ভালো করেই চেনে, এরকম কথা বলার লোক তিনি নন।
“আমি একটা বাজি ধরতে চাই,” অদ্ভুত কণ্ঠে বললেন তিনি। শার্ল জুয়া বেলার লোক ছিলেন না। সভাসদেরা একে অন্যের দিকে তাকাতে শুরু করলো।
“আমার সৈনিক গরিয়াঁ যদি আমার সাথে জিতে যায় তাহলে আমি তাকে আমার রাজ্যের আচেন আর বাস্ক পিরেনিজ অঞ্চলটি দান করে দেবো, সেই সাথে তার বিয়ে দেবো আমার বড় মেয়ের সাথে। আর সে যদি হেরে যায় তাহলে ভোরবেলায় তার গর্দান কাটা হবে এই রাজসভায়।
পুরো রাজসভায় ফিসফিসানি শুরু হয়ে গেলো। সবাই জানতো রাজা তার মেয়েদের এতোটাই ভালোবাসেন যে তিনি চান তারা যেন তার জীবিত অবস্থায় বিয়ে না করে।
রাজার সবচাইতে প্রিয়বন্ধু বারগুন্ডির ডিউক এগিয়ে এসে রাজার একহাত ধরে তাকে একটু পাশে নিয়ে গেলেন। “এটা কি ধরণের বাজি?” নীচুকণ্ঠে বললেন তিনি। “আপনি দেখছি মাতাল আর অসভ্য-বর্বরদের মতো বাজির কথা। বলছেন?”
শার্ল টেবিলে বসে পড়লেন। তাকে দেখে মনে হলো তিনি বেশ দ্বিধায় পড়ে গেছেন। ডিউকও মাথামুণ্ডু কিছু বুঝতে পারলো না। গরিয়াঁ নিজেও দ্বিধাগ্রস্ত। রাজা ডিউকের দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন কিছুক্ষণ, তারপর কোনো কথা না। বলেই খেলা শুরু করে দিলেন। গরিয়াঁ বেছে নিলো সাদা ঘুটি। প্রথম চাল দিলেন রাজা। শুরু হয়ে গেলো খেলা।
সম্ভবত পরিস্থিতির উত্তেজনার কারণেও হতে পারে, তবে খেলাটা যতোই এগোতে লাগলো মনে হলো দু’জন খেলোয়াড় যেনো অদৃশ্য কোনো শক্তির প্রভাবে দাবার খুঁটি চাল দিচ্ছে, এক অদৃশ্য হাত যেনো ভেসে বেড়াচ্ছে বোর্ডের উপরে। একটা সময় এমনও মনে হলো দাবার খুঁটিগুলো যেনো নিজে থেকেই জায়গা বদল করছে। খেলোয়াড় দু’জন নিশ্চুপ আর ফ্যাকাশে হয়ে বসে রইলো, হতভম্ব হয়ে পড়লো সভাসদেরা।