বেঞ্চে বসা নানেরা আৎকে উঠলো। শুরু হয়ে গেলো ফিসফিসানি। মিরিয়ে শক্ত করে ভ্যালেন্টাইনের হাতটা ধরে রাখলো। তাদের দুজনের চোখ সামনে থাকা বক্তার দিকে নিবদ্ধ। এ কক্ষের মহিলারা কখনও এরকম কথা কানে শোনে নি। এসব কথা তাদের বিশ্বাস করতেও কষ্ট হচ্ছে। নির্যাতন, অরাজকতা, রাজা নিধন। এটা কিভাবে সম্ভব?
অ্যাবিস টেবিলের উপর হাত ঠুকে সবাইকে চুপ করতে নির্দেশ দিলে নানেরা চুপ মেরে গেলো। এবার আলেক্সান্দ্রিয়ে আসনে বসে পড়লে কেবল দাঁড়িয়ে রইলো সিস্টার শালোত্তে। তার কণ্ঠ খুবই দৃঢ় আর জোরালো।
“অ্যাসেম্বলিতে একটা শয়তান আছে। ক্ষমতার জন্যে সে লালায়িত, যদিও নিজেকে সে যাজকদের একজন বলেই দাবি করে থাকে। এই লোকটা হলো আঁতুয়ার বিশপ। রোমের চার্চ অবশ্য মনে করে লোকটা শয়তানের পুণর্জন্ম হওয়া পাপাত্মা। বলা হয়ে থাকে শয়তানের চিহ্ন হিসেবে পরিচিত অশ্বখুড় সদৃশ্য পা নিয়ে জন্মেছে লোকটা। ছোটো ছোটো বাচ্চাদের রক্ত পান করে সে চিরযৌবন পাবার আশায়। ব্ল্যাক মাসের আয়োজন করে এই লোক। অক্টোবর মাসে এই বিশপ অ্যাসেম্বলিতে প্রস্তাব করে চার্চের সমস্ত সম্পত্তি রাষ্ট্রের অধীনে নিয়ে আসতে হবে। নভেম্বরের দুই তারিখে তার প্রস্তাবিত বিল অব সিজার অর্থাৎ ‘সম্পত্তি অধিগ্রহণ বিল’ মহান রাষ্ট্রনায়ক মিরাবিউ কর্তৃক সমর্থিত হলে অ্যাসেম্বলিতে পাস হয়ে যায়। ফেব্রুয়ারির তেরো তারিখ থেকে এই অধিগ্রহণের কাজ শুরু হয়েছে। কোনো যাজক এর বিরোধীতা করলে তাকে গ্রেফতার করে জেলে পাঠানো হচ্ছে। ফেব্রুয়ারির ষোলো তারিখে অ্যাসেম্বলির সভাপতি পদে নির্বাচিত হয়েছে আঁতুয়ার বিশপ। তাকে এখন কেউ থামাতে পারবে না।”
নানের দল চরম উত্তেজনা আর ভয়ে অস্থির হয়ে উঠলো। অনেকে প্রতিবাদও করলো এসব কথাবাতার কিন্তু সবকিছুকে ছাপিয়ে গেলো শালোত্তের দৃঢ় জোরালো কণ্ঠ।
“অধিগ্রহণ আইন পাস হবার অনেক আগেই আঁতুয়ার বিশপ ফ্রান্সের সমস্ত চার্চের সহায়-সম্পত্তি কোথায় কিভাবে আছে সেসবের একটি তালিকা তৈরি করে রেখেছিলো। যদিও বিলটাতে নির্দিষ্ট করে বলা আছে সর্বাগ্রে পতন ঘটাতে হবে যাজকদের, নানদেরকে এ ব্যাপারে রেহাই দেয়া হবে, কিন্তু আমরা জানতে পেরেছি বিশপের কুনজর পড়েছে মন্তগ্লেইন অ্যাবির উপর। এজন্যেই আমরা আপনাদেরকে এসব জানাতে তড়িঘড়ি করে ছুটে এসেছি। মন্তগ্লেইনের সম্পদ কোনোভাবেই যেনো ঐ বদমাশটার হাতে না পড়ে।”
অ্যাবিস উঠে দাঁড়িয়ে শালোত্তের কাঁধে হাত রাখলেন। তারপর স্থিরদৃষ্টিতে তাকালেন সামনে বসা কালো আলখেল্লা পরা নানদের দিকে। তাদের মাথার স্কা একটু দুলে উঠলো একসঙ্গে। অ্যাবিসের ঠোঁটে দেখা গেলো মুচকি হাসি। দীর্ঘদিন তিনি এদের রাখালের ভূমিকা পালন করে এসেছেন, এরা তার ভেড়ারপাল। এখন যে কথাটা তিনি বলবেন সেটা বলার পর তাদের সাথে আর এই জীবনে তার দেখা হবে না। চিরজীবনের জন্যে বিদায় জানাতে হবে সবাইকে।
“এখন তোমরা নিশ্চয় পরিস্থিতিটা বুঝতে পেরেছে,” বললেন অ্যাবিস। “অবশ্য এসব কথাবার্তা আমি কয়েক মাস আগেই জানতে পেরেছিলাম, তবে সিদ্ধান্ত নেবার আগে তোমাদেরকে এ কথা বলে ঘাবড়ে দিতে চাই নি। আমার অনুরোধেই কায়েন-এর এই দুই সিস্টার আমাকে নিশ্চিত করেছে, আমার আশংকাই সত্যি।” নানের দল এবার মৃতলাশের মতো নিপ হয়ে পড়লো। অ্যাবিসের কণ্ঠ ছাড়া আর কিছুই শোনা গেলো না পুরো কক্ষে। “আমার অনেক বয়স হয়ে গেছে, হয়তো খুব শীঘ্রই ঈশ্বর আমাকে তার কাছে ডেকে নেবেন। এই কনভেন্টে প্রবেশ করার সময় আমি যে শপথ নিয়েছিলাম সেটা কেবল ঈশ্বরের প্রতি ছিলো না। আজ থেকে চল্লিশ বছর আগে, এই কনভেন্টের অ্যাবিস হিসেবে নিযুক্ত হওয়ার সময় আমাকে আরেকটা শপথ নিতে হয়েছিলো-একটা সিক্রেট রক্ষা করার শপথ। নিজের জীবন দিয়ে হলেও সেটা রক্ষা করা আমার দায়িত্ব। এখন সময় এসেছে সেই শপথ রক্ষা করার। তবে সেটা করার আগে আমি তোমাদের প্রত্যেককে সিক্রেটটার কিছু অংশ বলবো। সেইসাথে এও বলবো তোমরা জীবন দিয়ে হলেও এটা গোপন রাখবে। আমার গল্পটা অনেক দীর্ঘ, আশা করি ধৈর্যচ্যুতি ঘটবে না কারোর। গল্পটা বলা শেষ হলে তোমরা প্রত্যেকেই জেনে যাবে কেন আমাদের এ কাজটা করতে হবে।”
অ্যাবিস একটু থেমে টেবিল থেকে পানির গ্লাস তুলে নিয়ে এক ঢোক পান করে নিলেন, তারপর বলতে শুরু করলেন আবার।
“আজ ১৭৯০ খৃস্টাব্দের এপ্রিল মাসের চার তারিখ। আমার গল্পটা অনেক অনেক বছর আগের এই এপ্রিলের চার তারিখেই শুরু হয়েছিলো। গল্পটা আমাকে পূর্বসূরীরা বলে গেছেন আমার অ্যাবিস হওয়ার প্রক্কালে, তাদেরকে আবার বলে গেছেন তাদের পূর্বসূরীরা। এভাবেই এটা চলে আসছে। এখন আমি তোমাদেরকে সেটা বলছি…”
অ্যাবিসের গল্প
৭৮২ খৃস্টাব্দের এপ্রিল মাসের চার তারিখে আচেনের ওরিয়েন্টাল প্রাসাদে এক জমকালো উৎসব অনুষ্ঠিত হয় মহান রাজা শার্লেমেইনের চল্লিশতম জন্মদিন উপলক্ষ্যে। তিনি তার রাজ্যের সমস্ত গন্যমান্য আর জ্ঞানীদেরকে দাওয়াত দিয়েছিলেন। সেন্ট্রাল রাজসভা আর পেঁচানো সিঁড়িতে রঙবেরঙের ফেস্টুন আর ফুলে সাজানো হয়। স্বর্ণ-রূপার লণ্ঠনের আলোতে বাদকের দল বাজনা বাজাতে ব্যস্ত। উপস্থিত সভাসদেরা বাহারি পোশাকে সজ্জিত। পাপেট শোয়েরও ব্যবস্থা ছিলো সেখানে। বন্য ভালুক, সিংহ, জিরাফ আর খাঁচায় ভরে ঘুঘু আনা হয়। রাজসভায়। বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরে রাজার জন্মদিন পালন করা হয় আনন্দমুখর পরিবেশে।