“এসবের মানে কি?” সে জানতে চাইলো ফিসফিস করে।
“আমার তো ভালো ঠেকছে না,” জবাব দিলো মিরিয়ে। তার কণ্ঠ আরো নীচু। “রেভারেন্ড মাদারকে দেখে খুব চিন্তিত মনে হচ্ছে। তাছাড়া এখানে এমন দু’জন মহিলা আছে যাদেরকে আগে কখনও দেখি নি।”
কক্ষের শেষে অবস্থিত নিজের ডেস্ক থেকে উঠে দাঁড়ালেন জরাজীর্ণ পার্চমেন্ট কাগজের মতো দেখতে বৃদ্ধ আর ভগ্ন স্বাস্থ্যের রেভারেন্ড মাদার। অবশ্য নিজের কর্তৃত্বের ব্যাপারে তিনি সচেতন। সেজন্যেই ভাবভঙ্গিতে বেশ দৃঢ়তা বজায় রেখে চলেছেন। তার মধ্যে এমন শান্ত আর ধীরস্থির একটা ব্যাপার আছে যে, মনে হতে পারে অনেক বছর আগেই তিনি আত্মার শান্তি খুঁজে পেয়েছেন। তবে আজ একটু উদ্বিগ্নতা দেখা যাচ্ছে তার মধ্যে। এরকমটি কোনো নান কোনোদিন দেখে নি।
তার দু’পাশে বেশ দীর্ঘাঙ্গি আর শক্তসামর্থ্য দুই তরুণী আজরাইলের মতো দাঁড়িয়ে আছে। একজনের কালো চুল, ফ্যাকাশে গায়ের রঙ, চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে। অন্যজন দেখতে ঠিক মিরিয়ের মতো, ক্রিম রঙের গায়ের রঙ আর বাদামী রঙের চুল, মিরিয়ের চেয়ে কিছুটা গাঢ়। তারা দু’জন নান হলেও নানদের পোশাক পরে নেই। তারা পরে আছে সাধারণ কোনো ভ্রমণকারীদের পোশাক।
সব নান নিজেদের আসনে বসার পর দরজা বন্ধ করার আগপর্যন্ত অ্যাবিস কিছু বললেন না। পুরো কক্ষটায় নীরবতা নেমে এলে তিনি বলতে আরম্ভ করলেন। তার কণ্ঠ শুনে ভ্যালেন্টাইনের কাছে সব সময়ই মনে হয় কোনো পাতার খসখসানি।
“আমার কন্যারা,” বুকের কাছে দু’হাত ভাঁজ করে বললেন অ্যাবিস। প্রায় হাজার বছর ধরে এই পর্বতের উপর অর্ডার অব মন্তগ্লেইন মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে মানুষ আর ঈশ্বরের সেবায় নিয়োজিত আছে। যদিও আমরা বাকি দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন থাকি, তারপরেও বাইরের পৃথিবী যে অশান্ত হয়ে উঠছে সে খবর আমাদের অজানা নয়। দুর্ভাগ্য হলেও সত্যি, আমাদের এই ছোট্ট নিভৃতস্থানে সেই অশান্তির প্রভাব পড়ছে। সেজন্যে এতোদিন ধরে আমরা যে নিরাপত্তা ভোগ করে আসছিলাম তাতে বিরাট পরিবর্তন হতে যাচ্ছে এখন। আমার দু’পাশে যে দু’জন মহিলাকে দেখতে পাচ্ছো তারা এরকম খবরই নিয়ে এসেছে। পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি সিস্টার আলেক্সান্দ্রিয়ে ফবোয়া”-কালো চুলের মহিলার দিকে মাথা নেড়ে ইশারা করলেন তিনি-”এবং ম্যারি-শালোত্তে দ্য কোরদে, তারা দু’জনেই উত্তর প্রভিন্সের কায়েন-এর অ্যাবি-অ-ড্যাম থেকে এসেছে। ফ্রান্সের বিশাল অঞ্চল ঘুরে এসে আমাদেরকে সতর্ক করতে এসেছে তারা। সেজন্যে আমি তোমাদেরকে বলবো তাদের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনতে। এটা আমাদের সবার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
অ্যাবিস নিজের আসনে বসতেই আলেক্সান্দ্রিয়ে নামের মহিলা গলা খাকারি দিয়ে মৃদু স্বরে কথা বলতে শুরু করলেন। তার নীচুস্বরের কথা শুনতে নানদের বেগ পেতে হলো তবে মহিলার শব্দচয়ন একেবারেই স্পষ্ট।
“আমার ধর্মবোনেরা, যে গল্পটা এখন বলবো সেটা দূর্বলচিত্তের কারোর জন্যে না শোনাই ভালো। আমাদের মধ্যে অনেকেই আছে যারা মানুষকে রক্ষা করার আশা নিয়ে খৃস্টের কাছে এসেছে, আবার অনেকে এ দুনিয়া থেকে পালিয়ে বেড়ানোর জন্যে এখানে আশ্রয় নিয়েছে। অনেকেই এসেছে নিজেদের ইচ্ছের বিরুদ্ধে।” কথাটা বলেই মহিলা জ্বলজ্বলে চোখে তাকালো ভ্যালেন্টাইনের দিকে,
সঙ্গে সঙ্গে তার ফ্যাকাশে মুখটা লাল হয়ে গেলো।
“তোমাদের উদ্দেশ্য যাই হোক না কেন, আজ থেকে সেটা বদলে গেছে। আমি আর সিস্টার শালোত্তে সমগ্র ফ্রান্স ঘুরে প্যারিস হয়ে এখানে এসেছি। আমরা দেখেছি ক্ষুধা আর দুর্ভিক্ষ। এক টুকরো রুটির জন্যে লোকজন একে অন্যের সাথে পথেঘাটে মারামারি করছে। রক্তারক্তি ব্যাপার। মহিলারা পাত্রে করে কর্তিত মস্তক নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে রাস্তায় রাস্তায়। নারীরা ধর্ষিত হচ্ছে, লাঞ্ছিত হচ্ছে। ছোটো ছোটো বাচ্চারা পর্যন্ত খুনখারাবির হাত থেকে বাঁচতে পারছে না। লোকজনকে রাস্তার মধ্যে ফেলে নির্যাতন করা হচ্ছে, হিংস্র দরদল তাদেরকে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলছে পৈশাচিক উল্লাসে..” আলেক্সান্দ্রিয়েঁর কাছ থেকে এসব ভয়ঙ্কর গল্প শুনে নানরা আর চুপ থাকতে পারলো না।
মিরিয়ে ভাবলো ঈশ্বরের সেবায় নিয়োজিত একজন নারী হিসেবে এরকম মর্মান্তিক ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে কোনোরকম করুণ অভিব্যক্তি প্রকাশ না। করাটা অদ্ভুতই বটে। এটা ঠিক যে, বক্তার কণ্ঠে কোনোরকম কম্পন ছিলো না। ছিলো না কোনো আবেগের বহিপ্রকাশ। ভ্যালেন্টাইনের দিকে তাকালো মিরিয়ে, তার চোখ দুটোয় খুশির ঝিলিক উপচে পড়ছে। পুরো কক্ষটায় নীরবতা নেমে আসার আগপর্যন্ত আলেক্সান্দ্রিয়ে দ্য ফরবোয়া চুপ করে রইলো।
“এখন এপ্রিল মাস। গত অক্টোবরে এক হিংস্র দস্যু রাজা আর রাণীকে অপহরণ করে ভার্সাই থেকে, তাদেরকে বাধ্য করা হয় প্যারিসের তুইলেরিতে ফিরে যেতে। সেখানে তাদেরকে বন্দী করে রাখা হয়েছে। রাজা বাধ্য হয়ে সকল মানুষের সম অধিকারের দলিল মানবাধিকার ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করেন। বর্তমানে কার্যত ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিই দেশ চালাচ্ছে। রাজার কোনো ক্ষমতাই নেই। আমাদের দেশে যা হচ্ছে তা কোনো বিপ্লব নয়, এটা হলো অরাজকতা। অ্যাসেম্বলি জানতে পেরেছে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে কোনো স্বর্ণ মজুদ নেই। রাজা পুরো দেশটাকে দেউলিয়া করে ফেলেছেন। প্যারিসের লোকজন বিশ্বাস করছে। তিনি আর বেশি দিন বেঁচে থাকতে পারবেন না।”