“কারণ আমরা নান,” ঠোঁটে আঙুল দিয়ে চুপ থাকতে বললো মিরিয়ে। শক্ত করে ধরলো ভ্যালেন্টাইনের হাতটা। “আর আমাদের কাজ হলো মানুষের জন্য প্রার্থনা করা।” উপত্যকা থেকে যে উষ্ণ কুয়াশা উঠে আসছে তাতে মিশে আছে চেরি ফলের মিষ্টি ঘ্রাণ। মিরিয়ে এই ঘ্রাণকে আমলে না নেবার চেষ্টা করলো।
“আমরা এখনও নান হই নি, এজন্যে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ,” বললো ভ্যালেন্টাইন। “শপথ নেবার আগপর্যন্ত আমরা কেবলই শিক্ষানবীশ। এ থেকে মুক্তি পাবার জন্যে খুব বেশি দেরি হয়ে যায় নি। আমি বুড়ি নানদেরকে ফিসফাস করে বলতে শুনেছি, ফ্রান্সে নাকি সৈন্যের দল ঘুরে বেড়াচ্ছে। সব মনাস্টেরির সম্পদ লুট করে নিচ্ছে তারা, পাদ্রীদেরকে হাত বেধে মার্চ করাচ্ছে প্যারিসের পথেঘাটে। হয়তো এখানেও কিছু সৈন্য চলে আসবে, তারা আমাকেও প্যারিসে মার্চ করাবে ওভাবে। প্রতিরাতে অপেরা দেখাতে নিয়ে যাবে আমায়, তারা আমার পায়ের জুতায় করে শ্যাম্পেইন পান করবে!”
“তুমি যেরকম ভাবছো সৈন্যেরা কিন্তু সব সময় ওরকম চার্মিং হয় না, মিরিয়ে বললো। “তাদের কাজ হলো মানুষ হত্যা করা, অপেরায় নিয়ে যাওয়া নয়।”
“সবাই ওরকম হয় না,” ফিসফিস করে কণ্ঠটা নীচে নামিয়ে বললো ভ্যালেন্টাইন। তারা পর্বতের একেবারে শীর্ষে চলে এসেছে, এখানে পথ মোটেই ঢালু নয়, একদম সমতল। এই রাস্তাটি বেশ চওড়া, কাঁকর বিছানো পথ। বড় বড় শহরে যেমনটি দেখা যায়। পথের দু’ধারে বিশাল বিশাল সাইপ্রেস বৃক্ষ। চেরি আর অচাড় গাছ ছাড়িয়ে বহু উপরে উঠে গেছে সেগুলো। দেখতে যেনো নিষ্প্রাণ দৈত্যের মতো লাগছে, অ্যাবিটাও দেখতে অদ্ভুত।
“আমি শুনেছি,” বোনের কানে কানে ফিসফিস করে বললো ভ্যালেন্টাইন, “সৈন্যেরা নাকি নানদের সাথে ভয়ঙ্কর সব কাজ করে। কোনো সৈন্য যদি বনেবাদারে কোনো নানকে একা পেয়ে যায় তাহলে নাকি প্যান্ট খুলে কী একটা জিনিস বের করে নানের ভেতরে ঢুকিয়ে দেয় কিছুক্ষণের জন্য, এরপরই নানের পেটে বাচ্চা এসে যায়!”
“কী জঘন্য কথা! এটা তো রাসফেমি!” ভ্যালেন্টাইনের কাছ থেকে একটু সরে গিয়ে বললো মিরিয়ে, তার ঠোঁটে যে চাপা হাসি ফুটে উঠেছে সেটা আড়াল করার চেষ্টা করলো সে। “তোমার এরকম সাহসী কথাবাতা নান হবার পক্ষে একদম বেমানান।”
“ঠিক বলেছো, এতোক্ষণ ধরে তো আমি এটাই বলে আসছিলাম,” বললো ভ্যালেন্টাইন। “আমি জিওর বউ হবার চেয়ে একজন সৈন্যের বউ হতেই বেশি আগ্রহী।
অ্যাবির দিকে এগোতেই দুই বোনের চোখে পড়লো সারি সারি সাইপ্রেস বৃক্ষের মাধ্যমে তৈরি করা কুসিফিক্সের আদলটা। কালচে কুয়াশা ভেদ করে তারা অ্যাবির প্রাঙ্গনে ঢুকে পড়লো। মূল ভবনের প্রবেশদ্বারের বিশাল কাঠের দরজার সামনে চলে এলো তারা, তখনও ঘণ্টা বেজে চলছে। যেনো ভারি ঘন কুয়াশ ভেদ করে মৃত্যুর বারতা পৌঁছে দেয়া হচ্ছে।
তারা দু’জনেই দরজার কাছে এসে পায়ের বুট জুতা থেকে কাদা মুছে নিয়ে বুকে ক্রুস আঁকলো দ্রুত। তারপর প্রবেশদ্বারের উপরে যে খোদাই করা লেখাটা আছে সেটার দিকে না তাকিয়েই ঢুকে পড়লো ভেতরে। তবে তারা দুজনেই জানে সেই লেখাটা কী বলছে। এটা তাদের হৃদয়ে খোদাই করে লেখা হয়ে আছে যেনো :
এখানকার দেয়াল যারা মাটির সাথে গুঁড়িয়ে দেবে তারা অভিশপ্ত হবে রাজা চেক হবে শুধুমাত্র ঈশ্বরের হাতে।
এই বাণীটার নীচে একটা নাম বড় বড় অক্ষরে খোদাই করা আছে, কারোলাস ম্যাগনাস।
ইনি হলেন এই অ্যাবির স্থপতি, যারা এই স্থাপনা ধ্বংস করবে তাদের জন্যে সতর্কবার্তা এটি। প্রায় হাজার বছর আগে ফ্রাঙ্কিশ সাম্রাজ্যের মহান অধিপতি ছিলেন তিনি, শার্লেমেইন নামেই যিনি সবার কাছে পরিচিত।
.
অ্যাবির ভেতরকার দেয়ালগুলো কালো, শীতল আর আদ্র। একটু কান পাতলেই শোনা যাবে ভেতরের স্যাঙ্কটাম থেকে শিক্ষানবীশ নানেরা প্রার্থনা করছে। মিরিয়ে এবং ভ্যালেন্টাইন দ্রুত নানদের দলের সাথে ঢুকে পড়লো বেদীর পেছনে থাকা ছোট্ট দরজা দিয়ে, এখানে রেভারেন্ড মাদারের স্টাডিরুম অবস্থিত। বয়স্ক এক নান সবার পেছনে থাকা দুই বোনের দিকে ভর্ৎসনার দৃষ্টিতে তাকালেন। ভ্যালেন্টাইন আর মিরিয়ে একে অন্যের দিকে তাকিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়লো একসঙ্গে।
এভাবে অ্যাবির স্টাডিতে সবাইকে ডেকে আনাটা অদ্ভুতই বটে। খুব কম নানই এখানে ঢুকতে পারে, আর যারা ঢোকে তাদের বিরুদ্ধে শৃঙ্খলা ভঙ্গের শাস্তি নেমে আসে। ভ্যালেন্টাইনকে বার কয়েক এই শাস্তি ভোগ করতে হয়েছে। তবে একটু আগে অ্যাবির ঘণ্টাধ্বনি সব নানকে এখানে ডেকে এনেছে জমায়েতের উদ্দেশ্যে। রেভারেন্ড মাদারের স্টাডিতে তাদের সবাইকে নিশ্চয় একসাথে ডেকে আনা হয় নি?
কিন্তু ভ্যালেন্টাইন আর মিরিয়ে যখন নীচু ছাদের বিশাল কক্ষটাতে প্রবেশ করলো দেখতে পেলো অ্যাবির সব নানই সেখানে উপস্থিত-তাদের সংখ্যা পঞ্চাশেরও বেশি। অ্যাবিসের লেখার যে ডেস্কটা আছে সেটার সামনে কয়েক সারি কাঠের বেঞ্চ, নানেরা সবাই সেই বেঞ্চগুলোতে বসে আছে। এভাবে ডেকে আনার জন্যে নিজেদের মধ্যে চাপা স্বরে কথা বলছে তারা। দুই বোন ভেতরে ঢুকতেই যেসব নান তাদের দিকে তাকালো তাদের মুখে ভীতি ছড়িয়ে আছে। তারা দু’বোন বসলো সবার শেষ বেঞ্চে। ভ্যালেন্টাইন শক্ত করে মিরিয়ের হাতটা ধরে রাখলো।