এভাবে প্রতিটি সাধারণ মানুষই…দাবাখেলার সাদা-কালো খুঁটির মতো বিরুদ্ধ নৈতিকতার হয়ে থাকে।
–অ্যানাটমি অব ক্রিটিসিজম
নরথ্রোপ ফ্রাইয়ে
.
মন্তগ্লেইন অ্যাবি, ফ্রান্স
১৭৯০ সালের বসন্তকাল
একদল নান রাস্তা পার হচ্ছে, তাদের মাথার ঘোমটা গাংচিলের মতো উড়ছে প্রবল বাতাসে। শহরের বিশাল পাথুরে প্রবেশদ্বার পেরিয়ে ভেতরে ঢুকতেই তাদের পথ থেকে ভীতসন্ত্রস্ত মোরগ-মুরগি আর হাঁসের দল কাদার মধ্য দিয়ে যে যেদিকে পারলো সরে গেলো। প্রতি সকালে উপত্যকা ঢেকে দেয়া ঘন কুয়াশা ভেদ করে নিঃশব্দে চলে গেলো তারা। সামনে পাহাড়ের চূড়া থেকে যে ঘণ্টা ধ্বনি বাজছে নানের দলটি সেদিকেই এগিয়ে গেলো ধীরে ধীরে।
এই বসন্তকালকে তারা প্রিম্পটেস্পস স্যাঙ্গলান্ট বলে অভিহিত করছে, অর্থাৎ রক্তঝরা বসন্ত। পাহাড়ের চূড়া থেকে বরফ গলার অনেক আগেই এ বছর চেরি গাছে ফুল ধরে যায়। লাল টকটকে চেরির ভারে নাজুক ডালপালা মাটি ছুঁয়ে ফেলেছিলো। অনেকে বলছিলো, আগেভাগে চেরিফল আসা নাকি ভালো কিছু ঘটার লক্ষণ। দীর্ঘ আর অসহনীয় শীতের পরে পুণজন্মের একটি প্রতীক। কিন্তু তারপরই এলো সুতীব্র হিমশীতল বৃষ্টি, ডালে থাকা লাল চেরি ফল জমে বরফ হয়ে গেলো, অনেকটা ক্ষতস্থান থেকে বের হওয়া জমাটবাধা রক্তের মতো। এটাকেও আরেকটা ঘটনার অশনি সংকেত বলে ভাবা হলো তখন।
উপত্যকার উপরে মন্তগ্লেইন অ্যাবিটা মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। দূর্গতুল্য স্থাপনাটি হাজার হাজার বছর ধরে রক্ষা পেয়ে গেছে বহিশক্তির হাত থেকে। পর পর ছয় স্তরের দেয়ালের উপর ভিত্তি করে এটা গড়ে উঠেছে। পুরনো পাথরের দেয়াল শত শত বছর পর ক্ষয়ে গেলে তার উপর নতুন দেয়াল তৈরি করা হয়েছিলো। সেইসব দেয়াল ঠেকনা দেয়ার জন্যে বড় বড় পিলার নির্মাণ করা হয়। ফলে স্থাপনাটির যে দশা হয় সেটা অনেক গুজবের জন্ম দেয়। এই অ্যাবিটা ফ্রান্সের সবচাইতে পুরনো চার্চ যা একটি প্রাচীন অভিশাপ বহন করে যাচ্ছে আর সেই অভিশাপটি খুব শীঘ্রই জেগে উঠবে। বিশাল ঘণ্টা বাজছে, বাকি নানেরা একে অন্যের দিকে তাকালো, তারপর সারি সারি চেরিগাছের মাঝখান দিয়ে যে পথ চলে গেছে অ্যাবির দিকে সেটা ধরে এগোতে শুরু করলো তারা।
দীর্ঘ দলটির পেছনে আছে দু’জন শিক্ষানবীশ ভ্যালেন্টাইন আর মিরিয়ে, তারা হাতে হাত ধরে কর্দমাক্ত বুট জুতা পরে এগিয়ে যাচ্ছে। নানদের সুশৃঙ্খল সারিতে তারা দু’জন একেবারেই বেমানান। লম্বা, লালচুল, দীর্ঘ পদযুগল আর চওড়া কাঁধের মিরিয়েকে দেখে নান বলে মনে হয় না, মনে হয় কোনো কৃষককন্যা। নানের আলখেল্লার উপর বেশ ভারি একটা বুচার অ্যাপ্রোন পরে আছে সে, মাথায় যে টুপিটা পরেছে সেটার কানায় ঝুলছে লাল টকটকে লেস। তার পাশে থাকা ভ্যালেন্টাইন তার মতো লম্বা হলেও স্বাস্থ্য বেশ ভঙ্গুর। তার গায়ের চামড়া একেবারে ফ্যাকাশে সাদা, সেই ফ্যাকাশে রঙটা আরো বেশি প্রকট করে তুলেছে কাঁধ অবধি নেমে আসা ধবধবে সাদা চুল। মাথার টুপিটা সে আলখেল্লার পকেটে ঢুকিয়ে রেখেছে। একান্ত অনিচ্ছায় মিরিয়ের পাশে পাশে হেঁটে যাচ্ছে, পায়ের বুট দিয়ে বার বার লাথি মারছে কাদায়।
অ্যাবির সবচাইতে অল্পবয়সী এই দুই নান একে অন্যের খালাতো বোন। তারা দুজনেই খুব অল্প বয়স থেকে এতিম, ভয়ঙ্কর প্লেগ রোগের মহামারিতে ফ্রান্স যখন প্রায় জনশূন্য হয়ে পড়েছিলো তখন এদের বাপ-মা মারা যায়। তাদের বৃদ্ধ নানা কাউন্ট দ্য রেমি চার্চের হাতে এদেরকে তুলে দেন। তার মৃত্যুর পর রেখে যাওয়া এস্টেটের সহায়-সম্পত্তির আয় থেকে এ দু’জনের ভরণপোষণের ব্যয় মেটানো হয়।
দু’জনের এই অভিন্ন প্রেক্ষাপট তাদেরকে একে অন্যের কাছ থেকে অবিচ্ছেদ্য করে রেখেছে। যৌবনের সীমাহীন উদ্দামতায় তারা পরাভূত। অ্যাবিসের কাছে বৃদ্ধ নানেরা প্রায়শই অভিযোগ করে, দিনকে দিন এই মেয়ে দুটোর আচার আচরণ মঠ জীবনের সাথে বেখাপ্পা হয়ে উঠছে। কিন্তু অ্যাবিস নিজে একজন মেয়েমানুষ হিসেবে ভালো করেই জানেন, যৌবনের উদ্দামতাকে ঝেটিয়ে বিদায় করার চেয়ে এর লাগাম টেনে ধরাই বেশি ভালো।
তবে এটাও ঠিক, অ্যাবিস এই দুই এতিম তরুণীর প্রতি কিছুটা পক্ষপাতদুষ্ট, তার যে রকম ব্যক্তিত্ব তাতে করে এরকম আচরনকে ব্যতিক্রমই বলা যায়। বুড়ি নানেরা আরেকটা কথা জেনে অবাক হবে যে, অ্যাবিস নিজেও তার যৌবনে এক তরুণীর সাথে এরকম উজ্জ্বল বন্ধুত্বে জড়িয়ে পড়েছিলেন, কিন্তু অনেক অনেক বছর আগেই তাদের মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটে, বর্তমানে তারা দু’জন প্রায় হাজার মাইলের ব্যবধানে বসবাস করছে।
এখন, তার হাত ধরে অলসভঙ্গিতে হাঁটতে থাকা ভ্যালেন্টাইনকে আলস্য কতো বড় পাপ সে সম্পর্কে লেকচার দিয়ে যাচ্ছে মিরিয়ে।
“তুমি যদি এভাবে শ্লথ গতিতে হাঁটতে থাকে তাহলে রেভারেন্ড মাদার আমাদেরকে আবারো শাস্তি দেবেন,” বললো সে।
ভ্যালেন্টাইন চারপাশটা তাকিয়ে দেখলো। “বসন্তে সব ভরে উঠেছে, চিৎকার করে কথাটা বলেই দু’হাত শূন্যে দোলাতে লাগলো সে। এটা করতে গিয়ে আরেকটুর জন্যে কাছের গিরিখাদে পড়ে যেতে উদ্যত হলো অবশ্য তার বোন তাকে ধরে ফেললে সঙ্গে সঙ্গে। বাইরের দুনিয়া যখন ফুলেফলে নতুন জীবনস্পন্দে ভরে উঠছে তখন আমরা কেন ঐ অ্যাবিতে দরজা জানালা বন্ধ করে। থাকি?”