“আপনি এসব কি বলছেন?” আমার পেট গুলিয়ে একটা শীতল প্রবাহ বয়ে গেলো মেরুদণ্ড দিয়ে। “আলজিয়ার্স জায়গাটা আবার কোথায়? এর সাথে আমার কি সম্পর্ক?”
“আলজিয়ার্স হলো আলজেরিয়ার রাজধানী, উত্তর-আফ্রিকার একটি সমাজতান্ত্রিক দেশ। যার গায়ে তৃতীয়-বিশ্বের তকমা লাগানো আছে। আমার মনে হয় এই বইটা পড়ে বাকি সব জেনে নেয়াই ভালো। বিশাল একটা বই আমার ডেস্কে আছাড় মেরে রেখে আবার বলতে লাগলো সে, “ভিসা যতোদিন না হয় ততোদিন এখানেই থাকবেন। আমার মনে হয় সেটা কমপক্ষে তিন মাসের ব্যাপার। ওখানে আপনাকে অনেক দিন থাকতে হতে পারে। এটাই হলো আপনার নতুন অ্যাসাইনমেন্ট।”
“ওখানে আমার অ্যাসাইনমেন্টটা কি? মানে আমি করবোটা কি?” বললাম তাকে। “নাকি এটা কোনো নির্বাসন?”
“না, ওখানে আমাদের একটা প্রজেক্ট শুরু হয়েছে। দারুণ দারুণ সব জায়গায় আমরা কাজ পাচ্ছি আজকাল। এটা এক বছরের একটা কাজ, তৃতীয় বিশ্বের একটি সমাজতান্ত্রিক দেশের গ্যাসোলিনের মূল্য নির্ধারণের কাজকারবার আর কি। এটাকে বলে OTRAM, না…দাঁড়ান দেখি আসলে কি,” জ্যাকেটের পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে পড়ে দেখলো সে। “হ্যাঁ, এটাকে বলে। OPEC।”
“জীবনেও এ নাম শুনি নি,” আমি বললাম। ১৯৭২ সালের ডিসেম্বরে এই। OPEC নামটা অবশ্য খুব বেশি সংখ্যক মানুষ শোনেও নি। যদিও এরপর দ্রুত নামটা পরিচিতি পেয়ে যায়।
“আরে আমিও তো শুনি নি,” লিসেল বললো। “এজন্যেই পার্টনাররা মনে করেছেন আপনার জন্য এটা পারফেক্ট অ্যাসাইনমেন্ট। মনে রাখবেন, তারা আপনাকে মাটি চাপা দিতে চায়, ভেলিস।” টয়লেটটা আবারো ফ্লাশ করে উঠলে আমার সব আশা ধুলিসাৎ হয়ে গেলো।
“কয়েক সপ্তাহ আগে প্যারিস অফিস থেকে আমরা একটা বার্তা পাই, তারা জানতে চেয়েছিলো আমাদের কাছে তেল, প্রাকৃতিক গ্যাস আর পাওয়ার প্ল্যান্টের উপর কম্পিউটার এক্সপার্ট আছে কিনা-এরকম কেউ থাকলে তারা তাকে পেতে। চাচ্ছে কিছু দিনের জন্য, এতে করে আমরা মোটা অঙ্কের কমিশনও পাবো। আমাদের সিনিয়র কনসালটেন্টদের কেউই যেতে রাজি ছিলো না। এনার্জি সেক্টরটা এখন আর হাই-গ্রোথ ইন্ডাস্ট্রি নয়। এটাকে ডেড-এন্ড অ্যাসাইনমেন্ট হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আমরা যখন তাদেরকে জানাতে যাচ্ছিলাম এরকম কেউ আমাদের অফিসে নেই ঠিক তখনই আপনার নামটা সবার কাছে বেশ মনে ধরে গেলো।”
তারা আমাকে এ কাজটা নিতে বাধ্য করতে পারে না; দাসপ্রথা গৃহযুদ্ধের পর পরই শেষ হয়ে গেছে। তারা চাইছে আমি যেনো বাধ্য হয়ে ফার্ম থেকে পদত্যাগ করি। কিন্তু তাদের কাছে এতো সহজে নতি স্বীকার করার মেয়ে আমি নই।
“এইসব তৃতীয় বিশ্বের বুড়ো-ভদ্র ছেলেদের সাথে আমি কি করবো?” খুব মিষ্টি করে হেসে বললাম। “আমি তো তেলের ব্যাপারে কিছুই জানি না। আর প্রাকৃতিক গ্যাসের ব্যাপারেও একই কথা খাটে। পাশের অফিস থেকে মাঝেমধ্যে তাদের আওয়াজ অবশ্য শুনতে পাই।” আমার অফিসের পাশে টয়লেটের দিকে মাথা নেড়ে ইঙ্গিত করলাম।
“জিজ্ঞেস করেছেন বলে খুশি হলাম,” দরজার কাছে যেতে যেতে বললো লিসেল। “দেশ ছাড়ার আগপর্যন্ত আপনাকে কড এডিসনের কাছে অ্যাসাইন করা হয়েছে। কয়েক মাসের মধ্যে আপনি এনার্জি কনভার্সনের উপর একজন এক্সপার্ট হয়ে উঠবেন।”
লিসেল মুচকি হেসে চলে যেতে যেতে বললো, “আরে আপনার তো খুশি হবার কথা, ভেলিন। ভাগ্য ভালো কোলকাতায় পোস্টিং হয় নি।
ফলে আমি মাঝরাতে প্যান অ্যাম ডাটা সেন্টারে বসে আছি। এমন একটা দেশ সম্পর্কে জানার চেষ্টা করছি যার নাম এর আগে কখনও শুনি নি। এমন কি সেই মহাদেশটা সম্পর্কেও খুব কমই জানি। এমন একটা ক্ষেত্রে এক্সপার্ট হতে চলেছি যার ব্যাপারে আমার কোনো আগ্রহ নেই। আমাকে এখন এমন সব লোকজনের মাঝে গিয়ে থাকতে হবে যারা আমার ভাষায় কথা বলে না। সম্ভবত তারা নারীদেরকে হেরেমে থাকা ভোগের বস্তু ছাড়া অন্যকিছু ভাবেও না। তবে ফুলব্রাইট কোন ফার্মের সাথে অনেক দিক থেকেই তাদের মিল রয়েছে বলে আমার ধারণা।
আমি নির্ভিক রইলাম। তিন বছর সময় লেগেছিলো ট্রান্সপোর্টেশন ফিল্ড সম্পর্কে জানতে। মনে হচ্ছে এনার্জি সম্পর্কে জানতে আরো কম সময় লাগবে। মাটি ফুটো করলেই আপনি দেখতে পাবেন তেল বেরিয়ে আসছে। এ আর এমন কি কঠিন? তবে এটা খুবই যন্ত্রণাদায়ক অভিজ্ঞতা হবে, আমার সামনে থাকা একটা বইয়ের কথা যদি সত্যি হয়ে থাকে তাহলে এটা বলতেই হয় :
১৯৫০ সালে মাত্র দুই ডলারে এক ব্যারেল আরবিয় কুডওয়েল বিক্রি হতো। ১৯৭২ সালেও ঐ একই দামে বিক্রি হচ্ছে। ফলে মনে হতে পারে আরবীয় কুডওয়েল এই বিশ্বের সবচাইতে কম গুরুত্বপূর্ণ জিনিস, যার মূল্যস্ফীতি শূন্যের কোঠায়। কিন্তু আসল সত্য হলো বিশ্বমোড়লেরা এই মহামূল্যবান জিনিসটার দাম নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।
দারুণ ব্যাপার। কিন্তু তারচেয়েও দারুণ যে ব্যাপারটা আমি খুঁজে পেলাম সেটা বইতে ব্যাখ্যা করা নেই। এটা এমন একটা বিষয় যা ঐ রাতে পড়া কোনো বইতেই আমি খুঁজে পাই নি।
আরবিয় কুডওয়েল আসলে এক ধরণের তেলই। সত্যি বলতে কি এটা এ বিশ্বের সবচাইতে কাঙ্খিত আর উচ্চমূল্যের পণ্য। সুদীর্ঘ বিশ বছরে এর দাম না বাড়ার কারণ, যারা এটা কেনে এবং যারা এটা মাটি থেকে উত্তোলন করে বিক্রি করে তারা কেউই এর দাম নিয়ন্ত্রণ করে না। এর দাম নিয়ন্ত্রণ করে ঐসব লোকজন যারা ডিস্ট্রিবিউট করে-কুখ্যাত মধ্যসত্ত্বভোগীর দল। ব্যাপারটা শুরু থেকেই হয়ে আসছে।