ষোড়শ শতকে শ্রমিকদের অবস্থা আরো বেশি খারাপ হয়, যা আমরা আগেই জানি। আর্থিক মজুরি বেড়ে গিয়েছিল সত্য, কিন্তু টাকার মূল্য যে-হারে কমে গিয়েছিল, তথা জিনিসপত্রের দাম যে-হারে বেড়ে গিয়েছিল, সেই হারে নয়। সুতরাং, বাস্তবিক পক্ষে মজুরি পড়ে গিয়েছিল। যাই হোক, শ্রমিকদের দাবিয়ে রাখার আইন গুলি চালু ছিল এবং সেই সঙ্গে ছিল, “যাদের কেউ কাজে নিতে চায়না, তাদের কান কেটে দেবার এবং দাগ মেরে দেবার ব্যবস্থা। শিক্ষানবিশ বিধি ৫ এলিজাবেথ, অনুচ্ছেদ ও শান্তি রক্ষী বিচারকদের ক্ষমতা দান করল কতকগুলি মজুরি বেঁধে দিতে এবং বছরের ঋতু এবং জিনিসপত্রের দাম অনুযায়ী সেগুলি সংশোধন করতে। প্রথম জেমস শ্রম-সংক্রান্ত এই নিয়ন্ত্রণগুলিকে তন্তুবায়, সুতো-কাটনি এবং শ্রমিকদের সম্ভাব্য সকল রকমের বর্গের ক্ষেত্রে সম্প্রসারিত করলেন।[৫] শ্রমিক-সম্মিলন-বিরোধী আইন গুলিকে দ্বিতীয় জজ সম্প্রসারিত করলেন ম্যানুফ্যাকচার সমূহের ক্ষেত্রে। যথাযথ ম্যানুফ্যাকচার-আমলে ধনতান্ত্রিক উৎপাদন-পদ্ধতি মজুরি-সংক্রান্ত আইনগত নিয়ম কানুনগুলিকে সমভাবে অপ্রয়োজনীয় ও অকার্যকরী করে দেবার মত যথেষ্ট শক্তি সঞ্চয় করেছিল; কিন্তু পুরনো অস্ত্রাগারের এই অস্ত্রগুলিকে আবশ্যকমত ব্যবহার করার অধিকার হাতছাড়া করতে শাসক শ্রেণীগুলি রাজি ছিলনা। তবু দ্বিতীয় জজের ৮নং বিধান প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দর্জিদের জন্য, লণ্ডনের ভিতরে ও আশেপাশে, একমাত্র সাধারণ শোকের দিন ছাড়া, ২ শিলিং ৭.৫ পেন্স-এর চেয়ে বেশি দৈনিক মজুরি নিষিদ্ধ করে দিল; তবু তৃতীয় জজের ১৩নং বিধানের ৬৮নং অনুচ্ছেদ রেশম-তন্তুবায়দের মজুরি নিয়মনের কর্তৃত্ব শান্তিরক্ষী বিচারকদের হাতে তুলে দিল; তবু ১৭০৬ সালে, উচ্চতর আদালতের দু-দুবার রায় দিতে হল কেবল এই ব্যাপারটা স্থির করতে যে শান্তিরক্ষী বিচারকদের নির্দেশ অ-কৃষি-শ্রমিকদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য কিনা; তবু, ১৭৯৯ সালে, পালমেন্টের একটা আইনে এই আদেশ জারি করল যে স্কচ খনি-শ্রমিকদের মজুরি এলিজাবেথের একটি বিধান এবং ১৬৬১ ও ১৬৭১ সালের দুটি স্কচ আইনের ধারা নিয়মিত হতে থাকবে। ইতিমধ্যে পরিস্থিতি কেমন পুরোপুরি বদলে গিয়েছে, তার প্রমাণ পাওয়া যায় এমন একটি ঘটনায়, যা ইংল্যাণ্ডের পালমেন্টের নিম্নতর পরিষদে আর কখনো শোনা যায়নি। যে-পরিষদ-ভবনে ৪০০ বছর ধরে প্রণীত হয়েছে কেবল মজুরির সর্বোচ্চ মাত্রা সংক্রান্ত আইন, যার উপরে মজুরি কখনো উঠতে পারবেনা, সেই ভবনে ১৭৯৬ সালে হুইটব্রেড কৃষি-শ্রমিকদের জন্য উত্থাপন করলেন একটি আইনগত সর্বনিম্ন মজুরি বেঁধে দেবার প্রস্তাব। পিট এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করলেন, যদিও স্বীকার করলেন, “গরিবদের অবস্থা নিষ্ঠুর।” সর্বশেষে, ১৮১৩ সালে মজুরি নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত আইনগুলি প্রত্যাহৃত হল। সেগুলি হয়ে পড়েছিল অদ্ভুত অবান্তর ব্যাপার কেননা ধনিক তার কারখানা পরিচালনা করত তার ব্যক্তিগত আইন-প্রণয়নের দ্বারা, এবং গরিব-করের দ্বারা পুষিয়ে দিতে পারত কৃষি-শ্রমিকের মজুরিকে যথাসম্ভব ন্যতম হারে। মালিক এবং শ্রমিকের মধ্যে চুক্তি, নোটিস দেওয়া ইত্যাদির মত শ্রম-বিধির অন্তর্গত সংস্থানগুলি যা লংঘন করলে মালিকের বিরুদ্ধে কেবল দেওয়ানি ব্যবস্থা নেওয়া যায় কিন্তু যা লংঘন করলে শ্রমিকের বিরুদ্ধে নেওয়া যায় ফৌজদারি ব্যবস্থা, সেগুলি আজও পর্যন্ত (১৮৭৩) পুরোদমে বলবৎ আছে। ট্রেড ইউনিয়নের বিরুদ্ধে বর্বর আইনগুলি ১৮২৫ সালে সর্বহারা শ্রেণীর ভীতিপ্রদ চেহারার সামনে ভেঙে পড়েছিল। তা সত্বেও, সেগুলি তখন ভেঙে পড়েছিল কেবল আংশিক ভাবে। পুরনো বিধির কতকগুলি সুন্দর অংশের অবলুপ্তি ঘটে কেবল ১৮৫৯ সালে। সর্বশেষে, পালমেন্টের ১৮৭১ সালের ২৯শে জুনের আইনটি ট্রেড ইউনিয়নগুলিকে আইনত স্বীকৃতি দান করে এই শ্রেণীর আইনের অবশেষগুলিকে নিশ্চিহ্ন করে দেবার ভান করল। কিন্তু ঐ একই তারিখের আরেকটি আইন (হিংসা, হুমকি ও পীড়ন সংক্রান্ত ফৌজদারী আইনের সংশোধনী আইন) কার্যত পুরনো ব্যবস্থাই নোতুন নামে পুনর্বহাল করল। শ্রমিকেরা ধর্মঘট ও তালাবন্ধ’-এর সময় যেসব উপায় অবলম্বন করতে পারত, এই সংসদীয় প্রকৌশলের দ্বারা সেগুলিকে সমস্ত নাগরিকদের সার্বজনিক আইনসমূহ থেকে প্রত্যাহার করে নেওয়া হল এবং স্থাপন করা হল বিশেষ দণ্ডবিধির অধীনে, যার ব্যাখ্যা করবেন স্বয়ং মালিকেরাইশান্তিরক্ষী বিচারক হিসাবে তাদের ভূমিকায়। দু বছর আগে এই একই কমন-সভা এবং এই একই মিঃ গ্ল্যাডস্টোন সু-পরিচিত সরাসরি ভঙ্গিতে শ্রমিক শ্রেণীর বিরুদ্ধে সর্বপ্রকার বিশেষ দণ্ডবিধির অবসান ঘটাবার জন্য একটি প্রস্তাব (‘বিল’ ) উত্থাপন করেছিলেন। কিন্তু সেটিকে “দ্বিতীয় পাঠ” (“সেকেণ্ড রিভিং” ) এর বাইরে যেতে দেওয়া হয়নি, এবং এই ভাবে ব্যাপারটাকে টেনে নেওয়া হয় যে পর্যন্ত না টোরিদের সঙ্গে মৈত্রীবদ্ধ হয়ে “মহান্ লিবারল পাটি” যে-সর্বহারা-শ্রেণী তাকে ক্ষমতায় এনেছিল, তারই বিরুদ্ধে দাঁড়াবার মত সাহস সঞ্চয় করতে না পেরেছিল। এতটা বেইমানি করেও “মহান লিবারল পার্টি” তৃপ্ত হলনা; শাসক শ্রেণীগুলির সেবায় যারা সব সময়েই আগ্রহী, সেই বিচারকদের সে অনুমতি দান করল “ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে পুরনো আইনগুলিকে আবার খুড়ে তুলতে এবং সেগুলিকে শ্রমিক সম্মিলনগুলির বিরুদ্ধে প্রয়োগ করতে। আমরা দেখতে পাই, ৫০০ বছর ধরে নিলজ্জ অহংকারের সঙ্গে শ্রমিকদের বিরুদ্ধে মালিকদের চিরস্থায়ী ট্রেড ইউনিয়ন হিসাবে কাজ করে আসার পরে শেষ পর্যন্ত ইংরেজ পালমেন্ট জনসাধারণের চাপে নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে ধর্মঘট ও ট্রেড ইউনিয়নের বিরুদ্ধে আইনকানুনগুলি পরিত্যাগ করল।