চোখে-মুখে বিতৃষ্ণার ছাপ ফুটিয়ে তুলে কর্কশ স্বরে মেয়েটা বলে উঠল—তোমার উপযুক্ত স্থান একমাত্র হাসপাতালের ওয়ার্ড, বুঝলে? কথাটা বলেই সে পিছিয়ে নিজের জায়গায় চলে গেল।
ন্যান্সি হগুপ্তায় আট ডলার রোজগার করে, এরকম উচ্চাশা নিয়ে দিন কাটাতে লাগল। শুকনো রুটিতে পেট ভরে দিনের পর দিন কোমরবন্ধটাকে আঁটতে আঁটতে অজ্ঞাত পুরুষকে শিকার করার প্রত্যাশায় দিন কাটাতে লাগল। তার চোখে-মুখে ভেসে উঠতে লাগল। অদৃষ্টের চক্করে পড়া পুরুষশিকারীদের হর্ষ-বিষাদ ক্লিষ্ট হাসির ছাপ। তার বিপনিটি অরণ্যের সামিলাই বটে। বহুবারই লম্বা শিং ও বড় মাপের শিকার জ্ঞান করে বারবার বন্দুক উঁচিয়ে ধরেও প্রতিবারই মনমরা হয়ে বন্দুকের নলটাকে নামিয়ে নিয়েছে। আবার নতুন শিকারের খোজে ওৎ পেতে অপেক্ষা করতে লাগল।
তার বান্ধবী লু? সে ইতিমধ্যেই বরাত ফিরিয়ে নিয়েছে। প্রতি হস্তায় পাওয়া সাড়ে আঠার ডলার থেকে ঘরভাড়া ও আহারাদি বাবদ ব্যয় করে ছাডলার। আর বাকি অর্থ পোশাক-পরিচ্ছদ বাবদ ব্যয় হয়ে যায়। ন্যান্সির তুলনায় রুচি ও জীবনযাত্রার মান উন্নত করার চিন্তায় নিজেকে লিপ্ত রাখার অবকাশ তার খুবই কম। সারাদিন গরম ইন্ত্রি হাতে নিয়ে তাকে কেবল কাজ আর কাজের মধ্যে ডুবে থাকতে হয়। ইন্ত্রি গরম থাকলে তো আর থামার কথা ভাবাই যায় না। আর আসন্ন সন্ধ্যার আকাঙ্খিত আনন্দ অনুষ্ঠানের ভাবনা মাঝে মধ্যে মাথায় এসে ভর করে। রঙ-বেরঙের আর দামী পোশাক-আশাক তাকে ইন্ত্রি করতে হয়। সে জন্যই হয়ত ইন্ত্রি নামক যন্ত্রটার মাধ্যমে তার ভেতরে পোশাক-পরিচ্ছদের প্রতি আকর্ষণ উত্তরোত্তর বেড়েই চলে।
দিনের শেষে হাতের কাজ ফুরিয়ে গেলে ডান তার জন্য বাইরে অধীর প্রতীক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকে। মাঝে-মধ্যে কৌতুহল-মিশ্রিত চাহনি মেলে লু-র পোশাকের দিকে তাকিয়ে থাকে। কারণ, পোশাকের চেয়ে লোক দেখানোর প্রয়াসই তার মধ্যে বেশী থাকে। ডান কিন্তু এতে খুশী নয়। পথচারীরা তার পোশাক আশাকের দিকে কৌতুহলী নজরে তাকিয়ে থাকলেও মোটেই আমল দেয় না।
তবে এ-ও সত্য নয় যে, লুতার বান্ধবীকে তেমন ভালবাসে না। ব্যাপারটা ধরতে গেলে রুটিনে দাঁড়িয়ে গিয়েছে, লু আর ডান যখন, যেখানে বেড়াতে যাবে ন্যান্সি তাদের সঙ্গে যাবেই। এ উপরি ব্যয়ের বোঝা ডান নিদ্বিধায়, হাসিমুখেই বহন করে। বরং বলা যেতে পারে, ভ্রমণে বেরোলে লু রং জোগায়, ন্যান্সি জোগায় সুর, আর ব্যয়ের বোঝা বয় ডান। রেডিমেড পোশাকে সজ্জিত হয়ে সহযাত্রী বন্ধটি পরমানন্দে তাদের সঙ্গদান করে। তাদের মেলামেশায় তিলমাত্র ব্যাঘাতও ঘটায় না। এমন সব ভাল মানুষ আছে যার উপস্থিতিতে সবাই নিজেদের ভুলে থাকে—সে এমনই একজন। আর সে অনুপস্থিত থাকলে তার কথা বডড বেশী করে স্মৃতির পটে ভেসে ওঠে।
কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, এরকম হাল্কা আনন্দ-অনুষ্ঠানে ন্যান্সি-র মত উন্নত ও মার্জিত রুচিসম্পন্না মেয়ের কাছে কিছুটা বিতৃষ্ণা তো মনে জাগেই। তবে সে-ও উদ্ভিন্ন যৌবনা। মানুষকে ভোজনরসিক করে তোলাই তো যৌবনের ধর্ম। সেক্ষেত্রে রুটির ব্যাপারটা প্রাধান্য পায় না।
একদিন লু তার বান্ধবী ন্যান্সি-কে বলল-একটা কথা। ডান-এর ইচ্ছে, আমি এখনই তাকে বিয়ে করি। আমি বিয়েটিয়ের হাঙ্গামায় যাব কেন,বল তো? আমি সত্যিকারের স্বাধীন। এখন আমি আমার টাকাকড়ি যেভাবে খুশি খরচ করতে পারি। কিন্তু বিয়ের পর? তখন তো সে আমাকে চাকরি করতেই দেবে না। মুহুর্তকাল নীরবে ভেবে আকাের মুখ খুলল—ভাল কথা, ন্যানস। তুমি আদ্যিকালের বিপনিটাতে কোন পড়ে রয়েছ? মনের মত খাবার বা ভাল পোশাক পরিচ্ছদ কিছুই জোগাড় করতে পার না। তুমি রাজি থাকলে আমাদের লণ্ড্রীতে তোমার একটা কাজের ব্যবস্থা করে দিতে পারি। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আরও কিছু বেশি পেনি রোজগার করতে পারলে তোমার এমন হিসেব করে খরচ করার দরকার পড়বে না।
মুচকি হেসে ন্যান্সি বলল—আমি হিসেব করে খরচ করি এমনটা তো আমার মনে হয় না। লু। একটা কথা শুনে রাখ, আমি বরং একবেলা খাব, আধ-পেটা খেয়ে দিন কটাব তবু যেখানে আছি সেখানেই থাকতে আগ্রহী। তবে সুযোগের প্রতীক্ষায় আমি আছি, চিরদিন সেখানে পড়ে থাকিব না, শুনে রাখি। আমি সেখানে নিত্য নতুন শিক্ষা লাভ করছি। ধনকুবের নিয়েই আমার কাজ হলেও তাদের আমি মোটেই বরদাস্ত করতে পারিনে।
লু, চোখে-মুখে বিদ্রুপাত্মক হাসির রেখা ফুটিয়ে তুলে বলল—একটা কথা ন্যানস, তোমার ধনকুবেরটাকে কি কাজ করতে পেরেছ?
না। আজ অবধি কাউকে নির্বাচন করতে পারিনি। জোর তল্লাশি চালিয়ে যাচ্ছি।
সে কী হে! এখনও তল্লাশি চালিয়ে যাচ্ছ? ব্যাপার কি, কাউকেই কি পাত্তা, মানে কাছে ঘোষতে দিচ্ছ না? তার মালকড়ি না হয় কিছু কমই থাকল, ক্ষতি কি? ধুৎ! তুমি রসিকতা করছ, টাকার কুমীরগুলো আমাদের কথা নিয়ে মাথা ঘামায় না।
যদি মাথা ঘামাত তবে আখেরে তাদেরই লাভ হত। স্বাভাবিক কণ্ঠেই ন্যান্সি জবাবটা ছুড়ে দিল। মানে কিভাবে টাকা জমানো যায় এটা আমরা কেউ না কেউ তাদের শিখিয়ে দিতে পারতাম।
খিল খিলিয়ে হেসে লু বলল—শোন, কেউ যদি আমার মুঠোর মধ্যে আসতে চায় আমি কিন্তু তাকে ঠিক বাগিয়ে নেব। আসলে তাদের চরিত্র সম্বন্ধে তোমার কোন ধারণা নেই বলেই তুমি এমন কথা এত সহজেই বলতে পারছি। সাধারণ মানুষ আর ধনীদের মধ্যে ফারাকটা বুঝতে হলে তাদের আরও কাছে গিয়ে দেখতে হবে। তুমি কি বুঝছি না, কোটটার চেয়ে ওই লাল সিক্ষের লাইনিংটা একটু বেশীই গাঢ়, কি, বুঝতে পারছ?