- বইয়ের নামঃ কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহার
- লেখকের নামঃ কার্ল মার্ক্স
- প্রকাশনাঃ টাঙ্গন
- বিভাগসমূহঃ অনুবাদ বই
কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহার
০. ভূমিকা – কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহার
১৮৭২ সালের জার্মান সংস্করণের ভূমিকা
কমিউনিস্ট লীগ ছিল শ্রমিকদের এক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান, তখনকার অবস্থা অনসারে তার গুপ্ত সমিতি হওয়া ছাড়া উপায় ছিল না। ১৮৪৭ সালের নভেম্বরে লণ্ডনে এর যে কংগ্রেস বসে তা থেকে নিম্নস্বাক্ষরকারীদের উপর ভার দেওয়া হয়, পার্টির একটি বিশদ তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক কর্মসূচি রচনা করতে প্রকাশের জন্য। নিচের ‘ইশতেহারটির উৎপত্তি হয় এইভাবে। ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের* কয়েক সপ্তাহ আগে এর পাণ্ডুলিপিটি ছাপা হবার জন্য লণ্ডনে যায়। জার্মান ভাষায় প্রথম প্রকাশের পর, জার্মানি, ইংল্যান্ড ও আমেরিকা থেকে এটি জার্মান ভাষায় অন্তত বারটি বিভিন্ন সংস্করণে পানঃপ্রকাশিত হয়েছে। ইংরেজীতে, শ্ৰীমতী হেলেন ম্যাকফারলেনের অনুবাদে, এর প্রথম প্রকাশ হয়েছিল লণ্ডনের Red Republican-এ (লাল প্রজাতন্ত্রী) ১৮৫০ সালে এবং পরে ১৮৭১ সালে আমেরিকায় অন্তত তিনটি স্বতন্ত্র অনুবাদের মাধ্যমে। ফরাসী অনুবাদ প্রথম বের হয়। প্যারিসে ১৮৪৮ সালের জুন অভ্যুত্থানের সামান্য আগে, আবার সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে নিউ ইয়র্কের Le Socialiste পত্রিকায়। আরও একটি অনুবাদের কাজ এখন চলেছে। জার্মান ভাষায় প্রথম প্রকাশিত হবার কিছু পরেই লণ্ডনে পোলীয় অনুবাদ বের হয়েছিল। উনিশ শতকের সপ্তম দশকে জেনেভা শহরে প্রকাশিত হয় এর রুশ অনুবাদ। প্রথম প্রকাশের অল্পদিনের মধ্যেই এর অনুবাদ হয়। ডেনিশ ভাষাতেও।
গত পঁচিশ বছরে বাস্তব অবস্থা যতই বদলে যাক না কেন, এই ‘ইশতেহার’এ যে সব সাধারণ মূলনীতি নির্ধারিত হয়েছিল তা আজও মোটের ওপর ঠিক আগের মতোই সঠিক। এখানে ওখানে সামান্য দু’একটি কথা আরও ভাল করে লেখা যেত। সর্বত্র এবং সবসময়ে মূলনীতিগুলির ব্যবহারিক প্রয়োগ নির্ভর করবে তখনকার ঐতিহাসিক অবস্থার উপর, ‘ইশতেহার’এর ভিতরেই সে কথা রয়েছে। সেইজন্য দ্বিতীয় অধ্যায়ের শেষে যেসব বিপ্লবী ব্যবস্থার প্রস্তাব আছে তার উপর বিশেষ জোর দেওয়া হয়নি। আজকের দিনে হলে এ অংশটা নানা দিক থেকে অন্যভাবে লিখতে হত। গত পাঁচিশ বছরে আধুনিক যন্ত্রশিল্প যে বিপুল পদক্ষেপে এগিয়ে গেছে, সঙ্গে সঙ্গে শ্রমিক শ্রেণীর পার্টি সংগঠন উন্নত ও প্রসারিত হয়েছে; প্রথমে ফেব্রুয়ারি বিপ্লবে, পরে আরও বেশী করে প্যারিস কমিউনে, যেখানে প্রলেতারিয়েত এই সব প্রথম পুরো দাই মাস ধরে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করেছিল, তাতে যে বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জিত হয়েছে তার ফলে এই কর্মসূচী খুঁটিনাটি কিছু ব্যাপারে সেকেলে হয়ে পড়েছে। কমিউন বিশেষ করে একটি কথা প্রমাণ করেছে যে : ‘তৈরি রাষ্ট্রযন্ত্রটা শুধু দখলে পেয়েই শ্রমিক শ্রেণী তা নিজের কাজে লাগাতে পারে না।‘ (ফ্রান্সে গৃহযুদ্ধ; আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী মানুষের সমিতির সাধারণ পরিষদের বিবৃতি, লণ্ডন, ট্রুলাভ, ১৮৭১, ১৫ পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য** সেখানে কথাটা আরও বিশদভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।) তাছাড়া একথাও স্বতঃস্পষ্ট যে, সমাজতন্ত্রী সাহিত্যের সমালোচনাটি আজকের দিনের হিসাবে অসম্পূর্ণ, কারণ সে আলোচনার বিস্তার এখানে মাত্র ১৮৪৭ পর্যন্ত; তাছাড়া বিভিন্ন বিরোধী দলের সঙ্গে কমিউনিস্টদের সম্পর্ক সম্বন্ধে বক্তব্যগুলিও (চতুৰ্থ অধ্যায়ে), সাধারণ মূলনীতির দিক থেকে ঠিক হলেও, ব্যবহারিক দিক থেকে সেকেলে হয়ে গেছে, কেননা রাজনৈতিক পরিস্থিতি একেবারে বদলে গেছে, এবং উল্লিখিত রাজনৈতিক দলগুলির অধিকাংশকে ইতিহাসের অগ্রগতি এ জগৎ থেকে ঝেঁটিয়ে বিদায় দিয়েছে।
কিন্তু এই ‘ইশতেহার’ এখন ঐতিহাসিক দলিল হয়ে পড়েছে, একে বদলাবার কোনও অধিকার আমাদের আর নেই। সম্ভবত পরবর্তী কোনো সংস্করণ বার করা যাবে। যাতে ১৮৪৭ থেকে আজ অবধি ব্যবধান কালটুকু নিয়ে একটা ভূমিকা থাকবে; বর্তমান সংস্করণ এত অপ্রত্যাশিতভাবে বেরল যে আমাদের পক্ষে তার সময় ছিল না।
কার্ল মার্কস। ফ্রেডারিক এঙ্গেলস
লণ্ডন, ২৪শে জুন, ১৮৭২
* ১৮৪৮ সালে ফ্রান্সের ফেব্রুয়ারি বিপ্লব।–সম্পাঃ।
** কাল মার্কস ও ফ্রেডরিক এঙ্গেলস, রচনা-সংকলন, প্রথম খন্ড, দ্বিতীয় অংশ দ্রষ্টব্য।–সম্পাঃ
১৮৮২ সালের রুশ সংস্করণের ভূমিকা
‘কমিউনিস্ট পার্টির ‘ইশতেহার’এর প্রথম রুশ সংস্করণ, বাকুনিনের অনুবাদে, সপ্তম দশকের গোড়ার দিকে* ‘কলোকোল’ পত্রিকার ছাপাখানা থেকে প্রকাশিত হয়েছিল। সেদিন পশ্চিমের কাছে এটা (‘ইশতেহার’এর রুশ সংস্করণ) মনে হতে পারত একটা সাহিত্যিক কৌতূহল-বস্তু মাত্র। আজ তেমন ভাবে দেখা অসম্ভব।
তখনো পর্যন্ত (ডিসেম্বর, ১৮৪৭) প্রলেতারীয় আন্দোলন কত সীমাবদ্ধ স্থান জড়ে ছিল সেকথা সবচেয়ে পরিষ্কার করে দেয় ‘ইশতেহার’এর শেষ অধ্যায়টা: বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন বিরোধী দলের সঙ্গে কমিউনিস্টদের সম্পর্ক। রাশিয়া ও যক্তরাষ্ট্রের উল্লেখই নেই। এখানে। সে যুগে রাশিয়া ছিল ইউরোপের সমস্ত প্রতিক্রিয়াশীলতার বিরাট শেষ-নির্ভর, আর দেশান্তরগমনের ভিতর দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র গ্রহণ করছিল ইউরোপীয় প্রলেতারিয়েতের উদ্বত্ত অংশটাকে। উভয় দেশই ইউরোপকে কাঁচামাল যোগাত, আর সেই সঙ্গে ছিল তার শল্পজাত সামগ্রীর বাজার। সে যুগে তাই দুই দেশই কোনো না কোনো ভাবে ছিল ইউরোপের চলতি ব্যবস্থার স্তম্ভ।