- বইয়ের নামঃ কহলীল জিবরান রচনাবলি
- লেখকের নামঃ কহলীল জিবরান
- বিভাগসমূহঃ অনুবাদ বই, রচনাবলী
কহলীল জিবরান রচনাবলি
০. কহলীল জিবরানের জীবন, সাহিত্য ও প্রেম / ভাষান্তর প্রসঙ্গে
কহলীল জিবরান রচনাবলি
ভাষান্তর : মোস্তফা মীর
প্রথম প্রকাশ মাঘ ১৪১৫ ফেব্রুয়ারি ২০০৯
.
উৎসর্গ
আগুনে লাফিয়ে পড়ার জন্য যার জন্ম হয়েছিল
তাকে ঝর্ণার সুশীতল জলের পাশে বসিয়ে
দিয়ে দেখেছি কোনো লাভ হয়নি। সে ঠিকই অনুসন্ধান
করেছে অগ্নিকুণ্ড এবং তাতে লাফিয়ে পড়েছে
যেমন আজকের জন্য, তেমনি আগামীকালের জন্য
এবং চিরকালের জন্য।
সৈয়দ আবু নাসের কর্নেল
আমাদের চোখের ভেতর দিয়ে যে তাকিয়ে আছে
অন্য এক পৃথিবীর দিকে।
.
কহলীল জিবরানের জীবন, সাহিত্য ও প্রেম
[জিবরানের পুরো নাম আরবিতে ছিল জিবরান খলিল জিবরান। নামের মধ্য-অংশ ‘খলিল’ হচ্ছে তার পিতার নাম। নামের প্রথম অংশের পর পিতার নাম ব্যবহার করা আরবের একটা প্রচলিত রীতি। তিনি তার আরবি রচনাগুলিতে পুরো নামই ব্যবহার করেছেন। ইংরেজি রচনায় তিনি নামের প্রথম অংশ হেঁটে ফেলেন এবং ‘খলিলের’ শুদ্ধ বানান ‘কহলীল’ লিখতে শুরু করেন। উল্লেখ্য, ১৮৯৭ পর্যন্ত বস্টনের স্কুলে লেখাপড়া করার সময় ইংরেজির শিক্ষক তার নামের বানান শুদ্ধ করে দেন।]
১
লেবাননের বিখ্যাত চিরহরিৎ বনভূমির কাছাকাছি বিসাররীতে ১৮৮৩ সালে জিবরান জন্মগ্রহণ করেন। তিনি মা, সৎ ভাই ও দুবোনসহ কৈশোরে আমেরিকায় অভিবাসী হন। প্রথমে থিতু হন বস্টনে এবং পরবর্তীকালে নিউইয়র্কে, যেখানে তিনি ১৯৩১ সালে মারা যান। দীর্ঘ অতীন্দ্রিয়বাদী কবিতা ‘প্রফেট’-এর রচয়িতা হিসেবে জিবরান কহলীল জিবরান মূলত বেশি পরিচিত। তিনি এমন একজন বিরল ব্যক্তিত্ব যিনি মাতৃভাষা ও ইংরেজি দুভাষাতেই লিখে খ্যাতি অর্জন করেছেন। যাহোক, অন্যান্য লেবানীয়দের মতো জিবরানও তাঁর জন্মস্থানের পাহাড়ি অঞ্চলের প্রতি আকর্ষণ অনুভব করতেন, যদিও তিনি জীবনের অধিক সময় কাটিয়েছেন আমেরিকায়। কিন্তু কখনই ভোলেননি যে, তিনি একজন লেবানীয়। তাঁর মাতৃভূমির সাংস্কৃতিক রীতিনীতি ও গ্রাম এলাকার দৃশ্য তাঁর অনেক ছবিতেই ফুটে উঠেছে, যেখানে আবেগ ও বুদ্ধিবৃত্তির ছোঁয়াও স্পষ্ট। পণ্ডিতেরা তাঁর রচনায় জার্মান দার্শনিক নিটশে, ফরাসি প্রতীকধর্মী কবিতা ও ইংরেজ কবি-চিত্রকর উইলিয়াম ব্লেকের প্রভাব লক্ষ্য করেছেন। এমনকি ছবি আঁকার ক্ষেত্রে তিনি অনুপ্রাণিত হয়েছেন ফরাসি ভাস্কর অগাস্টি রোডিন-এর দ্বারা। এ ছাড়াও প্রাচ্য ও লেবাননের গ্রাম এলাকার অতীন্দ্রিয়বাদী কবিরাও তাঁর চিন্তা-ভাবনাকে প্রভাবিত করেছে। তাঁর কবিতার বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ভৌগোলিক বিচরণের ক্ষেত্রে সময়হীনতা ও মরমী দার্শনিকের এক অবাস্তব জগৎ-এ যেন লেবাননের ভূদৃশ্য, পাহাড়, পাথর এবং বনভূমির ক্রমাগত দৃশ্য পরিবর্তন। জিবরানের কাছে তাঁর মাতৃভূমির কোনো অস্তিত্ব ছিল না, ছিল শুধুমাত্র ছবির মতো একটা ভাণ্ডার বিশেষ যা গ্রামীণ প্রতিমূর্তিতে আছন্ন, যা তিনি স্থানীয় রঙ মিশিয়ে লেখায় তুলে ধরতে পারতেন। সত্যি বলতে কি তাঁর ইন্দ্রিয় সাড়া দিত ‘মাউন্ট সান্নাই’-এর ওপরে চাঁদ ওঠা, সমুদ্র থেকে বিবলজের দৃশ্য, বরফে চিরহরিৎ বনভূমি ঢেকে যাওয়া ও ধাবমান মেষপালকের পাশে বসে থাকা মেষপালক দেখলে! এমনকি রুপার সুতোর মতো পাহাড়ি পথকে ক্ষতবিক্ষত করে এরকম দৃশ্যের বর্ণনাও তাঁর রচনায় লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু তাঁর মেধা উৎসাহিত হয়েছিল লেবাননের ঐতিহাসিক ও পৌরাণিক গাথা কাহিনীর দ্বারা। এছাড়া সাধারণভাবে তাঁকে আরও আকর্ষণ করেছিল সাদা পাথরের ফিনিসীয় মন্দির, আলবেক-এর উঁচুস্তম্ভ এবং ধর্মযুদ্ধে বিবলজ দুর্গের বিশাল ক্ষয়-ক্ষতি। জিবরান বর্ণনা করেছেন এভাবে : ‘লেবানন একটা পাহাড়ের নাম নয়, লেবানন হল কাব্যিকতার ব্যাখ্যা। আমেরিকার প্রযুক্তিগত সাফল্য দ্বারা প্রভাবিত হয়ে এবং অধিক সংখ্যক নাগরিকের। বস্তুগত সাফল্যের বিষয়ে সতর্ক থেকে জিবরান তাঁর অভিবাসিত গৃহকে নিজের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সুবিধাজনক দৃষ্টি থেকে গ্রহণ করেন। ফলশ্রুতিতে পাশ্চাত্যের বস্তুবাদের ভেতরে তিনি ধীরে ধীরে ঢেলে দিয়েছেন প্রাচ্যের অতীন্দ্রিয়বাদের তরল মিশ্রণ। জিবরান বিশ্বাস করতেন মানবতা হল শ্রেষ্ঠ সেবা এবং তা দুই সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্যই স্বীকার করে ও তা ডিঙিয়ে গিয়েও করা সম্ভব।
২
জিবরানের সাহিত্যজীবনকে দুই ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। প্রথম পর্যায় শুরু ১৯০৫ সাল থেকে, যখন তার প্রথম আরবি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। আরবিতে লেখালেখি চলে ১৯১৮ সাল পর্যন্ত। দ্বিতীয় পর্যায় শুরু হয় ১৯১৮ থেকে, যে তারিখে প্রথম তাঁর ইংরেজি গ্রন্থ প্রকাশিত হয় এবং এ পর্যায় ১৯৩১ সাল অর্থাৎ তার মৃত্যু পর্যন্ত চলে। প্রথম পর্যায়ে জিবরান শুধুমাত্র আরবিতে লিখতে থাকেন। ইংরেজিতে লেখালিখির পর্যায়ে তিনি আটটি গ্রন্থ লিখেছেন। দুটো গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে জিবরানের মৃত্যুর পর।
সাহিত্যজীবনের শুরুতে আরবিতে জিবরানের পাঁচটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। এগুলি হচ্ছে : আল মুসিকাহ (১৯০৫), আরাইজ আল মুরুজ (১৯০৬), আল আরওয়াহ আল মুতামাররিদাহ (১৯০৮) আল আজনিহাল মুতাকাসসিরা (১৯১২), ও দাম আহ ওয়া ইবতিছামাহ (১৯১৪)। দ্বিতীয় পর্যায়ে লেখালিখির সময় অর্থাৎ ১৯১৮ থেকে ১৯৩১ সালের ভেতরে তিনি আরও তিনখানা আরবি গ্রন্থ রচনা করেন। সেগুলি হচ্ছে : একটি অতীন্দ্রিয়বাদী কবিতা আল মাওয়াকিব (১৯১৯), বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত লেখার সংগ্রহ, যথাক্রমে আল আওয়াছিফ (১৯২০) এবং আলবাদাই ওয়াল তারাইফ (১৯২৩)।