- বইয়ের নামঃ সিংহশাবক
- লেখকের নামঃ এনায়েতুল্লাহ আলতামাশ
- প্রকাশনাঃ আল-এছহাক প্রকাশনী
- বিভাগসমূহঃ অনুবাদ বই, উপন্যাস
সিংহশাবক
১.১ প্রথম খণ্ড – ষড়যন্ত্র
সিংহশাবক / মূল : এনায়েতুল্লাহ আলতামাস / অনুবাদ : ফজলুদ্দীন শিবলী
ভূমিকা
বড়ই রোমাঞ্চকর সেই যুগ যে যুগে আজকের স্পেনে সবুজ চাঁদতারা নিশান উড়ত। সুন্দর, স্বপ্নীল ও বর্ণিল অনুভূতি নিয়ে কর্ডোভার মসজিদ কালের সাক্ষী হয়ে আজো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। আলহামরার পোড়া ইট, বালুকণা আজ তারিকী তলোয়ারের স্মৃতি-রোমন্থন করে। গোয়াদেলকুইভার, জিব্রাল্টার প্রণালী, যাল্লাকা প্রান্তর, আলমেরিয়ার যমীন বুকে ধারণ করে আছে বীর মুসলিম জাতির অশ্বখুরের ছোঁয়া।
স্পেনের ইতিহাসের ধূসর পাতা খুললে সর্বাগ্রে মনে পড়ে সেই মহান বিজেতাদের অমিততেজা হিম্মতি উপাখ্যান, উপকূলে নেমে যারা জ্বেলে দিয়েছিলেন স্বদেশে ফেরার রণতরীগুলো। অপরিচিত দেশ, অচেনা মানুষ এমন কি আসমান-যমীনও যাদের কাছে বৈরী সেই মর্দে মুমিনদের এই দুঃসাহসিকতা দেখে ইউরোপিয়ান ঐতিহাসিকদের কলম পর্যন্ত স্তব্ধ হয়ে যায়।
মুসলিম জাতির বিজয় কেবল স্পেন ভূ-ভাগেই থেমে থাকেনি-সীমানা পেরিয়ে তা প্যারিস পর্যন্তও বিস্তৃত হয়। কুলাঙ্গার উমাইয়া খলীফা সুলায়মান ইবনে আবদুল মালিক তারিক বিন যিয়াদ ও মূসা ইবনে নুসায়েরের অগ্রাভিযানের মাঝপথে বাদ না সাধলে হয়ত আজকের ইউরোপের মানচিত্র অন্যভাবে আঁকতে হত।
মোটকথা স্পেন সেদিন একটি শক্তিধর মুসলিম রাজ্যে পরিণত হয়েছিল। খোদাপাগল বিজেতাদের মৃত্যুর পর অবশ্য স্পেনের গদিতে এমন সব নীল ভ্রমরদের আবির্ভাব ঘটে যারা পূর্বসূরিদের রক্তমাখা উপাখ্যানগুলো গিলে খেতে থাকে। কেন্দ্রীয় খলীফার শাসনাধীন হয়েও এরা নিজেদের বাদশাহ ভাবতে শুরু করে। পতনের শুরুটা মূলত এখান থেকেই। পরবর্তী ইতিহাস আরো করুণ আরো বেদনাবিধুর।
খ্রিস্টানরা মুসলমানদের প্রজা ছিল। তাদের সব ধরনের নাগরিক সুবিধা ও ধর্মীয় স্বাধীনতা ছিল। ইসলাম গ্রহণের জন্য তাদের ওপর জবরদস্তি করা হয়নি কোনদিনও। এদের যারা ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নিয়েছে-তারা নিজ উদ্যোগেই ইসলামের মহানুভবতায় আকর্ষিত হয়েছিল। কিন্তু ধর্মান্ধ, প্রতিক্রিয়াশীল, প্রতিহিংসাপরায়ণ, মৌলবাদী, গোড়া খ্রীস্টানরা উগ্রবাদী মনোভাব নিয়ে স্পেন ও মুসলমানদেরকে স্পেন ছাড়া করতে আদা নুন খেয়ে ময়দানে নামে। এই শয়তানী লক্ষ্যে হেন কাজ নেই যা। তারা করেনি। এ জন্য তারা তাদের সুন্দরী মেয়েদেরকে আমীর-ওমরাদের প্রাসাদে পাঠিয়েছে। প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্তাদের শয্যাসঙ্গিনী হয়ে এরা ধোকা, ষড়যন্ত্র ও বিদ্রোহে অদৃষ্টপূর্ব ভূমিকা রেখেছে। এই কূলটা নারীরাই সেদিনের স্পেনে মুসলিম প্রশাসনের জন্য কালনাগিনী হয়ে দাঁড়িয়েছিল। দাগাবাজ বিদ্রোহী খ্রীষ্টানরা ফ্রান্সসহ ইউরোপের অন্যান্য শাসকবর্গ থেকে মদদ পেতো।
বিধর্মীরা মুসলিম স্পেনকে যতটা না ক্ষতি করেছে তার চেয়ে অধিক ক্ষতি করেছে বিলাসী নারীলোভী ও মদ্যপ রাজা-বাদশাহরা। বক্ষ্যমান বইয়ে আমি স্রেফ এমন এক আমীরের কাহিনী তুলে ধরতে চেষ্টা করেছি। আমার লেখার উপজীব্য হচ্ছে রাজধানী কর্ডোভর হেরেমে ঠাই পাওয়া চাটুকারদের ষড়যন্ত্র ও হেরেমের বাইরের এলোগেইছ ও জোরা কাহিনী। ৮ম খ্রীষ্টাব্দের স্পেনের আমীর ছিলেন দ্বিতীয় আঃ রহমান। ওই সময় কিছু সিংহশাবক গাঁটে গামছা বেঁধে নেমেছিলেন আন্তর্জার্তিক ও অভ্যন্তরীণ শত্রু থেকে স্পেনকে বাঁচাতে। এরা স্রেফ স্পেন নয় বাঁচিয়েছিলেন আঃ রহমানকেও।
আমাদের কাহিনীকাররা ফ্লোরাকে কোন না কোন মুসলিম শাসকের হেরেমের হীরা সাব্যস্ত করেছেন। তাকে নিয়ে রোমাঞ্চকর উপাখ্যান তৈরি হয়েছে। কিন্তু বাস্তব এর উল্টো। ফ্লোরা কোনদিনও মুসলিম হেরেমে কারো শয্যাসঙ্গিনী হয়নি।
সবশেষ কথা হলো এটি উপন্যাস, ইতিহাসনির্ভর। ঘটনা সত্য। কাল্পনিকতা স্রেফ সাহিত্যের উপস্থাপনে, মৌলিকতায় নয়। হায়! এ যুগের শাসকবর্গ ও আগামী দিনের শাসকবর্গ যদি এ থেকে সবক নিতেন।
.
প্রথম খণ্ড – ষড়যন্ত্র
৮২৫ খ্রিস্টাব্দের গোড়ার দিকের কথা। আজকের স্পেনে সেদিন মুসলিম শাসন ছিল। ওই সময় পর্তুগালও মুসলিম শাসনাধীনে ছিল। ওই সময়কার ফ্রান্সের সম্রাট ছিলেন সুই। একদিন তিনি রাজ দরবারে উপবিষ্ট। তার পাশেই গোথ মুর্চের রাজা ব্রেন হার্ট ও কর্ডোভার এলোগেইছ নামী প্রভাবশালী খ্রীস্টান। সারিবদ্ধ চেয়ারে উপবিষ্ট যথাক্রমে মন্ত্রী ও দু জেনারেল।
এলোগেইছ। সম্রাট লুই শাহী কণ্ঠে বলেন, স্পেনে সরকারীভাবে কোন পদমর্যাদা নেই জেনে সিদ্ধান্তহীনতায় পড়েছিলাম যে, তোমাকে সাক্ষাতের অনুমতি দেব কিনা। কিন্তু এক্ষণে বুঝলাম, তোমার মত লোকের সাক্ষ্য আমার কাছে খুবই জরুরী ও তাৎপর্যবহুল। আমার স্রেফ এটুকু নিশ্চিত হওয়া দরকার যে, তুমি মুসলিম গোয়েন্দা নও! আর তুমি আবেগপ্রবণ হয়ে আলাপ করতেও আসেনি। এক্ষণে প্রয়োজন কাজ ও শ্রমের; ত্যাগ-তিতিক্ষার মুহূর্তে আবেগ কোন কাজে আসেনা।
এলোগেইছ বলল, আমি মুসলিম নই-এ হয়ত মুখের ভাষা দিয়ে বোঝাতে পারব না। আপনার গোয়েন্দা যদি এতটা চৌকস ও সুনিপুণ হয় যতটা মুসলিম গোয়েন্দারা; তাহলে প্রস্তাবের উত্তর ত্যাগ-তিতিক্ষাক্ষণেই পেয়ে যাবেন।