ন্যান্সি বলল—লু, তোমার পছন্দ খুবই খারাপ। এরকম একটা কোমরবন্ধ কি করে পর ভেবে পাইনে!
চোখের তারায় ক্ষোভের ছাপ ফুটিয়ে তুলে লু। তার কথার উত্তর দিতে গিয়ে বলল— এ কোমরবন্ধটার কথা বলছ? ষোল ডলার দিয়ে কিনেছি। আসলে কম সে কম পাঁচশ ডলার তো দাম হবেই। এখানে এক মহিলা ইন্ত্রি করাতে দিয়ে গিয়ে আর নেয় নি। মালিক শেষ পর্যন্ত বিক্রি করে দিলেন। দেখতে পাচ্ছ, পুরো কোমরবন্ধটাই হাতে নক্সা করা। তোমার বিশ্রি কোমরবন্ধটার কথা ভাব তো একবারটি।
ভ্যান এলস্টাইন ফিশার-এর কোমরবন্ধটা দেখে আমি নিজে হাতে এটা তৈরী করে নিয়েছি। মেয়েদের বক্তব্য, এটা তৈরী করতে গুদাম থেকে বারশ ডলারের বিল পাঠানো হয়। আর মাত্র দেড় ডলার খরচ করে আমি নিজে হাতে আমারটা তৈরী করে নিয়েছি। ফুট দশেক দূর থেকে দেখলে চিনতে পারবে না। কোনটা তার আর কোনটা আমার।
কণ্ঠস্বরে স্বাভাবিকতা বজায় রেখে লু এবার বলল-ভাল কথা, পেটে কিল মেরে তুমি যদি বড়লোকি চাল দেখাতে চাও তবে আমার আর আপত্তির কি থাকতে পারে। আমার কথা যদি জানতে চাও তবে বলব, দিনভর কঠোর পরিশ্রম করে যা রোজগার করব তা দিয়ে নক্সা করা ঝলমলে পোশাকই ব্যবহার করব।
তাদের কথোপকথনের মাঝখানে ডান এসে হাজির হল। গভীর স্বভাবের যুবক। গলায় সাদামাঠা ধরনের একটা নেক-টাই। ইলেকট্রিক মিস্ট্রির কাজ করে। হাপ্তায় ত্রিশ ডলার রোজগার করে। লু-র দিকে রোমিও-র মত বিষন্ন দৃষ্টিতে তাকাল। সে ভাবল, লু-র কোমরবন্ধটা যেন একটা মাকড়সার জাল, যাতে জড়িয়ে পড়তে যেকোন পতঙ্গ উদ্রান্তের মত ছুটে আসবে।
লু আবেগ মধুর কণ্ঠে বলল—বন্ধু মিঃ ওয়েন্স, মিস ডানফোর্থ-এর সঙ্গে করমর্দন কর।
করমর্দনের জন্য হাতটা এগিয়ে দিয়ে ডান ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা ফুটিয়ে তুলে বলল-মিস ডানফোর্থ লুপ্রিায়ই আপনার কথা বলে। আজ পরিচয় হওয়ায় খুবই আনন্দ পেলাম।
ন্যান্সি তার সঙ্গে করমর্দন সারতে গিয়ে তার আঙুলের সঙ্গে নিজের আঙুলগুলি ছুঁইয়ে বলল—ধন্যবাদ! লু-এর মুখে আপনার কথাও বহুবার শুনেছি।
সশব্দে হেসে লু বলল—ন্যান্সি, একটা কথা, মিসেস ভ্যান এলস্টাইন ফিশার-এর সঙ্গেও তুমি এভাবেই করমর্দন কর কি?
ন্যান্সি গভীর স্বরে তার কথার উত্তর দিল-আমি যদি করিই তুমিও অনায়াসেই এমনটা করতে পার।
না, অবশ্যই না। এ হাত দিয়ে আমার পক্ষে তা করা সম্ভবই না। এমন ভঙ্গীতে করমর্দন করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। এমন বড়লোকিপনায় করমর্দন সারতে হলে আঙুলে হীরের আংটি থাকা দরকার। আগে সেরকম কটা আংটি জোগাড় করি, তারপর না হয় চেষ্টা করব।
কায়দাটা আগে রপ্ত করে নাও, তবেই আংটি জোটানোর ব্যাপারটা সহজ হয়ে উঠবে।
মুখের মুচকি হাসিটুকু অব্যাহত রেখেই ডান বলল, আমি মনে করি, আপনাদের উভযাকে টিফানির দোকানে নিয়ে গিয়ে তর্কাতর্কির ব্যাপারটার নিম্পত্তি করার ক্ষমতা আমার নেই। তার চেয়ে বরং একটা রঙ্গ-নাটিকা দেখে আসা যেতে পাবে। আমি টিকিট সংগ্রহ করে এনেছি। আসল হারের আংটি পরে করমর্দন সারা যখন সম্ভবই নয়। তখন রঙ্গমঞ্চের হীরের আংটি দেখে এলে হয় না।
লু তার হাতের মুঠোর ভদ্রলোকটির গায়ে প্রায় গা লাগিয়ে চকচকে পোশাকে সজ্জিতা হয়ে বনময়ুরীর মত ছোট ছোট পা ফেলে হাঁটছে সাদামাটা পোশাক পাবে ন্যান্সি পিছন পিছন হোটে নাট্যশালার দিকে এগিয়ে চলেছে।
বৃহদায়তন বিভাগীয় বিপনিকে কেউ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্বীকৃতি দিতে পারে বলে আমি বিশ্বাস করি না। তবে ন্যান্সির কর্মস্থলটা তার চোখে একটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেই তুলনীয়। সেখানকার দ্রব্যসামগ্ৰী রুচি শিল্পতা ও সংস্কৃতির পরিচয়ই বহন করে। বিলাসের পরিবেশে কেউ বাস করলে তাকে তো বিলাসী না হয়ে উপায় নেই। খরচাপাতির টাকা তুমি বা অন্য কেউ যে-ই দিক না কেন।
সে যেসব ক্রেতার কাছে দ্রব্যসামগ্ৰী বিক্রি করে তাদের বেশীর ভাগই মহিলা। তাদের পোশাক আশাক, ভাবভঙ্গী আর সামাজিক মর্যাদা সবই মানদণ্ড হিসেবে গণ্য হয়। ন্যান্সি যা কিছু শিখেছে সবই তাদের দেখে। মোদা কথা, প্রত্যেকের কাছ থেকে হাঁসের মত জলটুকু ফেলে রেখে দুধ টুকু, মানে ভাল শিক্ষাটা বেছে নিয়েছে। যার মধ্যে যেটুকু ভাল দেখেছে, সেটুকুই সে নিয়েছে। যার হাঁটা চলা, বন্ধুকে আপ্যায়ণ কবাবি ভঙ্গীটুকু পর্যন্ত। সামাজিক সদাচার আর সুরুচির পরিমণ্ডলে বাস করায় গভীরতর একটা পরিণতিকে পাশ কাটিয়ে যাওয়াও তার পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠে। সুঅভ্যাসকে সুনীতির চেয়েও শ্রেষ্ঠ জ্ঞান করা হয়। আর সৎ আচরণকে হয়ত বা সুনীতির চেয়েও শ্ৰেষ্ঠত্বের আসন দেওয়া হয়। বাবা-মার কাছ থেকে যে সুশিক্ষা তুমি লাভ করেছ তা হয়ত তোমার নতুন ইংল্যান্ডের বিবেককে টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হবে না। কিন্তু সোজা পিঠওয়ালা একটা চেয়ারে বসে যদি তুমি ত্ৰিশির কাঁচ আর তীর্থযাত্ৰা কথাটা চল্লিশবার মনে মনে বলতে পার তবে অতি বড় শয়তানও তোমার কাছ থেকে দূরে সরে যেতে পথ পাবে না। ঠিক তেমনি ন্যান্সিও যখন ভ্যান এলস্টাইন ফিশার-এর স্বর ও ভঙ্গী অনুকরণ করে কথা বলে তখন তার অস্থির চিত্তের ভেতর দিয়ে শিষ্টতার দায়বদ্ধতার শিহরণ জেগে ওঠে।
সে বিভাগীয় বিপনি থেকে শিক্ষালাভের আর একটি উৎস ছিল। যেখানেই দেখা যাবে তিনচারটে শপ-গার্ল একত্রিত হয়ে অর্থহীন আলোচনার সঙ্গে তাদের হাতের ব্রেসলেটের রিনিঝিমি আওয়াজ মিশিয়ে দিচ্ছে তখন যেন ভেবে বসবেন না যে এথেশ, কোন কায়দায় চুল বেঁধে তার সমালোচনা করতেই তারা সেখানে জড়ো হয়েছে। এসব আলোচনা থেকেই ন্যান্সি আত্মরক্ষার কৌশল রপ্ত করে নিয়েছিল। আর মেয়েদের ক্ষেত্রে আত্মরক্ষায় সাফল্য লাভ করার অর্থই হচ্ছে জয়ী হওয়া। ন্যান্সি-র ক্ষেত্রে একথা পুরোপুরি প্রযোজ্য।