চুপ কর! ধমকে উঠল বড় তরুণী। এসব কথা আর কারো সামনে বললে মরতে হবে। শোন, এ মুহূর্তে আমরা শেখ সিনানের দুর্গে, এটাই রূঢ় বাস্তবতা। শেখ সিনানকে দিয়ে আমাদের অনেক কাজ। তাকে কোন অবস্থাতেই নারাজ করা যাবে না, তাকে সন্তুষ্ট রাখতে হবে।
এই লোকটির প্রতি আমাদের ঘৃণা জন্মে গেছে। বলল ছোট তরুণী। এই লোকটি ভাড়াটে ঘাতক দলের নেতা। তাকে আমি আমার শরীরে হাত লাগানোর উপযুক্ত মনে করি না।
বড় তরুণী দীর্ঘ সময় বুঝালো ছোট তরুণীকে। অনেক কথা বলার পর ছোট তরুণীকে সিনানের কক্ষে রাত যাপনে সম্মত করলো বড় তরুণী। তাকে বলল, তুমি আমার ক্ষমতা দেখোনি। শেখ সিনানতো নস্যি, বড় বড় ক্ষমতাধর ব্যক্তিদেরকে আঙ্গুলের ফাঁকে নাচাই আমি। সেই তুলনায় শেখ সিনান কিছুই না। কিন্তু বর্তমানে আমাদের সামনে কঠিন সময়। এ মুহূর্তে শেখ সিনানকে আমাদের ব্যবহার করতে হবে। তাই তাকে ক্ষেপাতে চাই না আমরা। আমি তাকে তোমার লোভ দেখিয়েছি, সে কাতরভাবে অপেক্ষা করছে। লক্ষ্মী বোনটি, ওর সাথে তুমি একটু অভিনয় করে সহজেই পরাস্ত করতে পারবে।
তুমি কি এখান থেকে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে পারো না। বড় তরুণীকে বললো ছোট তরুণী।
হ্যাঁ, যথাশীঘ্রই বের হয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছি। তবে আমরা যে এখানে আছি, সবার আগে সেই খবরটি কর্তাদের জানাতে হবে।
ঠিক এমন সময় দুজন লোক তাদের কক্ষে প্রবেশ করল। তারা চার কয়েদী সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে বড় তরুণী তাদের জানাল, এরা কারা, কিভাবে এদেরকে তারা এখানে নিয়ে এসেছে।
ওরা এখন কি করছে? জিজ্ঞেস করল বড় তরুণী।
মাত্রই ঘুমিয়েছে। উত্তর দিল একজন।
এদেরকে কি কয়েদখানায় অন্তরীণ করা হবে? জিজ্ঞেস করল ছোট তরুণী।
কয়েদ খানায় বন্দী করার কোন দরকার নেই। জবাব দিল অপর এক আগন্তুক। এখান থেকে পালাবে কোথায়?
আমরা কি ওদের দেখতে পারি?
কেন পারবে না? তোমাদের শিকার তারা। তাদের কাছে তোমাদেরই তো যাওয়া দরকার। যাতে তোমাদের জালে তাদের আটকে রাখতে পার।
একটু পরে বড় তরুণীর বাধা সত্ত্বেও ছোট তরুণী নাসের যে কক্ষে ঘুমুচ্ছে সেখানে চলে গেল। নাসের ঘুমের ভান করে বিছানায় পড়ে ছিল, ছোট তরুণীকে দেখে সে উঠে বসে জিজ্ঞেস করল, কোথায় নিয়ে এসেছ আমাদের? বল না, তোমরা কে, কোত্থেকে এসেছো, আর আমাদের এখানে কেন নিয়ে এসেছো?
বিস্ময়ভরা দৃষ্টিতে নাসেরকে দেখল ছোট তরুণী। আবেগের সুপ্ত আগ্নেয়গিরি জ্বলে উঠল তরুণীর মধ্যে, সে কানে কানে নাসেরকে বলল, ফেরার হতে চাও?
আমি কি করব, সেকথা তোমাকে বলব না। যা করা দরকার তা আমি করেই দেখাবো।
নাসেরের ঘনিষ্ট হয়ে গেল তরুণী। ক্ষীণ আওয়াজে বলল, আমি জিন নই, মানুষ। আমাকে ভুল বুঝবে না। আমার উপর বিশ্বাস রাখো।
নাসের তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল তরুণীর দিকে। তরুণী লেপ্টে গেল নাসেরের সাথে।
* * *
৩. চোখে দেখা নিজের লাশ
নাসেরের মনের মধ্যে জিনের ভীতি ছিল প্রকট। অথচ টগবগে যৌবনের অধিকারী আইয়ূবীর স্পেশাল ফোর্সের এই কমান্ডার মৃত্যুর চোখে চোখ রেখে লড়াই করতে অভ্যস্ত। খৃস্টানরা আইয়ূবীর ঝটিকা বাহিনী সম্পর্কে বলতো, ওদের দেখে মৃত্যুও ভয় করে। মরুভূমির যাতনা, সাগরের কষ্ট এবং দীর্ঘ মরু যাত্রাকেও এরা পরওয়া করতো না। এরা অনায়াসে আগুনে ঝাঁপ দিতে পারতো। শত্রু বাহিনীর রসদে আগুন লাগিয়ে ওদের কেউ কেউ আগুনে জীবন্ত দগ্ধ হয়ে যেতেও পরোয়া করতো না কিন্তু জিন পরী সম্পর্কে এদের মধ্যে ছিল ভয়ানক ভীতি। ওরা সব সময় জিন-পরীর কাল্পনিক দানবীয় ত্রাসে-সন্ত্রস্থ থাকতো। অথচ কোন দিন তাদের কেউ জিন-পরী দেখেনি।
নাসের যদি জ্ঞাতসারে, স্বজ্ঞানে ঈসিয়াত দুর্গে নীত হতো তাহলে অতোটা ভয় পেতো না। বন্দী হয়ে এখানে নীত হলেও অতোটা ভয় হতো না তাদের। ফেরার হওয়ার বিষয় নিয়ে ভাবতো নির্ভিক চিত্তে। হাশীশ নেশা খাইয়ে অবচেতন করে, তাদের দেমাগে জিন-পরীর কল্পচিত্রের মায়াজাল সৃষ্টি করে ঈসিয়াত দুর্গ পর্যন্ত নিয়ে এসেছে তাদের। নেশার প্রভাব মুক্ত হলে সে বুঝতে পারলো মাইলের পর মাইল পর্যন্ত একই ধরনের মনোরম দৃশ্য থাকতে পারে না।
তরুণী নাসেরের গায়ের সাথে মিশে বসে যখন তাকে বলল, আমি জিন নই, তুমি আমার উপর বিশ্বাস রাখতে পার, এতে আরো ভড়কে গেল নাসের। তরুণী তার কাছে কল্পনার চেয়েও বেশী সুন্দরী। নাসের তাকে মানুষ ভাবতে পারছে না। সে জানতো, জিনরা মানুষকে ধোকা দেয়ার জন্য ছলনা করে থাকে। তার কাছে এই দুর্গটিকে মনে হলো জিন-পরীদের আবাস স্থল। তার সাথীরা তখনও গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। সে মনে সাহস সঞ্চয় করে বলল, তোমার উপরে কিসের ভিত্তিতে আস্থা রাখবো, আমাদের প্রতি কেন তুমি এতোটা দরদী হয়ে উঠলে? কোথায় আমাদের নিয়ে এসেছো তোমরা? কেন এখানে এনেছো, জায়গাটির নাম কি?
আমাকে বিশ্বাস না করলে তোমাদের ভাইদের রক্তে রঞ্জিত হবে তোমাদের হাত, আপন সহকর্মীকে খুন করে আত্মতুষ্টি লাভ করবে তোমরা। হ্যাঁ। আমি একথা বলতে পারবো না; কেন তোমাদের প্রতি এতোটা দয়াবান হয়ে উঠলাম আমি। এই জায়গার নাম ঈসিয়াত। আর এটা ফেদাঈদের দুর্গ। ফেদাঈ নেতা শেখ সিনান এই দুর্গের অধিপতি। ফেদাঈদের সম্পর্কে তোমার তো জানার কথা?