টারজান রচনা সমগ্র

অজেয় টারজন (টারজান দি ইনভিন্সিবল)

যে গল্পটা আমি বলতে যাচ্ছি সেটা যদি দুটি নির্দিষ্ট ইউরোপীয় রাষ্ট্রের সংবাদপত্রে প্রকাশিত হত তাহলে তার ফলে মহাযুদ্ধের চাইতেও ভয়ঙ্কর আর একটা যুদ্ধ বেধে যেতে পারত। কিন্তু তা নিয়ে আমার কোন রকম মাথা ব্যথা নেই। আমার কথা হচ্ছে, গল্পটা খুব ভাল আর এই কাহিনীর অনেকগুলো লোমহর্ষক অধ্যায়ের সঙ্গে অরণ্যরাজ টারজান খুবই ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত।

আফ্রিকার জঙ্গলে পাকাঁপোক্তভাবে গড়া একটা ছোটখাট শিবির। অনেক কালো মানুষ গোমাঙ্গানি অর্থাৎ নিগ্রো আর কিছু সাদা মানুষ অর্থাৎ টারমাঙ্গানি সেখানে বাস করে। তারা বেশ কিছুদিন এখানে আছে। মনে হচ্ছে আরও কিছুদিন থাকবে। সাধা মানুষদের জন্য চারটে তাবু আর আরবদের জন্য ‘ব্যেট’গুলো বেশ সুন্দরভাবে শৃঙ্খলার সঙ্গে সাজানো; তার পিছনে আছে স্থানীয় গাছ-গাছালি দিয়ে তৈরি নিগ্রোদের চালাঘর।

একটা ‘ব্যেট’ এর সামনে খোলা জায়গায় বসে জনাকয় বেদুইন তাদের প্রিয় কফি খাচ্ছে; আর একটা তাবুর সামনে গাছের ছায়ায় বসে চারজন সাদা মানুষ তাস খেলছে; চালাঘরে একদল দীর্ঘদেহী গালা যোদ্ধা মিংকালা’ খেলছে; অন্য জাতির কালা মানুষরাও সেখানে আছে পূর্ব আফ্রিকার ও মধ্য আফ্রিকার মানুষদের সঙ্গে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে কিছু পূর্ব উপকূলের নিগ্রো অধিবাসী। তাদের সঙ্গে এত বেশি রাইফেল আছে যে মনে হয় বুঝি তাদের প্রত্যেকের জন্যই একটা করে রাইফেল আছে।

একটা পাগড়ি-বাঁধা কালো পূর্ব-ভারতীয় মানুষ তাঁবুর সামনে পা ভেঙে বসেছিল। তার চোখে রয়েছে কিছু দূরের আর একটা তাঁবুর দিকে। একটু পরেই একটা মেয়ে যখন সেই তাঁবু থেকে বেরিয়ে এল, তখনই রঘুনাথ জাফল উঠে তার দিকে এগিয়ে গেল। মিষ্টি হেসে তাকে কি যেন বলল। মেয়েটি উত্তর দিল, কিন্তু হাসল না। তারপরই যারা তাস খেলছিল মেয়েটি তাদের দিকে এগিয়ে গেল।

একটি পরিষ্কার মুখ বড়সড় লোক বলে উঠল, হেলো জোরা! ভাল ঘুম হয়েছে তো?

মেয়েটি বলল, তাতো হয়েছে কমরেড; কিন্তু ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে যে বিরক্তি ধরে গেল। এভাবে অকর্মার মত তো আর বসে থাকা যায় না।

যা বলেছ। আমরাও সেই দশা।

রঘুনাথ জাফর শুধাল, কমান্ডার জাভেরি মার্কিনী লোকটির জন্য তুমি আর কতদিন অপেক্ষা করবে?

বড় কর্তাটি কাঁধে ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, তাকে আমার দরকার। বংশজাত ধনী মার্কিনীটিকে আমাদের কাজের জন্য সক্রিয়ভাবে যুক্ত রাখার নৈতিক সুবিধার কথা চিন্তা করেই তার জন্য অপেক্ষা করাটা যুক্তিযুক্ত বলে মনে করছি।

মেক্সিকোবাসী কৃষ্ণকায় যুবক রোমেরো বলল, এই লোকগুলো সম্পর্কে আমি কিন্তু সর্বদাই সন্দিহান। পুঁজিবাদই তাদের একমাত্র ভরসা। মনে-প্রাণে তারা সর্বহারাদের ঘৃণা করে, ঠিক যেমন আমরা তাদের ঘৃণা করি।

জাভেরি তবু বলল, এ লোকটি একটু স্বতন্ত্র মিগুয়েল। সে পুরোপুরিভাবেই আমাদের দলে এসে গেছে।

যে লোকটি এখনও জমায়েতে হাজির হয়নি তার সম্পর্কে এইসব কথা শুনে জোরা ড্রিনের ঠোঁট ঈষৎ ঘৃণায় বেঁকে গেল।

বেলা গড়িয়ে এল।

আর একটা দলের আগে আগে হাঁটতে হাঁটতে একটি যুবক মাথাটা খাড়া করে কান পাতল। বলল, এত দূরে তো নয় টনি।

না স্যার, আরও অনেক কাছে, ফিলিপিনোটি উত্তর দিল।

যুবকটি বকুনির সুরে বলল, অন্য সকলের সঙ্গে দেখা হবার আগেই ওই ‘স্যার কথাটা তোমাকে ছাটাই করতে হবে টনি।

ফিলিপিনোটি মুচকি হেসে বলল, ঠিক আছে কমরেড। সকলকেই আমি স্যার’ বলি তো, তাই ওটা পাল্টানো একটু শক্ত।

তাহলে তো তুমি খুব সাচ্চা লাল হতে পারনি টনি।

ফিলিপিনোটি এবার জোর গলায় বলল, আমি নিশ্চয় সাচ্চা লাল। না হলে এখানে এসেছি কেন? তুমি কি মনে কর সিংহ, পিঁপড়ে, সাপ, মাছি ও মশায় ভর্তি এই নিষিদ্ধ দেশে আমি বেড়াতে এসেছি? না, আমি এসেছি ফিলিপিনের স্বাধীনতার জন্য জীবন দিতে।

অপরজন গম্ভীর গলায় বলল, কিন্তু তুমি এখানে আসায় ফিলিপিনের মানুষ স্বাধীন হবে কেমন করে?

এন্টনিও মোরি মাথা চুলকে বলল, তা জানি না; তবে এর ফলে আমেরিকার বিপদ হবে।

নতুন দিন দেখা দেবার সঙ্গে সঙ্গে শিবিরবাসীদের মধ্যেও দেখা দিল নতুন কর্মব্যস্ততা। একটা ফোল্ডিং ক্যাম্প-টেবিলে বসে জাভেরি সহকারীদের নির্দেশ দিচ্ছে; জোরা ও রঘুনাথ জাফরের সাহায্যে সারিবদ্ধ সশস্ত্র মানুষগুলোর হাতে গুলি-গোলা তুলে দিচ্ছে। শেখ আবু বতন তার রোদে-পোড়া সৈনিকদের নিয়ে দূরে বসে আছে।

জোরা বলল, শিবির পাহারা দেবার জন্য কতজনকে রেখে যাচ্ছ।

জাভেরি জবাব দিল, তুমি ও কমরেড জাফর এখানেই থেকে যাবে। শিবিরের রক্ষী হিসেবে তোমরা ছেলেরা থাকবে; তাছাড়া দশজন আস্কারিও এখানে থেকে যাবে।

মেয়েটি বলল, তাই যথেষ্ট। এখানে কোন বিপদ নেই।

জাভেরি বলল, না। এখন নেই, তবে সেই টারজান এসে পড়লে ব্যাপারটা অন্য রকম দাঁড়াবে। তবে আমি শুনেছি সে নাকি অনেক দিন এ দেশে নেই। আকাশ পথে কি একটা অভিযানে বেরিয়েছে। সেই। থেকে তার কোন খবর নেই। প্রায় নিশ্চিত যে সে মারাই গেছে।

শেষ কালো মানুষটির হাতে গুলি-গোলা পৌঁছে দেয়া হয়ে গেলে কিটেম্বো তার স্বজাতীয়দের কিছুটা দূরে সরিয়ে নিয়ে গিয়ে নিচু গলায় কি যেন বোঝাতে লাগল। তারা সকলেই বাসোম্বা; তাই তাদের সর্দার কিটেম্বো তাদের ভাষাতেই কথা বলছে।

কিটেম্বো সব সাদা মানুষকেই ঘৃণা করে। স্মরণাতীতকাল থেকে ব্রিটিশরা এসে তাদের দেশকে অধিকার করেছে।

কিটেম্বো সর্দার অসভ্য, নিষ্ঠুর, বিশ্বাস হন্তা; তার কাছে সব সাদা মানুষই অভিশাপস্বরূপ। তবু জাভেরির সঙ্গে যোগাযোগটাকে সে ব্রিটিশদের উপর প্রতিশোধ নেবার একটা সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করেছে। তাই সে তার স্বজাতিদের অনেককে এনে জাভেরির অভিযানে নাম লিখিয়েছে, কারণ জাভেরি। তাকে কথা দিয়েছে ব্রিটিশদের চিরদিনের মত এখান থেকে তাড়িয়ে দেবে এবং আবার কিটেম্বোকে সগৌরবে তার আসনে বসাবে।

আজকের এই মনোরম সকালে এমনি একটি দলই যাত্রা করেছে রহস্যময় ওপার-এর রত্ন- ভাণ্ডার লুট করার আশায়।

জোরা ড্রিনভ তাদের যাত্রার পথের দিকেই তাকিয়ে আছে। যতক্ষণ দেখা গেল ততক্ষণ জোরার দুটি সুন্দর চোখের তারা স্থিরনিবদ্ধ হয়ে রইল পিটার জাভেরির উপর। ধীরে ধীরে নদীর পথটা ধরে চলতে চলতে সে অন্ধকার বনের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল।

জাভেরি দলবল নিয়ে চলেছে ওপার-এর পথে। ষড়যন্ত্রকারীদের মূল দলটার সঙ্গে তাড়াতাড়ি মিলিত হবার আশায় ওয়েনি কোল্ট তার লোকজনদের তাড়া দিচ্ছে দ্রুততর গতিতে অগ্রসর হতে। পাছে অধিক সংখ্যায় এক সঙ্গে আফ্রিকায় ঢুকলে সকলের মনোযোগ তাদের প্রতি আকৃষ্ট হয় তাই প্রধান ষড়যন্ত্রকারীরা। ভিন্ন ভিন্ন পথে আফ্রিকায় ঢুকেছে। কোল্ট নেমেছে পশ্চিম উপকূলে। সেখান থেকে কিছুটা পথ ট্রেনে গিয়ে তারপর চলেছে পব্রজে। স্বভাবতই অন্য প্রধান ষড়যন্ত্রকারীদের সঙ্গে মিলিত হতে সে খুবই ইচ্ছুক হয়ে পড়েছে। কারণ একমাত্র পিটার জাভেরি ছাড়া আর কারও সঙ্গে তার পরিচয় নেই।

ইউরোপের শান্তিকে বিঘ্নিত করা এবং উত্তর-পূর্ব আফ্রিকার একটা বিস্তীর্ণ অঞ্চলের উপর আধিপত্য বিস্তার করাই যাদের লক্ষ্য সে রকম একটি অভিযাত্রী দলের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করার মধ্যে যে প্রচণ্ড বিপদের ঝুঁকি আছে মার্কিন যুবকটি তা ভাল করেই জানে। তবু যৌবনের উৎসাহ দমিয়ে রাখতে পারেনি।

উপকূল থেকে একঘেয়ে দীর্ঘ যাত্রাপথে তার একমাত্র সঙ্গী ছেলে মানুষ টনি। ফিলিপিনের স্বাধীনতা সম্পর্কে তার ধারণা খুবই অস্পষ্ট। অর্থনৈতিক বিপ্লবের ফলে একদিন না একদিন ফোর্ড বা রকফেলারের সম্পত্তির অংশীদার হয়ে সেও ভাল ভাল পোশাকপত্র কিনতে পারবে এই স্বপ্নেই সে বিভোর।

কোল্টরা চলেছে তো চলেছে। তারা কিন্তু ঘুণাক্ষরেও জানতে পারে নি যে তাদের মাথার উপরকার বৃক্ষ-পথে চলেছে এক অরণ্য-দেবতা এপোলো, আর তার কাঁধে বসে অবিরাম কিচিরমিচির করছে একটা ছোট বানর। গাছের উপর দিয়ে চলতে চলতে হঠাৎ-ই এই সাদা মানুষটি টারজনের চোখে পড়ে যায়। তখনই তার মনে হয়, যে নবাগত মানুষদের মূল শিবিরের খোঁজে সে চলেছে এই যুবকটিও হয়তো সেই দিকেই যাচ্ছে; আর তাই ধৈর্যের সঙ্গে সে এই যুবকটিকে অনুসরণ করে চলেছে।

ওদিকে রঘুনাথ জাফর চলেছে জোরা ড্রিনভের তাঁবুর দিকে। মেয়েটি খাটিয়ায় শুয়ে বই পড়ছিল। জাফর দরজায় দাঁড়াতেই তার ছায়া পড়ল বইটার উপর। মেয়েটি চোখ তুলে তাকাল।

হিন্দুটির ঠোঁটে খোসামোদের হাসি। বলল, দেখতে এলাম তোমার মাথার ব্যথাটা কেমন আছে।

মেয়েটি ঠাণ্ডা গলায় বলল, ধন্যবাদ। কিন্তু কেউ আমার বিশ্রামের ব্যাঘাত না ঘটালেই আমি তাড়াতাড়ি ভাল হয়ে যাব।

তবু জাফর ভিতরে ঢুকে একটা চেয়ারে বসল। বলল, সকলেই চলে যাওয়ায় বড় একা-একা লাগছে।

না। আমি একাই ভাল আছি। বিশ্রাম নিচ্ছি।

জাফর বলল, তোমার মাথা ব্যথাটা বড় তাড়াতাড়ি চাড়া দিয়ে উঠল। একটু আগেও তো তোমাকে বেশ তাজা ও হাসিখুশি দেখেছিলাম।

মেয়েটি কোন জবাব দিল না।

সম্ভবত তার মনের কথাটা আঁচ করেই রঘুনাথ জাফর বলল, ওয়ামালা আস্কারিদের সঙ্গে শিকারে গেছে।

আমি তো তাকে অনুমতি দেইনি, জোরা বলল।

অনুমতিটা আমিই দিয়েছি, জাফর বলল।

খাটিয়ায় উঠে বসে মেয়েটি সক্রোধে বলল, সে অধিকার তোমার নেই। তুমি বড় বেশি দূর এগিয়েছ। কমরেড জাফর।

হিন্দুটি সান্ত্বনার ভঙ্গীতে বলল, একটু অপেক্ষা কর লক্ষ্মীটি। ঝগড়া করো না। তুমি তো জান আমি তোমাকে ভালবাসি, আর ভিড়ের মধ্যে ভালবাসা জমে না।

মেয়েটি বলল, বটে, এতদূর! জাভেরি ফিরে আসুক, তারপর এর ফয়সালা হবে।

হিন্দুটি সাগ্রহে বলল, জাভেরি ফিরে আসার অনেক আগেই আমি তোমাকে শিখিয়ে দেব কেমন করে আমাকে ভালবাসতে হয়। বলেই সে পা বাড়াল। মেয়েটিও লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল। আত্মরক্ষার জন্য অস্ত্রের খোঁজে চারদিকে তাকাল।

হিন্দুটি বলল, তুমি সম্পূর্ণ নিরস্ত্র। তাঁবুতে ঢুকেই আমি সব কিছু দেখে নিয়েছি।

তুমি একটা পশু, জোরা বলল।

কেন এত অবুঝ হচ্ছ জোরা? ভেবে দেখ

বেরিয়ে যাও! মেয়েটি আদেশ করল।

কিন্তু রঘুনাথ জাফর দ্রুত এগিয়ে গিয়ে মেয়েটিকে জড়িয়ে ধরল।

ওয়েনি কোল্টের গাইড কিছুটা আগে আগেই চলছিল। হঠাৎ থেমে মুখটা হাসিতে ভরিয়ে সে পিছন ফিরে তাকাল। সামনে আঙুল বাড়িয়ে বিজয়গর্বে বলল, ঐ শিবির বাওয়ানা!

সেই রকমই দেখাচ্ছে। কোল্ট ঘাড় নাড়ল। চারদিকে ঘুরে একটু দেখাই যাক। টনিকে সঙ্গে নিয়ে কোল্ট তাঁবুগুলো পরীক্ষা করে দেখতে লাগল।

সঙ্গে সঙ্গে তার নজরে পড়ল, একটা তাঁবুর মধ্যে ধস্তাধস্তি চলছে।

তাঁবুর ভিতরকার কাণ্ড দেখে কোল্ট তো একেবারে হা–দুটি নর-নারী মেঝেতে পড়ে ধস্তাধস্তি করছে; পুরুষটি মেয়েটির গলা টিপে ধরেছে, আর মেয়েটি প্রাণপণে পুরুষটির মুখে কিল-গুতো মারছে।

কোল্ট জাফরের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে এক ঝটকায় তাকে এক পাশে ঠেলে ফেলে দিল। রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে জাফরও এক লাফে উঠে দাঁড়িয়ে মার্কিন যুবকটিকে আক্রমণ করতেই সে তাকে এমন এক ঘুষি চালাল যে জাফরের মাথাটা ঘুরে গেল। আবার আক্রমণ করতেই আর এক ঘুষি পড়ল তার মুখে। এবার জাফর মাটিতে পড়ে গেল। কোন রকমে উঠে দাঁড়াতেই কোল্ট তাকে সজোরে চেপে ধরে একপাক ঘুরিয়ে পাছায় লাথি মেরে তাবুর দরজা দিয়ে বাইরে ঠেলে দিল। ফিলিপিনো সঙ্গীকে বলল, ও যদি আবার তাঁবুতে ঢুকতে চেষ্টা করে তো গুলি করবে টনি। তারপর মেয়েটিকে তুলে নিয়ে খাটিয়ায় শুইয়ে দিয়ে কোল্ট বালতি থেকে জল এনে জোরার কপাল, গলা ও কব্জি ভাল করে মুছে দিল।

বাইরের গাছের ছায়ায় কুলি ও আস্কারিদের শুয়ে থাকতে দেখে রঘুনাথ জাফর গুটি গুটি নিজের তাঁবুর দিকে সরে পড়ল। তার বুকের মধ্যে ক্রোধ ও খুনের নেশা টগবগ করে ফুটছে।

জোরা ড্রিনভ চোখ মেলে তাকাল। তার মুখের উপর ঝুঁকে দাঁড়িয়ে আছে ওয়েনি কোল্ট।

কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে জোরা ড্রিনভ বলল, নিশ্চয় তুমিই সেই মার্কিন যুবক।

কোল্ট জবাব দিল, আমি ওয়েনি কোল্ট। আর তুমি আমাকে চিনতে পেরেছ বলেই অনুমান করছি যে এটা কমরেড জাভেরির শিবির।

মেয়েটি মাথা নাড়ল। তুমি ঠিক সময়েই এসে পড়েছিলে কমরেড।

সেজন্য ঈশ্বরকে ধন্যবাদ।

একটু পরে কোল্ট শুধাল, কমরেড জাভেরি কি শিবিরে নেই?

না; সে একটা ছোট অভিযানে বেরিয়েছে।

কোল্ট হেসে বলল, তাহলে তো আমাদের দু’জনকে পরিচয় করিয়ে দেবার মত কেউ এখানে নেই।

জোরা বলল, আমি ক্ষমা চাইছি। আমার নাম জোরা ড্রিনভ।

আর ও লোকটা কে?

রঘুনাথ জাফর, একজন হিন্দু।

ও কি আমাদের লোক?

হা; কিন্তু আর থাকবে না- পিটার জাভেরি ফিরে আসার পরে তো নয়ই।

তার মানে?

মানে পিটার ওকে খুন করবে।

কোল্ট কাঁধ ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, সেটাই ওর প্রাপ্য। হয়তো সে প্রাপ্যটা আমারই মিটিয়ে দেয়া উচিত ছিল।

মার্কিন যুবকটি তাঁবু থেকে বেরিয়ে গেল। চোখ দুটো অর্ধেক বুজে জোরা খাটিয়াতেই শুয়ে রইল।

গাছের উপর বসে টারজান সবই লক্ষ্য করছে। অপরিচিত যুবকটি ব্যক্তিত্বপূর্ণ আচরণ তার মনকে টেনেছে। ওদিকে রঘুনাথ জাফর যে একটা রাইফেল হাতে নিয়ে তাঁবু থেকে বেরিয়ে গেল সেটাও তার দৃষ্টি এড়ায়নি।

তাঁবু থেকে বেরিয়ে জাফর সোজা জঙ্গলে ঢুকে পড়ল। টারজানও গাছের উপর দিয়ে তার পিছু নিল। জঙ্গলের আড়ালে আড়ালে শিবিরের অর্ধেকটা ঘুরে জাফর থেমে গেল। সেখান থেকে গোটা শিবিরটাই সে অস্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে, কিন্তু পাতার আড়ালের জন্য তাকে কেউ দেখতে পাচ্ছে না।

কোল্ট লোকজনের কাজকর্মের তদারক করছে। পথশ্রমে ক্লান্ত লোকগুলো চুপচাপ কাজ করে চলেছে। চারদিকে শান্ত নিস্তব্ধতা। হঠাৎ একটা আর্ত চীৎকার ও রাইফেলের গুলির শব্দ শুনে সে স্তব্ধতা খান্ খান্ হয়ে গেল। একটা বুলেট কোল্টের মাথার পাশ দিয়ে শাঁ করে বেরিয়ে গিয়ে পিছনে দাঁড়ানো লোকটির কানের নতি ছিঁড়ে দিয়ে চলে গেল। সঙ্গে সঙ্গে হৈ-চৈ পড়ে গেল। কোন দিক থেকে গুলিটা এসেছে খুঁজতে গিয়েই কোল্টের চোখে পড়ল জঙ্গলের ভিতর থেকে এক ঝলক ধোঁয়া উঠছে।

ঐ তো ওখানে, বলে কোল্ট সেদিকেই ছুটে যাচ্ছিল, হঠাৎ থেমে আস্কারিদের সর্দারকে বলল, কিছু লোক সঙ্গে নিয়ে তুমি ডান দিক থেকে এগিয়ে যাও, আর বাকিদের নিয়ে এগোচ্ছি বাঁদিক থেকে।

ঠিক আছে বাওয়ানা, বলে সর্দার কিছু লোক নিয়ে এগিয়ে গেল।

কোল্টই প্রথম দেখতে পেল-শিবিরের কাছাকাছি পড়ে আছে রঘুনাথ জাফরের মৃতদেহ। তার ডান হাতে রাইফেলটা ধরাই আছে, বুকের উপর থেকে বেরিয়ে আছে একটা তীরের কাঠি।

হিন্দুটিকে কবর দেবার নির্দেশ দিয়ে ওয়েনি কোল্ট লোকজন নিয়ে তাঁবুতে ফিরে এল।

জোরা ড্রিনভ তার তাঁবুর দরজাতেই দাঁড়িয়ে ছিল। জিজ্ঞাসা করল, ব্যাপার কি? কি হয়েছে?

রঘুনাথ জাফর খুন হয়েছে।

সব বিবরণ শুনে জোরা বলল, তাহলে তীরটা কে ছুঁড়ল?

কোল্ট বলল, আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। সবই যেন রহস্যে ঢাকা।

খাবার টেবিলে বসে কোল্ট বলল, আজ তোমার উপর দিয়ে একটা ঝড় বয়ে গেছে, অথচ তোমার তো কোনরকম ভাবান্তর দেখছি না।

জীবনে এ রকম অনেক ঝড় আমি কাটিয়ে এসেছি কমরেড কোল্ট, কাজেই আমার মধ্যে এখন স্নায়ু বলতে কিছু নেই।

কোল্ট এক দৃষ্টিতে তার দিকেই তাকিয়ে ছিল। বলল, তোমাকে দেখে মনে হয় জন্মসূত্রে তুমি প্রোলেতারিয়েত নও।

আমার বাবা ছিল শ্রমিক। জারের আমলে নির্বাসনে থাকতেই তার মৃত্যু হয়। তাই তো যা কিছু রাজকীয়, যা কিছু পুঁজিবাদ সংক্রান্ত সে সবেতেই আমার এত ঘৃণা। তাই তো কমরেড জাভেরির দলে যোগ দেবার প্রস্তাব যখন এল তখন প্রতিশোধ নেয়ার আর একটা ক্ষেত্র আমি খুঁজে পেলাম।

কোল্ট বলল, যুক্তরাষ্ট্রে জাভেরির সঙ্গে যখন আমার সর্বশেষ দেখা হয় তখন তার মাথায় এখনকার মত কোন পরিকল্পনা নিশ্চয় ছিল না, কারণ এ ধরনের কোন অভিযানের কথা সে তখন আমাকে বলেনি। এখানে এসে তার সঙ্গে যোগ দেবার নির্দেশ যখন পেলাম তখনও বিস্তারিত বিবরণ কিছুই আমাকে জানানো হয়নি। কাজেই তার উদ্দেশ্য সম্পর্কে আমি এখন সম্পূর্ণ অন্ধকারেই আছি।

জোরা এবার বলল, অবশ্য মোটামুটি পরিকল্পনাটা আমাদের কারো কাছেই গোপনীয় কিছু নয়। মূল পরিকল্পনাটা হচ্ছে, পুঁজিবাদী শক্তিগুলোকে এমনভাবে যুদ্ধ ও বিপ্লবের মুখে ঠেলে দিতে হবে যাতে তারা আমাদের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ হতে না পারে। আমাদের প্রেরিত প্রতিনিধিরা দীর্ঘকাল ধরে ভারতবর্ষের বিপ্লবকে এমন একটা পর্যায়ে নিয়ে যেতে চেষ্টা করছে যাতে গ্রেট ব্রিটেনের মনোযোগ ও সামরিক শক্তি সেই দিকে আকৃষ্ট হতে বাধ্য হয়। কিন্তু ফিলিপিনে আমাদের ভবিষ্যৎ খুব উজ্জ্বল। চীনের অবস্থা তো তুমি ভালই জান। আমরা আশা করি, আমাদের সহায়তায় অচিরেই তারা জাপানের পক্ষে বিপদের কারণ হয়ে উঠবে। ইতালি একটি সাংঘাতিক শত্রু, আর প্রধানত সে দেশকে ফ্রান্সের সঙ্গে একটা যুদ্ধে জড়িয়ে ফেলতেই আমরা এখানে এসেছি।

কোল্ট তবু প্রশ্ন করল, কিন্তু আফ্রিকার জঙ্গলে অভিযান চালিয়ে জাভেরি ইতালি ও ফ্রান্সের মধ্যে যুদ্ধ লাগাবে কেমন করে?

এই মুহূর্তে ফরাসী ও ইতালীয় কমরেডদের একটি প্রতিনিধিদল রোমে রয়েছে ঠিক এই কাজেরই জন্যে। ফরাসী সেনাবাহিনী কর্তৃক ইতালীয় সোমালিল্যান্ড অভিযানের পরিকল্পনা সমন্বিত কাগজপত্র তাদের সঙ্গে দেয়া হয়েছে।

যথাসময়ে কমরেড জাভেরির রোমস্থ জনৈক গুপ্ত সদস্য ফ্যাসিস্ট সরকারকে এই ষড়যন্ত্রের কথাটা। জানিয়ে দেবে; আর প্রায় সেই একই সময়ে আমাদের অভিযানের কিছু সাদা মানুষ ফরাসী সামরিক অফিসারের ইউনিফর্ম গায়ে চড়িয়ে আমাদেরই কালো মানুষদের ফরাসী স্থানীয় সৈনিক সাজিয়ে ইতালীয় সোমালিল্যান্ড আক্রমণ করবে।

কোল্ট সোসাহে বলে উঠল, পরিকল্পনাটি যেমন দুঃসাহসিক তেমনি বিরাট, কিন্তু এ রকম একটা পরিকল্পনাকে সফল করতে তো প্রচুর অর্থ ও জনবলের প্রয়োজন।

মেয়েটি বলল, আমি অবশ্য সব কথা জানি না, তবে এটুকু জানি যে প্রাথমিক পর্যায়ের কাজের জন্য এই যথেষ্ট অর্থ সে ইতোমধ্যেই সগ্রহ করতে পেরেছে; আর বাকি অর্থের জন্য এই অঞ্চল থেকে পাওয়া সোনার উপরেই সে নির্ভর করছে।

মাথার উপরে গাছের ডালের উপর টান-টান হয়ে শুয়ে টারজান কান খাড়া করে সবকিছুই শুনছে।

কোল্ট আবার বলল, আচ্ছা, কথাটা যদি খুবই গোপনীয় না হয় তাহলে বলতো এত বেশি পরিমাণ। সোনা কমরেড জাভেরি কোথায় পাবে বলে আশা করছে।

ওপার-এর বিখ্যাত রত্ন-ভাণ্ডারে। আশা করি তার কথা তুমিও শুনেছ।

তা শুনেছি, কিন্তু তাকে নিছক উপকথা ছাড়া আর কিছুই ভাবিনি। এ ধরনের রত্ন-ভাণ্ডারের কথা সারা বিশ্বের গ্রাম্য কাহিনীতে অনেক শোনা যায়।

কিন্তু ওপার উপকথা নয়।

মাথার উপরে টারজান নিঃশব্দে সেখান থেকে সরে গেল। যাবার আগে নকিমাকে কাঁধ থেকে নামিয়ে দিল।

কোল্ট ও জোরার কথাবার্তা বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে ঘুরতে লাগল। এক সময় টারজান আবার সেখানে ফিরে এল। এবার কিন্তু সে একা নয়।

জোরা বলল, জাফরকে কে যে মেরেছে তা হয়তো আমরা কোনদিনই জানতে পারব না।

তার কথা শেষ হবার আগেই তাদের মাথার উপরকার গাছের ডালে একটা সর-সর শব্দ হল, আর তারপরেই একটা ভারী দেহ ছিটকে পড়ল দু’জনের মাঝখানের টেবিলের উপরে। টেবিলটা ভেঙে চৌচির হয়ে গেল।

দু’জনেই লাফিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। কোল্ট চকিতে রিভলবারটা বের করল, আর জোরা পিছনে সরে গিয়ে উদগত চীৎকারটাকে চেপে দিল। কোল্টের মাথার চুল খাড়া হয়ে উঠল। তাদের দুজনের মাঝখানে চিৎ হয়ে পড়ে আছে রঘুনাথ জাফরের মৃতদেহ; মৃত চোখ দুটি তাকিয়ে আছে রাতের অন্ধকারের দিকে।

টারজান ও নকিমা পাহাড়ের চূড়াকে অতিক্রম করে নির্জন উপত্যকার পথে এগিয়ে চলেছে তাদের সামনেই দেখা যাচ্ছে প্রাচীন ওপার-এর দীর্ঘ প্রাচীর, সুউচ্চ গৃহশীর্ষ ও গম্বুজের সারি। আফ্রিকার উজ্জ্বল সূর্যকিরণে শহরের লাল ও সোনালী গম্বুজ ও মিনারগুলো ঝকঝক করছে।

টারজান ইতঃপূর্বেও আর একবার ওপারে এসেছিল। সেবারে প্রধান পুরোহিত কাড়জিকে পরাস্ত করে সে লা-কে তার প্রিয় প্রজাদের সিংহাসনে প্রতিষ্ঠা করে গিয়েছিল। সেবারে ওপার-এর মানুষদের বন্ধুত্বের স্মৃতি নিয়েই সে ফিরে গিয়েছিল। তারপর বেশ কিছু বছর ধরে লা-কে সে বান্ধবী বলেই জানে। সেখানে বন্ধুর সমাদর পাবার আশা নিয়েই সে ওপার-এর পথে চলেছে।

কাজেই নির্ভয়ে ও নিঃশংকচিত্তে সে ওপারের নিরেট পাথরের বহিঃপ্রাচীরের ফাটলের ভিতর দিয়ে ঢুকে কয়েক ধাপ সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে গেল। সেখানে খানিকটা ভোলা জায়গার ওপারে আরও একটা সংকীর্ণ পথ পার হয়ে সে একটা প্রশস্ত রাজপথে গিয়ে পড়ল। তার বিপরীত দিকেই দাঁড়িয়ে আছে ওপার এর বিরাট মন্দিরের ধ্বংসস্তূপ।

নিঃশব্দে সে মন্দিরের দরজা পার হয়ে গেল। দুই পাশে সারি সারি স্তম্ভ দাঁড়িয়ে আছে। স্তম্ভের গায়ে নানা কিন্তু দর্শন পাখির মূর্তি খোদাই করা।

টারজান নির্ভয়ে দরজা ঠেলে ভিতরে পা রাখল। সঙ্গে সঙ্গে একটা পাকানো গদা সজোরে তার মাথায় এসে পড়ল। টারজান অজ্ঞান হয়ে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ল।

জটা-বাঁধা চুল-দাড়িওয়ালা জনবিশেক লোক তাকে ঘিরে ফেলল। ছোট ছোট বাঁকানো পায়ে তারা এগিয়ে এল। তাদের পাট-করা দাড়ি লোমশ বুক পর্যন্ত নেমে এসেছে। দুর্বোধ্য ভাষায় কলরব করতে করতে তারা শক্ত বেড়ি দিয়ে টারজনের হাত-পা বেঁধে ফেলল। তারপর তাকে তুলে নিয়ে আর একটা বড় ঘরে ঢুকল। মেঝেতে কয়েক ফুট উঁচু বেদীর উপরকার মস্ত বড় সিংহাসনে বসে আছে একটি যুবতী নারী।

তার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল জট-বাঁধা চুল-দাড়িওয়ালা আর একটি লোক। তার হাতে-পায়ে সোনার তাগা বাঁধা, গলায় সাতনরী হার। নিচে মেঝের উপর অনেক নর-নারীর জটলা-তারা ওপার-এর অগ্নি দেবতার সন্ন্যাসী ও সন্ন্যাসিনী।

লোকগুলো টারজানকে এনে সিংহাসনের নিচে ফেলে দিল। ঠিক সেই মুহূর্তে চৈতন্য ফিরে আসায় টারজান চোখ মেলে চারদিকে তাকাল।

সিংহাসনের পাশে দাঁড়ানো লোকটিকে বলল, এ সবের অর্থ কি ডুথ? লা কোথায়? তোমাদের প্রধান সন্ন্যাসিনী কোথায়?

মেয়েটি ক্রুদ্ধ হয়ে সিংহাসন থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, জেনে রাখ হে বিদেশী, আমিই প্রধান সন্ন্যাসিনী। আমার নাম ওআ, অগ্নি-দেবতার প্রধান সন্ন্যাসিনী আমি।

তাকে উপেক্ষা করে টারজান আবার ডুথকে জিজ্ঞাসা করল, লা কোথায়?

ওআ রাগে জ্বলে উঠল। তার হাতের বলিদানের খড়ের রত্নখচিত হাতলভাঙ্গা ছাদের ফাটল দিয়ে আসা সূর্যকিরণে ঝিকমিকিয়ে উঠল। লাফ দিয়ে বেদীর শেষ প্রান্তে এসে সে চীৎকার করে বলে উঠল, সে মারা গেছে। ঠিক যেমন তুমি মারা যাবে যখন তোমার রক্ত দিয়ে আমরা অগ্নি-দেবতার পূজা করব। লা ছিল দুর্বল। সে তোমাকে ভালবেসেছিল। অথচ দেবতা তোমাকে বেছে নিয়েছিল বলি হিসেবে। কিন্তু ওআ শক্তিময়ী। টারজান ও লা তার কাছ থেকে ওপার-এর সিংহাসন চুরি করে নিয়েছিল। এবার সে তর প্রতিশোধ নেবে। ওকে নিয়ে যাও। বলির যূপকাষ্ঠে ফেলার আগে ওকে যেন আমাকে আর না দেখতে হয়।

টারজনের পায়ের বেড়ি কেটে দিয়ে তাকে নিয়ে চলল ওপার-এর অন্ধকার কারাকক্ষের দিকে। মশালের আলোয় পথ দেখে দেখে তাকে কারাকক্ষে রেখে লোকজনরা চলে গেল।

আগেও একবার টারজান এই কারাগারে ছিল; আর পালিয়েও গিয়েছিল। কাজেই এবারও সে সঙ্গে সঙ্গে পালাবার পথ খুঁজতে শুরু করে দিল।

সে বুঝতে পারল, ঘরের একমাত্র ঘুলঘুলির ওপারের বারান্দাটাতে কোন সন্ন্যাসী পাহারায় নেই। পালাবার এই তো সুযোগ।

ঘুলঘুলিটার লোহার শিক বেঁকিয়ে টারজান লাফিয়ে পড়ল নিচের অন্ধকার বারান্দায়। ঘরের পর ঘর পার হয়ে সে এগিয়ে চলল।

টারজনের সামনে কাঠের হুড়কো দেয়া একটা বড় দরজা। দ্রুত হাতে হুড়কোটা তুলে দরজা খুলে সে ভিতরে পা দিল।

শিবিরে আসবার পরদিন ওয়েনি কোল্ট সাংকেতিক ভাষায় একটা লম্বা চিঠি লিখে ছোকরা চাকরটাকে দিয়ে সেটা উপকূলে পাঠিয়ে দিল। নিজের তাঁবু থেকেই জোরা ড্রিনভ সেটা দেখতে পেল। কিছুক্ষণ পরে কোল্ট এসে হাজির হল জোরার তাঁবুর পাশে বড় গাছটার ছায়ায়।

জোরা বলল, কমরেড কোল্ট, আজ সকালেই তুমি একটি চিঠি পাঠিয়েছ।

দ্রুত চোখ তুলে কোল্ট বলল, হ্যাঁ।

তোমার জানা উচিত ছিল যে এই অভিযানে একমাত্র কমরেড জাভেরি ছাড়া আর কেউ চিঠি লিখতে পারে না।

কোল্ট বলল, আমি জানতাম না। আমি উপকূলে পৌঁছবার আগেই কিছু টাকা সেখানে এসে থাকার কথা ছিল। টাকাটা আসেনি। সেটার খোঁজ নিতেই ছোকরাকে পাঠিয়েছি।

ও, বলে জোরা চুপ করল।

বিকেলে দু’জন একসঙ্গে শিকারে বের হল। একসঙ্গে রাতের খাবার খেল। এইভাবে দিন কাটতে লাগল। তারপর একদিন উত্তেজিত কালা আদমি এসে খবর দিল, অভিযাত্রীরা ফিরে এসেছে। সকলেই বুঝল, ছোট দলটির পতাকায় জয়ের বার্তা লেখা হয়নি। নেতাদের মুখে পরাজয়ের হতাশা। জাভেরি জোরাও কোল্টের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করল।

রাতে খাবার টেবিলে বসে দু’পক্ষই তাদের অভিজ্ঞতার কথা শোনাল। রঘুনাথ জাফরের মৃত্যু, করে দেয়া ও তার ভৌতিক পুনরভ্যুত্থানের কাহিনী সকলকেই রোমাঞ্চিত কলে তুলল।

পরদিন সকাল থেকেই ওপার-এ অভিযান পরিচালনা নিয়ে একটা বৈঠক বসল। আলোচনায় স্থির হল, পুরো দলটাই ওপার-এর প্রাচীর পর্যন্ত যাবে; কিন্তু যোদ্ধাদের মধ্যে মাত্র দশজন সাদা মানুষদের সঙ্গে শহরে ঢুকবে।

নতুন অভিযানের উদ্যোগ-আয়োজনেই কয়েকটা দিন কেটে গেল। একদিন সকালে জাভেরি ও তার দলবল নতুন করে ওপার-এর পথে যাত্ৰ করল। জোরা ড্রিনভও তাদের সঙ্গে যেতে চেয়েছিল, কিন্তু যেহেতু উত্তর আফ্রিকার অনেক এজেন্টের কাছ থেকে চিঠিপত্র আসার কথা আছে তাই তাকে শিবিরে রেখে যাওয়া হল। আবু বতনও তার সেনাদল ও কিছু চাকরবাকরসহ শিবির পাহারা দেয়ার জন্য রয়ে গেল।

ঘরের ভিতরে পা দিয়েই টারজান বুঝতে পারল, আবার সে বন্দী হয়েছে। এখন সে কি করবে? ভাবতে ভাবতেই ঘরের পিছন দিক থেকে চুপি চুপি পা ফেলার শব্দ তার কানে এল। খাপ থেকে ছুরি খুলে সে চকিতে ঘুরে দাঁড়াল। ও কার পায়ের শব্দ! নিঃশব্দে সে অপেক্ষা করতে লাগল।

কে তুমি? একটি নারী-কণ্ঠের প্রশ্ন।

তুমি কোথায়? টারজনের পাল্টা প্রশ্ন।

ঘরের পিছন দিকে, স্ত্রীলোকটি জবাব দিল।

তারপর বলল, আমি তোমাকে চিনতে পেরেছি। এ কণ্ঠস্বর আমার পরিচিত। তুমি তো অরণ্যরাজ টারজান।

টারজান সাগ্রহে জিজ্ঞেস করল, কি ব্যাপার বল তো? ওআ হয়েছে প্রধান সন্ন্যাসিনী, আর নিজের কারাগারে তুমি নিজেই বন্দী?

লা তার দুঃখের কাহিনী শোনাল। ওআ ডুথের সঙ্গে ভালবাসা করে তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র পাকিয়ে তোলে। টারজানকে ভালবাসার জন্য রাজ্যের জনসাধারণ এমনিতেই লার প্রতি অসন্তুষ্ট ছিল। এবার ওআর মিথ্যা প্রচারের ফলে সকলেই তার বিরুদ্ধে গেল। লাকে সিংহাসন থেকে নামিয়ে সেখানে বসাল ওআকে, আর লাকে করল বন্দিনী।

কাহিনী শেষ করে লা বলল, তুমি এসে পড়েছ, এবার আমাদের পালাতে হবে।

টারজান অসহায়ভাবে বলল, কোন পথে পালাব?

লা বলল, আমার ঘরের পিছনের দেয়ালে দীর্ঘকাল ধরে অব্যবহৃত একটা সুড়ঙ্গ আছে।

সেটাই আমাদের পালাবার একমাত্র পথ।

হাতে হাত ধরে দু’জন অন্ধকার সুড়ঙ্গের মধ্যে পা বাড়াল।

অনেক কষ্টের পথ পার হয়ে এক সময় দু’জনই একটা নির্জন ঘরে এসে বিশ্রাম নিল। অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে থাকল। প্রধান সন্ন্যাসিনীর দুটি সুন্দর চোখ অরণ্য-দেবতার সুন্দর শরীরের উপর নিবদ্ধ।

এক সময় লা ডাকল, টারজান!

চোখ তুলে টারজান বলল, বল লা।

আমি আজও তোমাকে ভালবাসি টারজান।

ও কথা এখন থাক।

না, আমাকে বলতে দাও। এ কথা বলতে আমার দুঃখই হয়, তবু এ যে এক মধুর দুঃখ-আমার জীবনের একমাত্র মধুস্বাদ।

তার কাঁধে হাত রেখে টারজান বলল, তুমি চিরদিনই আমার অন্তর অধিকার করে আছ লা। তাকে ভালবাসাও বলতে পার।

টারজান কোন জবাব দিল না। দু’জন চুপচাপ এখন শুধু রাত নামার অপেক্ষা, যাতে সকলের অলক্ষ্যে তারা শহরে নামতে পারে। টারজনের মনে একটিমাত্র চিন্তা-কেমন করে তাকে আবার সিংহাসনে বসানো যায়।

লা বলল, অগ্নি-দেবতা যখন রাতের বিশ্রাম নিতে যায় তার ঠিক আগে সব সন্ন্যাসী-সন্ন্যাসিনীরা দরবার-কক্ষে সমবেত হয়। আজ রাতেই সেই সমাবেশ হবে। তখন আমরা শহরে নামতে পারব।

তারপর? টারজনের সাগ্রহ প্রশ্ন।

দরবার-কক্ষে যদি আমরা ওআকে খুন করতে পারি, সেই সঙ্গে ডুথকেও, তাহলে আর ওদের কোন নেতা থাকবে না। আর নেতাহীন হলেই ওরা শক্তিহীন।

বেলা পড়ে এল। সূর্য নেমে এল পশ্চিম আকাশে। ক্রমে সন্ধ্যা হল। সকলের অলক্ষ্যে প্রাঙ্গণ পেরিয়ে দু’জন পথে নামল। সন্ন্যাসীরা টের পেয়ে হৈ-হৈ করে তাদের পিছু নিল। টারজান এবার লাকে কাঁধে ফেলে দ্রুত ছুটতে লাগল।

বাইরের জগতের অন্ধকারে ওপার-এর মানুষরা অভ্যস্ত নয়। তাই আর না এগিয়ে তারা ফিরে গেল।

টারজান লা-কে মাটিতে নামিয়ে দিল। লা কিন্তু তবু তার গলা জড়িয়ে ধরেই রইল। তার বুকের মধ্যে মুখ রেখে কেঁদে উঠল।

টারজান বলল, কেঁদো না লা। আমরা আবার ওপার-এ ফিরে যাব; তোমাকে আবার সিংহাসনে বসাব।

লা বলল, আমি সেজন্য কাঁদছি না।

তাহলে?

কাঁদছি আনন্দে, কারণ এখন আমি অনেকটা সময় তোমার সঙ্গে একলা থাকতে পারব।

একটা গাছে চড়ে তারা রাতটা কাটাল।

ভোরে প্রথম ঘুম ভাঙ্গল টারজনের। আকাশ মেঘে ঢাকা। ঝড় উঠবে। অনেক সময় হয়ে গেল কোনরকম খাবার মুখে পড়েনি। আগের দিন সকাল থেকে লাও কিছু খায়নি। অতএব সকলের আগে চাই কিছু খাবার। আর এখানে খাবার মানেই শিকার। টারজান একবার ঘুমন্ত লা-র দিকে তাকিয়ে শিকারের সন্ধানে চলে গেল।

একটা শুয়োরের রাং কেটে নিয়ে টারজান ফিরে চলল সেই গাছটার দিকে যার উপরে সে ঘুমন্ত লা কে রেখে এসেছে। সেখানে পৌঁছে দেখল লা নেই। নাম ধরে ডাকল, সাড়া পেল না। কোথায় গেল লা? নিশ্চয় ওপার-এর দিকে ফিরে গেছে। সেটাই তো তার একমাত্র পরিচিত জায়গা। টারজান ভাবল, তার ফিরতে যত দেরিই হয়ে থাকুক, লা কোনমতেই তার আগে ওপার-এর পর্বত-প্রাচীরে পৌঁছতে পারবে না। পথেই সে তাকে ধরে ফেলতে পারবে। টারজান তাই ওপার-এর পথেই পা চালিয়ে দিল।

কিন্তু পর্বত প্রাচীরের সানুদেশে পৌঁছেও তাকে দেখতে না পেয়ে সে একটা পাহাড়ের চূড়ায় উঠল। সেখান থেকে অনেক দূরে ওপার-কে দেখা যায়। এখানে বৃষ্টি খুবই অল্পই হয়েছে। ফলে লা ও তার নেমে যাওয়ার পায়ের ছাপ বেশ স্পষ্টই চোখে পড়ছে। কিন্তু সে পথ বেয়ে উপরে ওঠার কোন পায়ের ছাপই তো দেখা যাচ্ছে না। তাহলে লা গেল কোথায়? তবে কি সে জঙ্গলের পথ ধরেই অন্য দিকে চলে গেছে?

দ্রুত পায়ে পাহাড় থেকে নেমে সে জঙ্গলের দিকে এগিয়ে গেল।

বনপথ ধরে কিছুদূর এগিয়েই নদীর তীরে সে একটা শিবির দেখতে পেল। তার মনে আশা জাগল, এখানে হয়তো লার দেখা মিলবে। কাঁটা গাছের বেড়া দেয়া জায়গাটার মাঝখানে কিছু সাদা মানুষদের তাঁবু; গাছের ছায়ায় বসে কুলিরা ঝিমুচ্ছে; একটা মাত্র আস্কারি রয়েছে পাহারায়; বাকিরা রাইফেল পাশে রেখে দিবান্দ্রিা দিচ্ছে। কিন্তু ওপার-এর লা-কে কোথাও দেখতে পাওয়া গেল না। তবে কি লা-কে কোথাও বন্দী করে রেখেছে? কিন্তু রাতের অন্ধকারে ছাড়া তো আর সন্ধান করা যাবে না। অতএব তাকে অপেক্ষা করতেই হবে। কাছেই একটা গাছের উপরে উঠে সে ঘুমিয়ে পড়ল।

সন্ধ্যাবেলা জোরার জন্য রান্না করতে করতে বাচ্চা চাকর ওয়ামালা বলল, এর আগে তোমাকে বাদামী বাওয়ানার কাছে রেখে গিয়েছিল; সে তোক ভাল ছিল না। শেখ আবু বতনকেও আমার বিশেষ ভাল মনে হচ্ছে না। এখন বাওয়ানা কোল্ট এসে পড়লে বাঁচি।

জোরা বলল, আমারও তাই মনে হয়। ওপার থেকে ফিরে আসার পর থেকেই আরবরা যেন কেমন হয়ে উঠেছে।

ওয়ামালা বলল, সারাদিন তারা সর্দারের তাঁবুতে বসে ফুসুর-ফুসুর করেছে, আর আবু বতন বারবার তোমার দিকে তাকিয়েছে।

জোরা বলল, ওটা তোমার কল্পনা ওয়ামালা। এত সাহস তার হবে না।

পরমুহূর্তেই সে হঠাৎ বলে উঠল, ওদিকে দেখ ওয়ামালা। ও কে?

কালো লোকটি সেই দিকে চোখ ফেরাল। শিবিরের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে একটি মেয়ে। সুন্দরী যুবতীটি এক দৃষ্টিতে তাদের দিকেই তাকিয়েছিল।

ততক্ষণে কয়েকজন আরবও তাকে দেখতে পেয়ে তার দিকে ছুট গেল। তা দেখে জোরাও দ্রুত তার দিকে এগিয়ে গেল যাতে আরবরা তাকে ধরবার আগেই সে পৌঁছে যেতে পারে। তার মুখের হাসি দেখেই ওপার-এর লা তার মনের ভাব বুঝতে পারল।

জোরা শুধাল, তুমি কে? একা এই জঙ্গলে কি করছ?

লা মাথা নেড়ে যে ভাষায় জবাব দিল তার মাথামুণ্ডু কিছুই জোরা বুঝতে পারল না। জোরা ড্রিনভ অনেক ভাষা জানে, কিন্তু কোন ভাষাতেই কাজ হল না। আরবরা তাদের ভাষায় কথা বলল; ওয়ামালা তার ভাষায় কথা বলল। কিন্তু কোন ফল হল না। তখন জোরা তার গলা জড়িয়ে ধরে তাঁবুর মধ্যে নিয়ে গেল। লা ইশারায় জানাল সে স্নান করবে।

আহারাদি শেষ হলে ওয়ামালা জোরার তাঁবুতে লা-র জন্য আর একটা খাটিয়া পেতে দিল।

জোরা বলল, ওয়ামালা, আজ রাতে তুমি তাঁবুর বাইরেই শোবে। এই নাও একটা পিস্তল।

শেখ আবু বতন অনেক রাত পর্যন্ত তার তাঁবুতে বসে সর্দারদের সঙ্গে কথাবার্তার শেষে বলল, এই নতুন চিজুটির জন্য যে দাম পাওয়া যাবে তেমনটি আগে কখনো মেলেনি।

ঘুম ভাঙতেই টারজান আকাশের তারার দিকে তাকাল। অর্ধেক রাত পার হয়ে গেছে। উঠে। শরীরটাকে টান টান করে নিচে নেমে সে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।

শিবিরের সকলেই ঘুমিয়ে পড়েছে। একটিমাত্র আঙ্কারি প্রহরী ধূনির পাশে বসে আছে। তার চোখের দৃষ্টিকে এড়িয়ে টারজান কুলিদের ঝুপড়ির পিছন দিয়ে ইউরোপীয়দের তাবুর কাছে পৌঁছে গেল। একটার পর একটা তাঁবুর পিছন দিকের দেয়াল কেটে ভিতরে ঢুকে সে লা-কে খুঁজতে লাগল। কিন্তু বৃথা চেষ্টা। লা-কে দেখতে পেল না।

অগত্যা টারজান আবার সেই গাছেই ফিরে গেল, রাতটা সেখানে কাটিয়ে সকাল হলে আবার বেরিয়ে পড়ল লা-র সন্ধানে।

এক সঙ্গে তৈরি হয়ে এসে দু’জন প্রাতরাশ খেতে বসল তাঁবুর বাইরে গাছের ছায়ায়। ওয়ামালা পরিবেশন করল। জোরার মনে হল, শেখদের ঘরগুলোতে যেন একটা কর্মব্যস্ততা চলেছে। ব্যাপারটাকে সে কোনরকম গুরুত্ব দিল না, কারণ মাঝে মাঝেই ওরা তাঁবুগুলোকে এক জায়গায় নিয়ে যায়।

প্রাতরাশের পরে জোরা তার রাইফেলটা তেল দিয়ে ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করে দুটো কালো কুলিকে সঙ্গে নিয়ে শিকারে বেরিয়ে গেল। লা তাদের চলে যেতে দেখল, কিন্তু ইচ্ছা থাকলেও জোরা তাকে ডাকল না বলে সে তাদের সঙ্গে গেল না।

আবু বতনের একই জাতির আর এক শেখের ছেলে ইব্‌ন দামু এই অভিযানে ইবন্ বতনের ডান হাত। দূর থেকে অনেকক্ষণ ধরেই সে মেয়ে দুটির উপর নজর রেখেছিল। একজন বন্দুকবহনকারী ও দু’জন কুলিকে নিয়ে জোরাকে বেরিয়ে যেতে দেখেই সে বুঝল যে ওরা শিকারে চলে গেছে।

সঙ্গী দুটিকে নিয়ে সে অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে রইল। তারপর ওপার-এর লা-র তাঁবুর দিকে এগিয়ে গেল। তার সামনে পৌঁছে ইবন্ দামুক কি যেন বলল। উদ্ধত দৃষ্টিতে তাকিয়ে মাথাটা নেড়ে লা তাঁবুর, দিকে এগিয়ে গেল। কিন্তু ইবন্ দামুক আর একটু কাছে গিয়ে লা-র খোলা কাঁধে হাত রাখল।

লা-র দুই চোখে আগুন জ্বলে উঠল। লাফ দিয়ে সরে গিয়ে কোমরের ছুরির বাটটা চেপে ধরল। ইবন্ দামুক কয়েক পা পিছিয়ে গেল, কিন্তু তার এক সঙ্গী লাফিয়ে পড়ে তাকে ধরতে গেল।

লোকটা মহামূর্খ! লা বাঘিণীর মত তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। বন্ধুরা বাধা দেবার আগেই লার ছুরিটা পর পর তিনবার আমূল বিদ্ধ হল তার বুকে। মরণ-আর্তনাদের সঙ্গে সঙ্গে তার মৃতদেহটা মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।

সে আর্তনাদ শুনে অন্য আরবরাও ছুটে এল। লা চীৎকার করে বলল, দূরে থাক। অগ্নি-দেবতার প্রধান সন্ন্যাসিনীর গায়ে কেউ হাত তুলতে চেষ্টা করে না।

তার কথাগুলো কেউ বুঝল না। কিন্তু বুঝল তার জ্বলন্ত চোখ ও রক্তাক্ত ছুরির অর্থ। সকলেই দূরে দাঁড়িয়ে হৈ-চৈ করতে লাগল। এ সবের অর্থ কি ইবন্ দামুক? আবু বতন প্রশ্ন করল।

লোকটা ওকে স্পর্শও করেনি, অথচ

আবু বতন বলল, সিংহিণী হলেও ওর কোন ক্ষতি করা চলবে না।

ইবন্ দামুক বলল, উল্লাহ! কিন্তু ওকে পোষ মানাতে তো হবে।

শেখ বলল, যে লোক ওর জন্য সবচাইতে বেশি স্বর্ণমুদ্র দেবে সে কাজের ভারটা সেই নেবে। আমাদের একমাত্র কাজ ওকে খাঁচায় বন্দী করা। শোন বাছারা, ওকে ঘিরে ধরে ছুরিটা কেড়ে নাও। ভাল করে পিঠমোড়া করে হাত বেঁধে ফেল। অন্য সকলে ফিরে আসার আগেই আমরা তাঁবু তুলে যাত্রার জন্য প্রস্তুত হয়ে থাকব।

ডজনখানেক লোক একযোগে লা-র উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। সিংহিণীর মত সেও লড়তে লাগল। ছুরির আঘাতে রক্তাক্ত হল অনেকে। আরও একটি আরবের মৃতদেহ লুটিয়ে পড়ল মাটিতে। তবু শেষ পর্যন্ত লাকে পরাজয় স্বীকার করতে হল। ছুরিটা কেড়ে নিয়ে তার দুই হাত শক্ত করে বেঁধে ফেলা হল।

দু’জন সৈনিককে পাহারায় রেখে আবু বতন অন্য চাকরদের সঙ্গে নিয়ে যাত্রার আয়োজন করতে লাগল। ইবন্ দামুকের উপর জিনিসপত্র ও খাবার-দাবার গুছিয়ে নেবার ভার দিয়ে সে নিজে গেল ইউরোপীয়দের তাঁবু লুট করতে। আর বিশেষ নজর জোরা ড্রিনভ ও জাভেরির তাঁবুর উপর। আশানুরূপ সোনাদানা না পেলেও জোরার তাঁবুতে একটা বাক্সের মধ্যে সে প্রচুর টাকা পেল। দূরদর্শী জাভেরি তার। অর্থ-ভাণ্ডারের বেশি অংশটাই তাঁবুর মেঝেতে মাটির নিচে লুকিয়ে রেখেছিল। তাই সেটার খোঁজ আবু বতন পেলই না।

জোরা খুব ভাল শিকার নিয়েই ফিরে এল। তার পিছনেই রাইফেল দুটো নিয়ে আসছে ওয়ামালা। কুলিরা চলেছে শিকারের ভারী বোঝা নিয়ে। কিন্তু শিবিরে পৌঁছবার আগেই পথের দু’পাশের ঝোপের ভিতর থেকে আরবরা তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। দু’জন ওয়ামালার হাত থেকে রাইফেল দুটো ছিনিয়ে নিল। বাকিরা চেপে ধরল জোরাকে। রিভলবারটা টেনে বের করেও সে এই আকস্মিক আক্রমণকে ঠেকাতে পারল না। অচিরেই তার দুই হাত পিটমোড়া করে বেঁধে ফেলা হল।

সে জোর গলায় বলল, এ সবের অর্থ কি? শেখ আবু বতন কোথায়?

লোকগুলো হো-হো করে হেসে উঠল।

আর একটু এগিয়ে শিবিরের অবস্থা দেখে সে তো স্তম্ভিত। সব তাঁবু খুলে ফেলা হয়েছে। আরবরা রাইফেল হাতে যাত্রার জন্য প্রস্তুত। তার ক্ষণপূর্বের অতিথিটিকেও হাত বেঁধে আটকে রেখেছে।

এসব কেন করেছ আবু বতন? জোরা প্রশ্ন করল।

শেখ বলল, আল্লাহর ইচ্ছায় আমাদের দেশকে আমরা নাসরানিদের হাতে তুলে দেব না। আমরা দেশে ফিরে যাচ্ছি।

এই নারী ও আমাকে নিয়ে কি করতে চাও?

কিছুটা পথ তোমাদের সঙ্গে করেই নিয়ে যাব। সেখানে একটি ধনী লোক বাস করে। সে তোমাদের দু’জনকেই ভাল বাড়িঘর দেবে।

তার মানে কোন কালা সুলতানের কাছে আমাদের বেচে দেবে?

শেখ কাঁধে ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, কথাটা সেভাবে আমি বলছি না। বরং বলতে চাই, আমরা চলে গেলে তোমরা যাতে এই জঙ্গলে শুকিয়ে না মর তাই একজন ভাল বন্ধুর কাছে তোমাদের উপহার-স্বরূপ রেখে যেতে চাই।

তীব্র ঘৃণায় ক্ষুব্ধ কণ্ঠে জোরা বলল, আবু বতন, তুমি ভণ্ড, বিশ্বাসঘাতক।

আবু বতন বলল, খুব হয়েছে। এস হে বাছারা, আমরা যাত্রা শুরু করি।

শিবিরে স্তূপীকৃত বাড়তি জিনিসপত্রে আগুন লাগিয়ে দিয়ে আরবরা দল বেঁধে চলে গেল পশ্চিমের দিকে।

সময় কাটাবার জন্য দুর্ভাগ্যের সঙ্গিনীটিকে জোরা একটু একটু করে ইংরেজি শেখাতে শুরু করল। প্রথমে ইশারায় নানা জিনিস দেখিয়ে তার নাম বলে বলে শুরু করল। এইভাবে কয়েকদিনের মধ্যেই তারা নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলার মত একটা চলনসই ব্যবস্থা করে ফেলল।

প্রথম দিনের পর থেকেই বন্দিনীদের হাতের বাঁধন খুলে দেয়া হয়েছে। অবশ্য আরব রক্ষীরা সব সময়ই তাদের চোখে-চোখে রাখে।

তারা চলতে লাগল আবিসিনিয়ার গালা অঞ্চলের ভিতর দিয়ে। কিন্তু গালা অঞ্চলের একেবারে প্রান্তে পৌঁছে বন্যায় স্ফীত একটা নদীর তীরে তারা বাধা পেল। উত্তরে মূল আবিসিনিয়ায়ও যেতে পারল না, আবার দক্ষিণে যাবারও সাহস হল না। কাজেই তারা নদীর তীরেই অপেক্ষা করতে বাধ্য হল।

পিটার জাভেরি এসে দাঁড়াল ওপার-এর প্রাচীরের সামনে। দলের আগে আগে চলেছে মিগুয়েল রোমেরা; তার ঠিক পিছনে ওয়েনি কোল্ট আর বাকি সাদা মানুষরা রয়েছে সকলের পিছনে যাতে দরকার হলে তারা অবাধ্য কালা আদমিদের জোর করে এগিয়ে যেতে বাধ্য করতে পারে।

রোমেরো ও কোল্ট ভিতরের প্রাচীরের ওপারে অদৃশ্য হয়ে গেল। বাকি চারজন বাইরের প্রাচীরের ভিতর ঢুকতেই বিধ্বস্ত নগরের বিষণ্ণ নিস্তব্ধতাকে ভেঙে শোনা গেল আর্ত কণ্ঠস্বর।

উঠোনটা পার হয়ে ভিতরের প্রাচীরের দিকে এগোতেই দেয়ালের বিপরীত দিক থেকে তাদের কানে এল একটা নারকীয় হল্লা-বহুকণ্ঠের বীভৎস রণ-হুংকার আর দ্রুত পায়ের শব্দ। একটা গুলির শব্দ হল; তারপর আর একটা, আরও একটা।

রাইফেল উদ্যত করে তারা মন্দিরের দিকে পা বাড়াল। কিছুটা এগোতেই ছায়া-ঢাকা খিলান ও অসংখ্য দরজার পথে ছুটে বেরিয়ে এল একদল মানুষ। তাদের বীভৎস রণ-হুংকারে প্রাচীন নগরীর স্তব্ধতা ভেঙে খান খান হয়ে গেল।

শুরু হল লড়াই। দু’জনই গুলি ছুঁড়তে লাগল। প্রতিপক্ষের কয়েকজন আহত হল। একটা ছুটন্ত গুলি এসে কোল্টের মাথায় লাগল। ধপাস করে সে মাটিতে পড়ে গেল, আর মুহূর্তের মধ্যে ওপার-এর বেঁটে মানুষগুলো তার দেহটাকে ঘিরে ফেলল।

মিগুয়েল রোমেরো বুঝল তার সঙ্গীর অবস্থা শোচনীয়। তার পক্ষে একাকি সঙ্গীকে উদ্ধার করার আশা সুদূরপরাহত। তাই সে চেষ্টা না করে নিজের প্রাণ বাঁচাতে সে পিছু হটতে লাগল। দুটো প্রাচীর পার হয়ে আবার সে ভোলা মাঠে ফিরে এল।

প্রাচীরের ভিতর থেকে আবার শোনা গেল অসভ্যদের বিজয়-উল্লাস। জাভেরি বলল, আমিও একা ওপার দখল করতে পারব না। অতএব সকলকেই শিবিরে ফিরে যেতে হবে।

বেঁটে সন্ন্যাসীরা কোল্টকে ঘিরে ধরে অস্ত্রশস্ত্র কেড়ে নিয়ে তাকে পিছমোড়া করে বেঁধে ফেলল। তারপর কাঁধে তুলে মন্দিরের ভিতরে নিয়ে গেল।

চেতনা ফিরে এলে কোল্ট দেখল সে একটা মস্ত বড় ঘরের মেঝেতে শুয়ে আছে। এটাই ওপার মন্দিরের দরবার-কক্ষ। কোল্টের চেতনা ফিরে আসতে দেখে রক্ষীরা, এক ঝটকায় তাকে দাঁড় করিয়ে ওআ-র সিংহাসনের বেদীর দিকে ঠেলে দিল।

সম্মুখে সুদৃশ্য সিংহাসনে বসে আছে অপরূপ সুন্দরী এক তরুণী। তাকে ঘিরে রয়েছে প্রাচীন সভ্যতার জৌলুষের প্রাচুর্য। কিন্তু চেহারার লোমশ পুরুষ ও সুন্দরী সখিদল পরিবৃত হয়ে উদ্ধত ভঙ্গীতে সে বসে আছে। চোখ দুটি নির্মম ও নিষ্ঠুর।

তরুণী সিংহাসনে উঠে দাঁড়াল। বন্দীর উপর স্থির দৃষ্টি রেখে কোমর থেকে ছুরি বের করে মাথার উপর তুলে হিংস্র দ্রুতকণ্ঠে কি যেন বলে গেল।

ওআ-র কথা শেষ হতেই রক্ষীরা কোল্টকে বাইরে নিয়ে গেল। বেচারা বুঝতেও পারল না। যে অগ্নি দেবতার প্রধান সন্ন্যাসিনী তাকে দিয়েছে মৃত্যুদণ্ড।

রক্ষীরা তাকে নিয়ে গেল সুড়ঙ্গের মুখে একটা গুহায়। লোহার গরাদ দেয়া দরজা ও জানালা দিয়ে প্রচুর আলো বাতাস সে ঘরে ঢুকছে। কব্জির বাঁধন খুলে দিলে রক্ষীরা তাকে সেই গুহার মধ্যে রেখে চলে গেল।

ওয়েনি কোল্ট জানালা দিয়ে তাকাতেই দেখতে পেল ওপার-এর সূর্য-মন্দির। যজ্ঞবেদির সিঁড়িতে অনেক রক্তের দাগ। প্রাঙ্গণে স্তূপীকৃত নর-কপাল। কোল্ট ভয়ে শিউরে উঠল। এতক্ষণে সে বুঝতে পারল, কি শাস্তি তার জন্য অপেক্ষা করে আছে।

হঠাৎ তার মনে হল, প্রাঙ্গণের যজ্ঞ-বেদীর দিক থেকে একটা অস্পষ্ট শব্দ যেন কানে এল। ভাল করে কান পাততেই বুঝতে পারল, সত্যি কে যেন আসছে। নিঃশব্দে উঠে জানালার কাছে গিয়ে বাইরে তাকাল। দূরাগত তারার আলোয় দেখল, প্রাঙ্গণ থেকে কে যেন তার গুহার দিকেই এগিয়ে আসছে; তবে সে মানুষ কি জন্তু তা সে ঠাহর করতে পারল না।

ওয়েনি কোল্ট তাকিয়েই আছে। মূর্তি তার গুহার দিকেই এগিয়ে আসছে। ও কি তার মৃত্যু দূত? তাকে যজ্ঞবেদীতে নিয়ে যেতে আসছে? কাছে আরও কাছে। সে এসে দাঁড়াল তার গুহার দরজার শিকের ওপারে। নরম গলায় ফিস্ ফিস্ করে কি যে বলল তার বিন্দু-বিসর্গও সে বুঝতে পারল না; শুধু বুঝতে পারল, যে এসেছে সে নারী।

কৌতূহলবশে সেও দরজার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। একটা নরম হাত এসে তাকে স্পর্শ করল পরম আদরে। প্রাঙ্গণের মাথার উপরে খোলা আকাশ থেকে ভরা চাঁদের উজ্জ্বল জ্যোৎস্না এসে পড়েছে গুহার মুখে। শিকের ফাঁক দিয়ে মেয়েটি তাকে খাবার দিল। আর সেই সময় তার হাতটা টেনে নিয়ে তাতে ঠোঁট দুটো ছোঁয়াল।

ওয়েনি কোল্ট হতবাক। সে জানত যে এই তরুণী সন্ন্যাসিনীটি প্রথম দর্শনেই তার প্রেমে পড়েছে। ওপার-এর কিম্ভুতদর্শনে লোমশ পুরুষদের দেখে অভ্যস্ত তার চোখে ও মনে এই নবাগত পুরুষটি দেখা দিয়েছে দেবতার মহিমায়। তারপরই হঠাৎ তাকে ছেড়ে দিয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিঃশব্দ পায়ে মন্দিরের খিলানের অন্ধকার পথে অদৃশ্য হয়ে গেল।

মেয়েটির আনা খাবার খেয়ে কোল্ট শুয়ে শুয়ে কেবলই ভাবতে লাগল, কী এক দুর্নিরীক্ষ শক্তি মানুষের সব কর্মধারাকে পরিচালিত করে। ভাবতে ভাবতে এক সময় সে ঘুমিয়ে পড়ল।

কোল্ট ঘুমের মধ্যেই একবার নড়ে উঠে চমকে জেগে উঠল। অস্তগামী চাঁদের আলোয় দেখল, দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে আছে সেই বাঞ্ছিতা নারী। চাবি ঘুরিয়ে তালা খুলে সে ভিতরে ঢুকল। কোল্ট লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল। নাও হাত ধরে তাকে নিয়ে গেল ঘরের বাইরে।

অনেক অন্ধকার গলি-পথে ঘুরে ঘুরে ভিতরের প্রাচীরের কাছে এসে নাও আঙ্গুল বাড়িয়ে বলল, ঐ পথে চলে যাও। নাও-র হৃদয়কে নিয়ে যাও তোমার সঙ্গে। তোমাকে আর কোন দিন চোখে দেখতে পাবে না, তবু সারা জীবন এই মুহূর্তটির স্মৃতি আমি বুকের মধ্যে বয়ে বেড়াব।

নাও তার খাপ-শুদ্ধ ছুরিটা কোল্টের হাতে তুলে দিল। এই বিপদসংকুল পথে নিরস্ত্র যাত্রা সমীচিন নয়। ভিতরের প্রাচীরের কাছে পৌঁছে কোল্ট একবার পিছন ফিরে তাকাল। চাঁদের আবছা আলোয় প্রাচীন

ধ্বংসস্তূপের ছায়ায় ছোট্ট সন্ন্যাসিনী খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কোল্ট হাত নাড়িয়ে নীরবে শেষ বিদায় সম্ভাষণ জানাল।

ইতালীয় সোমালিল্যান্ড অভিযানের চূড়ান্ত সাফল্যের ব্যাপারে যে আত্মবিশ্বাস পিটার জাভেরি একেবারেই হারিয়ে ফেলেছিল, ধীরে ধীরে সে আবার সেটা ফিরে পাচ্ছে। বিভিন্ন অঞ্চলের প্রতিনিধিদের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় সরবরাহ আসতে আরম্ভ করেছে; বিদ্রোহী নিগ্রোরাও অনেকটা শান্ত হয়েছে, আর। তার ফলে নতুন নতুন সংগ্রামী মানুষ এসে তার দলে যোগ দিচ্ছে। জাভেরির পরিকল্পনাটা এই রকমঃ দ্রুত ও আকস্মিক আক্রমণ চালিয়ে কিছু আদিবাসী গ্রাম ধ্বংস করে ও দু’একটা ফাঁড়ি দখল করে তড়িৎ গতিতে সীমান্ত পার হয়ে চলে আসবে, ফরাসী ইউনিফর্মগুলোকে ভবিষ্যৎ প্রয়োজনের জন্য বাক্সবন্দী করে রাখবে এবং আবিসিনিয়াতে রাস্তাকারিকে গদীচ্যুত করবে; সেখানকার দলীয় প্রতিনিধিরা আগেই জানিয়েছে যে সেখানে বিপ্লবের ভূমি সম্পূর্ণ প্রস্তুত। প্রতিনিধিরা আরও আশ্বাস দিয়েছে, একবার আবিসিনিয়া দখল করে সেখানে ঘাঁটি বানাতে পারলে সমগ্র উত্তর আফ্রিকার আদিম জাতিরা দলে দলে এসে তার পতাকাতলে সমবেত হবে।

ওদিকে মার্কিন পুঁজিপতিদের লোভের সুযোগ নিয়ে সুদূর বোখারোতে বহুবার, স্কাউট ও যোদ্ধা বিমানসহ দু-শ’ বিমানের একটা বহরকে হঠাৎ পারস্য ও আরবের আকাশপথে নিয়ে আসা হবে তার আবিসিনিয়ার ঘাঁটিতে। স্থানীয় লোকদের নিয়ে যে বিরাট বাহিনী সে গড়ে তুলেছে তার সঙ্গে এই সব শক্তি মিলিত হলে গোটা পরিস্থিতি আসবে তার অনুকূলে; তার সঙ্গে যোগ দেবে মিশরের বিদ্রোহী সেনাদল। এইভাবে, ইউরোপ একটা যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে তার বিরুদ্ধে কোন সম্মিলিত প্রতিরোধ গড়ে তোলা সম্ভব হবে না। তার সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন সফল হবে, আর সে হবে চিরদিনের মত অজেয়।

হয়তো এটা একটা উন্মাদ স্বপ্ন; হয়তো পিটার জাভেরি সত্যি উন্মাদ- কিন্তু আজ পর্যন্ত কোন্ বিশ্ব বিজয়ী কিছুটা উন্মাদ ছিল না?

সে যেন দিব্য দৃষ্টিতে দেখতে পাচ্ছে তার সাম্রাজ্যের সীমান্ত একটু একটু করে দক্ষিণে প্রসারিত হচ্ছে। তারপর একদিন সে শাসন করবে একটা বিরাট মহাদেশ-সে হবে আফ্রিকার সম্রাট প্রথম পিটার।

একদিকে সমস্ত শিবির জুড়ে যখন চলেছে এই স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করার উদ্যোগ কর্মব্যস্ততা, তখন ওদিকে একশ’ কাল সৈনিক এগিয়ে আসছে জঙ্গলের পথে। তাদের গায়ের চামড়া মসৃণ, চকচকে; তাদের ঘুমন্ত মাংসপেশী ও সহজ পদক্ষেপ তাদের দৈহিক সক্ষমতার সাক্ষ্য বহন করছে। গোড়ালিতে ও কব্জিতে তামার বালা, গলায় সিংহ বা চিতার নখের মালা, এবং সিংহ বা চিতার চামড়ার এক ফালি কটি-বস্ত্র ছাড়া নগ্ন দেহ। প্রত্যেকের মাথায় সাদা পাখির পালক গোঁজা। কিন্তু তাদের আদিম সাজ-সজ্জার এখানেই ইতি, কারণ তাদের সকলেরই হাতে আধুনিক অস্ত্রের সম্ভার; স্বয়ংক্রিয় রাইফেল, রিভলবার ও বুলেট ভর্তি চামড়ার বক্ষবন্ধনী। একটি দুর্ভেদ্য বাহিনী নিঃশব্দে দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে চলেছে জঙ্গলের ভিতরে দিয়ে। তাদের দলপতির কাঁধের উপর বসে আছে একটা ছোট্ট বানর।

নদী তীরের অস্থায়ী শিবির থেকেই সুযোগমত আলাদা আলাদা ভাবে জোরা ড্রিনভ ও ওপায়ের লা আবু বতনের হাত থেকে পালিয়ে গেল। ঘটনাচক্রে এক সময় আকস্মিকভাবে দেখা হয়ে গেল। পথশ্রমে ক্লান্ত ওয়েনি কোল্ট ও লার সঙ্গে। ঠিক এই ভাবে একদিন জঙ্গলের মধ্যে জোরা’ড্রিনভের দেখা হয়ে গেল টারজনের সঙ্গে। দু’জন এক সঙ্গে চলতে লাগল। আর সেই অবস্থাতেই একদিন এক গুপ্ত আততায়ীর গুলিতে আহত হল টারজান। ফলে তারা দুজনেই ধরা পড়র জাভেরির দলের হাতে।

পরদিন খুব সকালে অভিযাত্রী দল সারি বেঁধে শিবির থেকে বেরিয়ে পড়ল। কালা আদমিরা গায়ে চড়িয়েছে ফরাসী উপনিবেশরক্ষী বাহিনীর উর্দি জাভেরি, রোমেরো, আইভিচ ও মোরির গায়ে ফরাসী অফিসারদের পোশাক। টারজনের সেবাশুশ্রূষার জন্য জোরা ড্রিন থেকে যেতে চেয়েছিল, কিন্তু জাভেরির হুকুমে তাকেও দলের সঙ্গে চলতে হচ্ছে। বন্দীর দেখাশুনা এবং রেখে যাওয়া রসদ ও অস্ত্রশস্ত্র পাহারা দেবার জন্য অল্প কয়েকটি নিগ্রো ও ডরস্কিকে শিবিরে রেখে যাওয়া হয়েছে।

যাত্রার ঠিক পূর্বক্ষণে জাভেরি চুপিচুপি শেষ নির্দেশ শুনিয়ে দিল ডবৃস্কিকে। ব্যাপারটা সম্পূর্ণ তোমার হাতেই ছেড়ে দিয়ে যাচ্ছি। এমন ব্যবস্থা করবে যাতে মনে হবে যে সে পালিয়েছে অথবা কোন আকস্মিক দুর্ঘটনায় তার মৃত্যু হয়েছে।

ডরস্কি বলল, এ নিয়ে তোমাকে আর মাথা ঘামাতে হবে না কমরেড। তুমি ফিরে আসার অনেক আগেই বাছাধনকে ভবপারে পাঠিয়ে দেব।

আক্রমণকারীদের সামনে কষ্টকর দীর্ঘপথ। পাঁচশ মাইল বন্ধুর পথে দক্ষিণ-পূর্ব আবিসিনিয়ার ভিতর দিয়ে তাদের ঢুকতে হবে ইতালীয় সোমালিল্যান্ডে। জাভেরির মনোগত বাসনা ইতালীয় উপনিবেশে আক্রমণের একটা মহড়া শুধু দেবে। তাতেই ফরাসীদের বিরুদ্ধে ইতালীয়দের ক্রোধ জাগ্রত হবে, আর সেখানকার ফ্যাসিস্ত ডিক্টেটর সেই ওজুহাতে ইউরোপের যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়বে।

জাভেরি হয়তো কিছুটা পাগল ছিল। এতদিন সে দেখেছে একটি সাম্রাজ্যের স্বপ্ন; এখন দেখছে দুটি সাম্রাজের স্বপ্ন। এক নতুন রোমক সম্রাট শাসন করবে ইউরোপ, আর সে নিজে হবে আফ্রিকার সম্রাট। তার চোখের সামনে ভাসছে দুই সোনার সিংহাসন–একটিতে আসীন সম্রাট প্রথম পিটার, আর অপরটিতে সাম্রাজ্ঞী জোরা। অভিযানের দীর্ঘ পথ এই স্বপ্ন দেখেই সে কাটাতে লাগল।

সকালে টারজনের জ্ঞান ফিরল। শরীর দুর্বল, রুগ্ন; মাথায় ভীষণ যন্ত্রণা। নড়বার চেষ্টা করতেই বুঝল, হাত-পা শক্ত করে বাঁধা। কি ঘটেছে, কোথায় আছে–কিছুই সে জানে না। তাঁবুর ক্যানভাসের দেয়ালে দেখে বুঝল, যে ভাবেই হোক শত্রুর হাতে সে ধরা পড়েছে। এখানে সে একা নয়; বাইরে লোকজনের গলা শোনা যাচ্ছে। তবে যতদূর মনে হয়, তারা সংখ্যায় বেশি নয়।

গভীর জঙ্গল থেকে ভেসে এল হাতির ডাক। অস্পষ্টভাবে কানে এল সিংহের গর্জন। মাথাটা ঘুরিয়ে তাঁবুর বাইরে তাকাল। তার ঠোঁট থেকে বের হল একটানা নিচু চীৎকার- বিপন্ন পশুর বুকফাটা ডাক।

ডরস্কি তার তাঁবুর সামনে একটা চেয়ারে হেলান দিয়ে ঝিমুচ্ছিল। লাফ দিয়ে উর্ধ্বে দাঁড়াল।

ছোকরা নিগ্রো-চাকরটাকে সঙ্গে নিয়ে ভয়ে ভয়ে টারজনের তাঁবুর দিকে এগোতে লাগল। ডরস্কির হাতে উদ্যত রিভলবার।

ঘরে ঢুকে দেখল, টারজান যেখানে ছিল সেখানেই শুয়ে আছে। তবে তার চোখ দুটি খোলা। ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে সে ডরস্কির দিকে তাকাল। ডরস্কি কয়েকটা প্রশ্ন করল, কোন জবাব পেল না।

ডরস্কির ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে গেল। চীৎকার করে বলল, বাঁটা গোরিলা, আমাকে বোকা বানাবার চেষ্টা করো না। আমি ভাল করেই জানি, এ লোকটার বকবকানি সব তুমি বুঝতে পেরেছ। তাছাড়া, তুমি একজন ইংরেজ, অবশ্যই ইংরেজি জান। তোমাকে পাঁচ মিনিট সময় দিয়ে গেলাম। ফিরে এসেও যদি দেখি তুমি কথা বলছ না, তাহলে তোমার কপালে অশেষ দুর্গতি আছে। বলেই সে তাঁবু থেকে সটান বেরিয়ে গেল।

ছোট্ট নকিমা অনেক পথ পার হয়ে গিয়েছিল। তার গলার শক্ত বেড়ি থেকে ঝুলছিল একটা চামড়ার থলে। তার মধ্যেই চিঠিটা ছিল। সেটা সে এনে দিয়েছিল ওয়াজিরিদের সেনাপতি মুভিরোকে। আর ওয়াজিরিরা যখন পথে নামল তখন নকিমা সগর্বে মুভিরোর কাঁধেই বসে পড়ল। অনেকটা সময় পর্যন্ত সে মুভিরোর কাঁধেই ছিল; তারপর মনের খেয়ালই হোক আর অন্য কোন প্ররোচনাতেই হোক সকলকে ছেড়ে সে নিজের কাজে চলে গেল।

বড় বড় গাছের ডালে ডালে ঝুলতে ঝুলতে সে চলতে লাগল। আপন খেয়াল খুশিতে একবার এদিকে ছোটে, একবার ওদিকে। আর তাতেই অনেক সময় নষ্ট হল।

এইভাবে নকিমা যখন বহুদূর জঙ্গলে অকারণে ছুটাছুটি করছে, ঠিক তখনই পাঁচ মিনিট পরে ডরস্কি আবার ঢুকল টারজনের তাবুতে। নিজস্ব মতলবটাকে মনে মনে ঠিক করে নিয়েই সে এসেছে।

বন্দীর মুখের ভাব বদলে গেছে। কান পেতে কি যেন শুনছে। ডরস্কিও কান পাতল। কিন্তু কিছুই শুনতে পেল না। টারজনের অন্তর কিন্তু খুশিতে ভরে উঠেছে।

ডরস্কি বলল, আমি এসেছি তোমাকে শেষ সুযোগ দিতে। ওপার-এর স্বর্ণ-ভাণ্ডারের সন্ধানে কমরেড জাভেরি দু’বার সেখানে অভিযান চালিয়েছে; দু’বারই ব্যর্থ হয়েছে। সকলেই জানে, ওপার-এর রত্ন ভাণ্ডার কোথায় আছে তা তুমি জান এবং আমাদের সেখানে নিয়ে যেতেও পার। কথা দাও, কমরেড জাভেরি ফিরে এলেই তুমি এ কাজ করবে, তাহলে তোমার কোনরকম ক্ষতি করা তো হবেই না, উপরন্তু যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তোমাকে মুক্তি দেয়া হবে। আমার প্রস্তাব না মানলে তুমি মরবে। কোমরের খাপ। থেকে লম্বা ছুরিটা টেনে বের করল।’

টারজান তবু পাথরের মত নিপ। ছুরির সরু ফলাটা তার চোখের সামনে এনে ডক্তি বলল, বেশ ভাল করে ভেবে দেখ। মনে রেখো, এই ফলাটা যখন তোমার পাঁজরের মধ্যে ঢুকিয়ে দেব তখন একটুও : শব্দ হবে না। ফলাটা তোমার হৃৎপিণ্ডে ঢুকে যাবে, আর রক্ত বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত সেখানেই থাকবে। তারপর ফলাটা বের করে ঘাটা জুড়ে দেব। বিকেলের দিকে দেখা যাবে তুমি মরে পড়ে আছ, আর নিগ্রোদের কাছে আমি জানাব যে হঠাৎ গুলি লেগে তুমি মারা গেছ। সত্য ঘটনা তোমার বন্ধুরা জানতেও পারবে না। তোমার মৃত্যুর প্রতিশোধও কেউ নেবে না। বৃথাই তোমার জীবনটা যাবে।

ছুরিটা টারজনের মুখের একেবারে কাছে এসে গেছে। হঠাৎ বন্য পশুর মত টারজানও গা-ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়াল। ইস্পাতের কঠিন চোয়াল দিয়ে চেপে ধরল ডবৃস্কির কব্জি। সে ছিটকে সরে গেল। অবশ আঙ্গুলের ভিতর থেকে ছুরিটা মাটিতে পড়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে টারজান তার আততায়ীকে লেঙ্গি মেরে মাটিতে ফেলে দিয়ে তার পিঠের উপর চেপে বসল।

চীৎকার করে লোকজনদের ডাকতে ডাকতে ডরস্কি বাঁ হাত দিয়ে কোমরের রিভলবারটা বের করতে চেষ্টা করল, কিন্তু অচিরেই বুঝতে পারল যে দেহের উপর থেকে টারজানকে সরাতে না পারলে সে কাজ করা যাবে না।

তার কানে এল, লোকজন সব হৈ-হৈ করে ছুটে আসছে। তারপরেই শুনতে পেল আতংকের চীৎকার। আর পরমুহূর্তেই মাথার উপর থেকে তাঁবুটা অদৃশ্য হয়ে গেল; ডরস্কি সভয়ে দেখতে পেল একটা প্রকাণ্ড হাতি তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।

মুহূর্তের মধ্যে ডরস্কিকে ছেড়ে দিয়ে টারজান পাশ ফিরে সরে গেল। সঙ্গে সঙ্গে ডরস্কিও রিভলবারে হাত দিল। টারজান চীৎকার করে বলল, মার ট্যান্টর, মার।

হাতির ঝোলানো শুড়টা এসে ডবৃস্কিকে পেঁচিয়ে ধরল। কর্কশ গলায় চীৎকার করতে করতে ডরস্কিকে মাথার উপর তুলে কয়েক পাক ঘুরিয়ে ছুঁড়ে দিল শিবিরের মধ্যে। আতংকিত নিগ্রোরা ছুটে জঙ্গলে পালিয়ে গেল। ট্যান্টর এগিয়ে গিয়ে দাঁত দিয়ে ডরস্কির দেহটাকে ক্ষতবিক্ষত করতে লাগল। শেষ পর্যন্ত এমনভাবে তাকে পায়ের নিচে পিষতে লাগল যে মাইকেল ডরস্কি একটা রক্তাক্ত পিণ্ডে পরিণত হল।

ধীরে ধীরে সে শান্ত হল। হেলে দুলে টারজনের পাশে এসে দাঁড়াল। তার কথামত টারজানকে পিঠের উপর তুলে নিয়ে জঙ্গলের মধ্যে চলে গেল।

গভীর বনে ঢুকে ট্যান্টর নরম ঘাসের উপর টারজানকে শুইয়ে দিল।

সেই সময় গাছের ডালে ডালে ঝুলতে ঝুলতে ছোট্ট নকিমাও সেখানে এসে উপস্থিত হল।

তাকে দেখে টারজান বলল, নিচে নেমে এস নকিমা; আমার হাতের বেড়ি খুলে দাও।

নকিমা ছোট ছোট দাঁত দিয়ে চামড়ার বেড়ি কেটে দিল। এবার সে নিজের পায়ের বেড়ি কেটে ফেলল।

এবার ট্যান্টর টারজানকে পিঠে তুলে নিল। নকিমাও মনিবের দেখাদেখি লাফিয়ে উঠল প্রথমে ট্যান্ট বের পিঠে, তারপর সেখান থেকে টারজনের কাঁধে।

তিন বন্ধু নিঃশব্দে এগিয়ে চলল। গাছের ছায়া দীর্ঘতর হতে লাগল। বনের আড়ালে সূর্য অস্ত গেল।

এইভাবে দিন কাটে। অসহায় কোল্ট শয্যাশায়ী। জাভেরি এগিয়ে চলেছে ইতালীয় সোমালিল্যান্ডের দিকে। মাথার ক্ষত সেরে যাওয়ায় টারজান চলেছে তাদেরই পথ ধরে।

এক সময় জাভেরির অগ্রগামী বাহিনীকে সে ধরে ফেলল। তখন রাত। শ্রান্ত লোকজনরা শিবিরে বসে আমোদ-ফুর্তি করছে। ব্যাপারটা যে জানে না তার মনে হবে এটা বুঝি ফরাসী উপনিবেশ রক্ষীবাহিনীর শিবির।

গাছের উপর বসে টারজান সবই দেখল। ধনুকে একটা তীর জুড়ল। ছিলায় টংকার দিয়ে তীরটা ছুঁড়ে দিল। সেটা গিয়ে বিধল একটি শাস্ত্রীর পায়ের গুলিতে। বিস্ময়ে ও বেদনায় চীৎকার করে সে মাটিতে পড়ে গেল। লোকজন এসে তাকে ঘিরে দাঁড়াল। সেই ফাঁকে টারজান জঙ্গলের অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।

ওদিকে আর একটা সেনাদলও চলেছে সেই জঙ্গলের পথ ধরে। সারাদিন হেঁটে রাতে তাদের অস্থায়ী শিবির পড়ল। আহারাদি শেষ করে শ’খানেক কালো সৈনিক ধুনির চারপাশে ইতস্তত শুয়ে বসে গল্প শুরু করল।

এমন সময় মাথার উপরকার গাছের ডাল থেকে একটি মূর্তি এসে নামল তাদের ঠিক মাঝখানে।

সঙ্গে সঙ্গে একশ’ সৈনিক লাফ দিয়ে অস্ত্র হাতে নিল; কিন্তু পরমুহূর্তেই সহজভাবে থেমে গিয়ে গলা ছেড়ে বলে উঠল, বাওয়ানা! বাওয়ানা।

যে কোন সম্রাট বা দেবতার সামনে তারা সকলেই নতজানু হল; যারা কাছে ছিল তারা শ্রদ্ধার সঙ্গে তার হাত-পা স্পর্শ করল। ওয়াজিরিদের কাছে টারজান তো শুধু রাজা নয়, সে যে তাদের জীবন্ত দেবতা।

টারজান বলল, খুব ভাল কাজ করেছ বাছারা। নকিমাও ঠিক মতই কাজটা করেছে। আমার চিঠিটা তোমাদের পৌঁছে দিয়েছে, আর যেখানে তোমাদের দেখা পাব বলে ভেবেছিলাম ঠিক সেখানেই তোমাদের পেয়ে গেলাম।

মুভিরো বলল, সব সময় আমরা নবাগতদের চাইতে একদিনের পথ এগিয়ে থাকি বাওয়ানা। শিবির। ফেলি ওদের পথ থেকে বেশ কিছুটা দূরে, যাতে আমাদের শিবির ওদের চোখে না পড়ে।

টারজান বলল, আগামীকাল আমরা এখানেই তাদের জন্য অপেক্ষা করব। আজ রাতে টারজান তোমাদের বুঝিয়ে বলবে তার পরিকল্পনার কথা।

পরদিন সকালে জাভেরির দলবল আবার যাত্রা শুরু করল। ঘণ্টাখানেক নির্বিঘ্নে কেটে গেল। হঠাৎ মাথার উপর থেকে একটি ভৌতিক কণ্ঠস্বর। বান্টু ভাষায় ঘোষণা করলঃ মুলুব, সন্তানরা, ফিরে যাও। যদি বাঁচতে চাও তো ফিরে যাও। আর বিলম্ব না করে সাদা মানুষদের সঙ্গ ত্যাগ কর।

জাভেরি বলল, ওটা কে? কি বলল?

আমাদের সতর্ক করে দিয়ে ফিরে যেতে বলল, কিটেম্বো জবাব দিল।

জাভেরি চমকে উঠল, ফেরা হবে না। যাই ঘটুক, আমরা এগিয়ে যাবই।

বিষণ্ণ মনে সকলে যার যার জায়গায় থেকে চলতে লাগল। সামনে অনেক দূর থেকে ভেসে এল সেই ভৌতিক কণ্ঠস্বর; সাদা মানুষদের সঙ্গ ত্যাগ কর।

জাভেরি ও জোরা ড্রিনভ পাশাপাশি হাঁটছিল। চোখ-মুখ খিঁচিয়ে বলল, ওই লোকটাকে যদি হাতের কাছে পেতাম তো এক গুলিতে

তার কথা শেষ হবার আগেই দলের পিছন দিকে আকাশ থেকে ভেসে এল সেই কণ্ঠস্বর ও সাদা মানুষদের সঙ্গ ত্যাগ কর।

ইতোমধ্যে গোটা দল জঙ্গল পার হয়ে একটা খোলা জায়গায় পড়েছে। সেখানে তারা মাথা-সমান উঁচু ঘাসের ভিতর দিয়ে চলতে লাগল। মাঝামাঝি পৌঁছবার পরেই গর্জে উঠল একটা রাইফেল। আর একটা। আরও একটা।

গুলি কারও গায়ে লাগে নি। তবু সেনাদলের মধ্যে হৈ-চৈ পড়ে গেল। দেখা দিল বিশৃংখলা।

আবার সামনে শোনা গেল সেই সতর্কবাণীঃ ফিরে যাও! এই শেষ সতক-বাণী। অমান্য করলে মৃত্যু অনিবার্য।

দলে ভাঙন দেখা দিল। রোমেরো গুলি করার হুকুম দিল। প্রত্যুত্তরে সামনের ঘাসের ভিতর থেকে গুলি চলল। এবার ডজনখানেক লোক পড়ে গেল– কেউ নিহত, কেউ আহত হল।

জাভেরির দলবল অনেক কষ্টে তাদের শেষ শিবিরে পৌঁছে গেল। কিন্তু রাত পর্যন্ত হিসেব করে দেখা গেল শতকরা পঁচিশজন তখনও নিখোঁজ; তাদের মধ্যে জোরা ও রোমেরোও আছে। একে একে যারাই শিবিরে এল তাদের প্রত্যেককে জাভেরি মেয়েটির কথা জিজ্ঞাসা করল, কিন্তু কেউ তাকে দেখেনি।

আরও একটু রাত হতেই দু’জন একসঙ্গে শিবিরে ঢুকল। তাদের দেখে জাভেরি যেমন স্বস্তি বোধ করল, তেমনি রাগও হল।

ধমক দিয়ে বলল, তোমরা আমার সঙ্গে থাকলে না কেন?

কারণ আমি তোমার মত ছুটতে পারি না, জোরা জবাব দিল। জাভেরি আর কিছুই বলল না।

শিবিরের উপরকার অন্ধকারের ভিতর থেকে ভেসে এল সেই পরিচিত সতর্কবাণী ও সাদা মানুষদের সঙ্গ ত্যাগ কর! তারপর দীর্ঘ নিস্তব্ধতা, মাঝে মাঝে কালা আদমিদের ফিসফিস্ আলোচনা। আবার সেই কণ্ঠস্বর ও তোমাদের দেশে ফিরে যাবার পথ সম্পূর্ণ বিপদমুক্ত, কিন্তু সাদা মানুষদের পিছনে হাঁটছে মৃত্যু। তোমাদের উর্দি ছুঁড়ে ফেলে দাও; সাদা মানুষদের ছেড়ে দাও জঙ্গলে ও আমার হাতে।

একটি কালা সৈনিক শরীর থেকে ফরাসী উর্দি খুলে ফেলে উনুনের আগুনে ছুঁড়ে ফেলে দিল। সঙ্গে সঙ্গে অন্যরাও তাই করতে লাগল।

থাম! জাভেরি চীৎকার করে বলল।

চুপ কর সাদা মানুষ! পাল্টা গর্জে উঠল কিটেম্বো।

সাদাদের মেরে ফেল! জনৈক বাসেম্বো সৈনিক চীৎকার করে বলল।

সবাই ছুটল সাদা মানুষদের লক্ষ্য করে। উপর থেকে আবার ভেসে এল সতর্কবাণী ও সাদা মানুষরা আমার লোক। তাদের আমার হাতেই ছেড়ে দাও।

সঙ্গে সঙ্গে সৈনিকরা থেমে গেল। জাভেরি রাগে ঘরময় পায়চারি করতে লাগল। সব্বাইকে গালাগালি করে বলল, আমাকে কেউ সাহায্য করলে এ রকমটা ঘটত না। কিন্তু আমি একা তো সব কাজে করতে পারি না।

এ কাজটা তো তুমি একাই করেছ, রোমেরো বলল।

কি বলতে চাও তুমি?

আমি বলতে চাই, একটা উদ্ধত গাধার মত কাজ করে তুমি সব্বাইকে শক্ত করে তুলেছ। তবু তোমার সাহসের উপর ভরসা থাকলে তারা তোমার সঙ্গেই চলত। একটা ভীরুকে অনুসরণ করতে কেউ চায় না।

তোমার এতদূর স্পর্ধা! চীৎকার করে উঠে জাভেরি রিভলবারে হাত দিল।

জোরা বলে উঠল, এ সব কি পাগলামি হচ্ছে। একদল উচ্ছল কালা আদমির মধ্যে আমরা মাত্র পাঁচজন। কাল তারাও আমাদের ছেড়ে চলে যাবে। আমরা যদি প্রাণ নিয়ে আফ্রিকা থেকে ফিরে যেতে চাই তাহলে আমাদের একসঙ্গে চলতে হবে। নিজেদের ঝগড়া ভুলে যাও; সকলের মুক্তির জন্য একযোগে কাজ কর।

বাকি রাতটা সুখে না হোক নির্বিঘ্নেই কাটল। সকালে দেখা গেল, সব কালা আদমি গা থেকে ফরাসী উর্দি খুলে ফেলেছে। পাতার আড়ালে লুকিয়ে থাকা অন্য একজনের সহাস্য চোখেও সে দৃশ্য দেখল। কোন কালো ছোকরা সাদা মানুষদের সেবা করতে এল না। তারা নিজেরাই প্রাতরাশ তৈরি করল।

কালা আদমিরা যার যার গাঠরি কাঁধে ফেলে শিবির থেকে বেরিয়ে পশ্চিম দিকে যাত্রা করল। তাদের যাত্রাপথের দিকে তাকিয়ে সাদা মানুষগুলো চুপচাপ বসে রইল।

পরদিন সকালে পাঁচ শ্বেতমূর্তি ফিরে চলল তাদের মূল শিবিরে।

আর ঠিক একদিনের পথ আগে থেকে অন্য এক সোজা পথে টারজান ও তার ওয়াজিরি সেনারা চলল। ওপার-এর দিকে।

টারজান মুভিরোকে বলল, লা হয়তো সেখানে নেই। কিন্তু ওআ ও ডুথকে আমি শান্তি দিতে চাই যাতে লা বেঁচে থাকলে একদিন না একদিন ওপার-এ ফিরে গিয়ে প্রধান সন্যাসিণীর গদিতে বসতে পারে।

বহু মাইল দূরে তাদের এই বন্ধুটি জঙ্গলের মধ্যে একটা ভোলা জায়গায় গিয়ে পৌঁছল। এক সময় সেখানে একটা বড় শিবির ছিল; এখন কয়েকটা ঝুপড়িতে কিছু কালা আদমি থাকে।

তার পাশাপাশি হাঁটছে ওয়েনি কোল্ট। এতদিনে সে বেশ সুস্থ হয়ে উঠেছে। তাদের পিছনে চলেছে সোনালী সিংহ জান্-বা-জা।

কোল্ট বলল, শেষ পর্যন্ত খুঁজে পেলাম। তোমাকে ধন্যবাদ।

লা বলল, ভালই হল। এবার তোমার কাছ থেকে বিদায় নেব। তার গলায় বেদনার সুর।

কোল্ট বলল, বিদায় কথাটা আমার ভাল লাগে না।

একটি নারী ও একটি পশু পাশাপাশি চলে গেল ওপার-এর পথে। সেদিকে তাকিয়ে কোল্টের গলায় কি যেন আটকে আসতে লাগল। দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে শিবিরে ফিরে গেল। কালো মানুষগুলো দুপুরের রোদেও ঘুমিয়ে আছে। তাদের ডেকে তুলল। কোল্টকে দেখে তারা তো হতবাক। তারা যে ধরেই নিয়েছিল সে মারা গেছে।

ওপার-এর প্রান্তরে বিধ্বস্ত নগরীর দিকে হাঁটছে একজন নারী ও একটা সিংহ। তাদের পিছনে খাড়ির। উঁচু মাথায় দাঁড়িয়ে তাদের দিকেই লক্ষ্য রেখেছে আর একজন মানুষ। তার পিছনে একশ’ সৈনিক পাহাড়ের উত্রাই বেয়ে উপরে উঠছে। তারা এসে পাশে দাঁড়াতেই দীর্ঘদেহ মানুষটি আঙ্গুল বাড়িয়ে বলল, লা!

আর নুমাও, মুভিরো বলল। সে পিছন পিছন হাঁটছে কী আশ্চর্য বাওয়ানা, সে কিন্তু আক্রমণ করছে না।

টারজান বলল, আক্রমণ করবে না। ও যে জাবাল-জা।

পিছনের হৈ-চৈ-এর শব্দ প্রথমে জাদু-বাল-জার কানেই ধরা পড়ল। থেমে সে মুখ ফেরাল। মাথাটা তুলল। কান খাড়া করল। নাক কুঁচকাল। তারপরই গাঁ-গাঁ করে ডেকে উঠল। লা দাঁড়িয়ে পিছন ফিরল। একটি অগ্রসরমান সেনাদলকে দেখে সে হতাশায় ভেঙে পড়ল।

দলটা এগিয়েই আসছে। হঠাৎ লা-র নজরে এল, যে লোকটি সকলের আগে আগে আসছে তার গায়ের রং ফর্সা। সে চিনতে পেরেছে। চীৎকার কলে বলল, ওই তো টারজান! জান্-বা-জা, ওই তো টারজান।

হয়তো জাদ-বাল-জাও মনিবকে চিনতে পারল। একছুটে এগিয়ে গেল। টারজনের সামনে গিয়ে খাড়া হয়ে দাঁড়াল। তার কাঁধে দুই থাবা রেখে আদর করে গালটা চাটতে লাগল। তাকে একপাশে সরিয়ে দিয়ে টারজান লা-র দিকে এগিয়ে গেল।

মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল, শেষ পর্যন্ত

লা বলল, হ্যাঁ, শেষ পর্যন্ত তুমি শিকার করে ফিরে এলে।

টারজান বলল, আমি তখনই ফিরেছিলাম, কিন্তু তুমিই চলে গিয়েছিলে।

তুমি ফিরে এসেছিলে? তা যদি জানতাম তাহলে তো আমি অনন্তকাল সেখানেই অপেক্ষা করে থাকতাম।

টারজান সস্নেহে লা-র কাঁধে হাত রাখল। অস্ফুট স্বরে বলল, সেই চিরকালের লা! তারপরই কি যেন মনে পড়তে ওপার-এর দিকে মুখ ফিরিয়ে বলে উঠল, চল। রানী এবার ফিরে যাবে তার সিংহাসনে।

ওপার-এর অদৃশ্য চোখগুলো অগ্রসরমান দলটিকে দেখতে পেল। লা, টারজান ও ওয়াজিরিদের তারা চিনতে পারল। অনেকে জান্-বা-জাকেও চিনল। ওআ ভয় পেল। ডুথ কাঁপতে লাগল। ছোট নাও এর বুক খুশিতে ভরে উঠল।

অভিযাত্রীরা বহিঃপ্রাচীরের প্রাঙ্গণে ঢুকল। একটি প্রাণীও তাদের বাধা দিল না। দরবার-কক্ষে ঢুকে যে দৃশ্য তাদের চোখে পড়ল তাতেই সব কিছু পরিষ্কার হয়ে গেল। রক্তাল্পত অবস্থায় পড়ে আছে ওআ ও ডুথ-এর মৃতদেহ; পাশেই ছ’টি সন্ন্যাসী ও সন্ন্যাসিনীর মৃতদেহ। আর কেউ কোথাও নেই।

অগ্নি-দেবতার প্রধান সন্ন্যাসিনী লা আর একবার ওপার-এর রানী হয়ে সিংহাসনে বসল।

সেদিন রাতে অরণ্যরাজ টারজান ওপার-এর সোনার থালায় আহার্য গ্রহণ করল। সুন্দরী তরুণীরা। পরিবেশন করল মাংস, ফল ও অমৃতস্বাদ দ্রাক্ষারস।

পরদিন সকালে অরণ্যরাজ ফিরে চলল দলবল নিয়ে। তার কাঁধের উপর ছোট্ট নকিমা, পাশে সোনালী সিংহ, আর পিছনে একশ’ ওয়াজিরি সৈন্য।

দীর্ঘ একঘেয়ে পথ চলার পর সাদা মানুষদের ক্লান্ত অবসন্ন দলটা তাদের মূল শিবিরে ফিরে এল। সকলের আগেই জাভেরি ও আইভিচ, তাদের পিছনে জোরা ড্রিনভ, বেশ কিছুটা দূরে পাশাপাশি রোমেরা ও মোরি। এই ভাবেই দীর্ঘ পথ তারা পার হয়ে এসেছে।

তাদের আসতে দেখে কোল্ট এগিয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে যেন জ্বলে উঠল জাভেরি। চীৎকার করে বলল, বিশ্বাসঘাতক! তোমাকে শেষ করাই আমার জীবনের শেষ কাজ। রিভলবার বের করে নিরস্ত্র কোল্টকে লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়ল।

প্রথম গুলিটা কোল্টের গা ঘেসড়ে বেরিয়ে গেল। কিন্তু দ্বিতীয়বার গুলি করার সময় আর জাভেরি পেল না। তার পিছন থেকে গর্জে উঠল আর একটা আগ্নেয়াস্ত্র। পিটার জাভেরির হাত থেকে পিস্তলটা পড়ে গেল। এক হাতে পিঠ চেপে ধরে সে মাতালের মত টলতে লাগল।

আইভিচ বিদ্যুৎগতিতে ঘুরে দাঁড়াল। হা ভগবান, এ তুমি কী করলে জোরা?

জোরা বলল, যা করতে বারো বছর অপেক্ষা করেছিলাম। শৈশব পার হবার পর থেকেই যে কাজটি করার জন্য বেঁচে আছি।

ওয়েনি কোল্ট ছুটে গিয়ে জাভেরির রিভলবারটা মাটি থেকে তুলে নিল। ততক্ষণে রোমেরো ও মোরিও ছুটে এসেছে।

মাটিতে লুটিয়ে পড়ে জাভেরি হিংস্র চোখে চারদিক তাকাতে তাকাতে বলল, কে? কে আমাকে গুলি করল?

আমি, জোরা ড্রিনভ বলল।

তুমি! জাভেরি ঢোক গিলল।

হঠাৎ ওয়েনি কোল্টের দিকে ফিরে জোরা বলতে লাগল, সব কথা তোমার জানা দরকার। আমি কম্যুনিস্ট নই, কোনো দিন ছিলাম না। এই লোকটা আমার বাবাকে, মাকে আর দাদা ও দিদিকে খুন করেছে। আমার বাবা ছিল–কিন্তু সে কথা থাক। এতদিনে তার মৃত্যুর প্রতিশোধ নিলাম। তীব্র দৃষ্টিতে জাভেরির দিকে তাকিয়ে বলল, গত কয়েক বছরে অনেকবারই তোমাকে মারতে পারতম, কিন্তু মারিনি। কারণ তোমার জীবনের চাইতেও বেশি কিছু আমি চেয়েছিলাম। গোটা বিশ্বের সুখ-শান্তিকে ধ্বংস করার যে জঘন্য পরিকল্পনা তুমি এবং তোমার মত লোকেরা করেছিল, আমি চেয়েছিলাম সেটাকে ব্যর্থ করার কাজে সাহায্য করতে।

পিটার জাভেরি উঠে বসল। বিস্ফারিত চোখ দুটি চকচক করছে। হঠাৎ সে খক- খক্ করে কাসল। মুখ দিয়ে ঝলকে ঝলকে রক্ত উঠতে লাগল। তার পরই সে ঢলে পড়ল মৃত্যুর কোলে।

খোলা জায়গাটার ওপারে জঙ্গলের প্রান্তে এসে দাঁড়াল একটি মূর্তি। নিঃশব্দে সে যেন আকাশ থেকে মেনে এসেছে। জোরা ড্রিনভই তাকে প্রথম দেখতে পেল। চিতার চামড়ার লেংটি-পরা একটি সাদা মানুষ এগিয়ে আসছে। তার চলনে সিংহের সাবলীল গতি-ভঙ্গী।

ও কে? কোল্ট প্রশ্ন করল।

জোরা বলল, কে তা জানি না, তবে এটুকু জানি যে জঙ্গলে পথ হারিয়ে ফেললে সেই আমার প্রাণরক্ষা করেছিল।

লোকটি সামনে এসে দাঁড়াল।

কে তুমি? ওয়েনি কোল্ট শুধাল।

আমি অরণ্যরাজ টারজান। এখানে যা কিছু ঘটেছে সব আমি দেখেছি, শুনেছি। জাভেরির মৃতদেহ দেখিয়ে বলল, ওই লোকটা যে মতলব কেঁদেছিল তা ভেস্তে গেছে, সেও মারা গেছে। এই মেয়েটি নিজেই বলেছে সে তোমাদের কেউ নয়। একে আমি সঙ্গে নিয়ে যাব; যে যাতে সভ্য জগতে ফিরে যেতে পারে তার ব্যবস্থা করব। তোমরা আর যারা আছ তাদের জন্য আমার কোন সহানুভূতি নেই। তোমরা জঙ্গল থেকে চলে যেতে পার। আমার কথা শেষ।

কিন্তু এই মার্কিন ভদ্রলোক ওদের সঙ্গে যাবে না, জোরা বলল।

যাবে না? কেন? টারজান জানতে চাইল।

কারণ সে যুক্তরাষ্ট্র সরকার কর্তৃক নিযুক্ত একজন স্পেশ্যাল এজেন্ট।

সকলেই সবিস্ময়ে জোরার দিকে তাকাল।

কোল্ট বলল, এ কথা তুমি কেমন করে জানলে?

শিবিরে এসে প্রথম যে চিঠিটা তুমি পাঠিয়েছিলে সেটা জাভেরির একজন লোকের হাতে পড়েছিল। এখন বুঝতে পারলে?

হা।

সেই জন্যই জাভেরি তোমাকে বিশ্বাসঘাতক ভেবে খুন করতে চেয়েছিল।

কালা আদমিরা এসে ভিড় করে দাঁড়িয়েছিল। তাদের ভাষায় টারজান বলল, তোমাদের দেশ আমি চিনি। উপকূলে যাবার রেল পথের শেষে সে দেশ অবস্থিত।

তাদের একজন বলল, ঠিক বলেছ হুজুর।

রেলপথের শেষ পর্যন্ত এই সাদা মানুষটিকে তোমার সঙ্গে নিয়ে যাও। আর খাবার ব্যবস্থা করে দিও। আর কোন রকম ক্ষতি করো না। তারপর তোমাদের দেশ থেকে তাকে চলে যেতে বলল। তারপর সাদা মানুষদের দিকে ফিরে বলল, আপাতত তোমরা আমার সঙ্গে শিবিরেই চুল।

সকলে ফিরে চলল। অন্যদের থেকে একটু পিছিয়ে পড়ে পাশাপাশি হাঁটতে লাগল জোরা ড্রিনভ ও ওয়েনি কোল্ট।

জোরা বলল, আমি তো ভেবেছিলাম তুমি মরে গেছ।

আমি তো ভাবছিলাম তুমি মরে গেছ, কোল্ট বলল।

জোরা আবার বলল, আর সবচাইতে দুঃসংবাদ কি জান, জীবিত বা মৃত কোন অবস্থাতেই আমার মনের কথাটি তোমাকে বলতে পারব না।

কোল্ট নিচু গলায় বলল, আর আমি ভেবেছিলাম, তোমার-আমার মধ্যে যে ব্যবধান তার একটা সেতু গড়ে তুলতে যে প্রশ্নটা তোমাকে করতে চাই তা কোন দিন করা হবে না।

জোরা ঘুরে দাঁড়াল। দুই চোখ জলে ভরা। ঠোঁট কাঁপছে। বলল, আর আমি ভাবছিলাম, জীবিত বা মৃত কোন অবস্থাতেই তোমার সে প্রশ্নের জবাবে কোন দিন হ্যাঁ বলতে পারব না।

একটা বাঁক ঘুরে তারা সকলের দৃষ্টির অন্তরালে চলে গেল।

চিতা-মানুষের দেশে চারজন (টারজান এণ্ড দি লিওপার্ড মেন)

মেয়েটি অস্বস্তির সঙ্গে বিছানায় পাশ ফিরল। বাতাসের বেগে পেট-মোটা মাছিগুলো সশব্দে তাঁবুর চাদোয়ার উপর আছড়ে পড়ছে। খোটায় টান লেগে তাঁবুর দড়িগুলো কডুকডু শব্দ করছে। খোলা পর্দাগুলো বাতাসে উড়ছে। তবু ঘুমন্ত মানুষটি পুরো জাগল না। সারাদিন অনেক ধকল গেছে। ভাপসা জঙ্গলের ভিতর দিয়ে একঘেঁয়ে দীর্ঘ পদযাত্রায় সে ক্লান্ত। শুধু একদিন তো নয়, অনেক দূর অতীতে যেদিন সে রেলের পথ ছেড়ে এসেছে তারপর থেকেই চলেছে এই একটানা পথ চলা।

না জানি কি অনিবার্য প্রয়োজন তাকে এই পথে নিয়ে এসেছে! বিলাস ও স্বাচ্ছন্দ্যের পথ ছেড়ে কোন্ প্রয়োজনে সে এসেছে এই আদিম অরণ্যে; বিপদ, রোদ-বৃষ্টি ও ক্লান্তির এই অনভ্যস্ত জীবনে? কেন সে এসেছে?

এই প্রচণ্ড ঝড়ের রাতে একটিমাত্র আস্কারি প্রহরী ঘুম-ঘুম চোখে জেগে আছে। দুটি প্রাণী ছাড়া তাঁবুর অন্য সকলেই ঘুমিয়ে আছে। বিশাল বপু আদিবাসীটি চুপি চুপি এগিয়ে চলেছে ঘুমন্ত মেয়েটির তাঁবুর দিকে।

মেয়েটির ঘুম ভেঙ্গে গেল। বিদ্যুতের আলোয় দেখতে পেল, একটা লোক তাঁবুতে ঢুকল। সর্দার গোলাটোর বিশাল দেহকে চিনতে তার ভুল হল না। কনুইতে ভর দিয়ে পাশ ফিরে প্রশ্ন করল, কিছু কি গোলমাল হয়েছে গোলাটো? কি চাও তুমি?

লোকটি চাপা গলায় জবাব দিল, তোমাকে চাই কালি বাওয়ানা।

তাহলে শেষ পর্যন্ত তাই ঘটল। দু’দিন যাবৎ এই ভয়ই সে করছিল। দলের অন্য সকলের মুখেই সে দেখেছে চাপা ঘৃণার প্রকাশ। সেই একই ঘৃণা ফুটে উঠেছে এই লোকটির চোখে।

খাটিয়ার পাশে রাখা খাপ থেকে রিভলবারটা বের করে মেয়েটি বলল, বেরিয়ে যাও; নইলে তোমাকে মেরে ফেলব।

লোকটি এক লাফে তার দিকে এগিয়ে এল। মেয়েটি গুলি ছুঁড়ল।

একটা প্রকাণ্ড গাছের নিচে আশ্রয় নিয়ে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে আছে একটি মানুষ। তার এক বগলে শীতে কুঁকড়ে গায়ের সঙ্গে কি একটা যেন লেপটে রয়েছে। লোকটি মাঝে মাঝে তার সঙ্গে কথা বলছে; অন্য হাত দিয়ে আদর করছে। দেখে মনে হয় তার ছেলে বুঝি। কিন্তু তা নয়, একটা ছোট বানর। বাতাসের প্রতিটি ঝাঁপটা, বিদ্যুতের প্রতিটি ঝলকানি, আর বর্জ্যের প্রতিটি হুংকারের সঙ্গে সঙ্গে সে কেঁপে কেঁপে আরও কুঁকড়ে যাচ্ছে। হঠাৎ ঝড়ের দাপট চরমে উঠল। যে গাছের নিচে তারা আশ্রয় নিয়েছিল সেটা ভেঙে পড়ল। বিড়ালের মত লোকটা এক পাশে লাফিয়ে পড়ল। বানরটা ছিটকে পড়ল বেশ খানিকটা দূরে। কিন্তু একটা মোটা ডাল এসে লাগল লোকটার মাথায়; সে মাটিতে পড়ে গেল; ডালটা তাকে মাটিতে পুঁতে ফেলল।

ঝড় থেমে গেল। বানরটা মনিবকে ডেকে ডেকে অনেক খুঁজল। অন্ধকারে ভাল দেখা যায় না। তারই মধ্যে এক সময় গাছের নিচে খুঁজে পেল মনিবকে, নিশ্চল ও নিষ্প্রাণ।

কিল্লু গ্রামের ছোট দলটির প্রাণ-পুরুষ ছিল নিয়ামওয়েগি। নিজের গ্রাম টুম্বাই থেকে সে সেখানে গিয়েছিল একটি কৃষ্ণা সুন্দরীর পানি গ্রহণ করতে। মনের ফুর্তিতে চলতে চলতে খেয়ালই ছিল না; হঠাৎ এক সময় নেমে এল নিরক্ষবৃত্তাঞ্চলের রাত।

সৈনিকটি নিঃশব্দ পদক্ষেপে টুম্বাইয়ের পরিচিত পথ ধরে চলতে লাগল। সঙ্গে বর্শা ও ঢাল; কোমরে ঝুলছে লম্বা ছুরি। তার গলার তাবিজটা অনেক শক্তি ধরে। মাঝে মাঝেই সেটাতে আঙুল ঝুলিয়ে সে। তার কূল-দেবতা মুজিমোর স্তব করছে।

অর্ধেক পথ পার হবার পরেই হঠাৎ পিছন থেকে কে যেন তাকে আক্রমণ করল। তার ধারালো নখর বসে গেল তার কাঁধের মাংসের মধ্যে। যন্ত্রণায় ও আতংকে আর্তনাদ করে দ্রুত ঘুরে দাঁড়িয়ে আক্রমণকারীদের হাত থেকে নিজেকে মুক্ত করার চেষ্টা করল। কাঁধের উপর থেকে থাবাটা সরিয়ে ছুরিটা বের করতেই আবার বিদ্যুৎ ঝলকে উঠল, আর সেই আলোয় তার চোখে পড়ল চিতাবাঘের মুখোশে ঢাকা একটা মানুষের বীভৎস মুখ।

নিয়ামওয়েগি অন্ধকারেই আবোল-তাবোল ছুরি চালাতে লাগল; সেই লোকটি পুনরায় পিছন থেকে নখর বসিয়ে দিল তার বুকে ও পেটে; পিছন থেকে সে তাকে জড়িয়ে ধরেছে লোমশ হাত দিয়ে। আবার ঝলসে উঠল বিদ্যুৎ। যে তাকে জড়িয়ে ধরেছে তাকে নিয়ামওয়েগি দেখতে পেল না, কিন্তু দেখতে পেল আরও তিনজনকে-একজন তার সামনের আর দু’জন দুই পাশে। এবার সে আশা ছেড়ে দিল; আক্রমণকারীদের সে চিনতে পেরেছে; চিতাবাঘের চামড়া ও মুখোশপরা এই লোকগুলো চিতা-মানুষদের গুপ্ত সংঘের সদস্য।

এইভাবে উটেনগান নিয়ামওয়েগির মৃত্যু হল।

ঊষার আলো পড়েছে গাছের মাথায়। নিচে টুম্বাই গ্রামের খড়ের ঘরে ঘুম ভাঙল গ্রাম-প্রধানের ছেলে ওরান্ডোর। খড়ের বিছানা ছেড়ে সে বাইরে এসে পথের উপর দাঁড়ালো। যে কূলদেবতার নামে তার নাম রাখা হয়েছে দুই হাত তুলে সেই মুজিমোর উদ্দেশ্যে প্রণাম জানাল।

যে পথ ধরে ওরান্ডো একাকি শিকারে চলল দুই মাইল পর্যন্ত সেটা কিন্তু গ্রামে যাবারও পথ। পরিচিত পথ, কিন্তু আগের রাতের ঝড়ে পথের এত ক্ষতি হয়েছে যে অনেক জায়গায় সে পথে চলাই দুষ্কর। পথের উপর গাছপালা পড়ে থাকায় পথের পাশের ঝোপের ভিতর দিয়ে ঘুরে যাবার পথে একবার তার চোখে পড়ল, একটা ভূপাতিত গাছের ডালপাতার নিচে থেকে মানুষের একটা পা বেরিয়ে আছে।

ওরান্ডো থামল। একটু পিছিয়ে এল। মানুষটা যেখানে পড়ে আছে সেখানকার ডালপালাগুলো নড়ে উঠল। সেখান থেকে মাথা বের করল একটা ছোট্ট বানর।

ওরান্ডোকে দেখে ভয় পেয়ে বানরটা কিচির-মিচির করতে করতে ছুটে গিয়ে একটা বড় গাছের ডালে উঠে পড়ল। ওরান্ডো তার দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে পায়ের দিকেই নজর দিল। সাবধানে অগ্রসর হয়ে ঝুঁকে পড়ে বাকি দেহটা দেখতে চেষ্টা করল।

দৈত্য বিশেষ একটি সাদা মানুষ: চিতাবাঘের চামড়ার কটি-বন্ধনী ছাড়া প্রায় নগ্নদেহ; গাছের একটা ভারী ডালের নিচে চাপা পড়ে আছে। দুটি ধূসর চোখের দৃষ্টি তার উপর নিবদ্ধ; লোকটি মারা যায়নি।

একটা ছোট ডালের নিচে সে চাপা পড়ে আছে। ওরান্ডো ডালটাকে একটু তুলে ধরতেই লোকটি ধীরে ধীরে উটে দাঁড়াল। দু’জনে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। ছোট বানরটা গাছের ডালে নিরাপদ দূরত্বে বসে মুখ ভেংচে কিচির-মিচির করতে লাগল।

কাজটা ভাল হল কি মন্দ হল বুঝতে না পেরে ওরান্ডো বর্শাটা হাতে নিয়ে নবাগতকে ভাল করে দেখতে লাগল। নবাগতও গাছটার নিচে থেকে ধনুক ও বর্শা তুলে নিল। তার কাঁধে তীরভর্তি তূণীর। অন্য কাঁধে একটা লম্বা, পাকানো দড়ি। কোমরে খাপে ঢাকা ছুরি।

ওরান্ডো কিস্তু গ্রামের পথ ধরেই এগিয়ে চলল। পিছনে নিঃশব্দ পায়ে চলল নবাগত লোকটি। চলতে চলতে আর একটা বানরের গলা শুনে পিছনে ফিরে তাকিয়ে ওন্ডো দেখল, বানরটা বসে আছে লোকটার কাঁধে, আর দু’জনে অনবরত কথা বলে চলেছে বানরদের ভাষায়।

অবাক কাণ্ড! এ কেমন ধারার লোক যে ভয় কাকে বলে জানে না, যে বানরদের ভাষায় কথা বলতে পারে। প্রশ্নটা মনে আসতেই আর একটা অস্বস্তিকর প্রশ্ন জাগল তার মনেঃ এই জীবটি মানুষ তো?

পথের একটা বাঁক ঘুরতেই একটা ভয়াবহ দৃশ্য দেখে ওরান্ডোর চিন্তায় বাধা পড়ল। তার চোখের সামনে পড়ে আছে একটি সৈনিকের বিকৃত মৃতদেহ। বন্ধু ও সহকর্মী নিয়ামওয়েগিকে চিনতে বিলম্ব হল না। কিন্তু কেমন করে তার মৃত্যু হল।

নবাগত লোকটি এসে তার পাশে দাঁড়াল। নিচু হয়ে মৃত্যুদেহটাকে ভাল করে পরীক্ষা করতে সেটাকে উল্টে দিতে চোখে পড়ল মুখময় ইস্পাত-নখরের নির্মম আঘাতের চিহ্নগুলো।

নিরুত্তাপ গলায় সে শুধু বলল, চিতা-মানুষের কাজ।

কিন্তু ওরান্ডো তখন থরথর করে কাঁপছে। বন্ধুর মৃতদেহটা দেখামাত্রই চিতা-মানুষদের কথা তার মনে হয়েছিল। এই নৃশংস গুপ্ত সমিতির ভীতি বাসা বেঁধে আছে তার মনের গভীরে। তাদের রহস্যময় নরহন্তারক ধর্মীয় অনুষ্ঠান আরও বেশি ভয়ংকর এই কারণে যে তাদের সংঘবহির্ভূত কোন মানুষ সে সব কখনও চোখে দেখে নি, বা দেখলে আর বেঁচে থাকে নি।

মৃতদেহটাকে সেই একইভাবে বিকৃত করা হয়েছে; নরমেধ যজ্ঞের জন্য দেহের কতকগুলো বিশেষ অঙ্গকে কেটে নিয়েছে। ওরান্ডো শিউরে উঠল; কিন্তু সে শিহরণ যত না ভয়ের, তার চাইতে বেশি ক্রোধের। নিয়ামওয়েগি তার বন্ধু। শৈশব থেকে দু’জন এক সঙ্গে বড় হয়েছে। এই পৈশাচিক আক্রমণ যারা হেনেছে তাদের বিরুদ্ধে প্রতিহিংসা সাধনের জন্য তার আত্মা চীৎকার করে উঠল। কিন্তু অনেকের বিরুদ্ধে সে একা কি করবে? নরম মাটিতে অনেক পায়ের ছাপ দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে অনেকে মিলে তাকে হত্যা করেছে।

নবাগত লোকটি বর্শায় ভর রেখে নিঃশব্দে সৈনিকটিকে দেখছিল- দেখছিল তার মুখের শোক ও ক্রোধের প্রকাশ। বলল, তুমি একে চিনতে?

আমার বন্ধু।

নবাগত কোন কথা বলল না; দক্ষিণের পথে পা বাড়াল।

ওরান্ডো তাকে অনুসরণ করে বলল, কোথায় যাচ্ছ?

যারা তোমার বন্ধুকে মেরেছে তাদের শাস্তি দিতে।

ওরান্ডো প্রতিবাদ করে বলল, তারা সংখ্যায় অনেক; আমাদেরই মেরে ফেলবে।

নবাগত জবাব দিল, তারা চারজন। আমিই মারতে পারব।

তারা যে চারজন তা জানলে কেমন করে?

পায়ের কাছের পথটা দেখিয়ে নবাগত বলল, একজন বৃদ্ধ খুঁড়িয়ে হাঁটে; একজন ঢ্যাঙা ও সরু; অপর দু’জন যুবক সৈনিক। তারা হাঁটে হাল্কা পায়ে, যদিও একজনের শরীর বেশ ভারী।

তুমি তাদের দেখেছ?

তাদের পায়ের ছাপ দেখেছি; সেটাই যথেষ্ট।

কথাগুলো ওরান্ডোর মনে ধরল। লোকটা পথের হদিস বোঝে বটে। আর দ্বিধা নয়। যা থাকে কপালে, ওর সঙ্গেই সে যাবে।

বলল, অন্তত ওরা কোন গ্রামে ফিরে গেল সেটা তো জেনে আসতে পারব। আমার বাবা টুম্বাই গ্রামের সর্দার। সারা ওয়াটেঙ্গা দেশে সে হরকরা পাঠাবে; যুদ্ধের ঢাক বেজে উঠবে; উটেঙ্গা যোদ্ধারা দলে। দলে আসবে। তখন আমরা চিতা-মানুষদের গ্রাম আক্রমণ করে নিয়ামওয়েগির রক্তের প্রতিশোধ নেব।

দু’জনে পথ চলতে লাগল। এক সময় ওরান্ডোর মনে হল, তার সঙ্গীটি কোন সাধারণ মানুষ নয়; অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী। বিদ্যুৎ-চমকের মত সহসা একটা নতুন চিন্তা তার মনে দেখা দিল : যে পরলোকগত পূর্বপুরুষের নামে তার নামকরণ হয়েছে তার আত্মাই বুঝি এসে দেখা দিয়েছে। এই নবাগতের রূপ ধরে-এই লোকটিই তার মুজিমো। তাছাড়া মুজিমোর কাঁধের উপরকার ছোট বানরটিও একটি আত্মা। হয়তো বা নিয়ামওয়েগির যেমন সারা জীবনের বন্ধু ছিল, তেমনি এরা দু’জনও খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু।

সে ডাকল, মুজিমো!

নবাগত মুখ ফিরিয়ে চারদিকে তাকিয়ে বলল, তুমি মুজিমোকে ডাকলে কেন?

ওরান্ডো জবাব দিল, আমি তোমাকেই ডেকেছি মুজিমো।

মুজিমো বলে?

হ্যাঁ।

তুমি কি চাও?

ওরান্ডো বুঝল, সে ভুল করে নি; এই তো তার মুজিমো।

তুমি আমাকে ডাকছিলে কেন?

কোন জবাব খুঁজে না পেয়ে ওরান্ডো শুধাল, আমরা কি চিতা-মানুষদের কাছাকাছি পৌঁছে গেছি মুজিমোঃ

আমরা সেই দিকেই চলেছি। এক কাজ করা যাক। গাছের ডালে ডালে ঝুলতে ঝুলতে যাওয়া যাক। চলে এস।

বলেই একটা বড় গাছের ডাল ধরে সে ঝুলে পড়ল।

ওরান্ডো চেঁচিয়ে বলল, দাঁড়াও। আমি তো গাছে-গাছে চলতে পারব না।

তাহলে হেঁটেই এস। আমি এগিয়ে গিয়ে চিতা-মানুষদের ধরে ফেলব।

ওরান্ডোকে আর কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়েই বানরটাকে কাঁধে নিয়ে নবাগত লোকটি মুহূর্তের মধ্যে গাছপালার আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেল। সবিস্ময়ে তার কথা ভাবতে ভাবতেই ওরান্ডো পায়ে হেঁটে এগোতে লাগল।

সে যদি আরও বেশি সতর্ক থাকত তাহলেই বুঝতে পারত যে চার জোড়া হিংস্র লোলুপ চোখে গাছ পালার আড়াল থেকে তার উপর নজর রেখে চলেছে। যেই সে ভোলা জায়গাটার মাঝখানে পৌঁছে গেল অমনি ভয়ঙ্কর চীৎকার করতে করতে বীভৎসভাবে সজ্জিত চারজন সৈনিক লাফিয়ে পড়ে তার দিকে ছুটে এল।

লোবোঙ্গোর ছেলে ওরান্ডো আগে কখনও চিতা-মানুষদের সংঘের ভয়ঙ্কর কোন সদস্যকে চোখে দেখে নি; তবু এই চারজনকে চিনতে তার কোন অসুবিধা হল না। তখন তারা চারদিক থেকে তাকে ঘিরে ফেলেছে।

মেয়েটি গুলি ছুঁড়তেই গোলাটো যন্ত্রণায় চীৎকার করে উঠল; ডান হাতের কনুইয়ের উপরটা বাঁ হাতে চেপে ধরে ছুটে তাঁবু থেকে বেরিয়ে গেল। কালি বাওয়ানা উঠে পোশাক পরল, খাপে-ঢাকা পিস্তলসহ কার্তুজের বেল্টটা বেঁধে নিল।

লণ্ঠনটা জ্বেলে চেয়ারে বসল; রাইফেলটাকে পাশে রাখল। বাকি রাতটা জেগেই পাহারা দেবে। কিন্তু সে রাতে আর কিছুই ঘটল না। এক সময় সে তন্দ্রায় ঢলে পড়ল।

যখন ঘুম ভাঙল তখন ঘণ্টাখানেক মত বেলা হয়েছে। ঝড় থেমে গেছে, কিন্তু তাঁবুর চারদিকে ছড়িয়ে রয়েছে তার চিহ্ন। তাবুর দরজার কাছে এগিয়ে মেয়েটি তার চাকরকে ডেকে স্নানের জল ও প্রাতরাশ দিতে বলল। দেখল, কুলিরা বাধা-ছাদা করছে। ব্যান্ডেজ-বাঁধা হাতটা গলার সঙ্গে ঝুলিয়ে গোলাটো ঘুরে বেড়াচ্ছে।

কুলিরা মালপত্র বেঁধে যাত্রার আয়োজন করছে, অথচ সে তো যাত্রার হুকুম জারি করে নি।

এগিয়ে গিয়ে গোলাটোর বদলে আর একটি লোককে জিজ্ঞাসা করল, এ সবের অর্থ কি?

লোকটি জবাব দিল, আমরা ফিরে যাচ্ছি।

আমাকে একা রেখে তোমরা ফিরে যেতে পার না।

লোকটি বলল, তুমিও আমাদের সঙ্গে আসতে পার। তবে তোমার ব্যবস্থা তোমাকেই করতে হবে।

বেপরোয়া ভঙ্গীতে মেয়েটি বলল, এ কাজ তোমরা করতে পার না। আমি যেখানে যাব সেখানেই তোমরা আমার সঙ্গে যাবে- এই শর্তেই তোমরা রাজী হয়েছিলে। মালপত্র নামাও; আমি হুকুম না দেয়া পর্যন্ত অপেক্ষা কর।

লোকটি তবু ইতস্তত করছে দেখে মেয়েটি রিভলবার বের করল। এবার গোলাটো হস্তক্ষেপ করল রাইফেলধারী অস্কারিদের দিকে এগিয়ে এসে ঠোঁট বেঁকিয়ে বলল, থাম! তোমরা তাঁবুতে ফিরে যাও। আমরা নিজেদের দেশে ফিরে যাচ্ছি। গোলাটোর সঙ্গে যদি ভাল ব্যবহার করতে তাহলে এসব ঘটত না; কিন্তু তা তুমি কর নি; আর এটা তারই শাস্তি।

মেয়েটির চোখের সামনে সকলে সার বেঁধে জঙ্গলের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল। ভগ্ন হৃদয়ে সে তাঁবুতে ফিরে গেল।

ওদিকে সংঘের প্রতীক চিতাবাঘের চামড়ায় সজ্জিত চারমূর্তি ওরান্ডোকে ঘিরে ধরতেই চোখের সামনে ভেসে উঠল বন্ধুর বিকৃত মৃতদেহের ছবি। মনের পটে আঁকা পড়ল নিজেরে শোচনীয় পরিণতির ছবি। কিন্তু সে ঘাবড়াল না। সে সৈনিক; মরতে হয় মরবে, তবু নিয়ামওয়েগির মৃত্যুর প্রতিশোধ সে নেবে। প্রাণপণ শক্তিতে বর্শাটাকে চেপে ধরে আঘাত হানল। একজন শত্রু আর্তনাদ করে মাটিতে পড়ে গেল। বাকি তিনজন ধীর পায়ে এগোতে লাগল।

দ্রুত মুখ ফিরিয়ে এনে সে বাকি শত্রুদের মোকাবিলার জন্য রুখে দাঁড়াল। পিছন থেকে কানে এল একটা বর্বর হুংকার। তা শুনে তার মাথার চুল খাড়া হয়ে উঠল। ফিরে তাকাবার অবসর নেই। বীভৎস মূর্তিগুলো ইস্পাতের বাঁকা নখরগুলো থাবার মত মেলে ধরে এগিয়ে আসছে তাকে ধরতে।

পিছন থেকে একটা মূর্তি হুংকার দিয়ে লাফিয়ে উঠে ওরান্ডোকে পাশ কাটিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল প্রথম চিতা-মানুষটার উপর। মূর্তিটি ওয়ান্ডোর মুজিমো। এও কি সম্ভব যে তার গলা থেকেই বেরিয়েছে সেই পাশবিক ভয়ংর হুংকার! যাইহোক, বেগতিক বুঝে চতুর্থ শত্রুটি মুখ ঘুরিয়ে জঙ্গলের দিকে ছুট দিল; শেষ সঙ্গীটিকে ছেড়ে দিয়ে গেল তার ভাগ্যের হাতে।

মুজিমো তখন দুটি যুবক চিতা-মানুষের বড়টির সঙ্গে লড়ছে। শক্ত মুঠোর দুটো থাবাওয়ালা হাতকে এক সঙ্গে চেপে ধরে আর এক হাতে মুজিমো চেপে ধরেছে তার গলা। একটু একটু করে তার দম বন্ধ হয়ে আসছে। ক্রমে তার হাত-পা সহ গোটা শরীরটাই শিথিল হয়ে এলিয়ে পড়ল। মৃতদেহটাকে সে মাটিতে ফেলে দিল।

তার দিকে এগিয়ে গিয়ে ওরান্ডো ভয়ে ভয়ে বলল, মুজিমো, আজ তুমি আমার প্রাণ রক্ষা করেছ। এ প্রাণ তোমার।

মুজিমো বলল, এখন মনে পড়ছে, তুমিও আমার প্রাণ রক্ষা করেছ।

হা মুজিমো, আজ সকালেই।

আজই সকালে! হ্যাঁ, তাই। আমরা শিকারে যাচ্ছিলাম। আমি সত্যি ক্ষুধার্ত; শিকারে চল।

ওরান্ডো বলল, যে পালিয়ে গেল তার পিছু নেব না? ওদের গ্রামটা চিনে আসতে হবে না?

মুজিমো বলল, আগে মরা মানুষদের সঙ্গে কথা বলে দেখি, তারা কতটা কি বলতে পারে।

ভয় কম্পিত গলায় ওরান্ডো শুধাল, তুমি মরা মানুষের সঙ্গেও কথা বলতে পার?

মুজিমো বলল, শব্দ দিয়ে কথা না বললেও অনেক সময় তারা অনেক কিছু বলতে পারে। ওদের ধারালো দাঁত বলেছে ওরা নরমাংস খায়; ওদের কবচ আর থলের জিনিসপত্র বলেছে যে ওরা জেলে; কোন বড় নদীর ধারে বাস করে, আর কুমীর গিমলাকে ভীষণ ভয় করে। ওদের থলের বঁড়শি ও কবচই সে কথা আমাকে বলে দিয়েছে। ওদের অলংকার অস্ত্র এবং কপাল ও থুতনির কাটা দাগ থেকেই জানতে পেরেছি ওরা কি জাতি, আর কোন্ দেশে বাস করে। যে পালিয়ে গেছে তাকে অনুসরণ করার কোন দরকার নেই; তার বন্ধুরাই সব কথা বলে দিয়েছে। তাই আপাতত শিকারে চল। চিতা-মানুষদের গ্রামে পরে যাওয়া যাবে।

দু’টি সাদা মানুষ একটা তালি-মারা জীর্ণ তাঁবুর সামনে বসেছিল। কোন চেয়ার না থাকায় তারা মাটিতেই বসেছিল। তাদের জামাকাপড় আরও বেশি তালি-মারা, আরও বেশি জীর্ণ। পাঁচটি আদিবাসী কিছুদূরে চুল্লীর পাশে বসে আছে। অপর একটি আদিবাসী তাঁবুর কাছে ছোট উনুনে সাদা মানুষদের জন্য আহার্য তৈরি করছে।

আর পারা যায় না, বয়স্ক লোকটি বলল।

একুশ-বাইশ বছরের যুবকটি বলল, তাহলে ফিরে যাচ্ছ না কেন?

বয়স্ক সঙ্গীটি কাঁধ ঝাঁকাল। কোথায় যাব? দেশে ফিরে গেলে একটা নোংরা বাউণ্ডুলে বনে যাব। শ্রদ্ধা করুক আর নাই করুক, তবু তো এখানে ক’টা চাকর রাখতে পেরেছি; নিজেকে একজন কেউ-কেটা বলে ভাবতে পারি। আর সেখানে গেলে তো অন্যের হুকুম-বরদার হতে হবে। কিন্তু তুমি-তুমি কেন যে এই পাণ্ডব-বর্জিত দেশে ছারপোকা ও জ্বরের জঙ্গে লড়াই করে চলেছ তা তো বুঝি না। তুমি যুবক। তোমার সামনে রয়েছে একটা পুরো জীবন একটা গোটা জগৎ।

যুবকটি বলে উঠল, থাক! এমন ভাবে কথা বলছ যেন তুমি একটা একশ’ বছরের বুড়ো। তোমার বয়স তো তিরিশও হয় নি। আমাদের দেখা হবার পরেই তোমার বয়সটা আমাকে বলেছিলে।

অপরজন বলল, আরে, তিরিশ হলেই তো বুড়ো। মানুষ হতে হলে তিরিশের অনেক আগেই শুরু করতে হয়। আরে, এমন অনেক লোককে আমি জানি যারা মাল-কড়ি কামিয়ে তিরিশ বছরেই অবসর নিয়ে বসেছে। আমার বাবার কথাই ধর না-হঠাৎ সে চুপ করে গেল। হাসতে হাসতে যুবকটি বলে উঠল, মনে হচ্ছে ফিরে গেলে আমরা যুগল নিষ্কর্মা বনে যাব।

বুড়ো টাইমার বলল, কিন্তু এভাবে কতদিন কাটবে? দেখেশুনে মনে হচ্ছে আফ্রিকার সব হাতি কোন অজ্ঞাত জগতে চলে গেছে।

কিড বলল, বুড়ো বোবোলো দিব্যি গেলে বলেছিল যে এখানেই হাতির দেখা পাব; এখন বুঝছি লোকটা মিথ্যাবাদী।

টাইমার বুড়ো বলল, সে সন্দেহ আমার মনেও জেগেছে। কিন্তু বলে সব চুপচাপ বসে থাকলে তো চলবে না। এইসব অনুগত লোকগুলো যদি অবিলম্বে কিছু হাতির দাঁত চোখে না দেখে তাহলে নির্ঘাৎ আমাদের মত, তারাও ভাল করেই জানে যে এখানে হাতির দাঁত নেই তো মাইনেও নেই।

তা তো বুঝলাম। কিন্তু আমরা করবটা কি? হাতি বানাব?

খুঁজে বের কর। দুরের পাহাড়ে হাতি আছে; কিন্তু তারা তো তোমার গুলি খাবার জন্য নাচতে নাচতে এই শিবিরে এসে হাজির হবে না। কাজেই দু’জন করে লোক আর দিন কয়েকের খাবার সঙ্গে নিয়ে আমাদেরই বের হতে হবে। তাতে যদি হাতির খোঁজ না মেলে তো আমার নামে একটা জেব্রা পুষো।

কিড বলল, আমি রাজী।

টাইমার বুড়ো বলল, বেশ, কালই যাত্রা করব।

অনেক নির্জন দিন। অনেক আতংকের রাত। সঙ্গী লোজনদের দ্বারা পরিত্যক্ত হবার পরে একমাত্র অন্তরের নির্ভিকতাই মেয়েটিকে পাগল হয়ে যাবার হাত থেকে বাঁচিয়েছে। তারপর অনন্তকাল বুঝি পার হয়ে গেছে; প্রতিটি দিন যেন এক একটি যুগ।

আজ সে একটা শিকার করেছে। রাইফেল চালিয়ে মেরেছে একটা শুয়োর।

কাজ করতে করতেই একটা শব্দ শুনে চোখ তুলতেই দেখতে পেল চারটি লোক নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে তাকেই দেখছে। একজন সাদা, বাকি তিনজন আদিবাসী। একটা যেন আশার আলো দেখতে পেল। তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়াল। ওরা এগিয়ে এল। সাদা মানুষটি সকলের আগে। ভাল করে তাকাতেই আশার আলো যেন নিভে এল। কোন সাদা মানুষের এ রকম অভদ্র চেহারা সে আগে কখনও দেখে নি। নোংরা জামা-পাকড় শতছিন্ন ও তালিমারা; মুখময় দাড়ি; টুপিটার এতই ভগ্নদশা যে মাথায় পরা আছে বলেই সেটাকে টুপি বলে চেনা যাচ্ছে; মুখটাও রুক্ষ, কঠিন।

বলল, তুমি কে? এখানে কি করছ?

ও দুটোর কোনটা নিয়েই তোমার মাথা ঘামাবার দরকার নেই। মেয়েটি ঘুরে দাঁড়াল।

লোকটির মুখ আরও বিকৃত হল; কিছু কড়া কথা ঠোঁটের ডগায় এসেওছিল; কিন্তু নিজেকে সংযত করে সে মেয়েটিকেই দেখতে লাগল। মেয়েটি সুন্দরী। নোংরা পোশাক, মুখ ঘামে ভেজা, শরীরে রক্তের দাগ; তবু তাকে সুন্দরী দেখাচ্ছে। দুই বছর পরে বুড়ো টাইমার এই প্রথম একটি সাদা মেয়ে মানুষকে দেখল।

সে প্রশ্ন করল, নিশ্চয় তুমি একাকি এ দেশের এত ভিতরে ঢোক নি। দলের অন্য সকলে কোথায় গেল?

তারা আমাকে ফেলে চলে গেছে।

আর তোমার সাদা সঙ্গীরা-তারা?

সে রকম সঙ্গী কেউ ছিল না। মেয়েটি ঘুরে দাঁড়াল।

এখন তুমি কি করবে? একা তো এখানে থাকতে পারবে না। তাছাড়া কুলির সাহায্য ছাড়া থাকবেই বা কেমন করে?

একাই তিন দিন কাটিয়েছি; আরও কাটাব যতদিন

যতদিন মানে?

জানি না।

লোকটি বলল, আমার কথা শোন। বল তো, এখানে থেকে তুমি কি করছ?

একটু আসার আলো যেন দেখতে পেল মেয়েটি। বলল, একজনের খোঁজ করছি। তুমি হয় তো তার কথা শুনেছ, হয় তো সে কোথায় আছে তাও জান। আগ্রহে মেয়েটির গলা কাঁপছে।

তার নাম কি? বুড়ো টাইমার জিজ্ঞাসা করল।

জেরি জেরোম। মেয়েটি অনেক আশা নিয়ে চোখ তুলল।

লোকটি মাথা নাড়ল। তার কথা কখনও শুনি নি।

মেয়েটির চোখ থেকে আশার সামান্য আলোটুকুও নিভে গেল। দুই চোখ বুঝি বা তার অজ্ঞাতেই জলে ভরে উঠল। তা দেখে বুড়ো টাইমার বলল, খুব হয়েছে; এখন চল।

কোথায়?

আমার সঙ্গে।

কেন?

এই জঙ্গলে একটা সাদা ইঁদুরকেও আমি রেখে যেতে পারতাম না; আর তুমি তো একটা সাদা মেয়ে।

মেয়েটি উদ্ধত ভঙ্গীতে বলল, তোমার সঙ্গে যদি না যাই তাহলে?

না যাই-টাই নয়, তোমাকে যেতেই হবে। মাথায় ঘিলু থাকলে সে জন্য তোমার কৃতজ্ঞ হবার কথা। কিন্তু তোমাদের কাছে তো ও সব কথা বলাই বৃথা। তুমিও তো অন্য সব মেয়েরই মত- স্বার্থপর, অবিবেচক, অকৃতজ্ঞ।

মেয়েদের সম্পর্কে তোমার ধারণা দেখছি খুব ভাল, কি বল?

ঠিক ধরেছ।

এবার নরম সুরে মেয়েটি শুধাল, আচ্ছা তোমার শিবিরে গেলে আমাকে নিয়ে কি করবে?

সঙ্গী-সাথী পেলেই যত তাড়াতাড়ি পারি আফ্রিকার বাইরে পাঠিয়ে দেব।

আফ্রিকা ছেড়ে আমি যাব না। একটা উদ্দেশ্য নিয়ে আমি এখানে এসেছি।

তোমার উদ্দেশ্য তো সেই জেরোম নামক ভদ্দর লোককে খুঁজে বের করা; কিন্তু তার ভালর জন্যই একটি পুরুষ মানুষ হিসেবে আমার কর্তব্য তুমি তাকে খুঁজে পাবার আগেই তোমাকে এ দেশ থেকে বের করে দেয়া।

লোকটা পাগল নাকি? মেয়েটি শুনেছে, পাগলের কথা মত চলতে হয়; নইলে তারা হিংস্র হয়ে ওঠে। তাই সে ভয়ে ভয়ে বলল, হয়তো তোমার কথাই ঠিক। আমি যাব তোমার সঙ্গে।

লোকটি বলল, খুব ভাল কথা। এই তো বেশ মীমাংসা হয়ে গেল। তাহলে বাকি কথাটাও খোলসা হয়ে যাক। এখানকার কাজ শেষ করে আগামীকাল অথবা পরশু আমি শিবিরে ফিরে যাব। তুমি আমাদের সঙ্গে যাবে না। আমার একটি চাকর তোমার দেখাশুনা করবে-রান্না করবে, সব কাজ করে দেবে। কোন মেয়ের হেপা আমি পোহাতে পারব না। তুমি আমাকে ঘাটাবে না, আমিও তোমাকে ঘাটাব না। তোমার সঙ্গে কথাও বলব না।

সেটা আমারও কথা, মেয়েটি সায় দিল।

লোকটি আবার বলল, আর একটা কথা। সর্দার বোবোলোর দেশে আমার শিবির। আমার যদি একটা কিছু হয় তাহলে একটা লোককে সঙ্গে নিয়ে সেখানে চলে যেয়ো। সেখানে আমার অংশীদার তোমার দেখাশুনা করবে। শুধু আমার নাম করো, তাহলেই হবে।

বুড়ো টাইমার ও তার সঙ্গীরা সে রাতের মত সেখানেই তাঁবু খাটাল। সন্ধ্যার পরে নিজের তাবু থেকেই মেয়েটি দেখল, লোকটি আগুনের পাশে বসে পাইপ টানছে। হঠাৎ তার মনে এমন একটা নিরাপত্তার ভাব জাগল যা আফ্রিকায় ঢোকার পর থেকে কখনও অনুভব করে নি। তার মন বলল, একেবারে একা থাকার চাইতে একটি সাদা পাগলা মানুষও ভাল। কিন্তু লোকটি কি সত্যিই পাগল?

কী আশ্চর্য, ওদিকে বুড়ো টাইমারও মেয়েটির কথাই ভাবছে। পাইপের ধোঁয়ার মধ্যে ভেসে উঠছে তারই মুখ এক অপরূপা সুন্দরীর মুখ।

নিজের মনেই সে বলে উঠল, মলো যা! কেন যে মরতে ওর সঙ্গে দেখা হয়েছিল?

পরদিন সকালে উঠেই সে তাঁবু ছেড়ে চলে গেল। সঙ্গে নিল দুটো চাকর। একটা পুরনো রাইফেল দিয়ে অপর চাকরটিকে রেখে গেল মেয়েটির রক্ষী হিসেবে। সে যাবার আগেই মেয়েটি ঘুম থেকে উঠে এসে দাঁড়াল; কিন্তু তার দিকে না তাকিয়েই সে চলে গেল।

মনের ক্ষোভ চেপে রাখতে না পেরে মেয়েটি হিসৃহিস্ করে বলে উঠল, অসভ্য কোথাকার।

বুড়ো টাইমারের সারাটা দিন কঠোর পরিশ্রমে কেটে গেল। অনেক খুঁজেও একটা হাতির চিহ্ন মাত্রও দেখতে পেল না। এমন এটা আদিবাসীর দেখা পর্যন্ত পেল না যে হাতির দলের চলাফেরার হদিসটাও অন্তত দিতে পারে। অগত্যা ক্লান্ত, অবসন্ন দেহে সে আবার শিবিরেই ফিরে চলল।

দূর থেকে যখন খোলা জায়গাটা দেখতে পেল সূর্য তখন পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়েছে। প্রথমেই চোখে পড়ল মেয়েটির তাঁবু। তাঁবুর বাইরে কি যেন পড়ে আছে দেখেই তার শরীর ভয়ে ঠাণ্ডা হয়ে এল। দ্রুত ছুটে গেল সেইদিকে। চাকর দুটিও ছুটল তার পিছনে। মেয়েটির রক্ষী হিসেবে যাকে রেখে গিয়েছিল তার ভয়ংকরভাবে বিকৃত মৃতদেহটা সেখানে পড়ে আছে। নিষ্ঠুর নখরাঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়েছে তার দেহ।

সঙ্গীর দেহের উপর ঝুঁকে পড়ে নিগ্রো দুটি নিজেদের ভাষায় কি যেন বলল; তারপর বুড়ো টাইমারের দিকে ফিরে বলল, চিতা-মানুষরা এসেছিল বাওয়ানা।

বুড়ো টাইমার ভয়ে ভয়ে তাঁবুর দিকে পা বাড়াল। মেয়েটি তাঁবুর মধ্যে নেই। প্রথমেই তার মনে হল, গলা ছেড়ে তাকে ডাকবে। কিন্তু কেমন করে ডাকবে? তার নামটাই ত জানা হয় নি। পর মুহূর্তেই মনে হল, তাকে ডাকা বৃথা। সে যদিও বেঁচেও থাকে তাহলেও এতক্ষণে সে অনেক দূর চলে গেছে-রক্তপিপাসু শয়তানরা তাকে ধরে নিয়ে গেছে। যেমন করে হোক তাকে উদ্ধার করতেই হবে প্রতিশোধ নিতে হবে।

ওরান্ডোর ডাকে উটেঙ্গা সৈনিকদের কাছ থেকে ভাল করে সাড়া পাওয়া গেল না। যুদ্ধের নামে সকলেই নাচে; কিন্তু চিতা-মানুষদের গুপ্ত সংঘের বিরুদ্ধে যুদ্ধের কথায় সকলেরই বুক কাঁপে। তাই দেখা গেল যুদ্ধ যাত্রার ডাক পড়লে শ’খানেক লোক এসে হাজির হল।

এদিকে আর এক বিপদ। মুজিমোকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সেই সঙ্গে নিয়ামওয়েগির আত্মাও উধাও হয়েছে। বড়ই অশুভ লক্ষণ। কিস্তু গ্রামের লুপিঙ্গুও যুদ্ধের বিপক্ষে। সুযোগ বুঝে সে ওরান্ডোকে শুধাল, তোমার মুজিমো তো চলে গেল। এখন কে আমাদের চিতা-মানুষদের গ্রামের পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে?

ওরান্ডো প্রবল আপত্তি জানিয়ে বলল, সে আমাকে ছেড়ে যাবে তা আমি বিশ্বাস করি না।

বুঝি বা তার কথা রাখতেই কাছের একটা গাছের ডাল থেকে নেমে এল একটা দৈত্যাকার মূর্তি। সে মুজিমো। এক কাঁধে একটা মরা হরিণ, অন্য কাঁধে নিয়ামওয়েগির আত্মা।

ওরান্ডো শুধাল, কোথায় ছিলে মুজিমো? ওরা বলছিল, সোবিটো তোমাকে মেরে ফেলেছে।

কাঁধ ঝাঁকুনি দিয়ে মুজিমো বলল, শুধু মুখের কথায় মানুষ মরে না। সোবিটো তো কথার বস্তা।

একটি বুড়ো প্রশ্ন করল, তুমি কি সোবিটোকে মেরে ফেলেছ?

তাকে বাধা দিয়ে মুজিমো বলল, আমি শিকারে বেরিয়েছিলাম। তোমাদের খাদ্য ভাল নয়; আগুনে পুড়িয়ে তোমরা সব নষ্ট করে ফেল।

একটা গাছের নিচে বসে শিকারের শরীর থেকে খানিকটা মাংস কেটে নিয়ে সে খেতে শুরু করল। মাঝে মাঝে গলার মধ্যে গরু-গর্ শব্দ হচ্ছে। বেশ কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে সৈনিকরা সভয়ে তাকে দেখতে লাগল।

খাওয়া শেষ করে উঠে দাঁড়াল। শরীরের আড়মোড়া ভাঙল। তারপর বলল, মুজিমো প্রস্তুত। উটেঙ্গারা প্রস্তুত থাকলে এবার যাত্রা শুরু হোক।

তিন দিন ধরে চলল একটানা অভিযান। মুজিমো পথ-প্রদর্শক; ওরান্ডো নেতা। যত এগিয়ে যাচ্ছে, সৈনিকদের মনোবল ততই বাড়ছে। সকলেরই ঠাট্টা বিদ্রুপের ফলে লুপিঙ্গুও চুপচাপ পথ চলেছে।

চতুর্থ দিন সকালে মুজিমো জানাল, তারা চিতা-মানুষদের গ্রামের কাছাকাছি এসে পড়েছে। পরদিন সকালেই সে একা এগিয়ে গিয়ে সব কিছু ভাল করে দেখে আসবে।

প্রাতরাশের পরে আগুনকে ঘিরে বসে গল্প করতে করতে এক সময় সকলের খেয়াল হল লুপিঙ্গু সেখানে নেই। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও তাকে পাওয়া গেল না। তখন সকলেই ধরে নিল যে শত্রুর কাছাকাছি এসে সে ভয়ে পালিয়ে গেছে। সেই ফাঁকে মুজিমো ও নিয়ামওয়েগির আত্মা নিঃশব্দে গাছের ডালে ডালে ঝুলে চিতা-মানুষদের গ্রামের দিকে এগিয়ে চলল।

গলায় দড়ি বেঁধে মেয়েটাকে টানতে টানতে নিয়ে চলেছে জঙ্গলের ভিতর দিয়ে। দড়ির অপর প্রান্ত ধরে আছে একটি বলিষ্ঠ আদিবাসী যুবক; তার আগে আগে পথ দেখিয়ে চলেছে একটি বুড়ো, তার পিছনে আছে আর একটি যুবক। তিনজনেরই শরীর চিতাবাঘের চামড়ায় ঢাকা; মাথায় বেশ ভাল করে বসানো চিতাবাঘের মাথা; ইস্পাতের বাঁকা নখ বসানো তাদের আঙুলের ডগায়; দাঁতগুলো ঘসে ঘসে ধারালো করা হয়েছে; আর সারা মুখ চিত্র-বিচিত্র করে আঁকা। তিনজনের মধ্যে বুড়োটাই সর্দার; দেখতেও ভয়ংকর। যুবক তার দুটি কথায় উঠছে-বসছে।

সকলের কুটিল, কঠোর দৃষ্টির সম্মুখ দিয়ে আদিবাসীরা মেয়েটিকে নিয়ে হাজির হল একটা বড় কুটিরের সামনে। বাড়ির সামনে বসে আছে একটি পেটমোটা বুড়ো নিগ্রো; তার সারা মুখে বলিরেখায় ভরা। চিতা-মানুষদের সর্দার গাটো মুঙ্গু। চোখ তুলে তাকাতেই সাদা মেয়েটিকে দেখে তার রক্ত-রাঙা চোখ দুটো জ্বল জ্বল করে উঠল। বুড়ো লোকটিকে লক্ষ্য করে বলল, তুমি আমার জন্য উপহার এনেছ, লুলিমি?

বুড়ো জবাব দিল, উপহার এনেছি, তবে কেবলমাত্র গাটো মুঙ্গুর জন্য নয়।

তার মানে? সর্দার ভেংচে উঠল।

উপহার এনেছি গোটা জাতির জন্য-চিতা-দেবতার জন্য।

মেয়েটিকে মন্দিরে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা চলতে লাগল। এমন সময় একটি সৈনিক ঘর্মাক্ত দেহে রুদ্ধশ্বাসে এসে হাজির হল।

গাটো মুঙ্গু বলল, তুমি কি সংবাদ এনেছ?

উটেঙ্গাদের সর্দার লোবোঙ্গোর ছেলে ওরান্ডোর নেতৃত্বে একশ’ সৈনিক এখান থেকে কয়েক ঘণ্টার পথ দূরে হাজির হয়েছে। তারা আক্রমণ করবে তোমার গ্রাম। এখনই যদি কিছু সৈনিক পাঠিয়ে তাদের পথের পাশে লুকিয়ে রাখতে পার তাহলে অতর্কিকে আক্রমণ করে তার সব উটেঙ্গাকে মেরে ফেলতে পারবে।

কোথায় তাঁবু ফেলেছে তারা?

বার্তাবহ সে স্থানের বিস্তারিত বিবরণ দিল। গাটো মুঙ্গু একজন উপ-প্রধানকে হুকুম দিল, তিনশ’ সৈনিক নিয়ে সে আক্রমণকারীদের উদ্দেশ্যে যাত্র করুক। তারপর বলল, আজ রাতে আমাদের মহাভোজ হবে, আর এই অতিথি সেখানে আমার পাশে বসে পানাহার করবে।

বার্তাবহ বলল, আমি তো থাকতে পারব না। এখনই আমাকে ফিরে যেতে হবে, নইলে সকলে আমাকে সন্দেহ করবে।

তুমি কে? গাটো মুঙ্গু প্রশ্ন করল।

বার্তাবহ জবাব দিল, আমি ওয়াটেঙ্গা দেশের কিস্তু গ্রামের লুপিঙ্গু।

রাত নামছে। সূর্য পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়েছে। বনের পথ ধরে ছিন্ন বসন একটি সাদা মানুষ এসে দাঁড়াল একটা ফসলের ক্ষেতের শেষ প্রান্তে। ক্ষেতের ওপারে একটা বেড়া দিয়ে ঘেরা গ্রামের দীর্ঘ ছায়া পড়েছে মাঠের উপরে। লোকটির সঙ্গে দুটি কালো মানুষ।

তাদের একজন বলল, আর যেয়ো না বাওয়ানা। ওটা চিতা-মানুষদের গ্রাম।

বুড়ো টাইমার বলল, ওটা গাটো মুঙ্গুর গ্রাম। আগেও আমি তার সঙ্গে ব্যবসা করেছি।

তখন তুমি এসেছিলে অনেক লোকজন ও বন্দুক নিয়ে। আর তখন গাটো মুঙ্গু ছিল ব্যবসাদার। আজ তুমি এসেছ মাত্র দুটি চাকর নিয়ে; আর আজ তুমি দেখবে বুড়ো গাটো মুঙ্গু চিতা-মানুষ হয়ে গেছে।

বাজে কথা! সাদা মানুষটি চেঁচিয়ে বলল। একজন সাদা মানুষের কোন ক্ষতি করার সাহস তার হবে না। তাছাড়া, সব কিছু দেখে মনে হচ্ছে যে মেয়েটিকে এখানেই আনা হয়েছে। আমি ঐ গ্রামে যাবই।

নিগ্রোরা মাথা নাড়ল। তুমি যেয়ো না বাওয়ানা। সাদা মেয়েটি তোমার স্ত্রী নয়, মা নয়, বোন নয়। তাহলে তার জন্য তুমি কেন জীবনটা দেবে।

বুড়ো টাইমারও মাথা নাড়ল। সে তোমরা বুঝবে না। সে নিজেই কি বুঝেছে। হাত নেড়ে বলল, তাহলে সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করো।

বুড়ো টাইমার মাঠ পেরিয়ে ফটকের দিকে এগিয়ে চলল। নিগ্রো দুটির চোখ জলে ভরে এল।

বুড়ো টাইমারকে দেখে গাটো মুঙ্গু উদ্ধত ভঙ্গীতে বলল, এখানে কি করতে এসেছ?

বুড়ো টাইমার বুঝল, অবস্থা সুবিধার নয়। এখানে নরম কথায় কোন কাজ হবে না। সে সরাসরি বলল, আমি এসেছি সাদা মেয়েটিকে নিয়ে যেতে।

কোন্ সাদা মেয়ে?

মিথ্যা প্রশ্ন করে আমাকে ভোলাতে চেষ্টা করো না। মেয়েটি এখানেই আছে। তাকে আমার হাতে তুলে দাও।

গাটো মুঙ্গু হুংকার দিয়ে উঠল, এ গায়ে কোন সাদা মেয়ে নেই। আর আমি সর্দার গাটো মুঙ্গু, হুকুম করি, কারও হুকুম শুনি না।

হুকুম তোমাকে শুনতে হবে বদমাশ। অন্যথায় একদল সৈন্য নিয়ে এসে তোমার গ্রামটাকে আমি মানচিত্রের বুক থেকে মুছে ফেলব।

গাটো মুঙ্গু ঘৃণাভরে বলল, তোমাদের আমি চিনি। তোমরা তো মাত্র দু’জন, আর বাকি পাঁচজন তো এখানকার মানুষ। তোমরা তো গরিব। হাতির দাঁত চুরি করে বেড়াও। মুখেই শুধু বড় বড় কথা বল। গাটো মুঙ্গু তোমার কথায় ভয় পায় না। তুমি তো এখন আমার বন্দী। একে এখান থেকে নিয়ে যাও। দেখো যেন পালিয়ে না যায়।

দু’জন সৈনিক এসে তাকে টানতে টানতে নিয়ে গেল। গোটা নোংরা ছোট ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে তার অস্ত্রশস্ত্র কেড়ে নিল। হাত-পা শক্ত করে বেঁধে রেখে চলে গেল। একজন মাত্র শাস্ত্রী রইল দরজার পাশে। পাহারায়। কিন্তু লোকটির পাজামার পকেটে যে একটা ছোট ছুরি ছিল সেটা খেয়ালই করল না।

অন্ধকার কারাগারে বসে বুড়ো টাইমার মেয়েটির কথাই ভাবছিল। এদের কবল থেকে কেমন করে তাকে উদ্ধার করবে সেই চিন্তাই এখন তার কাছে বড় হয়ে উঠেছে। এমন সময় কে যেন ঘরে ঢুকল। অন্ধকারে তাকে চিনতে পারল না, কিন্তু কথা শুনেই বুঝতে পারল যে, লোকটি তার পূর্ব-পরিচিত সর্দার বোবোলো।

বোবোলো বলল, আমি হয়তো তোমাকে সাহায্য করতে পারি। এখান থেকে বাইরে যেতে চাও তো?

নিশ্চয় চাই।

আমি তোমাকে সাহায্য করব। কিন্তু তার জন্য দাম চাই।

কত?

দশটা হাতির দাঁত।

বুড়ো টাইমার শিস দিয়ে উঠল। বলল, সেই সঙ্গে একটা স্টিম-ইয়াট আর একটা রোলস রয়েসও চাই তো?

কিছু না বুঝেই বোবোলা ঘাড় নাড়ল, হ্যাঁ।

অনেক কথা-কাটাকাটির পর স্থির হল, বুড়ো টাইমার তার আংটিটা দেবে। সেই আংটি নিয়ে বোবোলো যাবে তার সঙ্গী কিডের কাছে। সেটা দেখেই কিভ চিনতে পারবে এবং বোবোলোর দাবীমত তাকে দশটা দাঁত দিয়ে দেবে। আর বুড়ো টাইমারও ছাড়া পাবে।

বুড়ো টাইমারের পিছনে গিয়ে বোবোলো তার আঙ্গুল থেকে আংটিটা খুলে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। মনে মনে বলল, আংটি আর হাতির দাঁত দুইই হাতিয়ে নেব। বুড়ো টাইমার এবার গভীর গাড়ায়।

ওদিকে গাটো মুঙ্গু অন্য সর্দারদের নিয়ে আলোচনায় বসেছে, নতুন বন্দীকে নিয়ে কি করা যায়। বোবোলো এসে তাদের সঙ্গে যোগ দিল। নানা জনের নানা মত। সকলেরই গলা সপ্তমে চড়া।

হঠাৎ তাদের আলোচনায় বাধা পড়ল। যে গাছের নিচে বসে আলোচনা চলছিল তার ডালে একটা সরু সরু শব্দ উঠল, আর পরক্ষণেই একটা ভারী জিনিস কে যেন ছুঁড়ে দিল তাদের ঠিক মাঝখানে। সভয়ে তারা উপরে তাকাল; অন্ধকারে কিছুই দেখতে পেল না। নিচে তাকিয়ে দেখল, তাদের পায়ের কাছে পড়ে আছে একটা মানুষের মৃতদেহ। তার হাত-পা বাঁধা, আর গলাটা এ-কান থেকে ও-কান পর্যন্ত কাটা।

গাটো মুঙ্গু ফিসফিস্ করে বলল, এ তো সেই উটোঙ্গা লুপিঙ্গু। এই তো আমাদের গোপনে খবর এনে দিয়েছিল।

একজন বলল, তারা বিশ্বাসঘাতককে শাস্তি দিয়েছে।

বোবোলো বলল, কিন্তু তাকে গাছের উপর তুলে আমাদের দিকে ছুঁড়ে দিল কে?

সকলেই একে-অন্যের মুখের দিকে তাকাতে লাগল। বোবোলোই আবার মুখ খুলল, ওরান্ডোর এক মুজিমোর কথা আমরা শুনেছি। সেই সাদা মানুষ নাকি টুম্বাইয়ের ওঝা সোবিটোর চাইতেও বেশি শক্তিশালী। হয় তো সেই লুপিঙ্গুকে এখানে ফেলে দিয়েছে। আমাদের সতর্ক করে দিয়েছে। কাজেই বন্দীকে অবিলম্বে প্রধান পুরোহিতের কাছে নিয়ে যাওয়া উচিত। সে যা ভাল বোঝে তাই করবে। বন্দীকে যদি মেরেও ফেলে তো সে দোষ আমাদের উপর বর্তাবে।

একজন বলল, খুব বুদ্ধিমানের মত কথা বলেছ।

পাতার ফাঁক দিয়ে মুজিমো সবই দেখতে পাচ্ছিল। নিয়ামওয়েগির আত্মা ঘুমিয়ে পড়েছে তার কাঁধের উপরে। সে দেখল, সাদা বন্দীটিকে সকলে টানতে টানতে নিয়ে চলেছে। তার পায়ের বাঁধন খুলে দেয়া হয়েছে। নদীর তীরে পৌঁছে ছোট ছোট ডোঙ্গার একটা বহর (প্রায় ত্রিশটা ডোঙ্গা) তারা জলে ভাসিয়ে দিল। প্রায় তিনশ’ সৈনিক তাতে চড়ে বসল। গায়ে-মুখে রং-করা অসভ্য লোকগুলোকে নিয়ে সবগুলো ডোঙ্গা ভাটির স্রোতে তরতর করে চলতে লাগল।

নিয়ামওয়েগির আত্মাকে কাঁধে নিয়ে মুজিমোও গাছ থেকে নেমে নদীর সমান্তরাল পথটা ধরে এগোতে লাগল।

ঘটনাক্রমে বুড়ো টাইমার ও বোবোলো এক ডোঙ্গাতেই উঠেছে।

মন্দিরের কাছে পৌঁছে সকলে ডোঙ্গা থেকে নামল। সকলে মিলে মিছিল করে ঢুকল মন্দিরের সেই বড় ঘরটায়। ঘরটা লোকজনে ভর্তি। সকলে যার যার নির্দিষ্ট আসনে বসল। বুড়ো টাইমারের সাগ্রহ চোখ দুটি বৃথাই সাদা মেয়েটির সন্ধানে চারদিকে ঘুরতে লাগল। সেখানে সে নেই।

ছোট বেদীটার উপর দাঁড়িয়ে আছে প্রধান পুরোহিত। তার নিচে ও চারদিকে অনেক ছোট পুরোহিতের ভিড়। পাশেই ভারী দণ্ডের সঙ্গে শিকল দিয়ে বাঁধা রয়েছে। একটা প্রকাণ্ড চিতাবাঘ; নিচের জনতার দিকে তাকিয়ে গরু-গ করছে। বুড়ো টাইমারের মনে হল, সেটা যেন এই সব কালো মানুষদের পাশবিক ধর্মের এক মূর্ত প্রতীক।

প্রধান পুরোহিত তাদের উদ্দেশ্য করে বলতে লাগল, হে চিতা-দেবতা, তোমার সন্তানরা তাদের এক শত্রুকে বন্দী করেছে। তোমার মহামন্দিরে তাকে নিয়ে এসেছে। এখন তোমার কি ইচ্ছা?

মহূর্তের জন্য সব নিশ্চুপ। সকলেরই চোখে প্রধান পুরোহিত ও চিতাবাঘের উপর নিবদ্ধ। তারপরই ঘটল এক অলৌকিক ঘটনা। সাদা মানুষটির শরীর ঠাণ্ডা হয়ে এল; চুল উঠল খাড়া হয়ে। চিতাবাঘের মুখ থেকে বের হল মানুষের ভাষা। এ যে অবিশ্বাস্য; অথচ সে তো নিজের কানেই শুনল : চিতা-দেবতার সন্তানরা যাতে খেতে পারে তার জন্য তাকে মেরে ফেলা হোক। কিন্তু তার আগে মন্দিরের নতুন প্রধান সন্ন্যাসীকে এখানে আনা হোক; আমার ভাইয়ের নির্দেশে লুলিমি তাকে এনেছে বহু দূর দেশ থেকে; আমার সন্তানরা তাকে একবার দেখুক।

অন্য তিনশ’ জনের সঙ্গে বুড়ো টাইমারের দৃষ্টি পড়ল বেদীর পিছনকার খোলা দরজার উপরে। অস্পষ্ট একটি মূর্তি অন্ধকারের ভিতর থেকে বেরিয়ে এসে দ্বারপথে দাঁড়াল; মশালের আলো পড়ল তার উপর।

বিস্ময় ও আতংকের একটা চীৎকার স্তব্ধ হয়ে গেল সাদা মানুষটির কণ্ঠতালুতে। এ মূর্তি যে সেই মেয়ের যাকে সে খুঁজছে।

অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেল। বেদীর মাঝখানে দাঁড়িয়ে ইমিগেগ অনবরত বিড় বিড় করে কি যেন বলতে লাগল; কখনও কোন ছোট সন্ন্যাসী বা সন্ন্যাসিনীকে উদ্দেশ্য করে, কখনও বা চিতা-দেবতার উদ্দেশ্যে। আর যখনই চিতা-দেবতা জবাব দেয় তখনই সমবেত সৈনিকরা ভয়ে আঁতকে ওঠে।

চিতার মুখে কথা শুনে আরও একজন বিস্ময়ে অভিভূত হয়েছে। ঘরটার ছাদের একটা বরগা সামনের দেয়াল ভেদ করে বাইরে খানিকটা বেরিয়ে আছে। তার উপরে বসে একটা ফোকড়ের ভিতর দিয়ে সব কিছুই সে দেখতে পাচ্ছে।

সে লোকটি মুজিমো। তার পাশে নিয়ামওয়েগির আত্মা। এত চিতাবাঘ দেখে সে বেচারি ভয়ে কাঁপছে।

মুজিমো আবার নিচে তাকাল। ঐ সাদা পুরুষ ও সাদা মেয়েটির কি হবে তা সে অনুমান করতে পারছে। কিন্তু তা নিয়ে তার কোন মাথাব্যথা নেই। কিন্তু হঠাৎ একটা কিছু দেখে তার আগ্রহ বেড়ে গেল। বীভৎস মুখোশগুলোর আড়ালে একটা পরিচিত মুখ যেন তার চোখে পড়ল। অনেকক্ষণ ধরেই তার উপর সে নজর রেখেছিল। কেমন যেন চেনা চেনা লাগছে। মুজিমোর ঠোঁটে ঈষৎ হাসি দেখা দিল। চলে এস। বলে সঙ্গীকে ডেকে সে কোন রকমে ছাদে উঠে গেল। বিড়ালের মত পা ফেলে এগিয়ে গিয়ে পার্শ্ববর্তী একটা গাছের ডালে লাফিয়ে পড়ল। বনের অন্ধকার দু’জনকেই ঢেকে দিল।

নিচের বড় ঘরে সন্ন্যাসিনীরা তখন বেদীর উপর অনেক উনুন জ্বেলে দিয়েছে, তার উপর মাটির পাত্রে নরমাংস রান্না হচ্ছে। ওদিকে সন্ন্যাসীরা ভাড়ে ভর্তি করে নিয়ে এসেছে ঘোল আর চোলাই। সেগুলো খেয়ে সকলেই নাচতে শুরু করেছে। চোলাই পেটে পড়ায় প্রধান সন্ন্যাসীও পাগলের মত নাচতে শুরু করে দিল।

বুড়ো টাইমারের দিকে এগিয়ে গিয়ে বোবোলো বলল, আমার সঙ্গে চলে এসো।

কোথায়?

তোমাকে পালাতে সাহায্য করব।

মেয়েটিকে সঙ্গে না নিয়ে আমি যাব না।

বেশ তো, সে ব্যবস্থাও করা হবে। কিন্তু তোতামাদের দুজনকে তো এক সঙ্গে নিয়ে যেতে পারব না। বুঝতে পারলেই ইমিগেগ আমাকে মেরে ফেলবে। আগে তুমি এস। মন্দিরের পিছনে একটা ঘরে তোমাকে লুকিয়ে রেখে আসি। তারপর মেয়েটিকে নিয়ে যাব।

বুড়ো টাইমারকে মন্দিরের পিছনের একটা ঘরে নিয়ে গেলে সে বলল, ফিরে যাবার আগে আমার হাতের বাঁধর কেটে দাও।

মুহূর্তের জন্য ইতস্তত করে বোবোলো বলল বেশ তো তাই দিচ্ছি। এখান থেকে তুমি একা তো পালাতে পারবে না। মন্দির একটা দ্বীপের মাঝখানে অবস্থিত। চারদিকের নদী কুমীরে ভর্তি; নদীপথে ছাড়া এখান থেকে বের হবার আর কোন পথ নেই।

বুড়ো টাইমার অধৈর্য গলায় বলল, বুঝেছি। এখন যাও; শিগ্‌গির মেয়েটিকে নিয়ে এস।

বোবোলো চলে গেল।

মন্দিরে তখন হুলুস্থুল কাণ্ড চলেছে। হাড়ির মাংস বিলি করা হচ্ছে; পাত্রের পর পাত্র চোলাই উজাড় হয়ে যাচ্ছে; উপরের বেদীতে প্রধান সন্ন্যাসী আচ্ছন্নের মত পড়ে আছে। চিতা-দেবতা উপুর হয়ে একটা মানুষের হাড় চিবুচ্ছে। প্রধান সন্ন্যাসিনী দাঁড়িয়ে আছে দেয়ালে হেলান দিয়ে।

বোবোলো তার কাঁধে হাত রাখল। মেয়েটি চমকে চোখ ফেরাল।

বোবোলো ইসারা করে চুপি চুপি বলল, চলে এস।

মেয়েটি একটু আগেই দেখেছে, এই মেয়েটি বুড়ো টাইমারকে এখান থেকে নিয়ে গেছে। সে বোবোলোকে অনুসরণ করল।

মেয়েটিকে বুড়ো টাইমারের ঘরে পৌঁছে দিয়ে বোবোলো বলল, তোমরা এখানে অপেক্ষা কর।

মন্দিরে ফিরে গিয়ে বোবোলো দেখল সেখানকার হৈ-হল্লা অনেকটা ঝিমিয়ে পড়েছে। হঠাৎ কৃতকর্মের জন্য তার কেমন ভয় করতে লাগল। মনে জোর আনবার জন্য তার চোলাইয়ের একটা বড় পাত্র তুলে মুখে ঢেলে দিল। ফল ফলতে দেরী হল না। এক ঘণ্টা পরে দেখা গেল বোবোলো মেঝেতে পড়ে অকাতরে ঘুমুচ্ছে।

গাটো মুঙ্গুরও একই অবস্থা। অগত্যা সে হুকুম জারি করল, খাদ্য-পানীয় যখন নেই, তখন ফিরে চল বাড়ি। সকলেই সম্মত হল। এমন কি বোবোলো পর্যন্ত। তারও মাথার মধ্যে সব কিছু গুলিয়ে গেছে। কি যেন তার করার ছিল, কিন্তু কিছু মনে করতে পারছে না। অগত্যা অন্য সর্দারদের সঙ্গে সেও তার দলবল নিয়ে ডোঙায় উঠে পড়ল।

কিছু সৈনিকের নেশা তখনো ভাঙে নি। মন্দিরের চত্বরে সকলেই ছড়িয়ে পড়ে আছে। কিছু ছোট সন্ন্যাসী ও সন্ন্যাসিনীও আছে তাদের মধ্যে। তাদের জন্য একটা ডোঙ্গা সর্দাররা রেখে গেছে। বেদীর এক কোণে ইমিগেগ গভীর ঘুমে কুঁকড়ে পড়ে আছে। পেট ভরা থাকায় চিতা-দেবতাও ঘুমিয়ে পড়েছে।

কালি বাওয়ানা ও বুড়ো টাইমার বোবোলোর অপেক্ষায় বসে আছে মন্দিরের পিছনের অন্ধকার ঘরে। বাড়িটা ক্রমেই চুপচাপ হয়ে আসছে; সকলের ফিরে যাবার আয়োজনও কানে আসছে। নদী তীরের হৈ হল্লা শুনেও তারা বুঝতে পেরেছে যে আদিবাসীরা নদীতে ডোঙ্গা ভাসিয়েছে।

বুড়ো টাইমার বলল, বোবোলোর তো এতক্ষণে আসা উচিত।

কালি বাওয়ানা বলল, সে হয় তো আমাদের ফেলেই চলে গেছে।

টাইমার বলল, তাহলে তুমিও চলে এস। সময় নষ্ট করো না। হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে আবার বলল, হাতে হাত দাও। আমরা যেন কখনও বিচ্ছিন্ন হয়ে না পড়ি।

অনেক কষ্টে মন্দির থেকে বেরিয়ে ছুটতে ছুটতে তারা নদীর তীরে পৌঁছে গেল। মনে ভয় ছিল, নদীতে ডোঙ্গা না পেলে সব পরিশ্রমই বৃথা হয়ে যাবে। কিন্তু না, উল্লাসে তাদের মন নেচে উঠল। তীরে কাদার মধ্যে একটা ডোঙ্গা দাঁড়িয়ে আছে।

বুড়ো টাইমার হাত ধরে কালি বাওয়ানাকে ডোঙ্গায় তুলে দিল; তারপর নিজেও উঠে বসল। নীরবে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানিয়ে তারা বড় নদীর দিকে ভেসে চলল।

মধ্যরাতের ঘণ্টাখানে পরে মুজিমো ও নিয়ামওয়েগি আত্মর ঘুমন্ত উটেঙ্গাদের মাঝখানে এসে নামল। শাস্ত্রীদের ঘাঁটিগুলো পরিদর্শন করে ওরান্ডো সবেমাত্র ফিরছে। সে জেগেই ছিল। বলল, কি সংবাদ নিয়ে এলে মুজিমো? শত্রু পক্ষের খবর কি?

প্রধান সন্ন্যাসী ও চিতা-দেবতার সঙ্গে পরামর্শ করতে তারা অনেকেই মন্দিরে চলে গেছে। আমরাও সেখানে গেলাম। কিন্তু এত বেশি পরিমাণ দেশী চোলাই তারা গিলল যে কিছু জানতেই পারল না। তাই তো তোমাকে বলতে এলাম, তাদের গ্রাম এখন প্রায় ফাঁকা; নারী, শিশু ও সামান্য কিছু সৈনিকমাত্র আছে। সে গ্রাম আক্রমণ করার এই উপযুক্ত সময়।

ঠিক বলেছ। ঘুমন্ত সৈনিকদের জাগিয়ে তুলতে ওরান্ডো হাততালি দিল।

বনের আঁকাবাঁকা পথ ধরে ওরান্ডোর সৈন্যদলকে সে নিয়ে চলল গাটো মুঙ্গুর গ্রামের দিকে। কনের শেষে ফসলের মাঠে পৌঁছে তারা একটু থামল, তারপর নিঃশব্দে হামাগুড়ি দিয়ে নদীর দিকে গেল। এতক্ষণে মুজিমো বুঝতে পারল যে চিতা-মানুষেরা মন্দির থেকে ফেরে নি। মুজিমোর কথামত সৈন্যদের নদীর ধারে ঝোপের মধ্যে লুকিয়ে রেখে ওরান্ডো প্রতিটি সৈনিককে নির্দেশ দিল, সংকেত পেলেই যেন তারা সাহসের সঙ্গে যুদ্ধ শুরু করে। ডোঙ্গার শব্দ কানে আসছে–ছলাৎ ছলাৎ, ছলাৎ। উটেঙ্গারা অধীর আগ্রহে অপেক্ষমান। একে একে বিশটা ডোঙ্গা এসে ভিড়ল সৈনিক ডোঙ্গা থেকে নেমে সারিবদ্ধভাবে গ্রামের দিকে এগিয়ে চলল। আর দেরী নয়। ওরান্ডো সংকেত করল। সঙ্গে সঙ্গে নববইটি উটেঙ্গা সৈনিকের কণ্ঠে ধ্বনিত হল রণহুংকার; তাদের বর্শা ও তীর বৃষ্টিধারার মত ঝরে পড়তে লাগল চিতা মানুষদের উপর।

চিতা-মানুষদের লম্বা সারি তচনচু হয়ে গেল। অতর্কিত আক্রমণের ফলে পলায়ন ছাড়া অন্য কোন চিন্তাই তাদের মাথায় এল না। নদীর তীরে যারা পড়েছিল তারা আবার ডোঙ্গা ভাসাবার চেষ্টা করল; যারা তখনও তীরে নামে নি তারা ডোঙ্গার মুখ ঘুরিয়ে দিল মন্দিরের দিকে। বাকিরা পালাতে লাগল গ্রামের দিকে। তাদের পিছু ধাওয়া করল উটেঙ্গা সৈনিকরা। গ্রামের ফটক বন্ধ; ভিতরের রক্ষীরা ফটক খুলতে সাহস করল না। তুমুল যুদ্ধ হল সেখানেই। নদীর তীরে যারা পড়েছিল উটেঙ্গা সৈনিকদের হাতে তারা একেবারে কচুকাটা হয়ে গেল। আর অনেকক্ষণ যুদ্ধের পরে ভিতরের রক্ষীরা যখন ফটক খুলে দিল বাইরে তখন তাদের দলের আর কেউ অবশিষ্ট নেই, হয় মরেছে, না হয় তো পালিয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে উটেঙ্গা সৈন্যরা হৈ-হৈ করতে করতে ভিতরে ঢুকে গেল। তাদের হাতের জ্বলন্ত মশালের আগুনে গাটো মুঙ্গুর গ্রামের খড়ের ঘরগুলো দাউ দাউ করে জ্বলতে লাগল। জয় সম্পূর্ণ হল।

ওরান্ডো তখন সেই ঘর-পোড়া আলোয় খুঁজে খুঁজে নিজের ক্ষয়-ক্ষতির হিসেবে করতে লাগল। ওরান্ডো দেখল, হতাহত সৈনিকদের পাশে একদলা কাদার মত চিৎ হয়ে পড়ে আছে মুজিমো।

সে দৃশ্য দেখে সর্দারের ছেলে বিস্মিত হল, শোকাহত হল; তার অনুচররাও মর্মাহত। তাদের ধারণা ছিল, মুজিমো প্রেতলোকের জীব, কাজেই তার মৃত্যু নেই। কিন্তু সেও তো মানুষের মতই মরণশীল। এতদিন লোকটা তাদের ধোকা দিয়েছে।

ওরান্ডো বলল, মানুষই তোক আর প্রেতই হোক, আমার প্রতি সে বিশ্বস্ত ছিল; তোমরাই তো চোখে দেখলে, সে যুদ্ধ করেছে অসীম সাহসিকতার সঙ্গে।

সকলেই সে কথা মেনে নিল।

ওদিকে শেষ ডোঙ্গাটাতে চেপে বুড়ো টাইমার প্রাণপণে বৈঠা চালিয়ে যাচ্ছে ছোট খালের জলে। কালি বাওয়ানা বসে আছে ডোঙ্গার মধ্যে। অসভ্য লোকদের পরানো মাথার ঢাকনা খুলে ফেলেছে; ছিঁড়ে ফেলেছে গলার দাঁতের হার।

মনের সুখে ডোঙ্গা বাইছে বুড়ো টাইমার। হঠাৎ বৈঠার ছপছপাৎ শব্দ তার কানে এল। টাইমারের বুকের ভিতরটা ধড়াস করে উঠল। তাড়াতাড়ি ডোঙ্গার মুখ দক্ষিণ তীরের দিকে ঘুরিয়ে দিল। সেখানে গাছপালার ছায়ার মধ্যে লুকিয়ে পড়ল।

ঠিক তখনই আর একটা ডোঙ্গা পিছনে এসে হাজির হল। বোবোলোর গলা চিনতে বুড়ো টাইমারে ভুল হবার কথা নয়। কয়েকজন সৈনিক লাফিয়ে তাদের ডোঙ্গায় চড়ে তার মাথায় আঘাত করল, টেনে হিঁচড়ে তাকে ফেলে দিল। আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলল।

আবার বোবোলোর গলা। জলদি কর। ওরা আমাদের পিছু নিয়েছে। উটেঙ্গারা আসছে।

অনেকগুলো শক্ত হাত ডোঙ্গার বৈঠা চেপে ধরল। বিদ্যুৎ কেগে ডোঙ্গাটা ছুটে চলল মন্দিরের দিকে। সাদা মানুষটির মুখ শুকিয়ে গেল। মেয়েটাকে প্রায় উদ্ধার করে এনেছিল। এমন সুযোগ আর আসবে না।

মেয়েটিকে ডাকল। কোন সাড়া এল না।

বোবোলোর ডোঙ্গা যখন বুড়ো টাইমার ও মেয়েটির ডোঙ্গার কাছাকাছি চলছিল তখন সাদা চামড়া ও নীল চুল দেখে বোবোলো মেয়েটিকে চিনতে পেরে অন্ধকারেই সবল হাত বাড়িয়ে তাকে নিয়ে এসেছিল তার নিজের ডোঙ্গায়। বোবোলোর হুকুমেই ডোঙ্গাটা বিদ্যুৎগতিতে গ্রামের দিকে ছুটে গিয়েছিল।

ঘটনার আকস্মিকতায় মেয়েটি তখন একেবাইে কিংকর্তব্যবিমূঢ়। একমাত্র যে মানুষটির উপর এতক্ষণ পর্যন্ত সে ভরসা করে ছিল এবার সেও হারিয়ে গেল।

হাত-পা বাঁধা অবস্থায় বুড়ো টাইমার ফিরে চলল মন্দিরের দিকে। সকলে তাকে টানতে টানতে মন্দিরে নিয়ে গের। মাতাল সন্ন্যাসী ও সন্ন্যাসিনীরা ইতস্তত পড়ে আছে মন্দিরের মেঝেতে। গণ্ডগোল কানে যেতে প্রধান সন্ন্যাসী ইমিগেগ ঘুম থেকে জেগে উঠল। দুই হাতে চোখ মুছতে মুছতে বলল, কি হয়েছে?

ততক্ষণে গাটো মুঙ্গু ঢুকেছে মন্দিরে। সেই জবাব দিল, অনেক কিছু ঘটেছে। তোমরা সকলে যখন মাতাল হয়ে পড়েছিল, এই সাদা মানুষটা তখন পালিয়েছিল। উটেঙ্গারা আমার সৈনিকদের হত্যা করেছে, আমার গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছে।

প্রধান সন্ন্যাসী আবছা চোখে চারদিকে তাকাল।

গাটো মুঙ্গু বিনীত গলায় বলল, বন্দীকে তাহলে ভাল করে বেঁধে মন্দিরের পিছনেই রেখে আসি?

ইমিগেগ বলল, তাই যাও। এমন করে বেঁধে যেন পালাতে না পারে।

মাটিতে শুয়েই শ্বেতকায় দানব চোখ মেলে তাকাল। দেখল, ওরান্ডো ও তার সৈনিকরা দাঁড়িয়ে আছে। কি যেন মনে পড়ায় হঠাৎ লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল।

বানরদের ভাষায় বলল, নকিমা! নকিমা! কোথায় তুমি নকিমা? টারজান এখানে।

ছোট বানরটি এক লাফে গাছ থেকে নেমে ছুটে এসে সাদা মানুষটির কাঁধে চড়ে বসল; তার গলা জড়িয়ে ধরে মনিবের গালে গাল রেখে আনন্দে কিচির-মিচির করতে লাগল।

ওরান্ডো সঙ্গীদের বলল, দেখছ তো মুজিমো মরে নি।

সাদা মানুষটি ওরান্ডের দিকে ফিরে বলল, আমি মুজিমো নই; আমি অরণ্যরাজ টারজান। বানরটিকে ছুঁয়ে বলল, এও নিয়ামওয়েগির আত্মা নয়; এ হল নকিমা। এখন আমার সব কথা মনে পড়ছে। অনেকদিন থেকে মনে করার চেষ্টা করছি, কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারি নি-যেমনি একটা গাছের নিচে চাপা পড়েছিলাম সেদিন থেকেই সব কিছু ভুলে ছিলাম।

সারাদিন বসে বসে অনেক কথাই টারজনের মনে পড়তে লাগলঃ কেন সে এ দেশে এসেছিল, কেমন করে একটা দুর্ঘটনার ফলে বাঞ্ছিত পথ ধরে সেই দেশেই সে এসে পড়েছে, আর যে দেশের মন্দিরের সন্ধানে সে একদা পথে নেমেছিল তার সন্ধানও সে পেয়ে গেছে। এ জন্যই সেই দুর্ঘটনার কাছে সে চিরকৃতজ্ঞ।

সন্ধ্যার পরে রাতের খাবার খেতে বসে হঠাৎ তার মনে পড়ে গেল চিতা-দেবতার মন্দিরে দেখা সাদা মানুষ ও সাদা মেয়েটির কথা। ওরান্ডোকে তাদের কথা জিজ্ঞাসা করলে সেও কিছুই বলতে পারল না।

টারজান অনেকক্ষণ ধরে কি যেন ভাবল। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে নকিমাকে ডাকল।

কোথায় চললে? ওরান্ডো শুধাল।

চিতা-দেবতার মন্দিরে, টারজান জবাব দিল।

হাত-পা বাঁধা অবস্থায় বুড়ো টাইমার সারাদিন সেখানে পড়ে রইল। না খাবার, না পানীয়। মাঝে মাঝে মন্দির-কক্ষ থেকে ভেসে আসছে মন্ত্রের শব্দ, প্রধান সন্ন্যাসীর কর্কশ কণ্ঠস্বর আর চিতাবাঘের গর্জন।

মশাল হাতে নিয়ে ঘরে ঢুকল এক সন্ন্যাসী। শয়তানের মত দেখতে এক বুড়ো; মুখে রং মাখানোর ফলে আরও বীভৎস দেখাচ্ছে। লোকটি টুম্বাই গ্রামের ওঝা সোবিটো। উপুর হয়ে সে বুড়ো টাইমারের পায়ের বাঁধন খুলতে লাগল।

আমাকে নিয়ে তোমরা কি করবে? বুড়ো টাইমার প্রশ্ন করল।

ঠোঁট চাটতে চাটতে সোবিটো বলল, প্রথমে তোমার হাত পা ভেঙ্গে দেয়া হবে; তারপর জলাভূমির উপর থেকে তোমাকে এমনভাবে হেঁট মুণ্ডে ঝুলিয়ে রাখা হবে যাতে তোমার নাক-মুখ জলের নিচে গিয়ে দমবন্ধ হয়ে তোমার মৃত্যু না ঘটে। এইভাবে তোমাকে তিন দিন রাখা হবে, আর তাতেই তোমার মাংস হবে নরম, সুস্বাদু।

বুড়ো টাইমার শিউরে উঠল। তিন তিন! হা ভগবান, এও কপালে ছিল!

বুড়ো টাইমারকে একটা লাথি মেরে বলল, আমার সঙ্গে এস।

অন্ধকার বারান্দা পার হয়ে তারা সেই বড় ঘরটায় হাজির হল। বন্দীকে দেখামাত্রই দেড়শ’ কণ্ঠ একযোগে চীৎকার করে উঠল, চিতাবাঘ গর্জে উঠল, প্রধান সন্ন্যাসী উপরের বেদীতে নাচতে লাগল, বীভৎস-দর্শন সন্ন্যাসিনীরা তার স্বরে চেঁচাতে চেঁচাতে এমনভাবে লাফিয়ে এল বুঝি সাদা মানুষটাকে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলবে।

সোবিটো এক ধাক্কায় বন্দীকে নিচু বেদীর উপর ফেলে দিয়ে টানতে টানতে প্রধান সন্ন্যাসীর সামনে নিয়ে এসে বলল, বলি এনেছি!

চিতা-দেবতাকে উদ্দেশ্য করে ইমিগেগ বলল, বলি এসে গেছে! চিতা-সন্তানদের হে পরম পিতা, এবার বল তোমার কি আদেশ?

ইমিগেগের হাতের ধারালো লাঠির খোঁচা খেয়ে পশুটার দাঁত বের করা মুখ থেকেই বেরিয়ে এল আদেশ। ওর হাত-পা ভেঙে দেয়া হোক, আর তৃতীয় রাতে একটা ভোজের আয়োজন করা হোক!

আর বোবোলো ও সাদা সন্ন্যাসিনীর কি হবে? ইমিগেগ প্রশ্ন করল।

তাদের মন্দিরে নিয়ে আসতে সৈনিক পাঠাও। আরেকটা ভোজের জন্য তার হাত-পা ভেঙ্গে দাও। আর সাদা মেয়েটিকে পাবে প্রধান সন্ন্যাসী ইমিগেগ। তারপর সেও ভোজে লাগবে।

ইমিগেগ চেঁচিয়ে বলল, চিতা-দেবতার বাণী শোনা হল। তার হুকুম মতই কাজ হবে।

সঙ্গে সঙ্গে আটজন সন্ন্যাসী লাফিয়ে পড়ে বন্দীকে চেপে ধরল, তাকে বেদীর উপর ছুঁড়ে ফেলল, হাত-পা ছড়িয়ে তাকে চিৎ করে ধরে রাখল, আর চারজন সন্ন্যাসিনী ছুটে এল ভারী মুগুর হাতে নিয়ে।

মেঝেতে চিৎ করে ধরে রাখা বুড়ো টাইমারকে লক্ষ্য করে সন্ন্যাসিনীদের হাতের মুগুরগুলো একসঙ্গে উদ্যত হওয়া মাত্রই একটি ক্রদ্ধ কণ্ঠস্বর ঘরের মৃত্যুস্তব্ধতাকে ভেঙ্গে খান খান করে দিল।

সঙ্গে সঙ্গে প্রায়-নগ্নদেহ সেই দৈত্যাকার সাদা মানুষটি বানরের মত স্বচ্ছন্দ গতিতে মন্দিরের একটা। থাম বেয়ে নিচে নেমে এল। এক লাফে নিচু বেদীটার উপর গিয়ে দাঁড়াল। ভয়ে ও বিস্ময়ে লোকগুলো যেন হতভম্ব হয়ে পড়ল। সোবিটোর মুখেও কথা নেই। পা কাঁপছে। সে ঘোর কাটিয়ে আর্তনাদ করতে করতে বেদীর উপর থেকে সে ছুটে নিচে গেল সৈনিকদের পাশে।

বুড়ো টাইমারও অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। বিচিত্র মানুষটি সোবিটোকে ধরবার চেষ্টা না করে তার কাছেই এগিয়ে এল। বলল, আমাকে অনুসরণ কর। মন্দিরের পিছন দিক দিয়ে আমি বেরিয়া যাব। পিছনের দরজা দিয়ে দু’জনই অদৃশ্য হয়ে গেল।

মুহূর্তের জন্য থেমে বলল, সাদা মেয়েটি কোথায়? তাকেও সঙ্গে নিতে হবে।

বুড়ো টাইমার জবাব দিল, সে এখানে নেই; একজন সর্দার তাকে চুরি করেছে; মনে হয়, ভাটির দিকে তাকে গ্রামে নিয়ে গেছে।

তাহলে এই দিকে এস। টারজান তীরের মত বাঁ দিকের দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল।

দু’জন ছুটে চলল নদীর দিকে। সেখানে পৌঁছে ডোঙ্গাটা দেখিয়ে বলল, চড়ে বস। এখানে একটা ডোঙ্গাই আছে। কেউ তোমার পিছু নিতে পারবে না।

তুমি কি আমার সঙ্গে যাবে না?

না। ডোঙ্গাটাকে ঠেলে দিয়ে প্রশ্ন করল, যে সর্দার মেয়েটিকে চুরি করেছে তার নাম জান?

তার নাম বোবোলো। ডোঙ্গা জলে ভাসিয়ে বুড়ো টাইমার আরও বলল, তোমাকে ধন্যবাদ জানাতে পারলাম না; ইংরেজি ভাষায় সে রকম কোন শব্দ নেই।

নীরব মূর্তিটি কোন কথা বলল না। স্রোতের টানে ডোঙ্গা ভেসে চলল। বুড়ো টাইমার বৈঠা তুলে নিল হাতে। সাধ্যমত গতি বাড়াতে হবে।

ওরান্ডোর সৈনিকরা তাঁবুতে বসে আগুন পোয়াচ্ছে। তাদের পেট ভরা, তাই তারা খুশি। কাল দেশে ফিরে যাবে। সেখানে তাদের জন্য অপেক্ষা করছে বিজয়ীর সম্বর্ধনা।

এমন সময় একটি দৈত্যাকার মূর্তি যেন বাতাস থেকে নেম এল তাদের সামনে। সকলেই তাকে চিনল। অরণ্যরাজ টারজান। কাঁধে হাত-পা বাঁধা একটা লোক।

কয়েকজন বলে উঠল, অরণ্যরাজ টারজান!

কেউ বলল, মুজিমো!

ওরান্ডো বলল, কাকে নিয়ে এসেছ?

লোকটাকে মাটিতে ফেলে টারজান বলল, তোমাদের ওঝাকে ফিরিয়ে এনেছি। ফিরিয়ে এনেছি সোবিটোকেসে যে চিতা-দেবতার একজন সন্ন্যাসী।

মিথ্যা কথা! সোবিটো আর্তনাদ করে উঠল।

টারজান বলল, চিতা-মানুষদের মন্দিরে আমি ওকে পেয়েছি। ভাবলাম, তোমরা হয়তো তোমাদের ওঝাকে ফিরে পেতেই চাও যাতে খুব কড়া ওষুধ বানিয়ে চিতা-মানুষদের হাত থেকে সে তোমাদের রক্ষা করতে পারে।

একজন সৈনিক গর্জে উঠল, ওকে খুন কর!

সোবিটোকে খুন কর! খুন কর! চার-কুড়ি কণ্ঠ একসঙ্গে গর্জে উঠল।

টারজান বলল, তোমাদের যা ইচ্ছা হয় তাই কর। সে তো আমার ওঝা নয়। আমার অন্য কাজ আছে। আমি চলি। যদি আর দেখা না পাও তবু টারজানকে মনে রেখো; তার জন্যই সাদা মানুষদের প্রতি সদয় ব্যবহার করো, কারণ টারজান তোমাদের বন্ধু, আর তোমরা তার বন্ধু।

যেমন নিঃশব্দে সে এসেছিল তেমনি নিঃশব্দেই অদৃশ্য হয়ে গেল। তার সঙ্গে নকিমাও চলে গেল-চলে গেল নিয়ামওয়েগির আত্মা।

রাতের অন্ধকারে পথ চলতে চলতে এক সময় বুড়ো টাইমার একটা বড় গাছে চড়ে বসল। সেখান থেকেই পাতার ফাঁক দিয়ে দেখতে পেল- গ্রামের মাঝখানে অনেকগুলো লোক গোল হয়ে নাচছে। তারই একটু ফাঁক দিয়ে চোখ ফেলতেই যে দৃশ্য তার চোখে পড়ল তাতে ভয়ে তার শরীর ঠাণ্ডা হয়ে গেল।

হাত-পা বাঁধা একটি মেয়ে মাটিতে পড়ে আছে, আর একটি কুৎসিত মেয়েমানুষ ওয়ালালা তার উপর ঝুঁকে হাতের বড় ছুরিটা ঘোরাচ্ছে। বুড়ো টাইমারের আতংকিত দৃষ্টির সামনে মুহূর্তের মধ্যে অভিনীত হল একটা বীভৎস নির্বাক দৃশ্যঃ সেই কুৎসিত মেয়েমানুষটা সাদা মেয়েটির চুলের মুঠি ধরে টেনে তুলল, আর তার হাতে উদ্যত ছুরিটা আগুনের আলোয় ঝলসে উঠল। একটি মাত্র ছুরি ছাড়া সম্পূর্ণ নিরস্ত্র হওয়া সত্ত্বেও বুড়ো টাইমার ছুটে গিয়ে আসন্ন নারী হত্যার সেই দৃশ্যের সামীল হয়ে পড়ল।

তার কণ্ঠে ধ্বনিত হল রণ-হুংকার; আর ঠিক সেই মুহূর্তে একটা তীর এসে বিঁধল ওয়ালালার বুকে। বুড়ো টাইমারের দৃষ্টি তখন হত্যাকারীর উপরেই নিবদ্ধ; তীরটা সে দেখতে পেল; কিন্তু সে তীর কে ছুঁড়েছে কোন বন্ধু না শত্রু, সেটা সেও যেমন বুঝতে পারল না তেমিন বামনরাও বুঝতে পারল না।

মুহূর্তের জন্য বামনরা হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। বুড়ো টাইমার বুঝতে পারল যে তাদের এই নিষ্ক্রিয় অবস্থা বেশিক্ষণ থাকবে না। সঙ্গে সঙ্গে একটা চালাকি খেলে গেল তার মনে। ভোলা ফটকের দিকে মুখ ফিরিয়ে চেঁচিয়ে বলে উঠল, গ্রাম ঘিরে ফেল! কাউকে পালাতে দিও না! তবে আমাকে না। মারলে কাউকে মেরো না! সে কথাগুলো বলল বোবোলোদের ভাষায়। কাজেই সকলেই তার কথা বুঝতে পারল। এবার তার দিকে ফিরে বলল, একপাশে সরে দাঁড়াও। সাদা মেয়েটিকে আমি নিয়ে যাচ্ছি। কেউ তোমাদের কোন ক্ষতি করবে না।

কেউ কিছু বলার আগেই এক লাফে এগিয়ে গিয়ে সে মেয়েটিকে কোলে তুলে নিল। ততক্ষণে দলের সর্দারের আচ্ছন্ন ভাবটা কেটে গেছে। তার সামনে মাত্র একটি লোক। গ্রামের বাইরে আরও লোক থাকতে পারে। কিন্তু তার সৈনিকরাও কি যুদ্ধ জানে না? লাফ দিয়ে সামনে এগিয়ে সে চীৎকার করে বলল, সাদা লোকটাকে মেরে ফেল!

আর একটা তীর এসে বিধল তার বুকে; সে মাটিতে পড়ে গেল। আর তিনটে তীর এসে পর পর তিনটে বামনকে খতম করে দিল। সঙ্গে সঙ্গে বাকি লোকগুলো সভয়ে চীৎকার করতে করতে নিজেদের ঘরে ঢুকে গেল।

মেয়েটিকে কাঁধে ফেলে বুড়ো টাইমার বিদ্যুঙ্গতিতে ফটক পার হয়ে জঙ্গলের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল। কিসের যেন একটা মড় মড় শব্দ তার কানে এল, কিন্তু সেটা কিসের শব্দ তা বুঝতে পারল না, বুঝবার চেষ্টাও করল না।

বন্দিনী সাদা মেয়েটির খোঁজে বোবোলেদের গ্রামে পৌঁছে একটা দৃশ্য দেখে টারজান অবাক হয়ে গেল। হাত-পা বাঁধা অবস্থায় একটি সাদা মেয়ে মাটিতে পড়ে আছে। আর তাকে ঘিরে রান্না-বান্না ও নাচ গানের মৌজ চলেছে।

এখন তার একমাত্র কাজ মেয়েটিকে উদ্ধার করা। মাটিতে নেমে বেড়া টপকে সে গ্রামের ভিতরে ঢুকল পিছন দিক দিয়ে; তারপর কাছেই একটা গাছে চড়ে লুকিয়ে সব দেখতে লাগল। আর ঠিক তখনই একটি কুৎসিত বুড়ি মেয়েটির চুলের মুঠি ধরে হাতের ছুরিটা তুলল তার গলায় বসিয়ে দিতে।

মুহূর্তমাত্র সময় নেই; টারজান সঙ্গে সঙ্গে ধনুকে তীর ছুঁড়ে দিল। সঙ্গে সঙ্গে ফটকের দিকে দিয়ে হুংকার ছুটে এল একটি সাদা মানুষ। বুঝতে পারল, মেয়েটিকে উদ্ধার করতেই সে এসেছে। তারপরের ঘটনা তো সকলেরই জানা।

টারজান গাছ থেকে নামবার আগেই যে ডালে সে দাঁড়িয়ে ছিল সেটা সশব্দে ভেঙ্গে পড়ল। সেই সঙ্গে টারজানও মাটিতে ছিটকে পড়ল। তার জ্ঞান হারিয়ে গেল। আবার জ্ঞান ফিরে আসতে দেখল, তার শরীরের উপর চেপে বসে বামনরা তার হাত পাকে বেশ শক্ত করে বেঁধে ফেলেছে। টারজান একবার আড়মোড়া ভাঙতেই বামনরা চারদিকে ছিটকে পড়ে গেল, কিন্তু তার হাত-পায়ের বাঁধন ছিঁড়ল না। সে বুঝল, একদল নির্মম, নিষ্ঠুর মানুষের হাতে সে বন্দী হয়েছে।

আত্মরক্ষা ও ফটক রক্ষার যথেষ্ট আয়োজন করা সত্ত্বেও বামনরা ভীষণ ভয় পেয়েছে। তাদের সর্দার মরেছে; মুখের গ্রাস সাদা মেয়েটা উধাও হয়েছে; দৈত্যের মত একটা সাদা মানুষ আকাশ থেকে নেমে এসে তাদের হাতে বন্দী হয়েছে। মাত্র কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে এতগুলো ঘটনা ঘটে যাওয়ায় তারা বেশ শঙ্কিত হয়ে পড়েছে।

এই সব ভাবতে ভাবতেই নিচের গ্রাম থেকে একটা অদ্ভুত হুংকার তাদের কানে এসে লাগল। ওটা কিসের শব্দ ভাল করে বুঝতে না পেরে আদিবাসীরাও ভয়ে আঁতকে উঠল। জঙ্গলের অন্ধকারে অনেক দূর থেকে ভেসে আসা এ ধরনের রহস্যময়, ভয় জাগানো ডাক তারা আগেও শুনেছে, কিন্তু আগে কখনও গ্রামের এত কাছ থেকে শোনে নি; এ যে প্রায় গ্রামের মধ্যে।

যে দুটি বামন বন্দী দৈত্যটির পাহারায় ছিল তারাই ছুটতে ছুটতে এসে জানাল, শব্দটা এসেছে তাদেরই ফাঁকা ঘরটার ভিতর থেকে। তাদের চোখ বিস্ফারিত, শ্বাসরুদ্ধ হবার উপক্রম। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, যাকে আমরা বন্দী করেছি সে মানুষ নয়, একটা দৈত্য। শোন নি তার হুংকার?

এদিকে বামনদের নতুন সর্দার নিয়ালওয়া দলবল নিয়ে টারজনের ঘরটাকে ঘিরে দাঁড়াল। সকলেরই হাতে বিষ মাখানো তীর ও বর্শা। নিয়ালওয়ার সংকেত পেলেই সেই সব ছোঁড়া হবে। টারজনের জীবন মুহূর্তকালের সুতোয় ঝুলছে। এমন সময় বেড়ার ওপাশ থেকে ভেসে এল অনেক ক্রুদ্ধ কণ্ঠের গর্জন। নিয়ালওয়ার মুখের হুকুম তার ঠোঁটে এসেই স্তব্ধ হয়ে গেল।

চীৎকার করে সে বলে উঠল, ও কি?

বেড়ার দিকে তাকিয়ে বামনরা সভয়ে দেখল, কালো কালো সব মূর্তি বেড়া ডিঙিয়ে ভিতরে ঢুকেছে। সকলেই এক সঙ্গে আর্তনাদ করে উঠল, দৈত্যরা আসছে।

আর একজন চেঁচিয়ে বলল, ওরা সব জঙ্গলের লোমশ মানুষের দল।

হাতের বর্শা ছুঁড়ে ফেলে বামনরা পালাতে লাগাল। একটা বাড়ির ছাদে উঠে নকিমা চেঁচাতে শুরু করে দিল, এই পথে জু-টো! গোমাঙ্গানির বাসায় এখানেই আছে অরণ্যরাজ টারজান।

একটা প্রকাণ্ড থঙ্খলে মূর্তি সেই বাড়িটার দিকে দুলে দুলে এগোতে লাগল। যেমন চওড়া তার কাঁধ, তেমিন লম্বা তার হাত। তার পিছু নিল আধ ডজন মস্ত বড় বড় গোরিলা।

টারজান ডাক দিয়ে বলল, এখানে! টারজান এখানে আছে জু-টো।

বড় গোরিলাটা নিচু হয়ে দরজা দিয়ে ভিতরে তাকাল। তার ভিতর দিয়ে তার প্রকাণ্ড শরীরটা ঢুকল না। দুই হাত দিয়ে দরজার চৌকাঠ ধরে গোটা বাড়িটাকেই মাটি থেকে তুলে নিজের পিঠের উপরে আছড়ে ভেঙে ফেলল।

টারজান হুকুম করল, আমাকে জঙ্গলে নিয়ে চল।

জু-টো তাকে কোলে করে বেড়ার কাছে নিয়ে গেল। রাগে গর গর করতে করতে অন্য গোরিলারাও তাকে অনুসরণ করল। মানুষের গন্ধ তাদের ভাল লাগছে না। তারা যেমন এসেছিল তেমনি চলে গেল। মুহূর্তকাল পরেই তারা জঙ্গলের ঘন অন্ধকারে মিশে গেল।

বুড়ো টাইমার ও মেয়েটি নিঃশব্দে অনেকটা পথ হাঁটল। কারও মুখে কথা নেই। থমথমে ভাব। কালি বাওয়ানা হাঁটছে একটু পিছনে থেকে। বারবার সে লোকটিকে দেখছে। কি যেন গভীর চিন্তায় সে মগ্ন।

একটা খোলা জায়গায় পৌঁছে বুড়ো টাইমার থামল। পাশেই নদী। নদীর তীরে একটা বড় গাছ। বলল, এখানেই আমরা বিশ্রাম নেব।

মেয়েটি কিছুই বলল না।

গাছের ডালপালা ও পাতা দিয়ে একটা আস্তানা বানাতে শুরু করে দিল বুড়ো টাইমার। তা দেখে কালি বাওয়ানাও সে কাজে হাত লাগাল। কাজ হয়ে গেলে দুজনে মিলে শুকনো ডালপালা কুড়িয়ে এনে আগুন জ্বালাল কারও মুখে কথা নেই।

এক সময় জঙ্গলের দিকে চোখ পড়তেই মেয়েটি চীৎকার করে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল।

হা ঈশ্বর! দেখ! দেখ!

চীৎকার শুনেই লোকটিও চোখ তুলে তাকাল। পরক্ষণে সেও লাফিয়ে উঠে বলল, পালাও! ঈশ্বরের দোহাই কালি, পালাও! মেয়েটি কিন্তু পালাল না। ছোট লাঠিটা হাতে নিয়ে সেখানে দাঁড়িয়ে রইল। একটা বড় মুগুর হাতে নিয়ে লোকটিও অপেক্ষা করতে লাগল।

অদ্ভুত ভঙ্গীতে দুলতে দুলতে তাদের দিকে এগিয়ে এল একটা প্রকাণ্ড গোরিলা। এতবড় গোরিলা বুড়ো টাইমার আগে কখনও দেখে নি। মেয়েটি তখনও দাঁড়িয়ে আছে দেখে মিনতিভরা গলায় বলল, কালি, দয়া করে পালাও। ঐ জন্তুটাকে আমি কিছুক্ষণ আটকে রাখতে হয়তো পারবো, কিন্তু ওকে থামাতে পারব না। তুমি কি বুঝতে পারছ না কালি যে ও তোমাকেই চাইছে? মেয়েটি তবু নড়ল না। গোরিলাটা ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে। দোহাই তোমার! লোকটি আবার মিনতি জানাল।

মেয়েটি বলল, আমি যখন বিপদে পড়েছিলাম তখন তুমি তো পালিয়ে যাও নি।

লোকটি কি যেন বলতে যাচ্ছিল কিন্তু তার আগেই গোরিলাটা আক্রমণ করে বসল। বুড়ো টাইমার মুগুর দিয়ে তাকে আঘাত করল; মেয়েটিও আঘাত করতে লাগল। সব বৃথা! জন্তুটা বুড়ো টাইমারের হাত থেকে মুগুরটা কেড়ে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিল। তারপর অন্য হাতে আঘাত করল কালি বাওয়ানাকে; মেয়েটির মাথা ঘুরতে লাগল। গোরিলাটা মুহূর্তের মধ্যে বুড়ো টাইমারকে একটা ভাঙ্গা পুতুলের মত তুলে নিয়ে জঙ্গলের দিকে এগিয়ে গেল।

আঘাতের জের কাটিয়ে টলতে টলতে উঠে দাঁড়িয়ে মেয়েটি বুঝল সে একেবারে একা; বুড়ো টাইমার ও জন্তুটা উধাও। চেঁচিয়ে ডাকল; কোন সাড়া নেই। ভাবল, তাকে খুঁজতে যাবে, কিন্তু তারা, কোন্ পথে গেছে তাই তো সে জানে না তাহলে? এই প্রথম কালি বাওয়ানার মনে একটা নতুন অনুভূতি জাগল। এই মানুষটি তো তারই মানুষ। সেই তো তাকে ডেকেছিল- আমার কালি।

অরণ্যরাজ টারজান ভাগ্যের হাতেই নিজেকে ছেড়ে দিয়েছে। হাত-পায়ের যে বন্ধন অচ্ছেদ্য তাকে ছিন্ন করার ব্যর্থ চেষ্টায় সে শক্তি ক্ষয় করে নি, আবার অকারণ অনুশোচনার গ্লানিও ভোগ করে নি। সে চুপচাপ শুয়ে থাকে। নকিমাও মনমরা হয়ে তার পাশেই বসে থাকে।

বেলা পড়ে আসছে। এমন সময় কার যেন পদধ্বনি টারজনের কানে এল। নকিমা বা বড় গোরিলা সে শব্দ শোনার আগেই সে শুনতে পেল; সঙ্গে সঙ্গে গরু-র গরু-র, শব্দ করে সে সকলকে সজাগ করে দিল। লোমশ জন্তুগুলো কান খাড়া করল। মেয়ে জন্তুগুলোও এসে হাজির হল।

একটা প্রকাণ্ড মূর্তি হেলে-দুলে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এল। সে গা-ইয়াট। তার এক বগলে একটা মানুষ।

বুড়ো টাইমারকে নিয়ে গা-ইয়াট টারজনের সামনে মাটিতে নামিয়ে দিল। বলল, আমি গা-ইয়াট। এই নাও একটা টার্মাঙ্গানি। কোন গোমাঙ্গানির দেখা পেলাম না।

গোরিলারা ক্রমেই বুড়ো টাইমারের কাছাকাছি আসতে লাগল। গোরিলাদের এত বড় দল সে আগে কখনও দেখে নি; গোরিলা যে এত বড় হয় তাও সে জানত না। হয়তো এগুলো গোরিলাই নয়; এরা গোরিলার চাইতে অনেক বেশি মানুষের মত দেখতে। আদিবাসীরা এই সব লোমশ মানুষদের কথা বলে বটে, কিন্তু সে সব গল্প বিশ্বাস করত না। সে আরও দেখত, হাত-পা বাঁধা একটি অসহায় সাদা মানুষ গোরিলাদের মাঝখানে শুয়ে আছে। প্রথমে সে তাকে চিনতে পারে নি। ভাবল, সেও হয়তো এই সব বন মানুষদের হাতে বন্দী। বন-মানুষটা যে কালির বদলে তাকে ধরে এনেছে সে জন্য সে কৃতজ্ঞ। বেচারী কালি! না জানি তার কপালে কি ঘটেছে।

গোরিলারা বুড়ো টাইমারকে ঘিরে ধরেছে। তাদের উদ্দেশ্যও স্পষ্ট। সে বেশ বুঝল, তার শেষের দিন সমাগত। তার পরই-কী আশ্চর্য! পাশেই মানুষটি গর্জন করে উঠল; ঠোঁট উল্টে যাওয়ায় তার ঝকঝকে সাদা দাঁতগুলো বেরিয়ে পড়ল। বলল, সাবধান! এই টার্মাঙ্গানি টারজনের সম্পত্তি; কেউ তার কোন ক্ষতি করো না।

গা-ইয়াট ও জু-টো ঝাঁপিয়ে পড়ে অন্য সব গোরিলাদের তাড়িয়ে দিল। বুড়ো টাইমার অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল। টারজনের কথা সে বুঝতে পারে নি; সে যে গোরিলাদের সঙ্গে কথা বলতে পারে এটা তার বিশ্বাস হয় না; কিন্তু নিজের চোখকে সে অবিশ্বাস করবে কেমন করে?

গম্ভীর নিচু গলায় ইংরেজি ভাষায় কেন যেন বলে উঠল, এক বিপদ পার হয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গেই আর এক বিপদে পড়েছ।

বুড়ো টাইমার বক্তার দিকে ফিরে তাকাল। গলাটা যেন চেনা-চেনা লাগছে। এতক্ষণে চিনতে পেরেই সোল্লাসে বলে উঠল, তুমিই তো আমাকে মন্দিরের বিপদ থেকে উদ্ধার করেছিলে!

আর এখন আমিই পড়েছি বিপদে, টারজান বলল।

বুড়ো টাইমার বলল, বিপদ তো দু’জনেরই। ওরা আমাদের নিয়ে কি করবে বলে আমার ধারণা?

কিছুই করবে না, টারজান বলল।

তাহলে আমাকে এখানে এনেছ কেন?

টারজান বলল, আমিই ওদের বলেছিলাম একটি মানুষকে ধরে আনতে। ঘটনাক্রমে তোমাকেই সে প্রথম দেখতে পেয়েছিল।

ওই জানোয়ারটাকে তুমি পাঠিয়েছিলে? তুমি যা বল তাই ওরা করে? তুমি কে? আর কেনই বা একটা মানুষকে আনতে ওকে পাঠিয়েছিলে?

আমি অরণ্যরাজ টারজান। আমার হাত-পায়ের এই তারের বাঁধনগুলো খুলতে পারে এরকম একজনকে আমার প্রয়োজন। এই সব গোরিলা বা নকিমাকে দিয়ে সে কাজটা হয় নি।

বুড়ো টাইমার বলে উঠল, তুমিই অরণ্যরাজ টারজান! আমি তো ভেবেছিলাম তুমি আদিবাসীদের উপকথার এক নায়ক। বলতে বলতেই সে অতি সহজে টারজনের হাত-পায়ের তামার তারের বাঁধন খুলতে লাগল।

টারজান শুধাল, সেই সাদা মেয়েটির কি হল? তুমি তো তাকে নিয়ে বামনদের গাঁ থেকে বেরিয়ে গেলে, কিন্তু আমি পারলাম না, বেঁটা শয়তান আমাকে আটক করল!

তুমি সেখানে ছিলে! ওহো, এবার বুঝতে পেরেছি; তুমিই তীরগুলো ছুঁড়েছিলে।

হ্যাঁ।

তারা তোমাকে ধরল কেমন করে, আর তুমি ছাড়াই বা পেলে কেমন করে? আমি ছিলাম একটা গাছের উপরে-ডালটা ভেঙে পড়ল। মুহূর্তের জন্য জ্ঞান হারিয়েছিলাম। সেই সুযোগে তারা আমাকে বেঁধে ফেলে।

ঠিক বটে। গ্রাম ছেড়ে আসার সময় একটা মড়মড় শব্দ শুনেছিলাম।

টারজান বলল, নিঃসন্দেহে বড় গোরিলাদের আমি ডেকেছিলাম, আর তারাই গিয়ে আমাকে তুলে নিয়ে এসেছে। ভাল কথা, সাদা মেয়েটি কোথায়?

আমরা দুজন শিবিরের দিকেই যাচ্ছিলাম, এমন সময় গোরিলাটা আমাকে পাকড়াও করল, বুড়ো টাইমার বলল। সেখানে সে এখন একা রয়েছে। তার খুলে দেবার পরে আমি তার কাছে ফিরে যেতে পারব তো?

আমিও তোমার সঙ্গে যাব। জায়গাটা কোথায়? চিনতে পারবে তো?

বেশি দূর নয়, কয়েক মাইলের বেশি হবে না; তবু খুঁজে নাও পেতে পারি।

আমি পারব, টারজান বলল।

কেমন করে? বুড়ো টাইমার শুধাল।

গা-ইয়াটের পায়ের ছাপ দেখে; সেটা এখনও স্পষ্টই আছে।

বুড়ো টাইমার তখন টারজনের কব্জির তার খুলে গোড়ালির তার খুলতে ব্যস্ত। এক মুহূর্ত পরেই টারজনের বন্ধন-মুক্তি ঘটল। এক লাফে সে উঠে দাঁড়াল।

চলে এস! গা-ইয়াট যেখানে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এসেছিল সেই দিকটা দেখিয়ে টারজান জোর কদমে ছুটল।

বুড়ো টাইমার তার সঙ্গে সমান তালে ছুটতে পারল না; ক্ষুধায় ও ক্লান্তিতে সে দুর্বল হয়ে পড়েছে। বলল, তুমি এগিয়ে যাও। তোমার সঙ্গে সমান গতিতে আমি ছুটতে পারছি না। কিন্তু সময় নষ্ট করা চলবে না। মেয়েটি সেখানে একা রয়েছে।

টারজান আপত্তি জানিয়ে বলল, একা রেখে গেলে তুমি পথ হারিয়ে ফেলবে। দাঁড়াও ব্যবস্থা করছি। নকিমাকে ডাকতেই সে গাছ থেকে লাফ দিয়ে টারজনের কাঁধে এসে বসল। টারজান বলল, তুমি টার্মাঙ্গানির কাছে থাক। ওকে পথ দেখিয়ে আমার পিছু পিছু নিয়ে এস।

দু’জনকে আলাপ করতে দেখে বুড়ো টাইমার তো অবাক। মানুষ আর বানরে কথা বলছে, এ যে অবিশ্বাস্য অথচ যা সে চোখে দেখছে, কানে শুনছে তাতো মায়া নয়, খাঁটি সত্য ঘটনা।

অসহায় সংকটে পড়ে কালি বাওয়ানা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ল। লোকটি যখন বামনদের হাত থেকে উদ্ধার করে আনল তখন তবু তার মনে কিছুটা স্বস্তির ভাব এসেছিল; তার সঙ্গে তুলনায় এখন তার পরিস্থিতি আরও অসহ্য মনে হতে লাগল। পরন্তু, বিপদের সঙ্গে এখন যুক্ত হয়েছে ব্যক্তিগত দুঃখ।

বুড়ো টাইমার যে অস্থায়ী আস্তানাটা তার জন্য বানিয়েছিল সেদিকে তাকিয়ে মেয়েটির দুই গাল বেয়ে চোখের জল ঝরতে লাগল। তার হাতের তৈরি ধনুকটা তুলে তাতে ঠোঁট দুটি ছোঁয়াল। আর কোনদিন তার সঙ্গে দেখা হবে না। এ-কথা ভাবতেই অবরুদ্ধ কান্নায় তার গলা আটকে এল। অনেক-অনেক দিন সে কাঁদে নি। সাহসের সঙ্গে কত দুঃখ, দুর্দশা ও বিপদের মোকাবিলা করেছে; কিন্তু এখন আস্তানার ভিতরে ঢুকে কান্নায় ভেঙে পড়ল।

সব কিছুই কেমন যেন গোলমাল হয়ে গেছে। জেরির সন্ধান ব্যর্থ হয়েছে। সম্পূর্ণ অপরিচিত একটি মানুষ তার সঙ্গে জড়িয়ে মৃত্যুর মুখে এগিয়ে গেছে। দুঃখে ও অনুশোচনায় এখন তারই মূল্য তাকে শুধতে হচ্ছে।

বেশ কিছু সময় সেখানে শুয়ে হা-হুঁতাশ করল। তারপর এক সময় বুঝল এতে কোন ফল হবে না। হাল ছেড়ে দিলে চলবে না। এই শেষ আঘাতের পরেও থেমে যাওয়া চলবে না। এখনও সে বেঁচে আছে, অথচ জেরিকে খুঁজে পায় নি। তাকে এগিয়ে যেতে হবে। নদীতে পৌঁছতে হবে। যেমন করে হোক নদী পার হতে হবে। বুড়ো টাইমারের শিবির খুঁজে বের করতে হবে। তার অংশীদারটির সাহায্য নিতে হবে কিন্তু তার জন্য তো খাদ্য চাই; বলকারক মাংস চাই। এই দুর্বল দেহ নিয়ে সে তো চলতে পারবে না। যে ধনুক সে তৈরি করে রেখে গেছে সেটার সাহায্যেই তাকে মাংসের ব্যবস্থা করতে হবে। তীরগুলো নিতে সে বাইরে বেরিয়ে এল। এখনও শিকারের সময় পার হয়ে যায় নি।

ঘর থেকে বেরিয়েই সে চমকে উঠল। ওটা কি? মনে মনে এই ভয়ই সে করছিল। জঙ্গলের কাছে দাঁড়িয়ে একটা চিতাবাঘ তার দিকেই তাকিয়ে আছে। চিতার হলদে চোখ দুটি তার উপর পড়তেই তার পেটটা মাটিতে নেমে গেল, বিকৃত মুখে একটা ফ্যাচফ্যাচ শব্দ হতে লাগল। জন্তুটা গুঁড়ি-মেরে তার দিকেই এগিয়ে আসছে; লেজটা বেঁকে বেঁকে নড়ছে।

ক্রমেই কাছে আসছে-আরও কাছে। মেয়েটি ধনুকে তীর লাগল। এ চেষ্টা বৃথা তা সে জানে। একটা বিধ্বংসী কামানকে এত ছোট একটা গুলিতে বিদ্ধ করা যাবে না। তবু শেষ চেষ্টা করতেই হবে।

চিতাটা এগিয়ে আসছে। এখন শুধু লাফিয়ে পড়ার অপেক্ষা। এমন সময় মেয়েটি দেখল, চিতাটার ঠিক পিছনে একটি মনুষ্য-মূর্তি জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এল-একটি দৈত্যাকার সাদা মানুষ, শুধুমাত্র কটিবস্ত্র পরিহিত।

কোন রকম ইতস্তত না করে লোকটি ছুটে আসছে চিতাটাকে লক্ষ্য করে নরম ঘাসের উপর তার পায়ের কোন শব্দও হচ্ছে না। হঠাৎ মেয়েটি সভয়ে লক্ষ্য করল, লোকটি নিরস্ত্র।

চিতা শরীরটাকে মাটি থেকে একটুখানি তুলল। পিছনের পা দুটি শরীরের নিচে টেনে আনল। এবার একটা লাফ। বাস, তাহলেই মেয়েটির ভবলীলা সাঙ্গ। ঠিক তখনই লোকটি যেন বাতাসে ভেসে এসে জন্তুটার পিঠের উপর চেপে বসল।

তারপর যা ঘটল সে অবিশ্বাস্য ঘটনা। দাগ-দাগ চামড়া ও বাদামী চামড়া, হাত ও পা, নখর ও দাঁতের অতি দ্রুত ওলোট-পালোট ও জড়াজড়ি; আর সে সব কিছুকে চাপিয়ে শোনা যেতে লাগল দুটি রক্তপাগল জন্তুর বীভৎস চীৎকার।

জড়াজড়ি করতে করতে মানুষটি হঠাৎ উঠে দাঁড়াল। পেছন থেকে চিতাটার গলা পেঁচিয়ে ধরে সেটাকেও টেনে তুলল। সেই মৃত্যু-মুষ্টি থেকে নিজেকে ছাড়াতে জন্তুটা আপ্রাণ চেষ্টা করছে; কিন্তু তার গলা দিয়ে এখন আর স্বর বেরুচ্ছে না। ধীরে ধীরে জন্তুটার দেহ শান্ত হয়ে এল। তখন চিতাটার গলাটা মুচড়ে ছিঁড়ে ফেলে লোকটি তার মৃতদেহটাকে মাটিতে ফেলে দিল। মুহূর্তের জন্য লোকটি তার উপর পা রেখে দাঁড়াল। গোরিলার বিজয় চীৎকারে সারা বনভূমি ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হতে লাগল।

কালি বাওয়ানা শিউরে উঠল। তার শরীরের ভিতরটা যেন ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। একবার ভাবল এই জংলী মানুষটার কাছ থেকে পালিয়ে যাবে। কিন্তু তখনই সে তার দিকে ঘুরে দাঁড়াল; পালাবার সুযোগই হল না। ভাবল, তীর-ধনুক তো হাতেই আছে; কিন্ত তা দিয়ে কি এই মানুষটাকে ভয় দেখানো যাবে!

লোকটি কিন্তু সহজভাবেই বলল, ঠিক সময়েই এসে পড়েছি। তোমার বন্ধুটিও এখনই এসে পড়বে; একটু থেমে বলল, ধনুকটা নামিয়ে রাখ, আমি তোমার কোন ক্ষতি করব না।

ধনুকটা পাশে রেখে মেয়েটি বলল, আমার বন্ধু! কে? তুমি কার কথা বলছ?

নাম তো জানি না। তোমার কি অনেক বন্ধু আছে?

বন্ধু তো একজনই আছে। কিন্তু আমি তো ভেবেছিলাম সে মারা গেছে। একটা মস্ত গোরিলা তাকে তুলে নিয়ে গেছে।

টারজান আশ্বাস দিয়ে বলল, সে ভালই আছে। এখনই আসবে।

কালি বাওয়ানা মাটিতে বসে পড়ল। অস্ফুট স্বরে বলল, ঈশ্বরকে ধন্যবাদ!

বুকের উপর দুই হাত রেখে টারজান মেয়েটিকে দেখছে। কী সুন্দর দেখতে! এই নরম শরীরে এত কষ্ট সে সহ্য করেছে? অরণ্যরাজ সাহসের প্রশংসা করে; সে জানে, যে বিপদের ভিতর দিয়ে মেয়েটি এসেছে তাতে কতখানি সাহস থাকা দরকার।

কার যেন পায়ের শব্দ কানে এল। টারজান বুঝতে পারল। পরিশ্রমের ফলে লোকটা হাঁপাচ্ছে। মেয়েটিকে দেখেই ছুটে গিয়ে বলে উঠল, তুমি ভাল আছ? মরা চিতাটা তার পাশেই পড়ে আছে।

হ্যাঁ, মেয়েটি জবাব দিল।

দু’জনই কেমন যেন দিশেহারা হয়ে পড়েছে। কার মনে কি আছে তা কেউ জানে না। লোকটিকে নিরাপদ দেখে মেয়েটি তার মনের ভাবটা চেপেই রাখল। আবার ওদিকে বুড়ো টাইমারের কানে তখনও বাজছে কালি বাওয়ানার সেই কঠোর উক্তি, আমি তোমাকে ঘৃণা করি।

টারজান বলল, তাদের দু’জনকে সে বুড়ো টাইমারের শিবিরে পৌঁছে দিতে পারে, অথবা নদীর ভাটিতে প্রথম থানায় তাদের রেখে আসতে পারে। মেয়েটি কিন্তু জিদ ধরল, সে শিবিরেই ফিরে যাবে, তারপর সেখান থেকে নতুন করে যাত্রার আয়োজন করবে; তখন বুড়ো টাইমার তার সঙ্গে নদীর ভাটিতেও যেতে পারে, অথবা জেরি জেরোমের অনুসন্ধানে তার সঙ্গীও হতে পারে।

রাত হবার আগেই টারজান মাংস নিয়ে ফিরে এল। দু’জনে সেই মাংস রান্না করতে বসল, আর টারজান একটু দূরে বসে শক্ত সাদা হাত দিয়ে কাঁচা মাংস ছিঁড়ে ছিঁড়ে খেতে লাগল। তার কাঁধে বসে ছোট্ট নকিমা ঘুমে ঢুলতে লাগল।

পশ্চিম অরণ্যের ওপারে সূর্য অস্ত যাচ্ছে। বোবোলোর গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া বড় নদীটার খরস্রোতে তার আলো পড়ে ঝিলমিল করছে। একটি পুরুষ ও একটি নারী সেই স্রোতধারার দিকে তাকিয়ে আছে। এই অন্ধকার গহন অরণ্য তার সভ্য জগতের মধ্যে এই নদীই একমাত্র যোগসূত্র; অনেক নগর, বন্দর পার হয়ে সে দীর্ঘ যাত্রায় চলেছে পশ্চিম দিকে সাগরের ডাকে।

লোকটি বলল, কালই আমরা যাত্রা করব। ছয় বা আট সপ্তাহের মধ্যেই তোমরা দু’জন বাড়ি পৌঁছে যাবে। বাড়ি’ এই একটি মাত্র ছোট শব্দের মধ্যে কত না ইচ্ছা পূরণের আনন্দ লুকিয়ে আছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে লোকটি বলল, তোমাদের দুজনের জন্য আমার কত আনন্দ।

মেয়েটি আরও কাছে এসে তার মুখোমুখি দাঁড়াল। চোখে চোখ রেখে বলল, তুমিও তো আমাদের সঙ্গেই যাচ্ছ?

এ কথা কেন ভাবছ? লোকটি শুধাল।

যেহেতু আমি তোমাকে ভালবাসি, তাই তুমি যাবে।

জঙ্গলের রাজা টারজান (টারজান লর্ড অফ দি জাঙ্গল)

সেদিন ভরদুপুরে জঙ্গলের ছায়াঘেরা গভীরে টারজনের প্রিয় বন্ধু ট্যান্টর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তার গুঁড়টা দোলাচ্ছিল। এই বিশাল জঙ্গলের মধ্যে বহু বছর ধরে নুমা, শীতা, ডাঙ্গো প্রভৃতি কত সব হিংস্র জন্তু জানোয়ারদের কাছাকাছি বাস করে আসছে হাতিটা। কিন্তু এদের কাউকে ভয় করে না সে। কেউ তাকে অকারণে মারতে আসে না বা লড়াই করতে আসে না তার সঙ্গে। একমাত্র মানুষই তার শত্রু। কালো সাদা সব মানুষই তার দাঁতের লোভে তাকে মারতে আসে।

মানুষদের মধ্যে একমাত্র টারজানই হলো ব্যতিক্রম। সে সাদা চামড়ার মানুষ হলেও তাকে কোনদিন মারতে আসেনি। ছেলেবেলা থেকে সে খেলা করে আসছে তার সঙ্গে।

একদিন ফাঁদ ও মতলগ নামে দু’জন আরব ফেজুয়ান নামে এক নিগ্রো ক্রীতদাসকে সঙ্গে নিয়ে। শিকার করতে করতে উত্তর দিকে চলে আসে।

হাতিটাকে দূর থেকেই গুলি করে আরবরা। ফেজুয়ান প্রথমে দেখতে পায়। কিন্তু গুলিটা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে হাতিটার পাশ দিয়ে চলে যায়। হাতিটা ছুটে পালিয়ে যায়। টারজান তখন হাতিটার পিঠের উপর শুয়েছিল। হাতিটা ডালপালা ভেঙ্গে সেখান দিয়ে পথ করে পালিয়ে যেতে গেলে একটা গাছের ডালে মাথায় জোর আঘাতের ফলে টারজান মাটিতে পড়ে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে যায়।

ফেজুয়ান ফাদকে বলল, তোমার গুলিটা লাগেনি মালিক।

ফাদ বলল, গুলিটার মধ্যে শয়তান ছিল। চল দেখি হাতিটার গায়ে হয়ত লেগেছে।

ফাদ বলল, একটা হাতি শিকার করতে গিয়ে একটা শ্বেতাঙ্গকে মারলাম?

মতলগ বলল, একটা খ্রিস্টান কুকুর, আবার প্রায় উলফঙ্গ। গুলিটা ওর কোথায় লেগেছে?

ওরা টারজনের দেহটা পরীক্ষা করে দেখল তার দেহে কোথাও কোন ক্ষতচিহ্ন নেই। শুধু মাথায় একটা ক্ষতচিহ্ন আছে।

ফেজুয়ান বলল, ও এখনো মরেনি। হাতিটা পালিয়ে গেছে। হাতিটা যখন পালিয়ে যাচ্ছিল তখন ওর মাথায় আঘাত লাগে।

ফাদ কোমর থেকে তার ছোরাটা বার করে বলল, আমি ওকে শেষ করব।

মতলগ বাধা দিয়ে বলল, আল্লার নামে বলছি তোমার ছোরাটা রেখে দাও। আমরা ওকে শেখের কাছে বেঁধে নিয়ে যাব। শেখ যা করার করবে।

ফাদ বলল, তাহলে ওকে বেঁধে ফেল।

টারজনের হাত দুটো পেটের উপর জড়ো করে উটের চামড়ার দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলল ওরা। টারজান তখন চোখ মেলে তাকিয়ে দেখল। সে আরবদের দেখে চিনতে পারল। সে তাদের বলল, তোমরা আমায় বাঁধছ কেন? আমার বাঁধন খুলে দাও বলছি।

ফাদ হেসে বলল, তুমি যে দেখছি শেখের মত হুকুম চালাচ্ছ। নিজেকে শেখ ভাবছ নাকি?

টারজান বলল, লোকে আমাকে টারজান বলে। আমি হচ্ছি শেখের শেখ।

টারজান!

চমকে উঠল মতলগ। গলার স্বর নিচু করে বলল, আমাদের দুর্ভাগ্য যে এই লোকটার সঙ্গে আমাদের দেখা হয়ে গেল। গত দু’সপ্তাহর মধ্যে যে গাঁয়েই গিয়েছি সেখানেই ওর নাম শুনেছি। গ্রামবাসীরা একবাক্যে বলেছে, থাম, টারজান আসছে। তার দেশ থেকে ক্রীতদাসদের ধরে নিয়ে যাওয়ার জন্য তোমাদের হত্যা করবে সে।

ফাদ বলল, তুমি বাধা দিলে আমায়। ওকে মেরে ফেলাই ভাল ছিল।

মতলগ বলল, পরে একথা প্রচার হয়ে গেলে আমাদের আর জীবন্ত দেশে ফিরে যেতে হবে না। আমাদের ক্রীতদাসরাই পালিয়ে গিয়ে প্রচার করে বেড়াবে একথা।

ফাদ বলল, ঠিক আছে। শেখের কাছেই নিয়ে চল ওকে।

শেখ ইবন জাদের মঞ্জিলে তখন অন্ধকার নেমে এসেছে। মঞ্জিলের ভিতরে একটা তাঁবুর ঘরের ভিতরে টারজান হাত পা বাঁধা অবস্থায় শুয়েছিল। বাঁধনগুলো খোলার জন্য অনেক চেষ্টা করল। কোনভাবে ছিঁড়তে বা খুলতে পারল না।

টারজান শুনতে পেল তাঁবুর বাইরে কারা ফিস ফিস করে কথা বলছে।

হঠাৎ ওরা কিসের একটা শব্দ শুনে চমকে উঠল। সে শব্দ শুনে সবাই চমকে উঠল। ক্রীতদাসরা তাঁবুর বাইরে এসে দেখতে লাগল। আরবরা বন্দুক তুলে নিল হাতে।

ইবন জাদ বলল, তাঁবুর ভিতর থেকে শব্দটা আসছে। মনে হচ্ছে একটা পশু গর্জন করছে। বন্দীটা ত মানুষ।

ফাদ বলল, ও মানুষ হলেও ওর মধ্যে শয়তান আছে।

ইবন জাদ হাতে বন্দুক আর কাগজের লণ্ঠন নিয়ে টারজনের ঘরে গিয়ে উঁকি মেরে দেখল টারজান ঠিকই আছে। সে জিজ্ঞাসা করল, তুমি একটা শব্দ শুনেছ? ওটা কিসের শব্দ?

টারজান বলল, এক পশুর প্রতি অন্য এক পশুর ডাক। জঙ্গলের ডাক শুনে বেদুইনরা ভয় পায়।

ইবন জাদ বলল, বেদুইনরা ভয় পায় না। আমরা ভেবেছিলাম বাড়ির মধ্যে হয়ত বা কোন জন্তু জানোয়ার ঢুকেছে। যাই হোক, আগামীকাল তোমাকে মুক্তি দেব।

টারজান বলল, কিন্তু আজ নয় কেন?

ইবন জাত বলল, সিংহ অধ্যুষিত এই নৈশ জঙ্গলে একা তোমাকে ছাড়া ঠিক হবে না।

টারজান হাসল। হাসিমুখে বলল, রাত্রির জঙ্গলে টারজান নিরাপদ। কোন সময়েই জঙ্গলকে ভয় করে না টারজান।

এদিকে টারজনের-ডাকটা জঙ্গলের মধ্যে দূরে একজন শুনতে পেয়েছিল এবং সে সাড়াও দিয়েছিল। সে হলো টারজনের বন্ধু ট্যান্টর। শেখের মঞ্জিলের সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ল এবং গোটা বাড়িটা স্তব্ধ হয়ে গেল তখন হাতিটা গঁড় তুলে জ্বলন্ত লাল চোখদুটো নিয়ে জঙ্গলের মধ্য দিয়ে হুড়মুড় করে আসতে লাগল।

এদিকে শেখের বাড়িতে সবাই ঘুমিয়ে পড়লেও শেখ তার ঘরের সামনে বসে তার ভাই-এর সঙ্গে বসে ধূমপান করছিল। শেখ এক সময় তার ভাই তোলোগকে বলল, কোন ক্রীতদাসকে জানাবে না যে তুমি টারজানকে হত্যা করছ। কাজটা হয়ে গেলে কবর খোঁড়ার জন্য দু’জন বলিষ্ঠ ক্রীতদাসকে জাগাবে। তাদের মধ্যে একজন হবে ফেজুয়ান আর একজন অন্য কেউ।

তোলোগ বলল, আব্বাস আর ফেজুয়ান-দু’জনেই বিশ্বস্ত।

শেখ বলল, তাহলে যাও। এখন সবাই ঘুমিয়েছে।

এই কথা বলে শেখ তার শোবার ঘরে চলে গেল। এদিকে হাতিটা জঙ্গলের মধ্য দিয়ে ভয়ঙ্করভাবে ছুটে আসতে লাগল। তার পথের সামনে কোন সিংহ বা চিতাবাঘ দাঁড়াতে পারল না। সবাই একপাশে সরে যেতে লাগল।

অন্ধকারে পা টিপে টিপে তোলোগ টারজনের তাঁবুর ভিতরে চলে গেল। টারজান তখন মাটিতে কান পেতে কিসের শব্দ শোনার চেষ্টা করছিল। তোলোগ তার ঘরে ঢুকতেই টারজান খাড়া হয়ে উঠে বসল। সে আবার সেই আগের মত চীৎকার করে উঠল। গোটা শিবিরটা কেঁপে উঠল সেই চীৎকারের শব্দে।

তোলোগ বলল, এখানে কোন জন্তু আসেনি ত?

সে দেখল তাঁবুর মধ্যে কোন জন্তু নেই। সে ছুটে বেরিয়ে গিয়ে একটা কাগজের লণ্ঠন নিয়ে এল। তোলোগ দেখল টারজান তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। সে বলল, তুমি আমাকে হত্যা করতে এসেছ!

তোলোগ টারজনের বুকে ছুরিটা বসাবার জন্যে এগিয়ে এলে টারজান তার বাঁধা হাতদুটো দিয়ে তাকে সরিয়ে দিল। তোলোগ আবার এলে টারজান তার মাথায় হাত দুটো দিয়ে এমনভাবে আঘাত করল। যে সে পড়ে গেল। কিন্তু তোলোগ উঠেই এবার টারজনের পেছন থেকে আঘাত করতে গেল। টারজান হাঁটুর উপর ভর দিয়ে বাধা দিতে গেলে সে টাল সামলাতে না পেরে পড়ে গেল। তোলোগ এবার সুযোগ পেয়ে ছুরিটা টারজনের বুকে বসাতে গেলেই সে আশ্চর্য হয়ে দেখল গোটা তাবুটা উপর থেকে কে তুলে নিল। তারপর দেখল একটা বিরাট হাতি খুঁড় দিয়ে তার দেহটা জড়িয়ে ধরে তাকে তুলে একটা তাবুর মাথায় ফেলে দিল।

হাতিটা এবার টারজানকে খুঁড় দিয়ে তার পিঠের উপর চাপিয়ে বেগে ছুটে পালাতে লাগল।

শেখের লোকজন ছুটে এসে দেখল বন্দী নেই। হাতিটা তখন জঙ্গলে পালিয়ে গেছে।

তোলোগ শেখকে বলল, বন্দীর একটা পোষা শয়তান আছে। সে হাতির রূপ ধরে এসে তাকে ছিনিয়ে নিয়ে গেল।

সব কিছু শুনে অনেক ভেবে শেখ বলল, কাল সকালেই আমরা শিবির গুটিয়ে উত্তর দিকে রওনা হব।

পরদিন সকালে কোনরকমে প্রাতরাশ সেরেই ঘণ্টাখানেকের মধ্যে শিবির গুটিয়ে ফেলল ওরা। আরবরা ঘোড়ায় চাপল। ক্রীতদাসরা মালপত্র নিয়ে হেঁটে যেতে লাগল। আতিজা আর জায়েদ ঘোড়ায়। চড়ে পাশাপাশি যাচ্ছিল।

তিন দিন ধরে আরবরা উত্তর দিকে হাবাসের পথে এগিয়ে যেতে লাগল ধীরে গতিতে। এদিকে টারজানও তিন দিন ধরে জঙ্গলের মধ্যে একটা ফাঁকা জায়গায় হাত পা বাঁধা অবস্থায় পড়ে রইল। হাতিটা। সর্বক্ষণ তার পাশে দাঁড়িয়ে পাহারা দিতে লাগল। তিন দিন কোন খাদ্য বা একটু জল পর্যন্ত খেতে পায়নি। টারজান।

এই কদিনের মধ্যে মনু বা ছোট ছোট বাঁদরদের ডেকেছিল তার বাঁধনগুলো খুলে দেবার জন্য কিন্তু তারা কেউ তা পারেনি।

চতুর্থ দিন সকাল হতেই হাতিটা অশান্ত হয়ে উঠল। হাতিটা এই কদিন টারজানকে ফেলে দূরে। কোথাও যায়নি। কাছাকাছি ঘাসপাতা যা পেয়েছে তাই খেয়েছে। আজ সে তাই টারজানকে নিয়ে দূরে কোথাও যেতে চাইল।

কিন্তু টারজান সেখান থেকে যেতে চাইল না। কারণ সে ভাবল, বাঁদর-গোরিলারা যেখানে থাকে এই জায়গাটা হলো তার কাছাকাছি। নিশ্চয়ই এই পথে একদল বাঁদর-গোরিলা আসবে এবং তাদের মধ্যে দু একজন ঠিক টারজানকে চিনবে এবং দাঁত দিয়ে তার বাঁধনগুলো কেটে দেবে।

হাতিটা টারজানকে পিঠের উপর চাপিয়ে নিতেই টারজান বলল, আমাকে নামিয়ে দাও ট্যান্টর তুমি আমাকে দূরে নিয়ে গেলে আমার বাঁধন খোলার কাউকে পাব না।

তার কথা বুঝে হাতিটা তাকে নামিয়ে দিয়ে চলে গেল।

টারজান যা ভেবেছিল তাই হলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই একদল বাঁদর-গোরিলা ঘুরতে ঘুরতে টারজান যেখানে হাত পা বাঁধা অবস্থায় পড়ে ছিল সেখানে হাজির হলো।

টারজান বাঁদর-গোরিলাদের ভাষায় তাদের বলল, আমি হচ্ছি বাঁদরদলের টারজান। তোমাদের বন্ধু। টারমাঙ্গানীরা আমাকে ধরে আমার হাত পা বেঁধে রেখে দেয়। তোমরা এসে আমার বাঁধন খুলে দাও।

একটা গোরিলা বলল, তুমি হচ্ছ টারমাঙ্গানী।

টারজান আবার বলল, না আমি বাঁদরদলের রাজা টারজান।

গাছের উপর থেকে একটা মনু বা ছোট বাঁদর বলল, হ্যাঁ, ও টারজানই বটে। গোমাঙ্গানী আর টারমাঙ্গানীরা মিলে ওকে ধরে নিয়ে বেঁধে ফেলে। আজ চারদিন হলো ও এইভাবে বাঁধা আছে।

সহসা গাছের আড়াল থেকে একটা গোরিলা এগিয়ে এসে বলল, আমি জানি টারজানকে।

টারজান বলল, আগে আমার বাঁধনগুলো খুলে দাও।

মোয়ালাৎ টারজনের হাত ও পায়ের বাঁধনগুলো খুলে দিল। মুক্ত হয়ে খাড়া হয়ে দাঁড়াল টারজান। এমন সময় বাঁদর-গোরিলা দলের রাজা তোয়াৎ এসে হাজির হলো সেখানে। সে টারজানকে দেখেই মাটিতে ঘুষি মেরে লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে তার শক্তির আস্ফালন করতে লাগল। দলের রাজা হিসেবে যুদ্ধে আহ্বান করতে লাগল টারজানকে। মোয়ালাৎ বলল, ও হচ্ছে মাঙ্গানীদের বন্ধু।

তোয়াৎ বলল, না, ও হচ্ছে টারমাঙ্গানী ও মাঙ্গানীদের শত্রু। ওকে মেরে ফেলো।

গয়াৎও মোয়ালাতের দলে এসে বলল, আমি যখন ছোট ছিলাম এই টারজানই আমাকে সিংহের কবল থেকে বাঁচায়। ও আমাদের বন্ধু।

বাঁদর-গোরিলারা একটা বিষয় নিয়ে বেশিক্ষণ মাথা ঘামায় না। তোয়াৎ যখন দেখল অনেক গোরিলা এক এক করে টারজনের দলে এল তখন সে আহারের সন্ধানে অন্যত্র চলে গেল। টারজান সেই বাঁদর দলেই রয়ে গেল তাদের বন্ধু হিসেবে।

জেমস হান্টার ব্লেক নামে এক ধনী আমেরিকান যুবক উইলবার স্টিম্বল নামে এক বয়স্ক ব্যক্তিকে সঙ্গে করে অভিযানে বার হয় আফ্রিকা জঙ্গলে। আফ্রিকার যত সব ভয়ঙ্কর জীব-জন্তুগুলোকে যতদূর সম্ভব চলচ্চিত্রের ক্যামেরায় ধরে রাখাই ছিল তাদের উদ্দেশ্য।

তাদের সঙ্গে কিছু নিগ্রো আদিবাসী ছিল; তারা মালপত্র বহন করত, যাবতীয় কাজকর্ম করত। তারা সাবই স্টিম্বলের নির্দেশে চলত। কিন্তু স্টিম্বলের মেজাজটা ছিল বড় রুক্ষ্ম। কথায় কথায় সে ঝগড়া করত যার তার সঙ্গে। একদিন তার দুর্ব্যবহারে অতিষ্ঠ হয়ে চলচ্চিত্রের ক্যামেরাম্যান দল ছেড়ে চলে যায়। ফলে আফ্রিকার অরণ্য জীবনের সচিত্র ছবি তোলার কাজ বন্ধ হয়ে যায়।

দুপুরে এক জায়গায় শিবির স্থাপন করতে বলল ব্লেক। ঠিক হলো ব্লেক শিবিরেই থাকবে আর স্টিম্বল একদল নিগ্রো যোদ্ধাকে নিয়ে শিকারে যাবে।

স্টিম্বল শিকারে চলে গেল। মাইলখানেক যাবার পর একটা বিরাটকায় বাঁদর-গোরিলা দেখতে পেল সে। গোরিলাটা সামনে দিয়ে চলে যাচ্ছিল। কিন্তু স্টিম্বল তাকে পিছন থেকে গুলি করল। গুলিটা লাগল না তার গায়ে। গোরিলাটা গাছের আড়ালে আড়ালে পালাতে লাগল। কিন্তু তাকে দেখতে পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গুলি করতে লাগল স্টিম্বল। সে তার নিগ্রো যোদ্ধাদের জিজ্ঞাসা করল, ওটা কি জন্তু?

তারা বলল, গোরিলা।

স্টিম্বল বলল, ওটাকে আমি ধরে নিয়ে যাব।

এদিকে টারজান তখন কাছাকাছি একটা গাছের উপর স্টিম্বলের গুলির আওয়াজ শুনতে পায়। সে গাছের উপর থেকে মুখ বাড়িয়ে দেখল, একটা বাঁদর-গোরিলা গুলির ভয়ে গাছপালা ভেঙ্গে ছুটে পালাচ্ছে আর তার পিছনে বন্দুক হাতে একজন শ্বেতাঙ্গ তাকে মারতে যাচ্ছে।

টারজান দেখল বোলগানি বা গোরিলাটা যে পথে ছুটছিল সেই পথের ধারে একটা গাছে একটা বড় অজগর রয়েছে। প্রাণ ভয়ে পালাতে গিয়ে সাপটাকে দেখতে পায়নি গোরিলাটা। এখন গোরিলাটা ডালপালা ভেঙ্গে ভয়ঙ্করভাবে গর্জন করতে করতে ছুটতে থাকায় অজগরটা তাকে কাছে পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জড়িয়ে ধরল। গোরিলাটা তার কুণ্ডলি থেকে নিজেকে মুক্ত করার যতই চেষ্টা করতে লাগল সাপটা ততই জোরে চেপে ধরল তার দেহটাকে।

এমন সময় স্টিম্বল আর টারজান একই সময়ে হাজির হলো সেখানে। টারজান দেখল একজন শ্বেতাঙ্গ শিকারী রাইফেল তুলে ধরে একই সঙ্গে গোরিলা আর অজগর সাপটাকে মারতে যাচ্ছে।

টারজান যখন দেখল শ্বেতাঙ্গ শিকারী স্টিম্বলই গোরিলাটার এই অবস্থার জন্য দায়ী তখন সে স্টিম্বলের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে ফেলে দিল মাটিতে। স্টিম্বল উঠে দাঁড়াবার আগেই টারজান তার ছুরিটা কেড়ে নিয়ে সাপটার কাছে গিয়ে আঘাত করতে লাগল তাই দিয়ে। সাপটার গায়ে ছুরিটা আমূল বসিয়ে দিতেই সাপটা গোরিলাটাকে ছেড়ে টারজানকে জড়িয়ে ধরতে লাগল। টারজান সাপটার গলাটা টিপে ধরে ক্রমাগত তার গায়ের বিভিন্ন জায়গায় ছুরিটা বসাতে লাগল। অবশেষে তার মাথাটা কেটে দিল।

গোরিলাটা জোর আঘাত পেয়েছিল। সে কিছুক্ষণ শুয়ে থাকার পর ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল। টারজান তাকে বলল, আমি বাঁদর-দলের টারজান। তোমাকে হিন্তা অর্থাৎ সাপের কবল থেকে বাঁচালাম।

গোরিলাটা ভেবেছিল টারজান এবার তাকে মারবে। সে ভয়ে ভয়ে টারজানকে বলল, তুমি আমাকে বধ করবে না?

টারজান বলল, না আমরা এখন বন্ধু।

গোরিলাটা তখন বলল, আমাদের পিছনে যে টারমাঙ্গানীটা রয়েছে সে আমাদের দু’জনকেই ঐ বজ্র ভরা লাঠিটা দিয়ে হত্যা করবে।

টারজান বলল, না, ওকে আমি এখান থেকে তাড়িয়ে দেব।

স্টিম্বল এতক্ষণ সবকিছু দেখছিল দাঁড়িয়ে। গোরিলাটার সঙ্গে টারজনের যে সব কথা হচ্ছিল তা সে বুঝতে পারছিল না। টারজান তার কাছে ফিরে এলে সে বলল, তুমি সরে যাও, এবার আমি গোরিলাটাকে বধ করব।

স্টিম্বল আর গোরিলাটার মাঝখানে এসে দাঁড়াল টারজান। বলল, তোমার রাইফেল নামাও।

স্টিম্বল বলল, মোটেই না, আমি কি শুধু শুধুই এতক্ষণ ওকে তাড়া করে বেড়াচ্ছিলাম? তুমি জান আমি কে? আমি হচ্ছি উইলবার স্টিম্বল। স্টম্বল এ্যান্ড কোম্পানি, নিউইয়র্ক-এর মালিক।

টারজান বলল, আমার এই দেশে কি করছ?

স্টিম্বল বলল, তোমার দেশ! তুমি কে?

টারজান তখন স্টিম্বলের নিগ্রো যোদ্ধাদের পানে তাকিয়ে বলল, আমি হচ্ছি টারজান। এই শ্বেতাঙ্গ এ দেশে কি করছে? এরা সংখ্যায় কত?

নিগ্রোরা তখন বলল, আমরা তোমাকে চিনি বড় বাওয়ানা। এরা সংখ্যায় আছে দু’জন। আমরা এদের কাছে কাজ করি। এরা শিকার করে বেড়ায়। এই লোকটা বড় খারাপ ব্যবহার করে আমাদের সঙ্গে। এখানে শিকার পাওয়া যাচ্ছে না। কালই ওরা চলে যাবে এখান থেকে।

টারজান আবার জিজ্ঞাসা করল, এদের শিবিরটা কোথায়?

নিগ্রোরা বলল, এখান থেকে খুব বেশি দূরে নয়।

টারজান এবার স্টিম্বলকে বলল, তোমাদের শিবিরে ফিরে যাও। আমি সন্ধ্যার সময় তোমাদের শিবিরে গিয়ে কথা বলব তোমাদের সঙ্গে। এখন শুধু খাবার মত শিকার করে নিয়ে চলে যাও।

স্টিম্বলের যেতে মন চাইছিল না। কিন্তু টারজনের ব্যক্তিত্ব আর তার কথা বলার ভঙ্গিমা দেখে ভয় হলো তার। টারজান চলে গেলে সে তার লোকদের বলল, আজ সারা দিনটাই মাটি হয়ে গেল। লোকটা কে?

নিগ্রোরা বলল, মালিক ও হচ্ছে টারজান, এই বনের রাজা। ওর কথাই হলো আইন। ওকে রাগিও না।

শিবিরে ফিরে এসে স্টিম্বল বলল, কিন্তু সেই বাঁদর লোকটা যখন আমার স্বরূপটা বুঝতে পারবে তখন আর সে উইলবার স্টিম্বলের ব্যাপারে নাক গলাতে আসবে না।

ব্লেক বলল, সে আমাদের এখানে আসবে। তাই হবে, তার সঙ্গে দেখা হবে। তার কথা আমি অনেক শুনেছি।

স্টিম্বল বলল, এই যে আমাদের লোকরা এসে গেছে।

সে তখন নিগ্রো কুলীদের লক্ষ্য করে বলতে লাগল, আমরা এবার থেকে দু’জনে ভাগ হয়ে যাচ্ছি। আমাদের মালপত্র সব ভাগ হয়ে গেছে। আমি পশ্চিম দিকে গিয়ে কিছুদিন শিকার করার পর সমুদ্র উপকূলে যাব। ব্লেক কোন দিকে যাবে তা আমি জানি না। তোমাদের মধ্যে অর্ধেক সংখ্যক লোক ব্লেকের সঙ্গে যাবে আর বাকি অর্ধেক আমার সঙ্গে যাবে। যারা ব্লেকের সঙ্গে যেতে চাও তারা তার কাছে গিয়ে দাঁড়াও।

এমন সময় হঠাৎ টারজান সেখানে এসে উপস্থিত হলো। শিবিরে যে আগুন জ্বলছিল তার আভায় ব্লেক টারজনের চেহারাটা দেখতে পেল।

স্টিম্বল বলল, সেই বুনো মানুষটা এসেছে।

ব্লেক টারজানকে বলল, তুমিই বাঁদর-দলের টারজান ত?

টারজান বলল, হ্যাঁ, তুমি?

ব্লেক বলল, আমি হচ্ছি নিউইয়র্কের জিম ব্লেক।

টারজান বলল, শিকার করে বেড়াচ্ছ?

ব্লেক বলল, আমার সঙ্গে সচল ছবি তোলার একটা ক্যামেরা আছে। আফ্রিকার বন্য জীবনের কিছু চলমান ছবি তুলতে চাই।

টারজান বলল, তোমার সঙ্গী একটা রাইফেল ব্যবহার করছিল।

ব্লেক বলল, তার কাজের জন্য আমি দায়ী নই।

টারজান বলল, আমি তোমাদের কথাবার্তা শুনেছি। নিগ্রোরা তোমার সঙ্গী সম্বন্ধে আমাকে কিছু কথা বলেছে। তোমরা দুজনে একমত হতে পারছ না বলেই পৃথকভাবে যেতে চাইছ। তাই নয় কি?

ব্লেক বলল, হ্যাঁ।

টারজান বলল, তোমরা কে কোনদিকে যেতে চাও?

স্টিম্বল বলল, আমি পশ্চিম দিকে গিয়ে উপকূলে পৌঁছতে চাই।

ব্লেক বলল, আমি উত্তর দিকে গিয়ে কিছু সিংহের ছবি তুলতে চাই। এখন যদি স্টিম্বলের সঙ্গে কোন লোক না যায় তাহলে আমাদের সঙ্গেই যেতে হবে এবং তাহলে ছবি না তুলেই সোজা উপকূলে চলে যাব।

টারজান স্টিলের কথায় কান না দিয়ে বলল, আগামীকাল রওনা হবে তোমরা। আমি ঠিক সময়ে আসব। সঙ্গের লোকেরা যাতে দু’দলে ভাগ হয়ে ঠিকমত যায় আমি তার ব্যবস্থা করব। তোমাদের কিছু ভাবতে হবে না।

এই কথা বলে বনের অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গেল টারজান।

পরদিন সকালে মালপত্র গুছিয়ে যাবার জন্য রওনা হতেই টারজান এসে পড়ল।

টারজান নিগ্রোভৃত্যদের এক জায়গায় ডেকে বলল, আমি হচ্ছি টারজান, এই বনের অধিপতি। তোমরা এই শ্বেতাঙ্গদের আমার দেশে আমার লোকজনদের মধ্যে নিয়ে এসেছ। তারা আমার লোকজনদের মারে, বনের জীবজন্তু মেরে বেড়ায়। যাই হোক, তোমরা যদি নিরাপদে গাঁয়ের বাড়িতে ফিরে যেতে চাও তাহলে আমার কথা শোন।

এরপর নিগ্রোভৃত্যদের সর্দারকে টারজান বলল, তুমি ব্লেকের সঙ্গে যাবে। তাকে বনের জীবজন্তুদের কিছু ছবি তোলার অনুমতি দিচ্ছি আমি। তোমার দল থেকে অর্ধেক লোক বাছাই করে দাও। তারা যাবে স্টিম্বলের সঙ্গে। তবে স্টিম্বল একমাত্র আহার ছাড়া কোন প্রাণী বধ করতে পাবে না।

এরপর ব্লেকের দিকে ফিরে বলল, তুমি আমার অতিথি। সুতরাং ইচ্ছা করলে শিকার করতে পার।

স্টিম্বল রেগে গিয়ে ব্লেককে বলল, তুমি এই বোকা শ্বেতাঙ্গ লোকটাকে বলে দাও আমি কে এবং আমি কিছুতেই তার এই সব হুকুম মেনে চলব না।

সেদিকে কান না দিয়ে টারজান স্টিম্বলের দলের লোকদের বলল, দেখবে এই ব্যক্তি যেন আমার আদেশ মত চলে। না চললে ওর দলে তোমরা থাকবে না।

এই কথা বলে টারজান জঙ্গলের ভিতরে চলে গেল।

অন্ধকার নেমে এল সারা বনভূমি জুড়ে মুষলধারে বৃষ্টি নামল। টারজান যে গাছটার তলায় দাঁড়িয়েছিল সেই গাছটা হঠাৎ ভেঙ্গে পড়ে যেতে তার ডালপালায় আঘাত লেগে চাপা পড়ে গেল। সে অচেতন হয়ে পড়ল। অদূরে সেই বোলগানিটা দাঁড়িয়েছিল।

টারজনের বুকের উপর কান পেতে স্টিম্বল দেখল তার দেহে প্রাণ আছে, সে মরেনি। তখন টারজানকে হত্যা করার জন্য তার ছুরিটা বার করল। বোলগানি বা গোরিলাটা এতক্ষণ দেখছিল ব্যাপারটা। স্টিম্বল ছুরিটা টারজনের বুকের উপর তুলতেই বোলগানি এক লাফে সেখানে গিয়ে স্টিম্বলের গলার উপর একটা হাত রাখল। সে তার গলা টিপে হত্যা করতে যাচ্ছিল তাকে।

এমন সময় চেতনা ফিরে পেয়ে চোখ মেলে তাকাল টারজান। মুহূর্তমধ্যে সমস্ত ব্যাপারটা সে বুঝতে পেরে বোলগানিকে বলল, ওকে যেতে দাও।

টারজান স্টিম্বলকে বলল, আমি এখানে ছিলাম দুটো কারণে। আমি লক্ষ্য করছিলাম তুমি আমার আদেশ মেনে চলছ কি না। আর দেখছিলাম তোমরা বিদ্রোহী হয়ে উঠে আমার কোন ক্ষতি করছ কি না। কিন্তু তুমি আমায় হত্যা করতে যাচ্ছিলে। তোমাকে হত্যা করাই উচিৎ। তবু আমি তোমাকে মারব না।

এবার স্টিম্বলের নিগ্রো মালবাহকদের বলল, এই শ্বেতাঙ্গ যতক্ষণ আমার আদেশ মেনে চলবে ততক্ষণ এর সঙ্গে থাকবে। তবে দেখবে এ যেন কোন শিকার না করে।

এই কথা বলে চলে গেল টারজান।

স্টিম্বল যখন বুঝল টারজান আর আসবে না তখন সাহস পেয়ে আবার খারাপ ব্যবহার করতে লাগল। তার নিগ্রোভৃত্যদের সঙ্গে। সে টারজনের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে একটা হরিণ শিকার করল অকারণে। তবে তার নিগ্রোভৃত্যরা রেগে গেল।

স্টিম্বল ভাবল সে এখানে কিছুক্ষণ বিশ্রাম করার পর ব্লেকের সন্ধানে বার হবে। সে একটা সিগারেট ধরাল।

স্টিম্বল একটা গাছে ঠেস দিয়ে বসে ছিল। সহসা একটা শব্দ শুনে চমকে উঠল। কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা ঝোপের ওপারে কালো কেশর ওয়লা একটা সিংহ দেখতে পেল। স্টিম্বল ভয়ে একটা গাছের উপর চড়ল। সিংহটা লাফ দিয়ে স্টিম্বলকে ধরতে গেল, কিন্তু পারল না। স্টিম্বল গাছে ওঠার সময় রাইফেল আর খাবারের মোটটা গাছের তলায় ফেলে যায় কিন্তু স্টিম্বলকে না পেয়ে সিংহটা রেগে গিয়ে খাবারের পুঁটলিটা ছিঁড়ে খুঁড়ে সব খাবার নষ্ট করে দিল। তারপর মুখে করে রাইফেলটা তুলে নিয়ে চলে গেল।

স্টিম্বল গাছের উপর থেকে চীৎকার করতে লাগল।

কিন্তু সিংহটা রাইফেলটা মুখে করে সোজা একটা ঝোপের মধ্যে চলে গেল।

সে রাতটা গাছেই কাটাল স্টিম্বল। পরের দিন সকালে সে ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে নেমে এল গাছ থেকে। তারপর ধীর পায়ে সে যখন ব্লেকের পথ ধরে এগিয়ে যেতে লাগল তখন তাকে দেখে মনে হচ্ছিল। তার বয়স যেন অনেক বেড়ে গেছে।

এদিকে ব্লেক সেদিন তার একজন নিগ্রোভৃত্যকে নিয়ে সিংহের ছবি তোলার জন্য মূল দল থেকে কিছুটা দূরে চলে গিয়েছিল। বনে ইতস্তত ঘুরতে ঘুরতে তারা একটা জায়গায় একটা বড়ো সিংহ, একটা সিংহী আর চার-পাঁচটা বাচ্চা দেখতে পেল। কিন্তু তাদের দেখতে পেয়ে সিংহগুলো সরে গেল। তখন আকাশে কালো মেঘ থাকায় উপযুক্ত আলো না পেয়ে ছবি তুলতে পারল না ব্লেক।

তখন জনপদের আশায় আরো কিছুটা এগিয়ে গেলে পথের ধারে পাথরের আড়াল থেকে দু’জন নিগ্রো এসে তার পথরোধ করে দাঁড়াল।

তাদের কথাবার্তা থেকে ব্লেক জানতে পারল তাদের দুজনের মধ্যে একজনের নাম পিটার আর অন্যজনের নাম পল বোদকিন। পল বোদকিন তার সঙ্গীকে বলল, এই লোকটাকে দেখে সারাসীন জাতীয় বলে মনে হচ্ছে। এর ভাষা বুঝতে পারা যাচ্ছে না। একে আমাদের ক্যাপ্টেনের কাছে নিয়ে চল।

পিটার বলল, পল, তুমি একে নিয়ে যাও ক্যাপ্টেনের কাছে, আমি এখানে পাহারায় থাকি। তুমি না আসা পর্যন্ত এখানেই থাকব আমি।

পল ব্লেককে নিয়ে এগিয়ে চলল। ক্রমে তারা একটা পাহাড়ের ভিতর দিয়ে চলে যাওয়ার পর সুড়ঙ্গপথ ধরল।

অনেকক্ষণ যাওয়ার পর ওরা এক প্রাচীন প্রাসাদের সামনে এসে পৌঁছল। গেটে ব্লেককে দেখতে পেয়ে রিচার্ডের কাছে এসে নানারকম প্রশ্ন করতে লাগল মেয়ে ও পুরুষরা।

রিচার্ড তাদের বলতে লাগল, ইনি হচ্ছেন স্যার জেমস হান্টার ব্লেক। ইনি একজন নাইট।

এবার ওদের রাজার কাছে ব্লেককে নিয়ে গেল রিচার্ড। রাজার চেহারাটা লম্বা এবং দামী পোশাক পরা। রাজা ব্লেককে আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করল। ব্লেকের ভিজে ও ছিন্নভিন্ন পোশাক দেখে তাকে নাইট বলে মনে হলো না তার।

রাজকন্যা পাশে দাঁড়িয়েছিল। সে বলল, ওঁকে কিন্তু শত্রু বলে মনে হচ্ছে না বাবা।

ব্লেক বলল, আমি একজন আমেরিকাবাসী।

রিচার্ড রাজাকে বলল, না ও শত্রু নয়। আমি দায়িত্ব নিচ্ছি। ওকে কোন না কোন একটা কাজ দিন।

রাজা ব্লেককে বলল, তুমি কাজ করবে?

ব্লেক একবার রাজকন্যার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, হ্যাঁ করব।

স্টিম্বল ব্লেকের সন্ধানে পথ চলতে চলতে এক সময় শেখের শিবিরের কাছে এসে পড়ল। ফেজুয়ান নামে একটা ক্রীতদাস তখন বাইরে পাহারা দিচ্ছিল। সে স্টিলকে দেখতে পেয়েই তাকে ধরে নিয়ে গেল শেখ ইবন জাদের কাছে। বলল, একজন শ্বেতাঙ্গ বিদেশীকে বন্দী করে এনেছি।

শেখ স্টিম্বলকে প্রশ্ন করল, কে তুমি?

স্টিম্বল বলল, আমি খেতে না পেয়ে মরতে বসেছি। আগে আমাকে কিছু খাবার দাও।

শেখ খাবার আনতে বলল। শেখের কথা স্টিম্বল বুঝতে না পারায় ফাঁদ ফরাসী ভাষায় স্টিম্বলকে জিজ্ঞাসা করল, তুমি কে বিদেশী? কোথা থেকে আসছ?

স্টিম্বল ফরাসী ভাষা বুঝতে পেরে বলল, আমি একজন আমেরিকান। জঙ্গলে পথ হারিয়ে ক্ষুধার্ত হয়ে পড়েছি।

শেখ ভাবল স্টিম্বলকে আটকে রেখে পরে মুক্তিপণ হিসেবে মোটা রকমের টাকা আদায় করা যাবে। সে তাই ফাঁদকে বলল, একে তোমার তাবুতে বন্দী করে রাখ।

ফাদ স্টিম্বলকে সরিয়ে নিয়ে গিয়ে বলল, শেখ তোমায় মেরে ফেলত। ফাদ তোমায় রক্ষা করেছে।

স্টিম্বল বলল, আমি তোমায় অনেক টাকা দেব। ধনী করে দেব তোমায়।

কয়েকদিনের মধ্যে ফাদের সঙ্গে ভালভাবে পরিচিত হয়ে উঠল স্টিম্বল। সে ফাদকে বুঝিয়ে দিল আমেরিকায় তার অনেক বিষয়সম্পত্তি আছে। ফাঁদও ভাবল তাকে দিয়ে তার অনেক উপকার হবে। ফাদ স্টিম্বলকে বুঝিয়ে দিল শিবিরের মধ্যে একটা ষড়যন্ত্র চলছে।

ফাদ রাতেরবেলায় প্রায়ই লক্ষ্য করত, রাতের খাওয়ার পর কাজকর্ম সেরেই আতিজা গোপনে জায়েদের সঙ্গে দেখা করতে যায়।

একদিন রাত্রিবেলায় ফাদ দেখল খাওয়ার পর তার তাবুর সামনে শেখ বসে বিশ্রাম করছে। সে আরও দেখল শিবিরের বাইরে একা একা আতিজার জন্য অপেক্ষ করছে জায়েদ। এই অবসরে সে জায়েদের তাঁবুর ভিতরে গিয়ে তার গুলিভরা বন্দুকটা এনে জায়েদের কাছে দাঁড়িয়ে শেখকে লক্ষ্য করে। একটা গুলি করল।

কিন্তু গুলিটা শেখের মাথার উপর দিয়ে গিয়ে একটা জায়গায় পড়ল। গুলি করেই বন্দুকটা জায়েদের পায়ের কাছে ফেলে দিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরল ফাঁদ। তারপর চেঁচামেচি করতে লাগল। শেখ ও অন্যান্য সকলে ছুটে এলে ফাঁদ বলল, আল্লার নামে বলছি শেখ, জায়েদ তোমাকে গুলি করেছিল। আমি ওকে ধরে ফেলেছি।

জায়েদ আশ্চর্য হয়ে বলল, ও মিথ্যা কথা বলছে শেখ। আমি এ কাজ করিনি।

ফাদ বলল, দেখুন এ বন্দুকটা কার।

সকলে পরীক্ষা করে দেখল বন্দুকটা জায়েদেরই। কেউ জানত না ওটা ফাদ লুকিয়ে জায়েদের ঘর থেকে নিয়ে আসে।

শেখ হুকুম দিল, আজ জায়েদকে বেঁধে এক জায়গায় রেখে দাও। কাল সকালেই ওকে গুলি করে হত্যা করা হবে।

আতিজা শেখকে অনেক করে বলল। জায়েদের জন্য বারবার প্রাণভিক্ষা চাইল। কিন্তু কোন ফল হলো না।

রাত্রিতে সবাই শুয়ে পড়লে আতিজা চুপি চুপি জায়েদের কাছে চলে গিয়ে তার হাতের বাঁধন কেটে তাকে মুক্ত করে বলল, বাইরে একটা ঘোড়া রেখেছি, তুমি এই মুহূর্তে এখান থেকে পালিয়ে যাও।

জায়েদ কোন কথা না বলে চলে গেল। তিন দিন ধরে সমানে ঘোড়ায় করে বনের মধ্য দিয়ে যেতে লাগল জায়েদ।

হঠাৎ ঘোড়াটা বনপথে যেতে যেতে একটা সিংহ দেখে একটা লাফ দিতেই জায়েদ পড়ে গেল ঘোড়ার পিঠ থেকে। মাটি থেকে উঠেই জায়েদ দেখল একটা সিংহ তার উপর ঝাঁপ দেবার জন্য উদ্যত হয়েছে।

এমন সময় জায়েদ দেখল কোথা থেকে এক দৈত্যাকার শ্বেতাঙ্গ এসে সিংহটার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তার গাড় ধরে তার উপর একটা ধারাল ছোরা বসাতে লাগল। এবার জায়েদ চিনতে পারল এই দৈত্যাকার শ্বেতাঙ্গই টারজান যে একদিন শেখের শিবিরে বন্দী ছিল।

জায়েদ ভাবল টারজান তাকে শেখের লোক ভেবে মারতে পারে। তাই সে অনুনয় বিনয় করে বলল, আমাকে মেরো না, শেখ আমাকে তাড়িয়ে দিয়েছে।

টারজান বলল, শেখ আমার দেশে কি করছে? কি চায় সে, ক্রীতদাস না হাতির দাঁত?

জায়েদ বলল, এ দুটোর কোনটাই চায় না সে। সে চায় নিমুরের ধনরত্ন।

টারজান বলল, কিন্তু তুমি একা কেন? শেখ কেনই বা তোমায় তাড়িয়ে দিয়েছে?

জায়েদ বলল, আমি শেখের মেয়ে আতিজাকে ভালবাসতাম। তাই ফাদ চক্রান্ত করে একটা খুনের ব্যাপারে আমাকে জড়িয়ে দেয়। সে নিজে গুলি করে বলে শেখকে আমি গুলি করেছিলাম। শেখ তাই আমাকে গুলি করে হত্যা করার আদেশ জারি করে। সেইদিন রাত্রিবেলাতেই আতিজা আমার বাঁধন কেটে দিয়ে মুক্ত করে আমাকে পাঠিয়ে দেয়।

টারজান বলল, এখন যাবে কোথায়?

জায়েদ বলল, আমার দেশ সুদানের অন্তর্গত একটা জায়গায়।

টারজান বলল, তুমি সেখানে একা যেতে পারবে না। আমি তোমাকে একটা গায়ে নিয়ে যাব। সেখান থেকে আর একটা গায়ে। এইভাবে তোমাকে তোমার দেশে পাঠাবার ব্যবস্থা করব।

টারজান যখন এইভাবে কথা বলছিল জায়েদের সঙ্গে তখন শেখের মঞ্জিলে চলছিল দারুণ গোলমাল। তোলোগ আর ফাদ চক্রান্ত করছিল দুজনে মিলে শেখের বিরুদ্ধে। ফাঁদের সঙ্গে স্টিম্বল চক্রান্ত করছিল। ক্রীতদাস ফেজুয়ান ভাবছিল মুক্তির কথা। আর আতিজা জায়েদের জন্য চোখের জল ফেলছিল নীরবে।

শেখ শুধু ভাবছিল নিমুরে যাবার কথা। কিন্তু কোথায় কিভাবে যাবে সেখানে তার কিছুই খুঁজে পাচ্ছিল না।

একদিন ফেজুয়ানকে ডেকে শেখ বলল, তুমি ছেলেবেলায় তোমার গায়ের লোকদের কাছ থেকে নিমুরের গল্প অনেক শুনেছ। তারা নিশ্চয় সেখানে যাবার পথ বলে দিতে পারবে। তোমাকে আপাতত মুক্তি দিচ্ছি। তুমি তোমার গায়ে চলে যাও। তারপর গাঁয়ের লোকদের কাছ থেকে সব জেনে আমাকে জানিয়ে যাবে তাহলে তোমাকে অনেক ধনরত্ন দেব।

ফেজুয়ান বলল, কখন যাব তাহলে?

শেখ ইবন জাদ বলল, কাল সকাল হলেই রওনা হবে তুমি।

পথ চলতে চলতে ফেজুয়ান যে তার গায়ের কাছে চলে এসেছে তা বুঝতে পারেনি সে। তার ছেলেবেলায় আরব বেদুইনরা তাকে ধরে নিয়ে যায়। তাই তার গাঁয়ের পথটা নিজেই ভুলে গেছে সে।

গাঁয়ের কাছে আসতেই একদল নিগ্রো যোদ্ধার সামনে পড়ে গেল।

নিগ্রোরা ফেজুয়ানকে বলল, তুমি আরব হয়ে আমাদের দেশে কি করছ?

ফেজুয়ান বলল, আমি আরব নই, আমিও তোমাদের মত নিগ্রো। তবে আরবরা আমার ছেলেবেলায় আমাকে চুরি করে নিয়ে যায়। সেই থেকে তারা আমায় আটকে রাখে।

নিগ্রোযোদ্ধাদের মধ্যে একজন বলল, তোমার নাম কি?

ফেজুয়ান বলল, আমার আসল নাম উলালা। আরবরা ফেজুয়ান বলে ডাকত।

এবার সেই নিগ্রোটি আনন্দে লাফিয়ে উঠে ফেজুয়ানকে জড়িয়ে ধরল। বলল, উলালা আমার ভাই। আমার নাম তাহো। চল গায়ে নিয়ে যাই। আমরা ভাবতাম তোকে সিংহতে ধরে নিয়ে গেছে। তুই আর বেঁচে নেই।

গাঁয়ে যেতেই সবাই এসে ভিড় করে দাঁড়াল। বাবা মা তাদের হারানো ছেলেকে ফিরে পেয়ে আনন্দে চোখের জল ফেলতে লাগল।

উলালা বললর, এক যাদুকর বলেছে প্রাচীন নগরী নিমুরে অনেক ধনরত্ন আছে, আর এক প্রমা সুন্দরী মেয়ে আছে। সেখানে যাবার পথ জানার জন্য আমাকে এক আরব সর্দার আমার গায়ে পাঠিয়েছে। সে পথ বলে দিলে তারা আমাদের মোটা রকমের পুরস্কার দেবে।

গাঁয়ের সর্দার বাতান্দো বলল, তাহলে আমরা সেখানে যাবার পথটা দেখিয়ে দিতে পারি।

উলালা সর্দারকে বলল, তুমি বলেছিলে আরবদের নিষিদ্ধ নগরী নিমুরের পথ দেখিয়ে দেবে।

বাতান্দো বলল, তাদের সঙ্গে আর তাহলে লড়াই করতে হবে না। উত্তর দিকে যে পাহাড় আছে সেই পাহাড়ী পথ দিয়ে নিমুরে প্রবেশ করা খুব একটা কঠিন কাজ হবে না।

উলালা বলল, কি ধরনের লোক বাস করে নিমুরে তা জান?

বাতান্দো বলল, কেউ তা বলতে পারে না। যারা যায় তারা আর ফেরে না। কেউ বলে সেখানে প্রেতাত্মারা বাস করে। কেউ বলে সেখানে শুধু চিতাবাঘ আছে।

উলালা বলল, তাহলে আমি এখন কি করব?

বাতান্দো বলল, তুমি এখন আরব সর্দার শেখকে গিয়ে বল, আমরা তাদের নিমুরের উপত্যকায় নিয়ে গিয়ে সেখানে যাবার পথ দেখিয়ে দেব। তাদের সঙ্গে আমাদের কোন শত্রুতা নেই। তবে তাদের হাতে যে সব নিগ্রো ক্রীতদাস আছে তাদের সবাইকে ছেড়ে দিতে হবে।

উলালা যথাসময়ে চলে গেল শেখের শিবিরে। গিয়ে সব কথা শেখকে বলল। শেখ প্রথমে তার নিগ্রো ক্রীতদাসদের ছেড়ে দিতে রাজী হলো না। কিন্তু উলালা যখন বলল তাদের ছেড়ে না দিলে অন্যান্য নিগ্রোযোদ্ধারা শত্রুভাবাপন্ন হয়ে উঠবে তখন বাধ্য হয়ে রাজী হলো শেখ। তবে সে ভাবল আপাতত সে রাজী হলেও পরে সুযোগ পেলেই সে মত পরিবর্তন করবে।

উলালার কথামত শেখ ইবন জাদ তিনদিন অপেক্ষা করল।

এদিকে টারজান জায়েদকে একটা আদিবাসী গায়ে নিয়ে গিয়ে সর্দারকে বলল, একে তোমাদের গাঁয়ে রেখে দেব।

সর্দার রাজী হয়ে গেল। জায়েদ তখন নির্জনে টারজানকে ডেকে বলল, আমার একটা কথা আছে বন্ধু। আমি একবার আতিজাকে শুধু চোখের দেখা দেখতে চাই। আমার বিশ্বাস ইবন জাদ তার দলবল নিয়ে এই পথেই নিমুরে যাবে। আমার অনুরোধ, শেখের দল না আসা পর্যন্ত তুমি আমার এই গাঁয়েই থাকার ব্যবস্থা করে দাও।

টারজান বলল, ঠিক আছে, তাই হবে। তুমি আজ হতে ছমাস এই গাঁয়ে থাকবে। এর মধ্যে শেখ যদি আসে তাহলে আমি তোমাকে আমার গায়ের বাড়িতে পাঠিয়ে দেব। সেখান থেকে তোমার দেশ সুদান যাবার ব্যবস্থা করে দেবে।

জায়েদ টারজানকে কথায় কথায় বলেছিল শেখের শিবিরে একজন বন্দী আছে। টারজান ভাবল সে শ্বেতাঙ্গ হবে হয় স্টিম্বল না হয় ব্লেক।

এদিকে নিমুরের রাজপ্রাসাদে মলাদ নামে একজন নাইটের সঙ্গে ব্লেকের শত্রুতা ক্রমশই বেড়ে চলতে লাগল। ব্লেক সব সময় হাসিখুশিতে মেতে থাকলেও তাকে একেবারেই সহ্য করতে পারল না মলাদ। রাজার কাছে ব্লেকের নামে প্রায়ই নিন্দা করত নানারকম। রিচার্ড অবশ্য ব্লেককে তলোয়ার খেলা, ঘোড়ায় চাপা প্রভৃতি নাইটদের নানারকম কার্যকলাপ ও আদবকায়দায় কুশলী করে তোলার চেষ্টা করে যেতে লাগল।

একদিন মলাদের দুর্ব্যবহারে অতিষ্ঠ ও বিরক্ত হয়ে পরদিন তার সঙ্গে ডুয়েল লড়তে চাইল ব্লেক।

ডুয়েলের আগে ব্লেকের পরম বন্ধু রিচার্ড কতকগুলো সৎ পরামর্শ দিল।

রিচার্ড বলল, সে যদি তোমার রক্তপাত ঘটিয়ে ক্ষান্ত হতে চাইত তাহলে কিছু বলার ছিল না। কিন্তু এক্ষেত্রে সে তোমার মৃত্যু ঘটাতে চায়। তার প্রথম কারণ তুমি তাকে পাঁচজনের সামনে অপমান করেছ। দ্বিতীয় কারণ সে রাজকন্যাকে বিয়ে করতে চায় এবং এজন্য সে তোমার প্রতি ঈর্ষান্বিত। কারণ সে জানে রাজকন্যার প্রতি তোমার দুর্বলতা আছে।

ব্লেক হেসে উড়িয়ে দিতে চাইল রিচার্ডের কথাটা।

পরদিন সকাল সাতটা বাজতেই ওরা রাজপ্রাসাদের সামনের প্রাঙ্গণে গিয়ে উপস্থিত হলো। ব্লেক আর মলাদ দু’জনেরই সঙ্গে একজন করে নাইট থাকবে। ব্লেকের সঙ্গে থাকবে রিচার্ড। রাজা এক জায়গায় বসল। রানী ও রাজকন্যা জিনালদা তার পাশেই বসেছিল। দর্শকরা সব চারদিকে ঘিরে বসল। দু’পক্ষেরই প্রচুর সমর্থক ছিল।

ডুয়েল শুরু হয়ে গেল। জয়ঢাক বাজতে লাগল। ব্লেক আর মলাদ দু’জনেই ঘোড়ায় চড়ে এসে দু’জনের মুখোমুখি হলো।

ব্লেক মলাদের সামনে এলেই তার ঢালটা ফেলে দিল মাটিতে। মলাদ তার তরবারি দিয়ে ব্লেকের মাথায় আঘাত করতে এলেই ব্লেক ঘোটা সরিয়ে নিয়ে তার লক্ষ্য ব্যর্থ করে দিল। তারপর অকস্মাৎ তার তরবারি দিয়ে মলাদের পাঁজরের উপর এক জায়গায় আঘাত করল। জায়গাটা ছিঁড়ে গিয়ে রক্ত পড়তে লাগল। মলাদের কোন আঘাতই লাগল না ব্লেকের গায়ে। একমাত্র মলাদের হাত থেকে তরবারিটা পড়ে গেল। এক্ষেত্রে নিয়ম অনুসারে মলাদকে ব্লেকের কাছে প্রাণভিক্ষা করতে হবে। কিন্তু অহঙ্কারের বশে তা করল না মলাদ। তা না করলেও উদারতাবশত ব্লেক মলাদের সহযোগী নাইটকে আর একটি তরবারি দিতে বলল মলাদকে।

মলাদকে আবার তরবারি দেয়া হলে আবার লড়াই শুরু হলো। দর্শকরা সবাই বুঝতে পারছিল ব্লেকই জিতছে। এবার মলাদ জয়লাভের জন্য জোর চেষ্টা করল, কিন্তু পারল না। ব্লেকের তরবারির এক প্রচণ্ড আঘাত মলাদের মাথায় লাগাতেই মলাদ ঘোড়া থেকে সোজা মাটিতে পড়ে গেল।

ব্লেক তখন ঘোড়া থেকে নেমে মলাদের বুকের উপর একটা পা রেখে তার গলার উপর তরবারির মুখটা ঠেকিয়ে রাজাকে বলল, হে রাজন, আমি লড়াইয়ে জয়ী হলেও আমার প্রতিপক্ষ এই নাইটকে হত্যা করব না। এ আপনার কাজে নিযুক্ত থেকে আপনার সেবা করে যেতে পারবে।

এই বলে রিচার্ডের সঙ্গে সেখান থেকে তার বাসায় চলে গেল। সকলেই ব্লেককে নিমুরের সর্বশ্রেষ্ঠ নাইট বলে অভিনন্দন জানাতে লাগল।

ব্লেক বলল, আমি যে দেশের মানুষ সে দেশের এটাই হলো রীতি। শত্ৰু পরাজিত বা নিরস্ত্র হলে তাকে আঘাত করা উচিৎ নয়।

রাজা নিজে স্বীকার করল ব্লেকের কাছে, সত্যিই তোমার উদারতা ও বীরত্ববোধের তুলনা হয় না। তুমি যে দেশের মানুষ সে দেশের রীতিনীতি আমার জানতে ইচ্ছা করছে।

সেদিন শেখের মঞ্জিলে ফেজুয়ানের কথামত বাতান্দোরা না আসায় ইবন জাদ খুব ভাবছিল। এমত অবস্থায় কি করা যায় তা নিয়ে যুক্তি করছিল তোলোগের সঙ্গে। তখন রাত্রিকাল।

এমন সময় হঠাৎ টারজান তাদের সামনে এসে হাজির হতেই চমকে উঠল সবাই। ইবন জাদ বলল, টারজান এসে গেছে। আল্লার অভিশাপ নেমে আসুক ওর মাথায়।

আরবদের মধ্যে স্টিম্বলকে দেখেই টারজান প্রথমে তাকে বলল, ব্লেক কোথায়?

স্টিম্বল বলল, আমি জানি না। সে ত অন্য দিকে গেছে।

টারজান বলল, তার কোন খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না।

এরপর শেখ ইবন জাদের দিকে মুখ ফিরিয়ে টারজান বলল, তুমি আমাকে মিথ্যা কথা বলেছ। তুমি, বলেছিলে ব্যবসার খাতিরে তোমরা এখানে আছ। অথচ তোমরা একটা প্রাচীন নগরীতে গিয়ে ধনরত্ন। লুণ্ঠন করে আনার জন্যই এখানে আছ।

শেখ ব্যস্ত হয়ে বলল, কে বলেছে তোমাকে এ কথা? এটা মিথ্যা কথা। বল কে বলেছে?

টারজান বলল, যে বলেছে সে মিথ্যাবাদী নয়। যে বলেছে সে হলো জায়েদ।

টারজান এবার শেখকে বলল, কালই তোমাদের এখান থেকে রওনা হতে হবে। তোমরা সোজা তোমাদের দেশে চলে যাবে। তোমাদের মনের মধ্যে কুমতলব না থাকলে কেন তোমরা এর আগে আমাকে বন্দী করে আমার জীবননাশের চেষ্টা করো?

তোলোগ সঙ্গে সঙ্গে বলল, না না, আমি ঠাট্টা করছিলাম তোমার সঙ্গে। আমি মারতে চাইনি।

টারজান বলল, যাই হোক, আমার শোবার জন্য একটা ঘরের ব্যবস্থা করে দাও। এবার যেন কোন চক্রান্ত করো না।

এদিকে সবাই শুয়ে পড়লে শেখ তার ভাই তোলোগের সঙ্গে যুক্তি করতে লাগল। শেখ ঘুমন্ত টারজানকে ছুরি মেরে হত্যা করার কথা বলল তোলোগকে।

শেখ বলল, যেমন করে হোক ওকে সরানো চাই। আমরা এতদিন এখানে বসে থেকে ধনরত্ন না নিয়ে শুধু হাতে ফিরে যেতে পারব না। এক কাজ করো, স্টিম্বলকে ডেকে আন।

স্টিম্বল এলে শেখ বলল, টারজান বলেছে তুমিই ব্লেককে হত্যা করেছ। তার জন্য আগামীকাল হত্যা করবে টারজান তোমায়।

স্টিম্বল বলল, তুমি আমাকে বাঁচাও। তোমাকে অনেক ধনরত্ন দেব আমি।

শেখ বলল, আমি কোন কিছু করতে পারব না। তুমি নিজেই নিজেকে উদ্ধার করতে পার। তুমি ঘুমন্ত টারজানকে ছুরি মেরে হত্যা করতে পার। তোমাকে আমি এই সুযোগ দিতে পারি।

স্টিম্বল বলল, আমি কখনো কাউকে হত্যা করিনি জীবনে।

শেখ বলল, হয় হত্যা কর না হয় নিতহ হও।

স্টিম্বল একটা ছুরি হাতে নিয়ে টারজনের ঘরে যাবার জন্য প্রস্তুত হতে লাগল।

স্টিম্বল চলে গেল তোলোগ শেখকে বলল, স্টিম্বল টারজানকে হত্যা করলে টারজনের লোকেরা এলে আমরা বলব আমাদের কোন দোষ নেই। তাকে আমরা রাতের মত আশ্রয় দিয়েছিলাম কিন্তু স্টিম্বল তাকে হত্যা করেছে।

এদিকে আতিজা ঘুমোয়নি। কান পেতে সব কথা শুনে সে টারজানকে সতর্ক করে দেবার জন্য তার ঘরে গেল। কিন্তু ঘরে ঢুকতে যেতেই তোলোগ তাকে ধরে ফেলল। বলল, এই বিদেশী জায়েদের বন্ধু বলে তাকে বাঁচাতে যাচ্ছিস? চলে যা এখান থেকে।

কিন্তু আতিজা সেখান থেকে চলে আসতেই পিছন থেকে টারজান ধরে ফেলল তোলোগকে। তার গলা টিপে ধরল এমনভাবে যে সে চীৎকার করতে পারল না। তারপর তাকে হত্যা করে তার বিছানায় শুইয়ে রেখে ঘর থেকে নিঃশব্দে বেরিয়ে গেল বনের মধ্যে।

এদিকে স্টিম্বল ঘরে ঢুকে কাপড় ঢাকা তোলেগের মৃতদেহটাকে ঘুমন্ত টারজান ভেবে বারবার ছুরিটা বসিয়ে দিতে লাগল সেই দেহের মধ্যে। অবশেষে সে টলতে টলতে শেখের কাছে চলে গেল।

সঙ্গে সঙ্গে শেখের মূর্তিটা পাল্টে গেল। সে চীৎকার করে সবাইকে জড়ো করে বলল, স্টিম্বলকে বেঁধে বন্দী করে রাখ ও আমাদের বন্ধু টারজানকে হত্যা করেছে। কাল ওর বিচার হবে।

কাপড় ঢাকা অবস্থাতেই সেই রাত্রিতে তোলোগের মৃতদেহটাকে কবর দিল ওরা। পরদিন সকালে তোলোগকে শিবিরের কোথাও পাওয়া না গেলে অনেকে বলল, সে হয়ত একা একা কোথাও শিকার করতে বেরিয়ে গেছে।

পরদিন সকালে শেখ শিবির গুটিয়ে সর্দার বাতালোর গায়ে গিয়ে নিজেই হাজির হলো। সর্দার তাকে যথেষ্ট খাতির করে বলল, আমরা তোমাকে পথ দেখিয়ে দেব। তবে আমাদের জাতির সব ক্রীতদাসকে। মুক্তি দিতে হবে।

শেখ বলল, তাহলে আমাদের মালপত্র বইবে কারা?

বাতান্দো বলল, নিমুরের উপত্যকা পর্যন্ত আমরা সবাই যাব। তারপর আমাদের সঙ্গে ক্রীতদাসরা চলে আসবে।

ধনরত্নের লোভে তাতেই রাজী হয়ে গেল শেখ। শেখ বাতান্দোর সঙ্গে উত্তর দিকে একটা পাহাড়ের কাছে শিবির স্থাপন করে তার দলের মেয়েদের রেখে উপযুক্ত পাহারার ব্যবস্থা করল। তারপর কিছু সশস্ত্র। আরব আর তার দেশ থেকে আনা কিছু ক্রীতদাস নিয়ে পাহাড়ের ওপারে সেই উপত্যাকাটায় গিয়ে। পৌঁছল।

বাতান্দো একটা উঁচু জায়গা থেকে শেখকে দেখাল, উপত্যকাটার ওধারেই আছে সেই নিষিদ্ধ নগরী নিমুর।

নিমূর থেকে কিছু দূরে উপত্যকাটার ওধারে সিটি অফ সেপালকার নামে একটি নগরী ছিল। সেই নগরীর রাজা ছিল বোহান। আজ হতে সাতশো বছর আগে এই দুই দেশের মধ্যে ঝগড়া-ঝাটি এবং যুদ্ধবিগ্রহ লেগেই থাকত। পরে এক চুক্তিবলে শান্তি স্থাপিত হয়।

সেই থেকে প্রতি বছর তিনদিন ধরে এক যুদ্ধ-ক্রীড়া প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। দুই দেশের নাইট ও বীরপুরুষেরা এই প্রতিযোগিতায় যোগদান করতে পারে। যে দেশ এই প্রতিযোগিতায় জয়ী হয় সেই দেশ বিজিত দেশের রাজার কাছ থেকে পাঁচজন সুন্দরী মেয়েকে বাছাই করা হয়। দুটি দেশ থেকেই পাঁচজন করে সুন্দরী মেয়েকে পুরস্কার হিসেবে সাজিয়ে রাখা হয়। যে দেশ জয়লাভ করে সেই দেশের বীর নাইটদের হাতে বিজিত দেশ তাদের পাঁচজন মেয়েকে তুলে দেয়।

মোট তিনদিন ধরে এই অনুষ্ঠান চলে। প্রতিদিন কয়েকবার করে খেলা হয়। প্রতিবার বিরাট খোলা মাঠটার দু’দিকে একশোজন করে দুই দেশের নাইট ঘোড়ায় চেপে সারবন্দীভাবে দাঁড়িয়ে থাকে। এবার। দক্ষিণ দিকে নিমুরের দল আর উত্তর দিকে সিটি অফ সেপালকারের দল ছিল। জয়ঢাক বাজতে থাকে। সঙ্কেত পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দু’পক্ষের নাইটরা এক এক জন বীর প্রতিপক্ষকে বেছে নিয়ে আক্রমণ করে। ঘোড়ার উপর থেকে তরবারি আর কখনো বা বর্শা দিয়ে যুদ্ধ হয়।

যাই হোক, খেলা শেষে দেখা গেল দুই পয়েন্টে নিম্নরই জয়লাভ করল প্রতিযোগিতায়। নিমুরের নাইটরা সবাই ঘোড়ায় করে উল্টোদিকে প্রতিপক্ষদের শিবিরে চলে গেল পুরস্কার নেবার জন্য।

এমন সময় সিটি অফ সেপালকারের রাজা বোহান তিন-চারজন নাইট আর একটা খালি ঘোড়া এনে

রাজকন্যা জিনালদাকে জোর করে ধরে খালি ঘোড়াটায় চাপিয়ে তীর বেগে ঘোড়া ছুটিয়ে পালিয়ে গেল। তার নাইটরাও চলে গেল তার পিছু পিছু।

এদিকে বাতান্দোরা সেই শূন্য বিরাট উপত্যকার প্রান্ত থেকে চরে গেলে শেখ তার দলবল আর। অনেকগুলো বন্দুক নিয়ে উপত্যকাটা পার হয়ে সেই নিষিদ্ধ নগরীর দিকে এগিয়ে চলতে লাগল। সে নিমুরের পথে না গিয়ে বোহানের রাজ্য সিটি অফ সেপালকারের পথে যেতে লাগল।

শেখ নগরদ্বারে গিয়ে দেখল বাইরে লোকজন বেশি নেই। মাত্র দুই তিনজন প্রহরী নগরদ্বারে হাতে শুধু বর্শা আর কোমরে তরবারি নিয়ে পাহারা দিচ্ছে।

শেখের লোকেরা বন্দুক থেকে একটা গুলি করতেই একজন প্রহরী মারা গেল আর একজন আহত হলো।

নগরের মধ্যে ঢুকে বিশেষ কোন বাধা পেল না শেখরা। তাদের হাতে বন্দুক দেখে এবং দুই-একটা গুলি খেয়ে ভয়ে পালাতে লাগল সবাই।

শেখ তার দলের লোকদের নিয়ে সোজা রাজপ্রাসাদে ঢুকে পড়ল। প্রাসাদের মধ্যে শেখ দেখল অনেক মণিমুক্তা, সোনা প্রভৃতি মূল্যবান ধাতু ছড়ানো রয়েছে।

শেখ ইবন জাদ অনেকগুলো বস্তা বার করে তাতে যতদূর সম্ভব ধাতুগুলো ভরে নিল। তারপর সেই সব ধনরত্ন নিয়ে অবাধে ও নিরাপদে চলে না গিয়ে সে অন্য একটা পরিকল্পনা করল।

রাত্রিবেলায় শেখ ভাবল এই প্রাসাদের শীর্ষদেশ থেকে সে আজ দেখেছে উপত্যকাটা যেখানে গিয়ে দূরে একটা পাহাড়ের পাদদেশে মিশেছে সেই পাহাড়ের কোলে এই ধরনের আর একটা নগরী আছে। সঙ্গে সঙ্গে ঠিক করে ফেলল কাল সকালেই সে সদলবলে যাবে সেখানে।

এদিকে সেদিন রাত্রিতে শেখের শিবির হতে বেরিয়ে জঙ্গলের মধ্যে রাত কাটিয়ে পরদিন সকাল থেকে ব্লেকের খোঁজ করতে থাকে টারজান।

টারজান নিমুরের উপত্যকায় পাথরের বিরাট ক্রসটার কাছে এসে দু’জন প্রহরীকে দেখে একটা ঝোপের ধারে লুকিয়ে পড়ল। একজন প্রহরীকে সে অতর্কিতে আক্রমণ করে মাটিতে ফেলে দিয়ে জিজ্ঞাসা করল, তোমরা কোন রাজ্যের লোক? তোমাদের রাজ্যে একজন শ্বেতাঙ্গ এসেছে? আমার কথার যদি ঠিক ঠিক জবাব দাও তাহলে তোমার কোন ক্ষতি করব না।

প্রহরীটি ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংরেজিতে উত্তর করল, আমাদের এই রাজ্যের নাম নিমুর। এখানে কিছুদিন আগে এক শ্বেতাঙ্গ আসে। তার নাম স্যার জেমস ব্লেক।

টারজান বলল, এখন সে কোথায়? কি করছে?

প্রহরী বলল, এখন সে একজন বীর নাইট হয়েছে। আমাদের নিমুরের সম্মান রক্ষার জন্য সে এখন সেখানকার নগরীর সঙ্গে আমাদের যে যুদ্ধ-ক্রীড়া প্রতিযোগিতা হচ্ছে তাতে অংশগ্রহণ করেছে।

অনুষ্ঠানের মাঠে ওরা পৌঁছে দেখল সেখানে দারুণ গোলমাল চলছে। এইমাত্র বোহান নিমুরের রাজকন্যা জিনালদাকে জোর করে নিয়ে পালিয়ে গেছে। সে যাবার পর সেপালকারের নাইটরাও তার পিছু পিছু পালিয়ে গেছে। একথা জানতে পারার সঙ্গে সঙ্গে ব্লেকসহ নিমুরের নাইটরাও তাদের পশ্চাদ্ধাবন করেছে।

কথাটা শুনে বাট্রাম টারজানকে বলল, যাবে আমার সঙ্গে?

টারজান নীরবে তার ঘোড়াটা বাট্রামের পিছু পিছু ছুটিয়ে দিল।

ব্লেক সোজা গিয়ে যে নাইটটা জিনালদাকে নিয়ে যাচ্ছিল তার পাঁজরে তরবারিটা আমূল বসিয়ে দিল। নাইটটা ঘোড়া থেকে পড়ে যেতেই ব্লেক জিনালদার হাত ধরে তাকে নিজের ঘোড়াটার উপর চাপিয়ে নিল। তখন পাশের অন্য নাইটদুটো ব্লেককে আক্রমণ করতে এলে ব্লেক তার প্যান্টের পকেট থেকে একটা রিভলবার বার করে গুলি করল পর পর দুটো।

গুলি খেয়ে দুটো নাইটই পড়ে গেল ঘোড়া থেকে এবং তাদের দলের অন্য সব নাইটরা পালিয়ে গেল ব্লেককে ছেড়ে দিয়ে। নিমুরের নাইটরা তখন তাড়া করে নিয়ে যেতে লাগল। এই অবকাশে ব্লেক জিনালদাকে নিয়ে পাশের একটা বনে গিয়ে প্রবেশ করল।

জিনালদা তাকে বলল, সত্যিই তুমি বীর। তুমি যেভাবে আমাকে উদ্ধার করেছ তা কল্পনা করাও যায় না।

ব্লেক তখন সত্যিই বড় ক্লান্ত ও অবসন্ন হয়ে পড়েছিল। সে জিনালদাকে বলল, আমি আজ সকাল থেকে যুদ্ধ করে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। তুমি আমাদের ঘোড়াটাকে এনে গাছের সঙ্গে বেঁধে দাও।

অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাই করল জিনালদা। তারপর বনের মধ্যে চারদিকে তাকিয়ে ভয় পেয়ে গেল সে। তার মনে হলো এখনি হয়তো কোন হিংস্র জন্তু বেরিয়ে এসে আক্রমণ করবে তাদের।

জিনালদা এবার ব্লেককে বলল, চল রওনা হওয়া যাক। তোমার এ আগ্নেয়াস্ত্রটা দিয়ে কত জন্তু তুমি মারবে?

এরপর সন্ধ্যা না হতেই বন পথে রওনা হয়ে পড়ল ওরা।

এদিকে ইবন জাদ তার সহচরদের নিয়ে বনের গভীরে এগিয়ে গেল। ওরা পশ্চিম দিক থেকে যেখানে ব্লেক জিনালদাকে নিয়ে দাঁড়িয়েছিল সেখানে গেল।

শেখ বলল, ওকে এইখানে বাঁধা অবস্থায় ফেলে রেখে মেয়েটাকে নিয়ে চলে যাও। ও এখানে মারা গেলে আমাদের কোন দোষী হতে হবে না।

শেখেরা সবাই চলে গেলে ব্লেক হাত পা বাঁধা অবস্থায় সেখানেই পড়ে রইল। সন্ধ্যা হতেই চাঁদ উঠল আকাশে। বনের মধ্যে যে ফাঁকা জায়গাটায় পড়েছিল ব্লেক, সেখানে কিছুটা চাঁদের আলো ছড়িয়ে পড়ল।

কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা চিতাবাঘ এগিয়ে এল তার দিকে। তার জ্বলন্ত চোখদুটো দেখতে পেল ব্লেক।

কিন্তু চিতাবাঘটা তাকে লক্ষ্য করে একটা লাফ দিতেই ব্লেক দেখল গাছের উপর থেকে একটা মোটা দড়ির ফাঁস এসে তার গলার উপর পড়ল আর তার গলাটা আটকে গেল। বাঘটা শূন্যে ঝুলতে লাগল।

এবার গাছ থেকে এক দৈত্যাকার শ্বেতাঙ্গ নেমে এসে ব্লেকের সামনে দাঁড়াল। তাকে দেখে ব্লেক বিস্ময়ে চীৎকার করে উঠল, টারজান তুমি!

টারজানও বিস্মৃত হয়ে বলল, ব্লেক তুমি! তোমাকে কত খুঁজে চলেছি আমি।

ব্লেকের হাতে পায়ের সব বাঁধন ছুরি দিয়ে কেটে দিল টারজান।

টারজান বলল, কারা তোমায় এভাবে বেঁধে রেখে গেল?

ব্লেক বলল, একদল আরব। একটি মেয়ে আমার কাছে ছিল। তাকে তারা ধরে নিয়ে গেছে।

টারজান প্রশ্ন করল, কখন কোন্ পথে গেছে তারা?

ব্লেক একটা পথ দেখিয়ে বলল, ঘণ্টাখানেক আগে ঐ পথে গেছে তারা।

ওরা দু’জনে সেই পথে কিছুদূর এগিয়ে গেলে টারজান বাতাসে গন্ধসূত্র ধরে বলল, এখান থেকে আরবরা দু’দলে বিভক্ত হয়ে দুদিকে গেছে। একদল গেছে উত্তর দিকে আর একদল গেছে দক্ষিণ দিকে নিমুরের পথে। তবে তুমি যে মেয়ের কথা বলছ তাকে শেখ উত্তর দিকে পাহাড়ের ওপারে নিয়ে গেছে। আমি জানি সেখানেই শেখের মঞ্জিল আছে। অবশ্য এটা আমার অনুমান। তুমি এখন উত্তর দিকে যাও। আমি যাব দক্ষিণ দিকে। আমি তোমার থেকে তাড়াতাড়ি যেতে পারব। আমি দক্ষিণ দিকে তাকে না দেখতে পেলে তাড়াতাড়ি ফিরে গিয়ে তোমাকে ধরব। আর তুমি তাকে পেলে দক্ষিণ দিকে আমার কাছে চলে যাবে। এই কথা বলে ব্লেকের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেল টারজান।

সারারাত ধরে ক্রমাগত উত্তর দিকে এগিয়ে চলল ইবন জাত তাদের দলের লোকদের নিয়ে।

শেখ সদলবলে এগিয়ে যেতে থাকল। এক দিকে ধনরত্ন আর এক দিকে এক সুন্দরী যুবতী। শেখের দারুণ ভয় হচ্ছিল। তার কেবলি ভয় হচ্ছিল কোন লুণ্ঠনকারী হয়তো এগুলো লুণ্ঠন করে নিয়ে যাবে। পথ চলার সুবিধার জন্য শেখ ধনরত্নগুলো ভাগ করে কয়েকটা বস্তায় ভরে বিশ্বস্ত কয়েকজন অনুচরের হাতে দিয়ে দেয়। জিনালদার ভার দেয়ে ফাঁদের হাতে। স্টিম্বলের জ্বর হয়েছিল। দুর্বল ও রুগ্ন অবস্থায় পথ হাঁটতে কষ্ট হচ্ছিল তার। তবু সে ফাঁদের পাশাপাশি অতি কষ্টে হেঁটে যাচ্ছিল।

পাহাড়টার পাদদেশে এসে আবার ইবন জাদ পূর্ব দিকের একটা পথ ধরল। কারণ সে বাতান্দোদের গায়ের কাছ দিয়ে যেতে চাইছিল না। তাতে নতুন বিপদ দেখা দিতে পারে।

সেদিন রাত্রিতে শিবিরে খুব তাড়াতাড়ি রান্নার কাজটা সারা হয়ে গেল। আতিজা একটু দূর থেকে দেখল ফাঁদ সবার অলক্ষ্যে শেখের খাবারে কি একটা জিনিস ফেলে দিল। তা দেখে সন্দেহ হলো আতিজার। সে ভাবল ফাঁদ হয়ত বিষ মিশিয়ে দিয়েছে তার বাবার খাবারের মধ্যে। তাই যেই খাবার জন্য তার বাবা মুখে তুলতে গেল সে এসে খাবারের থালাটা ছিনিয়ে নিল তার বাবার হাত থেকে। শেখ এর কারণ জানতে চাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ধরা পড়ে যাবার ভয়ে ফাঁদ তার বন্দুকটা নিয়ে চলে গেল। সে প্রথমে মেয়েদের তাঁবুতে গিয়ে জিনালদাকে ধরে তাকে টানতে টানতে তার তাবুতে নিয়ে গেল। সেখানে। স্টিম্বলকে ডেকে বলল, শেখ তোমাকে হত্যা করার হুকুম দিয়েছে। বাঁচতে চাও ত এই মুহূর্তে আমার সঙ্গে পালিয়ে চল।

এদিকে আতিজা যখন শেখকে বলল ফাঁদ তার খাবারে বিষ মিশিয়ে পালিয়ে গেছে তখন শেখ ফাঁদকে ধরে আনার হুকুম দিল। একজন লোক ফাঁদকে ধরার জন্য তার শিবিরের দিকে গিয়ে দেখল, ফাঁদ জিনালদা আর স্টিম্বলকে সঙ্গে করে পালাচ্ছে। তারা তাকে ধরতে গেলে ফাঁদ গুলি করল বন্দুক থেকে। ওদের হাতে তখন অস্ত্র না থাকায় ওরা ফিরে এল। ফলে অবাধে শিবিরের সীমানা ছেড়ে পালিয়ে গেল ফাঁদ।

এদিকে টারজান দক্ষিণ দিকে গিয়ে শেখের আবদেল আজিজের দলটাকে ধরে ফেলল। কিন্তু যখন দেখল তাদের দলে কোন মেয়ে বন্দী নেই তখন সে সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিকে ফিরে পথ চলতে লাগল।

শেখের দল সেপালকার নগরীর সীমান্তবর্তী পাহাড়টার পূর্ব প্রান্ত থেকে আবার দক্ষিণ দিকে যেতে টারজান তাদের দেখতে পেল। কিন্তু সে দলে স্টিম্বল আর জিলানদাকে দেখতে পেল না।

শেখকে দেখে প্রচণ্ড রাগ হলো টারজনের। শেখ তাকে বরাবর মিথ্যা কথা বলে ঠকিয়ে এসেছে।

টারজান দেখল পাঁচজন লোক বস্তাভরা ধনরত্নগুলো বয়ে নিয়ে যাচ্ছে। বোঝাভারে ভারাক্রান্ত হয়ে ধীর গতিতে পথ হাঁটছিল তারা।

সহসা সবার অলক্ষ্যে একটা বিষাক্ত তীর এসে শেখের পাশে হাঁটতে থাকা একজন মালবাহকের গলাটাকে বিদ্ধ করল ভীষণভাবে। সঙ্গে সঙ্গে পড়ে গেল লোকটা। শেখরা অবাক হয়ে গেল। কোথাও কোন শত্রুকে দেখতে পেল না ওরা। শুধু পোকামাকড়ের ডাক ছাড়া আর কোন সাড়াশব্দ নেই।

সন্ধ্যা হতে পার্বত্য অরণ্যের মাঝখানেই পথের ধারে এক জায়গায় শিবির স্থাপন করল শেখ। মৃত দেহটাকে পথের উপর ফেলে এসেছে তারা।

এদিকে আতিজার তাঁবুর পিছন দিকের পর্দাটা সরিয়ে সহসা একজন অন্ধকারে ঢুকে একটা হাত তার মুখে আর একটা হাত তার ঘাড়ের উপর দিয়ে কে বলল, কোন শব্দ করো না। চেঁচিও না, আমার কথার উত্তর দাও। তোমার কোন ক্ষতি হবে না।

আতিজা বুঝল, এ নিশ্চয় কোন জিন বা অপদেবতার কাজ।

টারজান বলল, বল ইবন জাদ উপত্যকা হতে যে মেয়েটিকে ধরে এনেছিল সে এখন কোথায়?

আতিজা বলল, ফাঁদ তাকে নিয়ে পালিয়েছে।

টারজান আবার বলল, জায়েদকে যদি বাঁচাতে চাও তাহলে সত্যি কথা বল আমায়। তারা কোথায়?

আতিজা বলল, সত্যি বলছি, গতরাতে মঞ্জিল থেকে তারা পালিয়েছে। এখন কোথায় তা জানি না।

কারাগারের মধ্যে যে দু’জন নগ্নদেহি বন্দী ছিল তাদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করল ব্লেক।

সহসা কার পদশব্দ শুনে সচকিত হয়ে উঠল ব্লেক। সঙ্গে সঙ্গে একটা বাতির আলো এগিয়ে আসতে লাগল কারাগারের অন্ধকারে। কিছুক্ষণের মধ্যে ব্লেক দেখল বাতি হাতে সেখানকার দু’জন নাইট তার সামনে এসে দাঁড়াল। ব্লেক তাদের চিনতে পারল। তারা হলো স্যার গী আর স্যার উইলডারর্ড।

উইলডারর্ড বলল, স্যার গী আর আমি শুনলাম আগামীকাল তোমাকে পুড়িয়ে মারা হবে? আমরা তাই তোমাকে মুক্ত করার জন্য এসেছি। তোমার মত একজন বীর নাইটকে এভাবে হত্যা করলে এখানকার সব নাইটদের সারাজীবন ধরে এক অনপনেয় কলঙ্কের বোঝা বয়ে যেতে হবে।

এই কথা বলেই উইলডারর্ড ব্লেকের হাত পায়ের লোহার শিকলের বাঁধনগুলো খুলে দিল।

ব্লেক বলল, তোমরা আমায় মুক্ত করে দিচ্ছ, একথা বোহান জানতে পারলে তোমাদের প্রাণ যাবে।

উইলডারর্ড বলল, না, জানতে পারবে না। স্যার গী তোমার সঙ্গে ঘোড়ায় চেপে গিয়ে নগরপ্রান্তে পৌঁছে দিয়ে আসবে তোমায়। সেখান থেকে তুমি নিমুরে চলে যাবে।

স্যার গী এবার ব্লেককে বলল, একটা কথার উত্তর দেবে? তুমি রাজকন্যা জিনালদাকে নিজের হাতে উদ্ধার করেছিলে। কিন্তু আরবরা তাকে কিভাবে ধরে নিয়ে গেল?

ব্লেক তখন যা যা ঘটেছিল সব কথা খুলে বলল তাদের।

তখন বিকালবেলা। বাঁদর-গোরিলাদের রাজা তোয়াৎ তার দলের গোরিলাদের নিয়ে বনের মধ্যে আহার অন্বেষণ করে বেড়াচ্ছিল। তাদের দিকে ধীর গতিতে তিনজন লোক আসছিল। একজন আরব, একজন শ্বেতাঙ্গ আর একজন নারী।

আগন্তুক তিনজনের মধ্যে একজন শ্বেতাঙ্গ বৃদ্ধ জ্বরে ভুগছিল। রুগ্ন অবস্থায় সে একটা গাছের ডাল লাঠির মত করে ধরে তার উপর ভর দিয়ে পথ হাঁটছিল। আরব লোকটির হাতে একটা বন্দুক ছিল। মেয়েটির পোশাকটা জমকালো হলেও তা ময়লা এবং ছেঁড়া।

জিনালদাকে তার লোমশ হাত দিয়ে ধরে ফেলল তোয়াৎ। সে, তাকে নিয়ে পালাতে চাইল। কিন্তু গোয়াদ নামে আর একটা বাঁদর-গোরিলা দাঁত বার করে তোয়াতের দিকে তেড়ে এল জিনালদাকে কেড়ে নেবার জন্য।

তোয়াৎ জিনালদাকে কাঁধে তুলে নিয়ে পালিয়ে গেল। কিন্তু সে বেশিদূর যেতে পারল না। গোয়াদ তাকে তাড়া করল। তখন জিনালদাকে নামিয়ে দিয়ে গোয়াদের সঙ্গে লড়াইয়ে মত্ত হয়ে উঠল তোয়াৎ।

ওরা যখন দু’জনে জোর লড়াই করছিল জিনালদাকে হাত করার জন্য তখন চেষ্টা করলে সেই অবসরে পালিয়ে যেতে পারত জিনালদা। কিন্তু সে তখন অত্যন্ত ক্লান্ত ও অবসন্ন হয়ে পড়ায় পালাতে পারল না।

এমন সময় সেখানে কালো কেশরওয়ালা সোনালী রঙের একটা সিংহ এসে পড়ায় লড়াই ছেড়ে পালিয়ে গেল তোয়াৎ আর গোয়াদ। সিংহের গায়ের সোনালী চামড়াটা শেষ বিকালের সূর্যের আলোয়। চকচক করছিল।

সিংহটা কাছে এসে পড়ায় জিনালদা কোন উপায় না দেখে শুয়ে পড়ল। সিংহটা এসে জিনালদার শায়িত দেহটা শুঁকতে লাগল।

এদিকে জায়েদের নেতৃত্বে টারজনের একশোজন ওয়াজিরি যোদ্ধা উত্তর দিকে আরবদের খোঁজ করে বেড়াচ্ছিল। হঠাৎ এক জায়গায় তারা তিনজনের পায়ের ছাপ দেখতে পায়। তিনজনের পায়ের ছাপের মধ্যে একজন মহিলার চটির ছাপ ছিল। জায়েদ তা দেখে বুঝল ওটা আতিজার চটির ছাপ।

এমন সময় ওরা দু’জন মানুষের কণ্ঠস্বর শুনতে পেল। লোকদুটো সেই দিকেই আসছিল। তাদের মধ্যে একজন ছিল ফাঁদ। ফাঁদকে চিনতে পেরে তার কাছে ছুটে গিয়ে জায়েদ জিজ্ঞাসা করল, আতিজা কোথায়?

ফাদ ভয় পেয়ে গেল। বলল আমি জানি না।

জায়েদ রেগে গিয়ে তার ছোরাটা ফাঁদের বুকে আমূল বসিয়ে দিল। ফাঁদ সঙ্গে সঙ্গে লুটিয়ে পড়ল। জায়েদ তখন তার ওয়াজিরি দল নিয়ে আবার উত্তর দিকে চল গেল।

এদিকে টারজান জিনালদার খোঁজ করতে করতে তার গন্ধসূত্র ধরে উত্তর দিক থেকে এসে সেই বনটায় ঢুকল। অবশেষে এক জায়গায় তোয়াতের সঙ্গে দেখা হয়ে যাওয়ায় তোয়াতের কাছ থেকে জানল জিনালদাকে একটা সিংহ ধরেছে।

টারজান জিজ্ঞাসা করল, কোথায়?

তোয়াৎ জায়গাটা দেখিয়ে দিলে টারজান সেখানে গিয়ে দেখল একটা মেয়ে চোখ বন্ধ করে শুয়ে রয়েছে। মরার মত আর তার পাশে একটা সোনালী সিংহ বসে রয়েছে থাবা গেড়ে।

জিনালদা কার পায়ের শব্দ শুনে শুয়ে শুয়েই চোখ মেলে তাকাল।

টারজান সিংহটাকে দেখেই তাকে ডাক দিল, জাদ-বাল-জা, চলে এস এদিকে।

জিনালদা আশ্চর্য হয়ে দেখল এক দৈত্যাকার শ্বেতাঙ্গ মানুষটি ডাক দিতেই সিংহটা তার কাছে পোষা কুকুরের মত ছুটে গেল।

টারজান এবার জিনালদার কাছে এসে জিজ্ঞাসা করল, তুমিই রাজকন্যা জিনালদা?

জিনালদা ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানাল।

টারজান তাকে বলল, তুমি কি আহত? আর ভয়ের কোন কারণ নেই। আমি তোমার বন্ধু। তোমার সঙ্গীরা কোথায়?

জিনালদা সব ঘটনার কথা বলল একে একে। পরে প্রশ্ন করল, কে তুমি, আমাকে চিনলে কি করে?

টারজান বলল, আমি টারজান জেমন ব্লেকের বন্ধু। সে আর আমি তোমারই খোঁজ করছিলাম।

জিনালদা উৎসাহিত হয়ে বলল, আপনি তার বন্ধু হলে আমারও বন্ধু।

টারজান হাসিমুখে বলল, আমি তোমাদের চিরকালের বন্ধু।

জিনালদা বলল, আচ্ছা স্যার টারজান, আমি বুঝতে পারছি না, সিংহটা আপনার কোন ক্ষতি করল না কেন এবং কেনই বা সে আপনার কথা শুনল।

টারজান বলল, ও হচ্ছে জাদ-বাল-জা বা সোনালী সিংহ। ওকে আমি বাচ্চাবেলা থেকে পালন করেছি। ও মানুষের কাছে বেশি থাকে বলে তোমার কোন ক্ষতি করেনি এবং আমাকে ভালবাসে।

জিনালদা বলল, আপনি কি নিকটেই কোথাও থাকেন?

টারজান বলল, না, আমি অনেক দূরে থাকি। আমার লোকজনরা কাছে কোথাও আছে বলেই সিংহটা তাদের সঙ্গে এসেছে।

সিংহটার কাছে টারজান জিনালদাকে রেখে তার জন্য কিছু ফল নিয়ে এল। জিনালদা তা খেয়ে সুস্থ হলো। তারপর জিনালদার হাঁটার শক্তি না থাকায় তাকে কাঁধে তুলে নিয়ে নিমুরের পথে রওনা হলো। নগরের বাইরে সেই পাথরের ক্রসটার কাছে জিনালদাকে নামিয়ে দিল টারজান। তারপর জাদ-বাল-জাকে নিয়ে ব্লেকের খোঁজে বেরিয়ে পড়ল।

আরবদের খোঁজ করতে করতে ব্লেকও ঢুকে পড়ল বনের মধ্যে। ঘোড়ায় চেপে ঘুরতে ঘুরতে এক জায়গায় এসে দেখল একটা লোক শুয়ে আছে আর তার পাশে একটা চিতাবাঘ ওৎ পেতে বসে আছে। লোকটা মড়ার মত পড়ে থাকায় সে অপেক্ষা করছে লোকটা নড়লেই তাকে ধরবে।

ঘোড়র উপর থেকেই তার হাতের বর্শাটা চিতাবাঘের গায়ে সজোরে ছুঁড়ে দিল ব্লেক। বাঘটা সঙ্গে সঙ্গে মরে গেল। ব্লেক তখন ঘোড়া থেকে নেমে লোকটার দিকে এগিয়ে গিয়ে বিস্ময়ে অবাক হয়ে গিয়ে বলল, একি স্টিম্বল তুমি?

স্টিম্বল বলল, আমি এখন মরতে বসেছি ব্লেক। মৃত্যুর আগে সব কথা বলে যেতে চাই তোমায়। তুমি, এখানে কি করছিলে? নাইটদের মত বর্ম ও অস্ত্রশস্ত্রই বা পেলে কোথায়?

ব্লেক বলল, এখন কিছু খাবারের জন্য নিকটবর্তী গায়ে নিয়ে যাব তোমাকে। আমি একবার সেখানে গিয়েছিলাম। কিন্তু আমাকে দেখে গাঁয়ের লোকেরা পালিয়ে যায়।

ব্লেক স্টিম্বলকে নিয়ে সেই আদিবাসীদের গায়ে চলে গেল। এবারেও গাঁয়ের লোকরা তাকে দেখে পালিয়ে গেল। ব্লেক প্রচুর খাদ্য পেল। স্টিম্বলকে পেট ভরে খাইয়ে সে তার ঘোড়াটাকেও খাওয়াল।

এমন সময় টারজনের ওয়াজিরি যোদ্ধারা সেখানে এসে হাজির হলো। তারা এসে ব্লেককে ইংরেজিতে বলল, তারা টারজনের লোক। তারা তাদের মালিকের খোঁজ করছে। যাই হোক, তারা সেই গাঁয়েতেই ব্লেককে নিয়ে রয়ে গেল। স্টিম্বল কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠল। ব্লেক ভাবল এবার তাকে কোন। উপকূলে পাঠাতে আর কষ্ট পেতে হবে না।

শেখ ইবন জাদের দলের অবস্থা ক্রমশই শোচনীয় হয়ে উঠছিল। মালবাহকরা ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। তার উপর তাদের পিছনে সর্বক্ষণ একটা সোনালী রঙের সিংহকে আসতে দেখে সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। তার মাঝে থেকে থেকে একটা কণ্ঠস্বর কানে আসছিল। তাদের, প্রতিটি রত্নের জন্য একফোঁটা করে রক্ত দিতে হবে তোমাদের। তবু ধনরত্নের লোভটা ছাড়তে পারছিল না শেখ।

হঠাৎ আবার একটা তীর এসে একজন মালবাহকের বুকে লাগল। লোকটা মারা যেতেই আবার সেই অদৃশ্য মানুষের কণ্ঠস্বর শোনা গেল, শেখ, তুমি নিজের সব ধনরত্ন তুলে নিয়ে বহন করতে থাক। তুমি নরহত্যা করে এই ধন লুণ্ঠন করেছ। তুমি হত্যাকারী। তোমার এই হলো শাস্তি।

বস্তা কাঁধে পথ চলতে পারছিল না শেখ। তার উপর তার পিছনে সিংহটা সমানে আসছিল। সে অন্যদের থেকে পিছিয়ে পড়েছিল। ..

তার এই অবস্থা দেখে আতিজা একটা বন্দুক হাতে তার বাবার কাছে এসে বলল, ভয় করো না বাবা, আমি তোমার সঙ্গে আছি। আমি তোমাকে রক্ষা করব।

পথে যেতে যেতে ওরা একটা আদিবাসীদের গায়ে এসে উঠল। ওরা আর চলতে পারছিল না। সেই গায়েই ছিল টারজনের ওয়াজিরি যোদ্ধারা, জায়েদ, ব্লেক আর স্টিম্বল।

ওয়াজিরিরা আরবদের দেখে তাদের সব অস্ত্র কেড়ে নিল। ক্লান্ত ও ভীত অবস্থায় বাধা দিতে পারল না তারা। জায়েদ আরবদের বলল, ইবন জাদ কোথায়?

আরবরা বলল, পিছনে আসছে।

জায়েদ দেখল আতিজা তার বাবা শেখকে সঙ্গে করে সেদিকেই আসছে। সে ছুটে গিয়ে আতিজাকে জড়িয়ে ধরল। ওয়াজিরি যোদ্ধাদের দেখে ভয়ে মাটির উপর বসে পড়ল শেখ। ধনরত্ন ভরা বড় বস্তাটা পড়ে গেল তার হাত থেকে।

এমন সময় শেখের স্ত্রী হিরফা ভয়ে চীৎকার করে উঠল। সে দেখল একটা বড় সিংহকে নিয়ে দৈত্যাকার এক শ্বেতাঙ্গ তাদের দিকে এগিয়ে আসছে।

টারজানকে দেখতে পেয়ে ব্লেক ছুটে এসে তাকে ধরল। বলল, দেরী হয়ে গেল টারজান, জিনালদা মারা গেছে।

টারজান হেসে বলল, বাজে কথা। আমি আজ সকালে তাকে নিমুর নগরীতে পৌঁছে দিয়ে এসেছি।

ব্লেক বিশ্বাস করতে চাইছিল না। টারজান তাকে সব ঘটনা একে একে পরিষ্কার করে বললে সে শান্ত হলো।

পরদিন সকালে সব ব্যবস্থা হয়ে গেল। ব্লেক বলল, সে নিমুর নগরীতে ফিরে যাবে। রাজকন্যা জিনালদ্বাকে নিয়ে নিমুরের রাজপ্রাসাদেই বসবাস করবে। সে আর দেশে ফিরবে না। স্টিম্বলকে চারজন ওয়াজিরি আপাতত টারজনের বাংলো-বাড়িতে বয়ে নিয়ে যাবে। সেখান থেকে তার যাবার ব্যবস্থা করে দেবে টারজান।

জায়েদ আর আতিজাকে টারজনের বাড়িতেই কাজ করতে বলল টারজান। তার বাড়িতে রেখে দেবে তাদের। কিন্তু শেখকে ও বাকি আরবদের ক্ষমা করল না টারজান। ঠিক করল, আপাতত শেখদের ওয়াজিরি যোদ্ধাদের একটি দল একটা গায়ে নিয়ে যাবে। সেখান থেকে ওদের আবিসিনিয়ায় নিয়ে গিয়ে ক্রীতদাস হিসেবে বিক্রি করে দেয়া হবে।

টারজন ও জঙ্গলে খুন (টারজন এ্যাণ্ড দি জাঙ্গল মার্ডারস)

লেফটেন্যান্ট সিসিল বার্টন ভূ-মধ্যসাগরের উপর দিয়ে দক্ষিণ দিকে আফ্রিকার উপকূলভাগের দিকে উড়ে চলেছিল। সে হঠাৎ পশ্চিমে ফিরে লন্ডনে চলে যেতে পারত। কিন্তু ইংরেজ সরকার থেকে নির্দেশ এসেছে তাকে আফ্রিকার কেপটাউনে যেতে হবে। যাবার পথে বঙ্গানিতে নেমে তার রাখা সেখানকার রেসিডেন্ট কমিশনারের হাতে নক্সাটা দিয়ে যেতে হবে।

বঙ্গানিতে একটা বিমানবন্দর ছিল। কিন্তু সেটা জরুরি অবস্থায় কাজ চালানোর জন্য ব্যবহৃত হত। সেখানে বিমানে তেল নেবার ব্যবস্থা আছে কি না তা না জানায় বার্টন ঠিক করল সে তিউনিসে নেমে ট্যাঙ্কে তেল ভরে নেবে।

সে যখন ট্যাঙ্কে তেল ভরছিল আর অফিসারদের সঙ্গে কথা বলছিল তখন তিউনিসের একজন অধিবাসী তাকে ইংরেজি ভাষায় বলল, ইতালীরা তোমাকে মারতে মারতে কেপটাউনে নিয়ে যাবে যদি বেশিক্ষণ এখানে থাক।

বার্টন বুঝল, ইতালীয় সরকার নিশ্চয় তার খোঁজ করছে এবং তাকে ধরার জন্য পিছু নিয়েছে।

তাই তেল ভরেই পাঁচ মিনিটের মধ্যে বিমান ছেড়ে দিয়ে আকাশে উঠল বার্টন। বুঝল তিউনিসের স্থানীয় লোক তাকে সতর্ক করে দিয়ে ভালই করেছে। তার উপকার করেছে।

বারবার পিছন ফিরে আকাশপথে দেখতে লাগল বার্টন কোন অনুসরণকারী বিমান তার পিছু পিছু আসছে কি না। তিউনিসের বিমানবন্দরে তার মোট সময় গেছে আধঘণ্টা। তখন গোধূলিবেলা। সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে আসতে তখনো কিছু দেরী আছে। তাই বার্টন ভাবল সন্ধ্যার আগে পর্যন্ত যদি সে অনুসরণকারীদের দৃষ্টিসীমার বাইরে থাকতে পারে তাহলে রাত্রির অন্ধকারে তাকে ধরতে পারবে না। তারা। সে যাচ্ছিল বঙ্গানি বিমানবন্দরের দিকে। কেপটাউনে যাবার আগে সেখানে থামবে সে।

সহসা পিছন ফিরতেই অস্তম্লান সূর্যের শেষ রশ্মিতে বার্টন এক সময় দেখল তার পিছনে অনেক দূরে একটা উড়ন্ত বিমানের রূপালি পাত চকচক করছে।

তার বিমানের আলো দেখে পিছনের বিমান সারারাত ধরে অনুসরণ করে আসতে লাগল। বিমানটা তার বিমানের থেকেও দ্রুতগামী। তাই তার খুব কাছে কাছে আসছে।

শত্রুদের আসল উদ্দেশ্যের কথা বুঝতে পারল বার্টন। শত্রুরা তাকে চায় না, চায় শুধু সেই নক্সাটা আর তার সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র। একবার সে কোন রকমে বঙ্গানিতে পৌঁছতে পারলেই আর তার কোন ভয়ই থাকবে না। তার নক্সা ও সরকারি কাগজপত্র সব নিরাপদে রেখে দিতে পারবে। তার যথাযথ নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হবে।

কিন্তু তা আর হলো না। সকাল হতেই বার্টন দেখল অনুসরণকারী বিমানটা তার একেবারে কাছে বাঁ দিকে এসে পড়েছে। তার একদিকের পাখাটা প্রায় ঠেকছিল তার বিমানের পাখায়।

বার্টন দেখল সেটা ইতালির বিমানবাহিনীর এক অনুসন্ধানকারী বিমান। ইতালীয় সামরিক বিভাগের একজন অফিসার সেটা চালাচ্ছে। এ ছাড়া সে বিমানে যে দু’জন যাত্রী ছিল তাদের চিনত না বার্টন। তবে তার মনে হলো তারাই হলো জুবানোভ আর ক্যাম্পবেল। তাদের কখনো চোখে দেখেনি এবং চিনত না। তবু তার মনে হলো তারা ছাড়া আর কেউ নয় এই দু’জন যাত্রী।

উড়ন্ত বিমান দুটোর পিছনে ছিল উন্মুক্ত প্রান্তর। অনুসরণকারী বিমানের চালক তাকে প্রায়ই থামতে বলেছিল। কিন্তু বার্টন থামবে না। সে দেখছিল আর মাত্র পঞ্চাশ মাইল পরেই বঙ্গানির বিমানবন্দর। সুতরাং সে ইশারায় জানাল সে থামবে না।

তখন পিছনের বিমান থেকে মেশিনগানের গুলি ছুটে এসে তার বিমানের পিছনে লাগল। বার্টনের হাতে তখন ছিল মাত্র একটা পিস্তল। সেই পিস্তল থেকে সে বিমানের কন্ট্রোলরুমের যাতে ক্ষতি হয় তার জন্য আরো তিন-চারবার গুলি করল সে।

পিছনের বিমানটা তখন তার দিকে পরিবর্তন করল। মনে হলো সেটা নামতে শুরু করেছে। বার্টন তখনো এগিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু যাবার আগ তার শত্রুরা চরম আঘাত হেনে গেল তাকে। মেশিনগান থেকে আবার গুলি করতে সে গুলির আঘাতে তার বিমানের পিছনের রাডার ও স্টেবিলাইজার ভেঙ্গে গেল। বিমানটা ঘুরতে লাগল। ঘুরতে ঘুরতে নিচে নামতে লাগল।

বার্টন তখন ইঞ্জিন থেকে বেরিয়ে এসে প্যারাসুটে করে মাটিতে নামল। নামার সময় দেখল অনুসরণকারী শত্রু বিমানটা দক্ষিণ দিকে নিচে নামতে নামতে বনের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেল।

একই বনের মধ্যে দু’জায়গায় ভেঙ্গে পড়ে থাকা এই বিমান দুটিকে দেখে টারজান।

প্যারাসুট থেকে বাইরে এসে বার্টন দেখল, চারদিকে শুধু বন আর বন। কোথাও কোন জনবসতি বা জনপ্রাণী নেই। দেখল আফ্রিকার বিশাল গভীর জঙ্গলের মাঝখানে এসে পড়েছে সে। তার মনে হলো এখান থেকে পূর্ব দিকে প্রায় পঞ্চাশ মাইল দূরে পড়বে বাসেলি।

বার্টন দেখল তার বিমানটা এক ফুট দূরে পড়েছে। ইঞ্জিনে আগুন লাগেনি। ইঞ্জিনটা কেটে দিয়েছিল সে শুধু। বিমানে গিয়ে কিছু খাবার আর গুলি নিয়ে এসে তার ধারণামত পথ ধরে বঙ্গানির দিকে রওনা হয়ে পড়ল সে।

সে বুঝতে পারল তার অনুসরণকারীদের বিমানটাও এখান থেকে কিছু দূরে পড়েছে এবং তারা তার খোঁজে বেরিয়ে পড়বে নিশ্চয়। সে ভাবল বঙ্গানি। যদি এখান থেকে পঞ্চাশ মাইল দূরে হয় তাহলে আজ থেকে তৃতীয় দিনের মধ্যে সে পৌঁছবে সেখানে।

কিন্তু বার্টন জানত না যে এ অঞ্চলে সিংহ আছে এবং এখানকার আদিবাসীরা মোটেই বন্ধুভাবাপন্ন নয়। সে আরও জানত না বঙ্গানি এখান থেকে পঞ্চাশ মাইল নয়, তিনশো মাইল দূরে অবস্থিত।

সিসিল বার্টনের পথে বুইরো নামে এক নরখাদক আদিবাসীদের বস্তি ছিল। কিন্তু সে তাদের দেখা না পাওয়ায় সম্পূর্ণ অক্ষত অবস্থায় পার হয়ে গেল তাদের অঞ্চলটা। অথচ এই আফ্রিকার জঙ্গলের মধ্যে যার জন্ম সেই বাঁদরদলের রাজা টারজান ঘটনাক্রমে বুইরোদের আকস্মিক আক্রমণে আহত ও বন্দী হলো।

টারজান সেদিন প্রতিকূল বাতাসে বনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল তখন অনুকূল বাতাসের অভাবে কোন গন্ধ-সূত্র না পাওয়ায় সে মোটেই জানতে পারেনি প্রায় বিশজন বুইরো তার পথ ধরেই আসছে। তারা শিকার করতে করতে এসে পড়ে সেই দিকে।

তারা খুবই নিঃশব্দে তার দিকে এগিয়ে আসছিল বলে তাদের পদক্ষেপের কোন শব্দ শুনতে পায়নি টারজান।

এমন সময় তার বাঁ দিকে একটা আহত সিংহকে দেখতে পেল সে। সিংহটার গায়ের এক পাশ থেকে রক্ত পড়ছিল। সিংহটা হঠাৎ ঘুরে আক্রমণ করল টারজানকে। টারজান তার ডান কাঁধ থেকে ভারী বর্শাটা নামিয়ে তা দিয়ে সিংহটাকে মারতে উদ্যত হতেই পিছন থেকে বুইরোরা এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল তার উপর।

তাদের সর্দার পিঙ্গুর ছেলে চেমিঙ্গো চিনতে পেরেছিল টারজানকে। এই চারজনই একবার তাদের গাঁ থেকে তাদের এক বন্দীকে ছিনিয়ে নিয়ে এসে বোকা বানায় তাকে।

চেমিঙ্গো তাই সময় নষ্ট না করে তার বর্শা দিয়ে টারজনের পিঠে আঘাত করল। তবে আঘাতটা তত জোর হয়নি, তেমন আহত হলো না টারজান। টারজানও তার পিঠের তৃণ থেকে একটা তীর নামাল।

এদিকে সিংহটা তখন ঢাল হাতে একজন বুইয়েরা যোদ্ধার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে ফেলে দিল। তখন অন্য যোদ্ধারা একযোগে আক্রমণ করে ঘায়েল করে ফেলল সিংহটাকে।

চেমিঙ্গো এবার খুশি হয়ে বন্দী টারজান আর সিংহের একটা মৃতদেহ নিয়ে বিজয়গর্বে তাদের গায়ে গিয়ে হাজির হলো।

তাদের গাঁয়ের যাদুকর ডাক্তার বন্দী অবস্থায় না রেখে তখনি মেরে ফেলতে বলল টারজানকে। কিন্তু গাঁয়ের অনেকে টারজানকে ছেড়ে দিতে বলল। কারণ তাকে বধ করলে তার মৃত আত্মা গায়ের অনেক ক্ষতি করবে।

তখন চেমিঙ্গোর বাবা সর্দার পিঙ্গু একটা আপোষ করল।

পিঙ্গু হুকুম দিল, বন্দীকে ভাল করে বেঁধে উপযুক্ত পাহারার মধ্যে রেখে দাও। তার ক্ষত স্থানের চিকিৎসা করো। এর মধ্যে যদি কোন অশুভ ঘটনা না ঘটে তাহলে অন্যান্য বন্দীদের মত তারও অবস্থা হবে। তখন ভোজন উৎসব চলবে।

টারজনের ক্ষত স্থান থেকে রক্ত ঝরা বন্ধ হয়ে গেল। সাধারণ মানুষ হলে সেই ক্ষততেই মৃত্যু হত। তার। কিন্তু টারজান সাধারণ মানুষ নয়। এরই মধ্যে সেরে উঠেছে সে। মুক্তির কথা ভাবতে শুরু করে দিয়েছে।

বুইরোরা তাকে শক্ত করে বেঁধে রেখেছিল। প্রতিদিন রাতে তারা বাঁধনটা শক্ত করে দিত। আবার টারজান তার পরে একটু একটু করে আলগা করে দিত সে বাঁধন যাতে তার হাতে পায়ের রক্ত চলাচলে কোন অসুবিধা না হয়।

টারজান বুঝতে পারে তারা ওকে খাইয়ে মোটা করতে চাইছে। তার শক্ত পেশীবহুল দেহটার মাংস খেতে ওদের ভাল লাগবে না। তাই তার দেহে চর্বির সঞ্চার করে ওর দেহটাকে নরম করতে চায়।

বন থেকে বাতাসে ভেসে আসা অনেক শব্দই শুনতে পায় সে। শীতা বা চিতা বাঘের ডাক, ভাঙ্গো বা হায়েনার অট্টহাসি, নুমা বা সিংহের গর্জন-অনেক কিছুই শুনতে পায় সে।

সহসা একটা শব্দ শুনে সজাগ হয়ে ওঠে সে। মাথাটা দোলাতে দোলাতে মন্ত্র উচ্চারণের মত মুখ থেকে একটা শব্দ বার করতে থাকে। প্রহারারত রক্ষী তাকে জিজ্ঞাসা করে, কি করছ?

টারজান বলে, আমি প্রার্থনা করছি।

রক্ষী পিঙ্গুর কাছে গিয়ে কথাটা জানালে সে বলে, ঠিক আছে। ওকে প্রার্থনা করতে দাও।

রক্ষী এসে দেখে সেইভাবে প্রার্থনা করতে করতে মাঝে মাঝে চীৎকার করে উঠছে টারজান।

টারজান বুঝতে পারে তার চীৎকারে কাজ হচ্ছে। কানে এক বাঞ্ছিত শব্দ আর নাকে এক আকাঙ্খিত গন্ধ পায় সে। বুইরোরা এসব কিছুই বুঝতে পারে না।

টারজান যখন এক একবার গলা ফাটিয়ে চীৎকার করে তখন বুইরোরা ভাবে তার গলায় খুব জোর আর সে তার দেবতাদের শোনাবার জন্য এত জোরে চীৎকার করছে।

এদিকে জঙ্গলের গভীরে তখন টারজনের হাতি-বন্ধু ট্যান্টর একদল হাতির সঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। সে ছিল দলপতি। সে হঠাৎ টারজনের ডাক শুনতে পায়। সে তখন চীৎকার করে তার দলের অন্য সব হাতিদের জড়ো করে এক জায়গায়। তারপর একযোগে টারজনের গলার শব্দ লক্ষ্য করে বুইরোদের বস্তির দিকে আসতে থাকে।

গাছপালা ভেঙ্গে গর্জন করতে করতে গায়ের দিকে আসতে থাকা হাতির দলের শব্দটাকে টারজানই। প্রথমে শুনতে পায়। হাসি ফুটে ওঠে টারজনের ঠোঁটে। তার প্রার্থনায় তাহলে কাজ হয়েছে।

টারজান এবার স্পষ্ট শুনতে পায় কাঠের গেট ভেঙ্গে গাঁয়ের মধ্যে ঢুকে পড়েছে মত্ত হাতির দল। সে তখন জোরে চীৎকার করে ওঠে, ট্যান্টর ট্যান্টর, তোমরা আমার কাছে এস, এই যে আমি।

কিন্তু টারজনের ডাক শোনবার কোন প্রয়োজন ছিল না হাতিদের। তার গন্ধ তারা পেয়েছিল।

গোটা গাঁটাকে বিধ্বস্ত করে সব কুঁড়েগুলোকে ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দিয়ে টারজনের ঘরের সামনে এসে উপস্থিত হল হাতিরা। তারপর ঘরের চালটাকে তুলে ফেলে টারজানকে শুড় দিয়ে পিঠে উঠিয়ে নিল তার বন্ধু ট্যান্টর।

হাতির পিঠে উঠেই টারজান অন্য হাতিদের কি করতে হবে না হবে নির্দেশ দিতে লাগল। গোটা গাটা একেবারে বিধ্বস্ত হলে এবং বুইবোরা হাতিদের অত্যাচারে গা ছেড়ে সাময়িকভাবে পালিয়ে গেলে টারজান হাতির দলকে বনে ফিরে যাবার নির্দেশ দিল। টারজনের হাত দুটো বাঁধা ছিল তখনো। হাতির পিঠে চেপে বনে ফিরে গেলে বাদরেরা খুলে দিল তার হাতের বাঁধন।

ট্যান্টরকে আদর করে হাতিদের কাছ থেকে বিদায় নেবার পর আবার গাছে উঠে যাত্রা শুরু করল টারজান। কিন্তু এবার আর বিদেশী বিমান যাত্রীদের খোঁজে নয়। সেই ইংরেজ বিমানযাত্রী হয়ত এতদিনে আর বেঁচে নেই। হয় সে বনের মধ্যে না খেয়ে মারা গেছে অথবা কোন হিংস্র জন্তুর পেটে গেছে।

যাই হোক, এখন বঙ্গানি যেতে হবে। সেখানকার রেসিডেন্ট কমিশনার তার বন্ধুবর টারজানকে ঢোল সহরৎ করে খবর পাঠিয়েছেন সে যেন অবিলম্বে দেখা করে তার সঙ্গে। বুইরোদের গায়ে বন্দী অবস্থায় থাকার সময়েই এই ঢোল সহরতের কথা শুনতে পায় সে।

আফ্রিকার গভীর জঙ্গলের মধ্যে দিনের পর দিন ধরে পথ চলাকালে দু’দুবার সিংহের কবলে পড়েছিল বার্টন। কিন্তু দুটোরই কাছাকাছি একটা গাছ পেয়ে যাওয়ায় সেই গাছের উপর উঠে পড়ে প্রাণ বাঁচায় সে। একবার সারাদিন গাছে উঠে বসে থাকতে হয় সিংহের ভয়ে। তৃষ্ণায় একটু জল পর্যন্ত খেতে পায়নি। অবশেষে অধৈর্য হয়ে শিকারের আশা ছেড়ে চলে যায় সিংহটা। আর একদিন আর একটা সিংহের সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। কিন্তু সিংহটার পেট ভর্তি ছিল বলে সে কোন মনোযোগ দেয়নি বার্টনের দিকে। বার্টন। অবশ্য ভাবত সিংহমাত্রই সব সময় নরখাদক। তারা জীবজন্তুকে দেখলেই বা হাতের কাছে পেলেই খেয়ে ফেলে।

কিন্তু খাদ্যের সমস্যাটা দিনে দিনে প্রকট হয়ে উঠল বার্টনের কাছে। খেতে না পেয়ে তার শরীর রোগা হয়ে যেতে লাগল দিনে দিনে। হাতের কাছে ফলমূল যা পেতে লাগল তাই খেতে লাগল।

কিন্তু দেহটা তার শীর্ণ হলেও মনে তখনো জোর ছিল। আশা ছিল বার্টনের।

একদিন সকালের দিকে পাহাড়ের ধারে বসেছিল সামনে উপত্যকাটার দিকে তাকিয়ে। সহসা দেখতে পেল উপত্যকাটার উপর থেকে একদল যাত্রীর একটা সফরী এগিয়ে আসছে তার দিকে।

বহুদিন পর আজ প্রথম মানুষের দেখা পেল আফ্রিকার জঙ্গলের মধ্যে। আনন্দে চীৎকার করে উঠল বার্টন। দেখল সফরীতে রয়েছে একদল শ্বেতাঙ্গ পুরুষ আর দু’জন শ্বেতাঙ্গ মহিলা। কুলিরা মালপত্র বয়ে নিয়ে আসছিল পিছনে। রোদের তাপ থেকে মাথা বাঁচানোর জন্য শ্বেতাঙ্গদের মাথায় ছিল শিরস্ত্রাণ। সামনেই একজন স্থানীয় পথ-প্রদর্শক ছিল।

সফরীর কাছে ছুটে গেল বার্টন। তার চোখে জল এসে গিয়েছিল, আনন্দে কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে পড়েছিল। সে হাত বাড়িয়ে ডাকতে লাগল তাদের।

তার ডাকে থেমে গেল চলমান সফরীটা। কিন্তু বার্টন দেখল তার প্রতি পথিকদের কারো কোন উৎসাহ বা আগ্রহ নেই।

বার্টনের ছেঁড়া ময়লা পোশাক আর শীর্ণ চেহারা দেখে একটি মেয়ে বলে উঠল, কি ভয়ঙ্কর!

বার্টন মেয়েটিকে চিনত। সে বলল, তোমার আচরণে আমি দুঃখিত বারবারা। তুমি শুধু উপরের পোশাকটাকেই দেখলে, কিন্তু সে পোশাক যে মানুষটা পরে আছে তাকে দেখলে না।

মেয়েটি অবাক হয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। বলল, তুমি চেন আমাকে?

বার্টন বলল, ভালভাবেই চিনি। তুমি হচ্ছ বারবারা রামসগেট। লর্ড জন রামসগেট নামে ঐ ভদ্রলোক তোমার ভাই। অন্যদের আমি চিনি না।

পথিকদের একজন বলল, লোকটা বোধহয় আমাদের এই সফরীর কথা কারো কাছে শুনেছে। যাই হোক, তোমার কথা বল। তুমি কি তোমাদের সফরীর দ্বারা পরিত্যক্ত হয়ে পথ হারিয়ে ফেলেছ? তুমি কি ক্ষুধার্ত? তুমি কি আমাদের যাত্রীদলে যোগ দিতে চাও?

লর্ড জন বলল, থাম বাল্ট ওকে ওর কথা বলতে দাও।

বার্টন বলল, আজ যদি তোমাদের একজন কুলির সঙ্গে আমার দেখা হত, তাহলে সে আগে আমায় কিছু খাদ্য ও পানীয় দিত।

মেয়েটি লজ্জিত হয়ে বলল, আমি দুঃখিত। আমি খাবার ও জল আনতে বলেছি।

বার্টন বলল, তাড়াতাড়ি করতে হবে না। আমি আগে তোমাদের প্রশ্নের উত্তর দেব। আমি লন্ডন থেকে একটি বিমানে করে কেপটাউন যাচ্ছিলাম। পথে নামতে বাধ্য হই। তারপর থেকে আমি বঙ্গানির দিকে এগিয়ে চলেছি। এবার আমি আমার পরিচয় দিচ্ছি। আমার নাম লেফটেন্যান্ট সিসিল গাইলস বার্টন। আমি সরকারি বিমানবাহিনীতে কাজ করি।

লেডি বারবারা বলল, অসম্ভব! এ কখনই হতে পারে না।

লর্ড জন বলল, আমরা বার্টনকে চিনি। তোমাকে তার মত দেখতে লাগছে না।

তার জন্য দায়ী আফ্রিকা। তোমরা কাছ থেকে খুঁটিয়ে দেখলে অবশ্যই চিনতে পারবে। প্রতি সপ্তার শেষে আমি তোমাদের রামসগেট প্রাসাদে অতিথি হিসেবে যেতাম।

লর্ড জন ভাল করে বার্টনকে দেখে চিনতে পেরে বলল, হা ভগবান! সত্যিই ত। ক্ষমা করো বন্ধু।

এই বলে করমর্দনের জন্য হাতটা বাড়িয়ে দিল তার।

বার্টন কিন্তু সে হাত গ্রহণ করল না। বলল, এই হাত একজন দুর্দশাগ্রস্ত বিপন্ন পথিকের দিকে আগেই বাড়িয়ে দেয়া উচিত ছিল। সুতরাং এখন এ হাত আমি মর্দন করতে পারব না।

লর্ড জন তার বোনকে বলল, ঠিকই বলেছে। ভুলটা আমাদেরই।

আর আপত্তি করল না বার্টন। তারা পরস্পরের করমর্দন করল। বারবারা তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ডানকান ট্রেন্ট নামে এক ভদ্রলোকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল।

খাওয়ার পর সফরীর অন্য সব সদস্যদের সঙ্গে পরিচিত হলো বার্টন। সেই দলে মিঃ রোমানফ নামে এক রুশীয় পথিক ছিল। সে দাড়ি কামাতে কামাতে বার্টনকে জানাল বঙ্গানি সেখান থেকে এখনো দুশো মাইল দূরে।

বার্টন আরো জানতে পারল আসলে দুটো সফরী ছিল। একটা ছিলা রোমানফের আর একটা ছিল লর্ড জনদের। পরে যখন ওরা দেখল ওদের গন্তব্যস্থল এক অর্থাৎ ওরা সকলেই বঙ্গানি যাবে তখন এক করে ফেলল দুটো সফরী।

জন বলল, তফাৎ এই যে রোমানরা বন্দুক নিয়ে শিকার করে আর আমরা ক্যামেরা নিয়ে শিকার করি।

ট্রেন্ট বলল, সব বাজে। এর থেকে পশুশালায় গিয়ে জীবজন্তুদের ছবি তুলে আনলেই হলো।

বার্টন আরও জানল জিরাল্ড ছিল আগে রোমানফের পথ-প্রদর্শক। বার্টন জানতে পারল একে একে সে ছাড়া আরো দু’জন বিপন্ন পথিক এই সফরীতে যোগদান করে। তারা হলো স্মিথ আর পিটারসন। তাদের আদিবাসী সঙ্গীরা নাকি তাদের ত্যাগ করে চলে যায়।

বার্টন বলল, ওদের দেখে কিন্তু ভাল মানুষ মনে হচ্ছে না।

লর্ড জন বলল, ওরা নিজেদের কোন কাজই করতে চায় না। তাছাড়া গল্টের আচরণ বড়ই প্রভুত্বমূলক। সে কথায় কথায় সকলকে বিদ্রূপ করে। সবাই তাকে ঘৃণা করে। আমাদের এই সফরীটাকে মোটেই এক সুখী পরিবার বলা যায় না।

ডিনারের পর কফি আর সিগারেট দেয়া হলো সকলকে।

বার্টন বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে বলল, আজ সকালেই আমি না খেয়ে শুকিয়ে মরে যাচ্ছিলাম। কার ভাগ্যে কি আছে তা কেউ জানে না।

বারবারা বলল, ভবিষ্যতে আমাদের কি আছে সেটা আগে হতে জানতে না পারাটাই বোধ হয় ভাল।

দিনের পর দিন কেটে যেতে লাগল। বার্টনের সঙ্গে জন রামসগেটের ঘনিষ্ঠতা বেড়ে যেতে লাগল। বিশেষ করে সে বারবারাকে ভালবেসে ফেলল। তার লক্ষণ দেখে ডানকান ট্রেন্ট ক্ষুব্ধ হয়ে উঠল।

একদিন গোলমান বাধল সফরীর মধ্যে। বার্টন হঠাৎ সেখানে এসে পড়ায় সে গোদেনস্কিকে একটা ঘুষি মেরে ফেলে দিল। গোদেনস্কিও তার ছুরি বার করল। তখন বারবারা এসে পড়ায় গোদেনস্কি চলে গেল।

বারবারা বার্টনকে বলল, তোমার একজন শত্রু হলো।

বার্টন বলল, আমার অনেক শত্রু আছে।

এরপর ডানকান ট্রেন্ট এসে বার্টনকে স্পষ্ট বারবারার কাছ থেকে সরে যেতে বলল।

শান্তভাবে বার্টন বলল, আমার মনে হয় এ ব্যাপারটা বারবারার উপরেই ছেড়ে দেয়া ভাল। কে সরে যাবে না যাবে সেটা সেই ঠিক করবে।

এতে ট্রেন্ট প্রথমে আঘাত করে বার্টনকে। বার্টন তখন জোরে একটা ঘুষি মেরে ফেলে দেয় ট্রেন্টকে।

পরদিন সকালে লর্ড জন গোদেনষ্কিকে জানিয়ে দেয় বঙ্গানিতে পৌঁছে গেলেই কাজ থেকে ছাড়িয়ে দেয়া হবে তাকে। সকলেই এড়িয়ে চলতে লাগল গোদেনস্কিকে। এমন কি স্মিথ ও পিটারসনও তাকে দেখতে পারত না। সারাদিন সে তাই একা একা মুখ ভারী করে পথ চলত ও তার কাজ করে যেত।

আগুনের মত গরম রোদের নিষ্ঠুর তাপে সকলেরই কষ্ট হচ্ছিল। মালবাহী কুলিদের কষ্ট হচ্ছিল সবচেয়ে বেশি। গল্ট সব সময় ছোটাছুটি করে কুলিদের দেখাশোনা আর বকাবকি করছিল।

এক সময় ধৈর্য হারিয়ে ফেলে গল্ট একটা কুলিকে মারতে মারতে মাটিতে ফেলে দিল। সে উঠে দাঁড়ালে আবার তাকে ফেলে দিল।

বার্টন তখন নিকটেই ছিল। সে গল্টের সামনে এসে বলল, খবরদার মারবে না বলে দিচ্ছি।

গল্ট বার্টনকে বলল, তুমি নিজের চরকায় তেল দাওগে। এ সফরী আমি পরিচালনা করছি।

বার্টন বলল, কার সফরীকে পরিচালনা করছ তা আমি দেখতে চাই না। তুমি কোন লোককে মারবে না বা গালাগালি দেবে না।

গল্ট সঙ্গে সঙ্গে একটা ঘুষি চালিয়ে দিল। বার্টন সরে গিয়ে সেটা এড়িয়ে গেল। তারপর এক ঘুষিতে ফেলে দিল গল্টকে।

সফরীতে আসার পর এই হলো বার্টনের তিন নম্বর লড়াই।

লর্ড জনকে বার্টন বলল, আমি দুঃখিত রামসগেট সকলের সঙ্গেই আমার ঝগড়া বাধছে।

তাকে সমর্থন করে রামসগেট বলল, তুমি ঠিকই করেছ।

বারবারাও বলল, গল্টকে উচিৎ শিক্ষা দিয়ে খুব ভাল করেছ তুমি। লোকটাকে সবাই খারাপ বলে।

বার্টন বলল, আর কারো সঙ্গে শত্রুতা করতে হবে না। আগামীকালই আমরা বঙ্গানিতে পৌঁছব।

এর পর পরস্পরকে শুভরাত্রি জানিয়ে সকলেই শুতে চলে গেল শিবিরের মধ্যে। শুয়ে শুয়ে ভাবতে লাগল বার্টন, আজ সে সত্যিই সুখী। আগামীকালই তার বাবার সঙ্গে দেখা হবে। তাছাড়া বারবারাকে সে পেয়েছে প্রেমিকারূপে।

শান্তিপূর্ণ এক স্তব্ধতা বিরাজ করছিল নৈশ শিবিরের মধ্যে। জ্বলন্ত আগুনের পাশে বসেছিল তন্দ্রাচ্ছন্ন প্রহরী। দূরে এক সিংহের গর্জন শোনা গেল। জ্বলন্ত আগুনে বেশি করে কাঠ ফেলে দিল আস্কারি।

তখনো কিছুটা রাত ছিল। ভোর হয়নি ভাল করে। আগের প্রহরীর পর নতুন যে প্রহরী এসেছে সে একগাদা কাঠের পাশে পিঠ দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল।

ঘুম ভাঙ্গতেই দৈত্যাকার নগ্ন এক শ্বেতাঙ্গকে আগুনের ধারে বসে থাকতে দেখে চমকে ওঠে সে। ভাল করে চোখ মেলে দেখে বুঝল এটা স্বপ্ন নয়, তার দেখার কোন ভুল হয়নি।

প্রহরী দৈত্যাকার লোকটিকে বলল, কে তুমি? কোথা থেকে এসেছ? তুমি যদি কোন দৈত্যদানব হও তাহলে আমি তোমাকে খাবার এনে দেব। কোন ক্ষতি করো না আমার।

আগন্তুক লোকটি বলল, আমার নাম টারজান। এটা কার সফরী?

প্রহরী বলল, এ সফরী দু’জনের-বাওয়ানা রোমানক আর বাওয়ানা রামসগেটের।

টারজান বলল, ওরা বঙ্গানি যাচ্ছে ত?

আমরা আগামীকালই বঙ্গানিতে পৌঁছব।

ওরা শিকার করে?

বাওয়ানা রোমানক শিকার করে। কিন্তু বাওয়ানা রামসগেট শুধু ছবি তোলে।

এরপর টারজান বলল, তোমাদের শিবিরের মধ্যে একজন মৃত লোক আছে।

এই বলে শ্বেতাঙ্গদের শিবিরটার দিকে হাত বাড়িয়ে দেখাল।

শিবিরের ভিতরে গিয়ে প্রহরী ডাকাডাকি করে সকলকে তুলল। বলল, কোথা থেকে দৈত্যের মত একটা নগ্নদেহ শ্বেতাঙ্গ এসে বলছে এই শিবিরের মধ্যে একটা মৃত লোক পড়ে আছে।

সকলেই টারজনের চেহারা দেখে অবাক হয়ে গেল। ভয় পেয়ে গেল। অবশেষে রামসগেট তার কাছে গিয়ে কথা বলল তার সঙ্গে।

টারজান বলল, আমার নাম টারজান। সত্যিই এই শিবিরের মধ্যে একটা লোক মরে পড়ে আছে।

রামসগেট বলল, কি করে বুঝলে তুমি?

বাতাসে গন্ধ পেয়ে বুঝলাম। মানুষ মরে গেলেই এটকা বিশেষ গন্ধ বার হয় তার দেহ থেকে।

সকলেই হেসে উড়িয়ে দিল তার কথাটা। বলল, নোকটা পাগল।

কিন্তু রামসগেট গল্টকে ডেকে খোঁজাখুঁজি করতে বলল। বলল, সবাইকে ডেকে তোল। আজ খুব সকালেই যাত্রা শুরু করব।

এমন সময় একজন ভৃত্য ছুটতে ছুটতে এসে খবর দিল বার্টন তার ঘরে মরে পড়ে আছে।

সকলেই বলতে লাগল, ঐ উলফঙ্গ আধ-পাগলা লোকটাই খুন করেছে বার্টনকে। কিন্তু লর্ড জন রামসগেট বা বারবারা এ কথা মানতে পারল না। ওরা বলল, ওর তাতে স্বার্থ কি? তাছাড়া প্রহরী বলছে, মাত্র কিছুক্ষণ আগে আসে লোকটা। এসে ঠাণ্ডায় আগুন পোয়াতে থাকে।

টারজান শান্তভাবে বলল, আমি আসার আগেই লোকটি নিহত হয়।

বার্টনের মৃতদেহ পরীক্ষা করে দেখা গেল। তার পিঠে ছোরা মারা হয়েছে। ছোরাটা তার হৃৎপিণ্ডটাকে বিদ্ধ করেছে।

রামসগেট বলল, আগন্তুককে সন্দেহ করার কোন অর্থ হয় না। বারবারা বলল, বার্টনের শত্রু ছিল এই শিবিরে। গল্ট আর ট্রেন্টের সঙ্গে তার মারামারি হয় এবং ওরা তাকে খুন করবে বলে ভয় দেখায়।

অবশেষে ঠিক হলো বঙ্গানিতে গিয়ে পুলিশের হাতে তুলে দেয়া হবে ব্যাপারটাকে। পুলিশ প্রমাণ করবে কে খুন করেছে।

গল্ট আর ট্রেন্ট বলল, লোকটাকেও আমরা বেঁধে সঙ্গে করে নিয়ে যাব।

কিন্তু গল্ট টারজনের কাছে যেতেই তাকে সরিয়ে দিল টারজান। ট্রেন্ট তখন পিস্তল তুলে ধরে টারজানকে বলল, পালাবার চেষ্টা করলেই গুলি করব।

কিন্তু ভয়ে লক্ষ্য ঠিক করতে পারল না ট্রেন্ট। গুলিটা অন্য দিকে চলে গেল। টারজান তার পিস্তল ধরা হাতটা ধরে ফেলল। তারপর তাকে টানতে টানতে বনের দিকে নিয়ে গেল।

ট্রেন্ট চেঁচাতে লাগল, তোমরা কিছু করতে পারছ না? ও আমাকে বনে নিয়ে গিয়ে খুন করবে।

রামসগেট বলল, গুলি করলে ট্রেন্টের গায়ে লাগবে। আমরা কিছুই করতে পারছি না।

বনের মধ্যে নিরাপদে ঢুকেই ট্রেন্টকে ছেড়ে দিল টারজান। ট্রেন্ট ছুটে শিবিরে এসে বলল, আমার হাতের কব্জি ভেঙ্গে গেছে। সাংঘাতিক জোর লোকটার গায়ে। আমাকে ছেড়ে দিয়েই গাছের উপর উঠে বাঁদরের মত ডাল থেকে ডালে লাফ দিয়ে দিয়ে চলে গেল।

একটা স্ট্রেচারে বার্টনের মৃতদেহটাকে চাপিয়ে বয়ে নিয়ে যেতে লাগল কুলিরা।

আবার যাত্রা শুরু হলো সফরী। আজ দেরী হয়ে গেল শিবির গোটাতে।

সেদিন বঙ্গানি পৌঁছতে পারল না ওরা। রাতে আবার এক জায়গায় শিবির স্থাপন করল ওরা। কিন্তু সেদিন মাঝরাতে পিটারসন খুন হলো। তারও পিঠে একটা ছোরা বসিয়ে দেয়া হয়।

স্মিথ বলল, সেই উলঙ্গ লোকটার কাজ। সে এসেছিল, আমি পালিয়ে যাবার সময় গুলি করেছি। অন্ধকারে দেখতে পাইনি গুলিটা লেগেছে কিনা। সে রাতে আর ঘুম হলো না কারো, ভয়ে আর উৎকণ্ঠায় স্তব্ধ হয়ে রইল সবাই।

বঙ্গানিতে মৃত সিসিল গাইলস বার্টনের বাবা কর্নেল জিরাল্ড গাইলস বার্টনের সরকারি বাংলোতে বসেছিল টারজান।

বার্টনের মৃত্যু সংবাদটা টারজানই দিল তার বাবাকে।

কর্নেল বার্টন বলল, কিন্তু কে কোন্ স্বার্থে আমার ছেলেকে খুন করল?

টারজান বলল, স্বার্থ নিশ্চয়ই আছে। তবে ওদের সফরীতে ট্রেন্ট নামে একটা লোক আছে। সে আর বার্টন একটি মেয়েকে ভালবাসত। সুতরাং অনেকের সন্দেহ ট্রেন্টও ওকে মারতে পারে।

বার্টন বললেন, সফরী বঙ্গানিতে এলে আমি ওদের সকলকে জিজ্ঞাসাবাদ করব। দোষীকে খুঁজে বার করতেই হবে।

টারজান বলল, খুনী যদি আফ্রিকাতে থাকে তাহলে আমাকে ফাঁকি দিয়ে পালাতে পারবে না।

সফরী বঙ্গানিতে পৌঁছেই শিবির স্থাপন করল। তারপর রোমানক আর রামসগেট কর্নেল বার্টনের বাংলোতে এসে দেখা করল। তারা বার্টনের মৃত্যু সংবাদ দিলে কর্নেল বললেন, এ খবর আগেই জেনেছেন তিনি।

ওরা আশ্চর্য হয়ে বলল, তা কি করে সম্ভব?

এমন সময় টারজান এসে তাদের সামনে দাঁড়াল।

রামসগেট বলল, গত রাতে আমাদের শিবিরে পিটারসন নামে আর একজন লোক খুন হয়।

টারজানকে দেখেই রামসগেট বলল, ওই হচ্ছে খুনী। ওই বার্টনকে এবং আগের রাতে পিটারসনকে খুন করেছে। স্মিথ ওকে গত রাতে দেখেছে শিবিরে।

কর্নেল বার্টন বলল, এ কখনই হতে পারে না। টারজান কখনই আমার ছেলেকে খুন করতে পারে না। আর গত রাতে ও আমারই কাছে ছিল। সুতরাং পিটারসনকে খুন করেনি।

টারজানকে সঙ্গে নিয়ে কর্নেল বার্টন রামসগেটদের শিবিরে গেলেন জিজ্ঞাসাবাদের জন্য।

তিনি গিয়ে বললেন, এই শিবিরের কেউ কারো নামে কোন অভিযোগ করতে চায়?

বারবারা বলল, আমি ট্রেন্টর বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগ আনছি।

টারজান কর্নেলের অনুমিত নিয়ে প্রশ্ন করতে লাগল। সে প্রথমে সকলের ছুরি পরীক্ষা করল। তারপর রামসগেটকে বলল, স্মিথ ও পিটারসনকে কতদিন থেকে চেন তোমরা?

রামসগেট বলল, মাত্র কয়েকসপ্তাহ আগে আমাদের সফরীতে যোগদান করে ওরা।

পিটারসন কিছুটা খুঁড়িয়ে চলত?

রামসগেট বলল, হ্যাঁ।

স্মিথ বলল, এ সব খুঁজে দরকার কি? লোকটার মাথায় ছিট আছে।

টারজান হঠাৎ স্মিথের পেটের কাছে দেখল তার শার্টটা উঁচু হয়ে আছে। সে হাত দিয়ে দেখল সেখানে বেশ কিছু কাগজপত্র আছে।

টারজান এবার সকলের সামনে জোর গলায় বলল, ট্রেন্ট বার্টনকে খুন করেনি, স্মিথই হচ্ছে খুনী। সে বার্টনকে খুন করেছে। সে পিটারসনকেও খুন করেছে।

কর্নেল বার্টন বললেন, কিন্তু কি কারণ থাকতে পারে এই খুনের?

টারজান স্মিথের জামার তলায় লুকোন কাগজগুলো টেনে বার করে বলল, এই দরকারী কাগজগুলোই হলো একমাত্র কারণ। আসলে ওদের স্মিথ আর পিটারসন নাম নয়। স্মিথের আসল নাম হলো যোশেফ ক্যাম্পবেল আর পিটারসনের নাম হলো জুবানেভ। বার্টনের কাছ থেকে এই কাগজগুলো ছিনিয়ে নেয়াই হলো ওদের একমাত্র লক্ষ্য। বার্টনের জীবিত অবস্থায় ওরা যদি চুরি করত কাগজগুলো তাহলে শিবিরের মধ্যে খোঁজ করলেই ধরা পড়ত ওরা। ক্যাম্পবেল তাই খুন করে ওকে। পরে ক্যাম্পবেল জুবানেভকেও খুন করে কারণ তাহলে এই কাগজগুলো ইতালি সরকারের কাছে বিক্রি করলে যা টাকা পাবে তাতে ভাগ দিতে হবে না কাউকে।

কর্নেল বার্টনের সঙ্গে যে পুলিশবাহিনী ছিল তারা ক্যাম্পবেল ওরফে স্মিথকে গ্রেপ্তার করল।

রামসগেট কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞাসা করল টারজানকে, জুবানেভই যে মৃত পিটারসন এটা কি করে বুঝলে?

টারজান বলল, আমার ঘ্রাণেন্দ্রিয় বড় প্রবল। কারণ আমি জঙ্গলে ছোট থেকে পশুদের কাছে মানুষ। পশুদের মতই আমার ঘ্রাণশক্তি প্রবল। সভ্য জগতের কেউ বুঝতে পারবে না একথা। ওদের ভাঙ্গা বিমান দুটো আমি দেখেছি। সেখানে একটা দস্তানা কুড়িয়ে পাই। সেই দস্তানাটা শুঁকে যে গন্ধ পাই পিটারসনের মৃতদেহটা এঁকেও সেই গন্ধ পেয়েছিলাম।

সবকথা শেষ করে সব রহস্যের সমাধান করে টারজান বলল, বিদায় বন্ধুগণ, আমি এবার আমার বাড়ি যাচ্ছি। মাঝে মাঝে আমার নিজের লোকদের দেখতে বাড়ি যাই বটে, কিন্তু জঙ্গলের ডাক না শুনে পারি না, তার টানে ধরা না দিয়ে পারি না।

টারজনের জঙ্গল জীবন (জাঙ্গল টেলস অফ টারজান)

সেদিন জঙ্গলের ঘন ছায়ার তলায় আরামে বিশ্রাম করছিল বাঁদর-গোরিলা টিকা। অদূরে একটা গাছের ডালের উপর বসে দোল খাচ্ছিল টারজান।

টিকা ছিল তার ছেলেবেলাকার খেলার সাথী। কিন্তু বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের বন্ধুত্বও বেড়ে যায়।

কিন্তু আজ সহসা টারজান যখন গাছের উপর থেকে দেখল টগ টিকার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে তার ঘাড়ের উপর একটা পা তুলে দিয়ে আদর করছে তাকে তখন মনটা বিগড়ে গেল টারজনের।

টারজান দাঁতগুলো বার করে গর্জন করে উঠল। তার পানে তাকাল টগ। টিকা মুখ তুলে তাকাল টারজনের পানে। সে এর কারণ কিছু বুঝতে পারল না। এবার সে টগের আদরের বিনিময়ে তার পিঠটা। চুলকে দিচ্ছিল।

এই দৃশ্যটা দেখার সঙ্গে সঙ্গে মাথাটা ঘুরে গেল টারজনের। তার মনে হলো এই মুহূর্তে টিকাকে সারা জগতের মধ্যে সবচেয়ে আশ্চর্যজনক বস্তু বলে মনে হচ্ছিল।

টারজান এগিয়ে এসে টগকে বলল, টিকা আমার।

টগ বলল, টিকা টগের, আর কারো নয়।

দু’জনেই এবার লড়াই-এর জন্য প্রস্তুত হলো। দু’জনেই দাঁত বার করে তেড়ে এল দু’জনকে। কিন্তু হঠাৎ সেখানে একটা চিতাবাঘ এসে পড়ায় টগ পালিয়ে গিয়ে একটা গাছের উপর উঠে পড়ল। টিকা তখনো গাছের তলায় মাটির উপরেই ছিল। কিন্তু চিতাবাঘটা তাকে সামনে পেয়ে তাকেই তাড়া করল। অন্য সব বাঁদর গোরিলাগুলোও গাছের উপর উঠে এক নিরাপদ আশ্রয় থেকে ঘটনাটা দেখে মজা পাচ্ছিল।

একা টারজান এগিয়ে গিয়ে চিতাবাঘটার সামনে দাঁড়াল। গর্জন করে চিতাবাঘটার দৃষ্টি টিকার উপর থেকে সরিয়ে তার নিজের উপরে নিবদ্ধ করার চেষ্টা করল। তার ঘাসের দড়ির ফাঁসটা চিতাবাঘটার গলায় ঠিক সেই মুহূর্তে আটকে না দিলে টিকাকে ধরে ফেলতো সে। চিতাবাঘটা গলার ফাঁসটা নিয়ে টানাটানি করতে থাকলে সেই অবসরে একটা গাছের উপর উঠে পড়ল টিকা।

সুযোগ পেয়ে টারজানও কাছাকাছি একটা গাছের উপর উঠে পড়ল। বাঘটা এবার দাঁত আর নখ দিয়ে ঘাসের দড়িটা ছিঁড়ে বনের ভিতর পালিয়ে গেল। চিতাবাঘটা পালিয়ে যেতেই বাঁদর-গোরিলাগুলো সব একে একে নেমে এল গাছ থেকে। টিকা দেখল টগ নয় টারজানই তার উদ্ধারকর্তা। তাই সে ভালবাসা ও কৃতজ্ঞতার বশে টারজনের কাছে সরে এল।

টারজান এরপর সোজা গাছে গাছে মবঙ্গাদের গায়ের কাছে চলে গেল। তখন সন্ধ্যে হয়ে গেছে। দেখল শিকারীরা বনপথের উপর পশু শিকারের জন্য একটা বড় খাঁচা পেতে রেখে সব গাঁয়ে ফিরে এসেছে।

রাতটা মবঙ্গাদের গায়ের কাছে একটা গাছে কাটিয়ে সকাল হতেই সেখান থেকে ফিরে আসতে লাগল টারজান। ফেরার পথে দূর থেকে বাঁদর-গোরিলার ক্রুদ্ধ গর্জন শুনতে পেল সে।

এদিকে সকাল হতেই মবঙ্গাদের গায়ের যেসব শিকারী খাঁচাটা পেতে রেখে গিয়েছিল তারা তাতে কোন জন্তু ধরা পড়েছে কি না তা দেখতে এল। এসে তারা দেখল একটা বিরাটকায় বাঁদর-গোরিলা ধরা পড়েছে তাতে। তাদের দেখে গোরিলাটা ছটফট করছে বার হবার জন্য। তা দেখে বেশ মজা পেল তারা। টারজান সেখানে এসে গাছের উপর থেকে সবকিছু দেখে তার দলের কাছে ফিরে এল।

টিকা বলল, টগ কোথায়?

টারজান বলল, তাকে গোমাঙ্গানীরা ধরেছে। তারা তাকে বধ করবে।

একথা শুনে এক অব্যক্ত বিষাদ ফুটে উঠল টিকার চোখে মুখে।

তা দেখে আর বসে থাকতে পারল না টারজান। লাফ দিয়ে গাছের উপর উঠে পড়ে মুহূর্তের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল কোথায়।

সোজা মবঙ্গাদের গায়ের দিকে চলে গেল টারজান। গায়ের কাছাকাছি গিয়ে দেখল শিকারী যোদ্ধারা ক্লান্ত হয়ে সবাই ঘুমোচ্ছে। শুধু একজন পাহারাদার খাঁচাটার কাছে বসে পাহারা দিচ্ছে।

টারজান তখন গাছ থেকে নেমে খাঁচাটার কাছে চলে গেল। তারপর পাহারাদারটার গলাটা দু’হাত দিয়ে টিপে ধরল। পাহারাদারটা মরে গেলে খাঁচার কাঠ খুলে টগকে মুক্ত করল টারজান। তারপর খাঁচার ভিতর পাহারাদারের মৃতদেহটা ফেলে রেখে টগকে নিয়ে গাছে উঠে পড়ল।

টারজান এবার টগকে বলল, তুমি টিকার কাছে চলে যাও। সে তোমার। টারজান তাকে চায় না।

টারজান গাছের উপর থেকে দেখল, একদল নিগ্রো যোদ্ধা একটা বড় রকমের গর্ত খুঁড়ছে। গর্তটা খোঁড়া শেষ হয়ে গেলে তার ফাঁকটায় কতকগুলো পাতা আর কিছু ঘাস চাপিয়ে দিল।

যোদ্ধারা সেখান থেকে চলে যেতেই টারজান গাছ থেকে নেমে গর্তটার চারদিকে ঘুরে সেটা খুঁটিয়ে দেখতে লাগল। উপর থেকে দেখে সেটাকে গর্ত বলে চেনাই যায় না। তারপর গাছে গাছে তার দলের বাঁদর-গোরিলাদের কাছে চলে গেল।

এইভাবে কিছুটা যাওয়ার পর টারজান তার নাকের মধ্যে এক বিরাটকায় জন্তুর গন্ধ পেল। কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখল একটা হাতি এগিয়ে আসছে সেই দিকে। টারজান গাছের উপর একটা ডাল ভাঙ্গতে তার শব্দে হাতিটা শুড় তুলে উপর দিকে তাকাল।

টারজান হাসতে লাগল। একটা নিচু ডালে নেমে এসে সে হাতিটাকে ‘ট্যান্টর, ট্যান্টর’ বলে ডাকতে লাগল।

এরপর হাতিটা শুধু মুখে একটা শব্দ করল। টারজান এবার গাছের ডাল থেকে হাতিটার পিঠের উপর নেমে পড়ল। হাতিটা টারজনের অনেক দিনের চেনা। ছেলেবেলা থেকে খেলা করে আসছে তার সঙ্গে।

টারজনের ক্ষিদে পাওয়ায় সে হাতিটার পিঠ থেকে আবার গাছের উপর উঠে পড়ল। তারপর শিকারের সন্ধানে চলে গেল।

শিকারের সন্ধানে প্রায় এক ঘণ্টা ঘুরে বেড়াল টারজান। তারপর হঠাৎ তার একটা কথা মনে পড়ে গেল। কৃষ্ণাঙ্গ নিগ্রো যোদ্ধারা কি কারণে বনের মধ্যে পথের ধারে সেই বিরাট গর্তটা খুঁড়ে রেখেছে। সে বুঝল তার প্রিয় বন্ধু ট্যান্টরকে ফাঁদে ফেলার জন্য সে খালটা করেছে তারা। হাতিটা ঘুরতে ঘুরতে এতক্ষণে হয়ত সেই খালে এসে পড়েছে। সে জানে মূল্যবান দাঁত আর বেশি মাংসের লোভে হাতি শিকার করে নিগ্রোরা।

গাছের ডালে ডালে তীর বেগে যেতে লাগল টারজান।

কিছুটা এগিয়ে টারজান দেখল হাতিটা শিকারীদের তাড়া খেয়ে এই দিকেই ছুটে আসছে। টারজান তখন গাছ থেকে নেমে হাতিটার সামনে দাঁড়িয়ে হাত দেখিয়ে বলল, থাম।

হাতিটা তাকে এবার চিনতে পেরে থামল। টারজান তখন চোরা গর্তটার উপরকার লতাপাতাগুলো তাড়াতাড়ি সরিয়ে হাতিটাকে গর্তটা দেখিয়ে দিয়ে তাকে সরে যেতে বলল। হাতিটা তখন ব্যাপারটা বুঝতে পেরে সরে গেল সেখান থেকে।

টারজান তখন তাড়াতাড়ি সেখান থেকে সরে যেতে গিয়ে পড়ে গেল গর্তটার মধ্যে। হঠাৎ পড়ে গিয়ে মাথায় আঘাত লাগায় সে অচৈতন্য হয়ে পড়ল।

এদিকে নিগ্রো শিকারীরা হাতিটার লোভে গর্তের মধ্যে উঁকি মেরে দেখে হাতিটাকে দেখতে পেল না। দু-তিনজন শিকারী গর্তের মধ্যে নেমে টারজানকে অচৈতন্য অবস্থায় দেখে বিস্ময়ে অবাক হয়ে গেল। তারা টারজানকে সেখান থেকে তুলে নিয়ে এসে তার হাত পা বেঁধে ফেলল। তারপর তাকে ওরা গাঁয়ের। দিকে নিয়ে যেতে লাগল।

মবঙ্গার নির্দেশে কয়েকজন যোদ্ধা টারজানকে একটা কুঁড়ে ঘরের দিকে নিয়ে গেল। টারজনের দূরে জঙ্গল থেকে একটা শব্দ কানে এল। টারজান সে শব্দ শুনতে পেয়ে মুখ তুলে জোরে অদ্ভুতভাবে একটা চীৎকার করল। টারজান বুঝতে পারল তার প্রিয় হাতিটা তাকে ডাকছে।

একটা কুঁড়ে ঘরের মধ্যে টারজানকে বন্দী করে রাখল ওরা।

সারাটা বিকেল ধরে টারজান তার হাত পায়ের বাঁধনগুলো খোলার চেষ্টা করতে লাগল। বাঁধনগুলো ক্রমে আলগা হয়ে এল। সন্ধ্যে হতেই একজন যোদ্ধা এসে টারজানকে তুলে ওদের উৎসবের মাঝখানে নিয়ে গেল। কিন্তু টারজনের হাত পায়ের বাঁধনগুলো তখন খুলে যাওয়ায় টারজান একটা লাফ দিয়ে। যোদ্ধাদের সঙ্গে লড়াই করতে লাগল খালি হাতে। সে ঘুষি মেরে অনেক যোদ্ধাকে ঘায়েল করল। একজন যোদ্ধা একটা বর্শা উঁচিয়ে টারজনের বুকটা লক্ষ্য করে এগিয়ে যেতে থাকলে গাঁয়ের প্রান্তে বনের ধারে ডালপালা ভাঙ্গার শব্দ হলো। টারজান বুঝত পারল তার প্রিয় ট্যান্টর এতক্ষণে মুক্ত করতে আসছে তাকে।

হাতিটা তীরবেগে এসে টারজনের চারপাশে ঘিরে থাকা যোদ্ধাদের একে একে গুঁড় দিয়ে জড়িয়ে। ধরে দূরে ফেলে দিতে লাগল। দুই-একজন হাতিটার পায়ের তলায় পড়ে মরল। অনেকে প্রাণভয়ে ছুটে পালাল। অবশেষে টারজানকে খুঁড় দিয়ে তার পিঠের উপর চাপিয়ে হাতিটা গাঁয়ের গেট পার হয়ে জঙ্গলের মধ্যে পালিয়ে গেল।

কিছুদিন পর টারজান যখন ঘাস দিয়ে একটা দড়ি তৈরি করছিল, টিকার ছেলে গজন তখন তাকে প্রায়ই বিরক্ত করছিল।

নতুন দড়িটা তৈরি হয়ে গেলে টারজান সেটা নিয়ে একা শিকারে বেরিয়ে যেতেই সেদিন কিন্তু অদ্ভুত এক খেয়াল চাপল তার মাথায়। সে মনে মনে ঠিক করল এবার থেকে সে এক মানব সন্তানকে কাছে রেখে তাকে পালন করবে, তাতে সে কৃষ্ণকায় হলেও চলবে। টিকার ছেরে তার মত মানুষ নয়, এক জন্তু। সে তার মনের কথা ঠিক বুঝতে পারে না। তাই এক কৃষ্ণাঙ্গ শিশুর খোঁজে মবঙ্গাদের গাঁয়ের পথে রওনা হলো সে।

মবঙ্গাদের গাঁয়ের কাছে নদীর ঘাটে এক নিগ্রো যুবতী মাছ ধরছিল। তার বয়স তিরিশ। নদীর পারে তার বছর দশেকের একটা ছেলে দাঁড়িয়েছিল।

গাছ থেকে নেমে পাশের একটা ঝোপ থেকে লক্ষ্য করল টারজান, ছেলেটা কালো হলেও দেখতে ভাল। টারজান তার দড়ির ফাসটা ছেলেটার গায়ের উপর ছুঁড়ে দিল। তারপর দড়িটা ধরে টান দিতেই ফাসটা ছেলেটার দুটো হাত সমেত গাটাতে আটকে গেল। এবার সে ছেলেটাকে টানতে টানতে গাছের দিকে নিয়ে যেতে লাগল। ছেলেটার জোর চীৎকারে তার মা মাছ ধরা ফেলে ছুটে এল।

কিন্তু ততক্ষণে ছেলেটাকে কাঁধের উপর তুলে নিয়ে মুহূর্ত মধ্যে গাছের মধ্য দিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল টারজান।

ছেলেটাকে নিয়ে অনেকটা দূরে গিয়ে টারজান তাকে বলল, শোন, কেঁদো না। আমার নাম টারজান। আমি তোমার ক্ষতি করব না। আমি একজন বড় শিকারী।

কিন্তু টারজনের কোন কথা বুঝতে পারল না ছেলেটা। সে টারজানকে বনদেবতা মনে করে ভয় করছিল।

টারজান কিন্তু ছেলেটাকে সোজা তার দলের বাঁদর-গোরিলাদের কাছে নিয়ে গেল। তারা নিগ্রো আদিবাসীদের শত্রু ভাবত বলে নিগ্রো ছেলেটাকে ‘গোমাঙ্গানী বলে দাঁত বার করে তেড়ে এল। তখন টারজান তাদের সাবধান করে দিয়ে বলল, এ হচ্ছে টারজনের ছেলে। এর কোন ক্ষতি করো না তোমরা। তাহলে তোমাদের মেরে ফেলব। এ টিকার ছেলে গজনের সঙ্গে খেলা করবে। এর নাম টিবো।

টারজান টিকার ছেলে গজনকে এনে টিবোর সঙ্গে খেলা করতে দিল। কিন্তু টিবো কিছুতেই সহজ হতে পারছিল না।

এদিকে টিবোর মা মোমায়া তার ছেলেকে টারজান নিয়ে যাওয়ার পর সে তাদের গায়ের যাদুকর পুরোহিতকে ডেকে তার ছেলেকে ফিরিয়ে আনার জন্য তুকতাক করতে বলে। তাকে তার জন্য দুটো ছাগল দেয়। কিন্তু কোন কাজ না হওয়ায় তার থেকে বড় যাদুকর বুকাবাইয়ের কাছে যাবার কথা ভাবে। কিন্তু গাঁয়ের সর্দার মবঙ্গা মোমায়াকে বুকাবাই-এর কাছে যেতে নিষেধ করল। বুকাবাই সেখান থেকে অনেক দূরে একটা পাহাড়ের গায়ে একটা গুহার মধ্যে থাকে। তার কাছে সব সময় দুটো হায়েনা থাকে। তাছাড়া সেখানে যেতে গেলে পথে বিপদ ঘটতে পারে।

কিন্তু মোমায়া একদিন সন্ধ্যের সময় সকলের দৃষ্টি এড়িয়ে বুকাবাইয়ের গুহার সামনে এসে হাজির হলো। গুহার ভিতর থেকে হায়েনাদের অট্টহাসির শব্দ আসতে থাকায় ভিতরে ঢুকতে সাহস পাচ্ছিল না। সে। অবশেষে বুকাবাইয়ের নাম ধরে বারকতক ডাকতে বুকাবাই বেরিয়ে এল গুহা থেকে। বয়সে বৃদ্ধ হলেও বুকাবাইয়ের দেহে শক্তি ছিল প্রচণ্ড।

মোমায়া বলল, বনদেবতা আমার ছেলেকে জোর করে ধরে নিয়ে গেছে।

বুকাবাই বলল, এর জন্য পাঁচটা ছাগল, একটা শোবার মাদুর আর একটা তামার তার দিতে হবে আগে।

মোমায়া বলল, এত কোথায় পাব আমি?

শেষে ঠিক হলো তিনটে ছাগল আর একটা মাদুর দেবে মোমায়া। বুকাবাই বলল, আজ রাতেই ছাগল আর মাদুর নিয়ে আসবে।

মোমায়া বলল, তুমি আগে আমার টিবোকে এনে দাও।

কিন্তু তাতে কিছুতেই রাজী হলো না বুকাবাই। হতাশ হয়ে গুহা থেকে বেরিয়ে গায়ের পথে রওনা হলো মোমায়া।

এদিকে তখন বুকাবাই যেখানে থাকত সেই পাহাড়টার কাছাকাছি জঙ্গলের এক জায়গায় টারজান ঘুরতে ঘুরতে শিকার করতে এসেছিল। এক সময় সে টিবোকে একটা ঝোপের ধারে রেখে কিছুটা দূরে চলে যায়। এমন সময় হঠাৎ ঝোপের ওধারে কার পায়ের শব্দ পেয়ে ভয় পেয়ে গেল টিবো। কাছে এসে মোমায়া তার ছেলেকে চিনতে পেরে ছুটে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরল।

এতক্ষণ একটা সিংহ ওদিকে একটা ঝোপের পাশ থেকে লক্ষ্য করছিল তাদের। এবার সিংহটা তাদের সামনে কিছুদূর এসে থমকে দাঁড়াতেই মোমায়া তার হাতের বর্শাটা সজোরে সিংহটাকে লক্ষ্য করে ছুঁড়ে দিল। বর্শাটা সিংহের গায়ের কিছুটা বিদ্ধ করে পড়ে গেল। তার গায়ের খানিকটা মাংস ছিঁড়ে গিয়ে রক্ত পড়তে লাগল। সিংহটা তাদের আক্রমণ করার জন্য সামনের পা তুলে উদ্যত হলো।

টিবোদের আর্ত চীৎকার কানে যেতে ছুটে এল টারজান। এসেই সে পিছন থেকে তার ছুরিটা সিংহটার পাঁজরে বসিয়ে দিল। এবার টারজনের ছুরির আঘাতে সিংহটা লুটিয়ে পড়তেই টারজনের ভয়ে ভীত হয়ে উঠল মোমায়া। সে টিবোকে বুকের উপর জড়িয়ে ধরল। ভাবতে লাগল টারজান হয়ত আবার তার ছেলেকে ছিনিয়ে নেবে তার কাছ থেকে। কিন্তু টারজান সে ধরনের কোন ভাব দেখাল না।

টিবো অনুনয় বিনয় করে বলতে লাগল, টারজান, তুমি আমাকে আমার মার সঙ্গে যেতে দাও। তোমার কথা আমরা কোনদিন ভুলব না। তুমি খুব ভাল লোক।

টারজান বলল, যাও। তবে আমি তোমাদের দুজনকে তোমাদের গাঁ পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে আসব, কারণ পথে কোন বিপদ ঘটতে পারে।

টারজনের কথাটা শুনে খুশি হলো মোমায়া। ওরা তিনজনে তখনি রওনা হয়ে পড়ল ওদের গায়ের পথে। এদিকে বুকাবাই তার গুহা থেকে বেরিয়ে মোমায়া কোন্ পথে যায় তা লক্ষ্য করতে গিয়ে দেখল বনদেবতা টারজান মোমায়ার ছেলেটাকে ফিরিয়ে দিয়েছে এবং তারা বাড়ি চলে যাচ্ছে। তবু সে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল, মোমায়াকে যে ছাগল আর মাদুরের কথা বলেছে তা সে আদায় করে ছাড়বেই।

প্রায় দু’দিন পর মবঙ্গাদের গায়ে গিয়ে পৌঁছল ওরা। মোমায়া আর তার ছেলেকে গায়ে পৌঁছে দিয়ে সেখান থেকে চলে এল টারজান।

কিন্তু বাঁদর-গোরিলাদলের মাঝে ফিরে গেল না। প্রায় তিন দিন তার নিঃসঙ্গ জীবনটা খুব একঘেঁয়ে লাগায় সে বিকালের দিকে মবঙ্গাদের গাঁয়ের পথে রওনা হলো। সে ঠিক করল সন্ধ্যের দিকে একটা কি দুটো নিগ্রো যোদ্ধাকে গলায় ফাঁস লাগিয়ে মারবে।

গাঁয়ের প্রান্তে বনের ধারে একটা গাছের উপর বসে লক্ষ্য করতে লাগল। সহসা এক নারীকণ্ঠের কান্না শুনে চমকে উঠল টারজান। সে ভাল করে দেখল একটা গাঁয়ের ভিতর একটা কুঁড়েঘর থেকে কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে আসছে মোমায়া।

টারজান এই কান্না দেখে ব্যাপারটা জানার জন্য নির্ভীকভাবে গায়ের মধ্যে সেই কুঁড়েগুলোর সামনে গিয়ে দাঁড়াল। তাকে দেখে মোমায়া চিনতে পারল। কাঁদতে কাঁদতে সে বলল, কে তার ছেলে টিবোকে আবার চুরি করে নিয়ে গেছে। তুমি মানুষ নও, দেবতা, একমাত্র তুমিই তাকে খুঁজে আনতে পারবে।

মোমায়ার ভাষা বুঝতে না পারলেও তার বক্তব্যটা মোটামুটি বুঝতে পারল টারজান। সে সেখানে আর না দাঁড়িয়ে গা থেকে বেরিয়ে বনে চলে গেল। টিবোকে সে সত্যিই ভালবাসত। তাকে সে তার মার কাছে এনে দেবেই।

গাছে গাছে কিছু দুর যাবার পর টারজান দেখল পাহাড়ের দিকে যে মাটির পথটা চলে গেছে সে পথে একটা ছেলে আর একটা বয়স্ক লোকের পায়ের ছাপ রয়েছে।

সেই ছাপ অনুসরণ করে সোজা বুকাবাই-এর গুহার সামনে যেতেই দুটো হায়েনা তাকে তেড়ে এল। টারজান গন্ধ শুঁকে বুঝল এই গুহার মধ্যেই টিবো আছে। টিবোকে দুটো হায়েনার পাহারায় রেখে বুকাবাই তার ছাগল আদায় করার জন্য মবঙ্গাদের গায়ে মোমায়ার কাছে গিয়েছিল।

বুকাবাই-এর আগে আর একদিন ঐ গায়ে গিয়ে মোমায়াকে বলে, আমার তুকতাকের জোরেই তুমি তোমার ছেলেকে ফিরে পেয়েছ। আমার জন্যই বনদেবতা ফিরিয়ে দিয়েছে তোমার ছেলেকে। অতএব আমাকে পাঁচটা ছাগল দিয়ে দাও। আর একটা শোবার মাদুর আর তামার তার।

মোমায়া বলে, তুমি ত আমার জন্য কিছুই করোনি। তুমি ত বললে ছাগল না দিলে কিছুই করবে না।

বুকাবাই তবু শুনল না। কিন্তু মোমায়া কিছু দিতে না চাইলে সে রেগে চলে আসে। পরদিন সে গাঁয়ের বাইরে লুকিয়ে গিয়ে টিবোকে একলা পেয়ে জোর করে তুলে এনে তার গুহায় বন্দী করে রাখে।

তারপর আবার পরদিন টিবোকে গুহার ভিতর হায়েনা দুটোর পাহারায় রেখে মবঙ্গাদের গায়ে চলে আসে বুকাবাই। সে মোমায়াকে বলে, আমি তোমার ছেলে যাতে ফিরে আসে তার ব্যবস্থা করব। আমাকে ছাগলগুলো দিয়ে দাও।

মোমায়া বলে, তুমিই আমার ছেলেকে চুরি করে নিয়ে গেছ।

বুকাবাই বলে, তোমার ছেলেকে আমি চুরি করে নিয়ে যাইনি। আমি জানি সে এক জায়গায় ভালই আছে। তবে দেরি হলে তার বিপদ ঘটতে পারে।

মোমায়া তখন তার ঘরে তার স্বামীকে ডাকতে গেল। সেখানে মবঙ্গা আর গাঁয়ের যাদুকর পুরোহিত রাব্বা কেগাও ছিল।

মবঙ্গা, মোমায়ার স্বামী ইবেতো আর যাদুকর কেগা ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বুকাবাইকে বলল, তুমি যাদুর কি জান? কি ওষুধ তৈরি করবে? কোন যাদু এখনি দেখাতে পারবে?

বুকাবাই বলল, হ্যাঁ পারব। আমাকে কিছুটা আগুন এনে দাও।

মোমায়া একটা পাত্রে করে বেশ কিছুটা আগুন আনল। বুকাবাই সেই আগুন থেকে কিছুটা নিয়ে মাটিতে ফেলে তার কোমরে বাঁধা একটা থলে থেকে কিছু পাউডার জাতীয় একটা বস্তু আগুনটায় ছড়িয়ে দিল। তার থেকে প্রচুর ধোয়া বার হতে লাগল। তখন বুকাবাই চোখ বন্ধ করে কি বিড় বিড় করে বকতে বকতে মূৰ্ছিত হয়ে পড়ার ভান করল। মবঙ্গা ও উপস্থিত সকলে তা দেখে অবাক বিস্ময়ে মুগ্ধ হয়ে গেল।

রাব্বা কেগা তা দেখে ঘাবড়ে গেল। সে তখন তার নিজের কৃতিত্ব দেখানোর জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠল। যে পাত্রটাতে আগুন ছিল তার উপর গোটাকতক শুকনো পাতা ফেলে দিল সে। তার থেকে ধোঁয়া বার হতে লাগল। কেগা তখন চোখ বন্ধ করে মুখটা পাত্রের উপর নামিয়ে অপদেবতাদের সঙ্গে কথা বলতে লাগল।

বুকাবাই এবার তার ভান করা মূৰ্ছা ভেঙ্গে উঠে একবার গর্জন করে উঠল। তারপর সে হাত দুটো শক্ত করে টান করে ছড়িয়ে বসে বলল, আমি তাকে দেখতে পাচ্ছি। তবে শয়তান বনদেবতা তাকে ধরতে পারেনি। আমাকে দশটা ছাগল দিলে এখনো উদ্ধার করা যাবে তাকে।

এবার কেগা বলল, আমিও তাকে দেখতে পাচ্ছি। তবে সে এখন মৃত। সে এখন নদীর তলায় পড়ে রয়েছে।

এদিকে টারজান বুকাবাই-এর গুহার মধ্যে ঢুকে দেখল টিবো কাঁদছে আর তার দুদিকে দুটো ক্ষুধিত হায়েনা তাকে ছিঁড়ে খাবার জন্য উদ্যত হয়েছে। টারজান ঢুকতেই হায়েনা দুটো টিবোকে ছেড়ে টারজানকে তেড়ে এল। টারজান একে একে হায়েনা দুটোর ঘাড় ধরে ছুঁড়ে দিতে লাগল। হায়েনা দুটো তখন ছুটে পালাল। টারজান তখন টিবোকে কাঁধে তুলে নিয়ে গুহা থেকে বেরিয়ে বনে চলে গেল। তারপর গাছে। গাছে তাদের গাঁয়ের দিকে উধ্বশ্বাসে এগিয়ে চলল।

মবঙ্গাদের গাঁয়ে যখন দু’জন যাদুকর তাদের আপন আপন যাদুর খেলা দেখিয়ে গ্রামবাসীদের মন জয় করার চেষ্টা করছিল ঠিক তখনি টারজান টিবোকে নিয়ে তাদের সামনে গিয়ে হাজির হলো। টিবোর। কাছে তার মা মোমায়া ছুটে যেতেই টিবো তাকে সব কথা বলল। এবার মোমায়া বুকাবাই-এর শয়তানির কথা জানতে পেরে তাকে ধরবার জন্য ছুটে গেল। কিন্তু তার আগেই বুকাবাই সরে পড়েছে। মোমায়া তখন কেগাকে রেগে বলল, আমার ছেলে নদীর তলায় মরে আছে? এই তোমাদের যাদু? ভণ্ড কোথাকার!

টারজান মবঙ্গাদের শত্রু হলেও টারজনের প্রতি কোন শত্রুতার ভাব দেখাল না মবঙ্গা। বরং তার উদারতা দেখে তারা সবাই খুশি হলো। কিন্তু টারজান টিবোকে তার মার হাতে তুলে দিয়েই সেখানে আর দাঁড়িয়ে চলে গেল।

বুকাবাই দেখল এখন তার একমাত্র শত্রু হলো শয়তান বনদেবতা টারজান। তার জন্যই আজ তার এই অপমান। তার জন্যই সে কোন ছাগল পেল না। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল সে টারজনের উপর প্রতিশোধ নেবেই।

সেদিন ঘুরতে ঘুরতে টারজান যখন আনমনে বুকাবাই-এর গুহার কাছে এসে পড়ল তখন সমস্ত আকাশটা মেঘে ঢেকে গিয়েছিল। একটু পরেই বৃষ্টি নামল।

টারজান একটা গাছের তলায় আশ্রয় নিল। পরে ঝড় শুরু হলে আর বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না টারজান। প্রচণ্ড ঝড়ের আঘাতে বিরাট একটা গাছ পড়ে গেল আর সঙ্গে সঙ্গে টারজানও ডাল পালাগুলোর তলায় চাপা পড়ে গেল। তার আঘাত তেমন গুরুতর না হলেও জ্ঞান হারিয়ে ফেলল সে।

ঝড় বৃষ্টি থামলে বুকাবাই তার হায়েনা দুটো নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। কিছুটা এগিয়ে যেতেই একটা ভেঙ্গে পড়া গাছের তলায় একটা লোককে মরার মত পড়ে থাকতে দেখে হায়েনা দুটো তাকে ছিঁড়ে খাবার জন্য ছুটে গেল। বুকাবাই তার হাতে হাড়ের যে একটা লাঠি ছিল তা দিয়ে হায়েনাগুলোকে মেরে তাড়িয়ে দিয়ে এগিয়ে গিয়ে দেখল যার উপর প্রতিশোধ নেবার কথা আজ সে দিনরাত ভাবছে এ সেই শয়তান বনদেবতা। সে টারজনের বুকের উপর কান পেতে দেখল এখনো জীবিত আছে টারজান। সে ভাঙ্গা গাছের ডালপালাগুলো সরিয়ে অচৈতন্য টারজানকে তুলে নিয়ে তার গুহার বাইরে নিয়ে গিয়ে নামিয়ে দিল।

এরপর একটা পাহাড়ের ধারে একটা গাছের গুঁড়ির সঙ্গে মোটা দড়ি দিয়ে তাকে বেঁধে রাখল বুকাবাই। কিন্তু তার হাত দুটো বাধল না।

এবার গুহার ভিতরে গিয়ে এক পাত্র জল নিয়ে এসে টারজনের চোখে মুখে ছিটিয়ে দিতেই চেতনা ফিরে পেয়ে চোখ মেলে তাকাল টারজান। বুকাবাই ঠিক করল সে হায়েনা দুটোকে এনে ছেড়ে দেবে টারজনের কাছে। তারা জীবন্তা টারজনের মাংস ছিঁড়ে খাবে। এইভাবে সে প্রতিশোধ নেবে টারজনের উপর।

বুকাবাই টারজানকে বলল, আমি হচ্ছি এক বিরাট যাদুকর বৈদ্য। আমার ওষুধ খুবই জোরাল। তোমার ওষুধের কোন জোর নেই। তোমার ওষুধের যে কোন জোর নেই তার প্রমাণ হলো এই যে তুমি এখন এখানে বলির ছাগলের মত বাঁধা আছ।

কিন্তু তার ভাষা টারজান বুঝতে না পারায় সে গুহায় চলে গেল হায়েনাগুলো আনার জন্য।

এবার বুকাবাই তার গুহার ভিতরে গিয়ে হায়েনা দুটোকে তাড়িয়ে নিয়ে এল টারজনের কাছে। তারপর সে গিয়ে গুহার মুখে পাতা মাদুরের উপর শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। ভাবল হায়েনাগুলোর খুব ক্ষিদে না পেলে তারা টারজনের মাংস ছিঁড়ে খাবে না। এই অবসরে সে তাই কিছুটা ঘুমিয়ে নেবে।

হায়েনা দুটো টারজনের কাছে এসে তার পা দুটো শুঁকতে লাগল। টারজান তার ছাড়া হাত দিয়ে হায়েনা দুটোকে সরিয়ে দিল। টারজান এদিকে গাছের গুঁড়ির গায়ে বাধনের দড়িগুলো ঘষতে ঘষতে সেগুলো আলগা করে ফেলল।

অবশেষে বিকালের দিকে হায়েনাগুলো ক্ষুধিত হয়ে উঠল। একটা হায়েনা টারজনের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। টারজান তার দেহের সমস্ত শক্তি দিয়ে টান দিতেই আলগা বাধনগুলো ছিঁড়ে গেল। সে তখন একটা হাত দিয়েই একটা হায়েনার গলা টিপে ধরল। আর একটা হাত বাড়িয়ে অন্য হায়েনাটাকে ধরতে গেল, এমন সময় বুকাবাই জোর চীৎকার শুনে ঘুম থেকে উঠে এল। টারজান তখন দুটো হায়েনাকে দু’হাতে ধরে একে একে বুকাবাই- এর মাথার উপর ছুঁড়ে দিল। একটা হায়েনা বুকাবাই-এর মুখটা কামড়ে দিল। আর একটা হায়েনা লাফ দিয়ে মাটিতে পড়ে পালিয়ে গেল।

হায়েনার কামড় খেয়ে মাটিতে পড়ে গেল বুকাবাই। এবার উঠে টারজনের দিকে এগিয়ে গেল তাকে আক্রমণ করার জন্য। কিন্তু টারজান এক ধাক্কায় ফেলে দিল তাকে। তারপর তাকে তুলে নিয়ে যে গাছটায় তাকে বেঁধে রেখেছিল সেই গাছের সঙ্গে খুব শক্ত করে বেঁধে রাখল।

টারজান আপন মনে বলল, এক সময় না এক সময় হায়েনাগুলো ফিরে আসবে।

সে জানত, হায়েনাগুলো ক্ষিদের জ্বালা অনুভব করলেই বুকাবাইকে এইভাবে বাঁধা অবস্থায় দেখলেই তাকে জীবন্ত ছিঁড়ে খাবে। সত্যিই ফিরে এসেছিল তারা। এক সময় ক্ষুধার জ্বালায় তারা তাদের প্রভুর জীবন্ত বুকাবাই-এর দেহটা ছিঁড়ে খুড়ে খেতে লাগল।

আজ প্রায় এক পক্ষকাল হলো টারজান মোটেই শিকার পাচ্ছে না। দিনকতক হলো সে এক রকম না খেয়ে আছে। সে তাই খাবার পাবার আশায় মবঙ্গাদের গায়ের কাছে গিয়ে দেখল মবঙ্গাদের গায়ের মধ্যে খাওয়া-দাওয়ার এক জোর উৎসব চলছে। একটা বিরাট হাতির মাংস তারা সব লোক মিলে আগুনে। ঝলসিয়ে খাচ্ছে। তাই দেখে ক্ষিদের জ্বালায় সেই মাংস খাবার খুব ইচ্ছে হচ্ছিল টারজনের। টারজান দেখল যে বিরাট পাত্রটাতে হাতির মাংস সিদ্ধ করা ছিল তার চারদিকে গাঁয়ের যোদ্ধারা ভিড় করে ছিল। তারা। সেই পাত্রটা থেকে মাংস নিয়ে খাচ্ছিল আর মাঝে মাঝে এক চুমুক করে তাদের দেশী মদ পান করছিল।

ক্ষিদের জ্বালায় জর্জরিত হয়ে গাছের উপর নীরবে বসে রইল টারজান। সে দেখল একে একে যোদ্ধারা সব মাংস আর মদ প্রচুর খাওয়ার পর ঘুমে কাতর হয়ে চলে যাচ্ছে। সবাই চলে গেলে একটা বুড়ো তখনো সেখানে মাংসের পাত্রটার পাশে বসে মাংস খাচ্ছিল। টারজান তাই আর অপেক্ষা না করে গাছ থেকে নেমে সোজা সেখানে চলে গেল। বুড়োটার গলাটা দুহাত দিয়ে টিপে ধরে তাকে হত্যা করে। পাত্রটা থেকে বেশকিছু মাংস নিয়ে বনের মধ্যে চলে এল সে।

বনের মধ্যে যেতে যেতে গাঁ থেকে মাইলখানেক দূরে এক জায়গায় থেমে কিছুটা মাংস খেল সে। এবার একটা গাছের উপর ঘুমোবার চেষ্টা করতে লাগল টারজান। ঘুম ভাঙ্গলে দেখল অনেক আগেই সকাল হয়ে গেছে, রোদ উঠেছে। গাছের তলায় একটা সিংহ দাঁড়িয়েছিল।

সিংহটা টারজনের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর গাছে উঠতে লাগল।

টারজান ক্রমশই যত উঁচু ডালে উঠতে থাকে সিংহটাও তাকে ধরার জন্য তত উপরে উঠতে থাকে। অবশেষে গাছের মাথায় শেষ ডালটায় উঠে টারজান ভাবল, এবার তার মৃত্যু সুনিশ্চিত। কারণ আর কোন দিকে এগোন সম্ভব নয়।

এমন সময় অদ্ভুত একটা কাণ্ড ঘটল। একটা বিরাটকায় পাখি কোথা থেকে উড়তে উড়তে এসে গাছটার মাথায় না বসেই টারজনের কাছে এসে ঠোঁট দিয়ে ঘাড়ে একটু ঠুকরে দিল আর টারজান সঙ্গে সঙ্গে সিংহের কবল থেকে বাঁচার জন্য পাখিটার পা দুটো দু’হাত দিয়ে ধরল শক্ত করে। পাখিটা টারজানকে নিয়েই উড়তে লাগল। এত বড় পাখি বইয়ে দেখলেও জীবনে কখনো চোখে দেখেনি সে।

এইভাবে পাখিটা অনেকদূর উড়ে যাবার পর টারজান একটা গাছের মাথা লক্ষ্য করে পাখিটার পা দুটো ছেড়ে দিয়ে সেই গাছটার উপর পড়ল।

টারজান দেখল আজ কয়েকদিন ধরে তার শরীরটা ভাল নেই। তাই বিশ্রামের আশায় সমুদ্রোপকূলে তার সেই কেবিনটায় চলে গেল। তারপর আপন মনে বই পড়তে লাগল।

সহসা তার মনে হলো কে যেন ঘরে ঢুকল। টারজান দেখল একটা বিরাট বাঁদর-গোরিলা ঘরে ঢুকে এগিয়ে আসছে তার দিকে। টারজান তার ছুরিটা শক্ত করে ধরে তৈরি হতে না হতেই গোরিলাটা তাকে জোর করে ধরে নিয়ে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। কেবিন থেকে কিছুটা দূরে যেতেই নিজেকে ছিনিয়ে নিয়ে টারজান তার ছুরিটা অতর্কিতে গোরিলার পেট ও বুকের উপর বসিয়ে দিল। তখন টলতে টলতে ধড়াস করে পড়ে গেল গোরিলাটা।

এরপর আবার কেবিনে ফিরে এল।

সেদিন তাদের দল থেকে একটু দূরে জঙ্গলের এক জায়গায় টিকা একা একা আহার সংগ্রহের কাজে ব্যস্ত ছিল। তার ছেলে গজন তার কাছে খেলা করছিল। এমন সময় টুগ নামে অন্য এক দলের বাঁদর গোরিলা এসে হাজির হলো সেখানে।

টিকা তাকে দেখেই দাঁত বার করে তেড়ে এল। টিকা গজনকে সাবধান করে দিয়ে বলল, তুমি গাছে উঠে পড়।

টুগ টিকাকে ধরতে গেলে গজন গাছের উপর থেকে গালাগালি দিতে লাগল। টুগ তখন টিকাকে ছেড়ে দিয়ে গাছের উপর উঠে গজনকে ধরতে গেল। গজন উপর ডালে উঠে গেলে টুগ সেই ডালটা ধরে জোর নাড়া দিতে লাগল। তখন গজন গাছ থেকে মাটিতে টিকার পায়ের কাছে পড়ে গেল। সে জোর আঘাত পেয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলল। টুগ এবার টিকাকে জোর করে ধরে কাঁধের উপর তুলে নিয়ে পালিয়ে গেল।

এদিকে টপ ঘুরতে ঘুরতে একটা গাছের উপর থেকে দেখতে পেল একটা হায়েনা একটা ঘুমন্ত ছেলের বুকের উপর মুখ লাগিয়ে শুঁকছে। সে এবার তার ছেলে গজনকে চিনতে পারল। সঙ্গে সঙ্গে গাছ থেকে লাফ দিয়ে মেনে ছুটে সেখানে চলে গেল। হায়েনাটাকে ধরে তার গলাটা টিপে তাকে বধ করে ছুঁড়ে ফেলে দিল তার প্রাণহীন দেহটাকে। তারপর চীৎকার করে তার দলের লোকদের ডাকতে লাগল।

তাদের চীৎকার শুনতে পেয়ে কেবিন থেকে ছুটে এল টারজান। টারজান গজনের দেহটা পরীক্ষা করে দেখল তার দেহে তখনো প্রাণ আছে। সে বলল, এ কাজ কে করেছে? টিকা কোথায়?

টগ বলল, আমি তার কিছুই জানি না।

টারজান মাটিটা পরীক্ষা করে গন্ধ শুঁকে বলল, অন্য দলের একটা বাঁদর-গোরিলা এই কাজ করেছে।

বাঁদর-গোরিলারা শত্রুর উপর প্রতিশোধ নেবার জন্য টিকার খোঁজে যেতে চাইল। কিন্তু টারজান বলল, আমি টগকে নিয়ে যাব। একটা মাত্র বাঁদর- গোরিলা এসে টিকাকে নিয়ে গেছে।

এই বলে টারজান টগকে সঙ্গে করে ঝড়ের বেগে চলে গেল। বাতাসে টুগ আর টিকার গন্ধ পাচ্ছিল সে। তাই ঠিক পথ ধরে এগোতে লাগল সে।

টুগ টিকাকে কাঁধে করে তার দলের কাছে যাচ্ছিল। পথে সে টিকাকে বশ করার অনেক চেষ্টা করে। কিন্তু টিকা প্রতিবারই তাকে কামড়াতে থাকে। টুগও তাকে আঘাত করে। এইভাবে যেতে যেতে পথে টুগ তার দলের দু’জন বাঁদর-গোরিলার সঙ্গে দেখা পেয়ে যায়।

এমন সময় একটা ছোটা বাঁদর টারজানদের সেই দিকে এগিয়ে আসতে দেখে টুগদের সাবধান করে দেয়। টুগরা তখন একটা ঝোপের মধ্যে লুকিয়ে পড়ে। কিন্তু টারজান বাতাসে গন্ধ শুঁকে ঠিক জায়গাতেই এসে পড়ে। টিকা চীৎকার করে তাদের উপস্থিতির কথা জানিয়ে দেয়। টুগ তখন তাকে জোর একটা ঘুষি মেরে ফেলে দেয়।

টারজান আর টগ এবার শত্রু গোরিলাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। টগ একা টুগ আর অন্য একজন। গোরিলার সঙ্গে লড়াই করতে লাগল। টারজান শুধু সবচেয়ে বড় গোরিলাটার সঙ্গে লড়াই করতে লাগল। পরে এক সময় টারজান ছুরিটা বার করে গোরিলাটার বুকে আমূল বসিয়ে দিতেই সে পড়ে গেল। টারজান তখন টগের সাহায্যে এগিয়ে গেল।

টারজনের হাতে একটা গোরিলা মারা যায়। এবার টুগ আর অন্য গোরিলাটা টারজনের জোর ঘুষি খেয়ে রক্তাক্ত দেহে অবসন্ন হয়ে হাঁপাতে লাগল। তারা আর লড়াই করতে পারছিল না।

এবার টুগ তাদের ভাষায় চীৎকার করে তাদের দলের গোরিলাদের ডাকতে লাগল। কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রায় কুড়িজন গোরিলা এসে টারজান আর টগকে আক্রমণ করল। টিকা একটা গাছের উপর উঠে পড়ল। কিন্তু সে যখন দেখল টারজান আর টগ দু’জনে এতগুলো গোরিলার সঙ্গে পেরে উঠবে না তখন গাছ থেকে নেমে সে টারজনের কাছে গিয়ে দাঁড়াল।

হঠাৎ টিকার কি মনে হলো সে টারজনের কোমর থেকে বাজীর থলেটা নিয়ে নিল। থলেটার মধ্যে ছোট ছোট কতকগুলো বিস্ফোরক বোমার মত বস্তু ছিল।

টিকা এবার থলে থেকে সেই ছোট ছোট বোমাগুলো একটা একটা করে বার করে শত্রু গোরিলাদের লক্ষ্য করে ছুঁড়তে লাগল। জোর আওয়াজ শুনে আর ধোয়া দেখে ভয়ে পালিয়ে গেল শত্রুরা। তারা এ জিনিস কখনো দেখেনি। তাই দারুণ ভয় পেয়ে গেল।

একদিন টারজান যখন তার কেবিনের দিকে যাচ্ছিল তখন বাতাসে একদল নিগ্রো শিকারীর গন্ধ পেল।

টারজান গাছের উপর দেখল মবঙ্গার গাঁয়ের একদল শিকারী একটা বড় বড় চাকাওয়ালা খাঁচা টেনে টেনে নিয়ে আসছে। টারজান বুঝল সিংহ শিকারের জন্য খাঁচাটা এক জায়গায় রেখে যাবে তারা। তারপর পরদিন সকালে শিকারসমেত খাঁচাটা নিয়ে যাবে তাদের গায়ে। খাঁচার ভিতরে একটা ছাগল ছিল। ছাগলটা প্রাণভয়ে ক্রমাগত চীৎকার করছিল।

শিকারীরা চলে গেলে টারজান গাছ থেকে নেমে খাঁচার কাছে চলে গেল। সে তার ছুরি দিয়ে ছাগলটাকে মেরে কিছুটা মাংস খেল। তারপর সে শিকারীরা যে পথে গেছে সেই পথে গাছে গাছে এগিয়ে যেতে লাগল।

এইভাবে মাইল দুয়েক যাবার পর টারজান দেখল শিকারীর দল তাদের গায়ের কাছে চলে গেছে। শুধু যাদুকর ডাক্তার রাব্বা কেগা দল থেকে পিছিয়ে পড়েছে। সে একটা গাছের তলায় বসে পঁড়িতে হেলান দিয়ে বিশ্রাম করছিল।

ভণ্ড কেগাকে ঘৃণা করত টারজান। টারজান দেখল তাকে হত্যা করার এই হলো সুবর্ণ সুযোগ। তারপর কেগার গলা টিপে ধরে তাকে খামার কাছে নিয়ে গিয়ে খাঁচাতে ঢুকিয়ে তাকে বেঁধে রেখে খাঁচাটা বন্ধ করে দিল। কিন্তু এর ভয়ঙ্কর পরিণতি কি হবে তা বুঝতে পারল কেগা।

এরপর দূরে একটা গাছের উপর উঠে রাতটা কাটাল টারজান। রাত্রিতে ঘুমের ঘোরে একবার একটা সিংহের গর্জন শুনেছিল সে। সকালে উঠে খাঁচার কাছে টারজান গিয়ে দেখল খাঁচার মধ্যে সত্যিই একটা সিংহ আটকে পড়েছে। সিংহটা কেগার দেহটাকে ক্ষতবিক্ষত ও বিকৃত করে তাকে বধ করে ফেলে রেখেছে। সিংহটা ছটফট করতে করতে গর্জন করছিল মাঝে মাঝে।

টারজান দেখল শিকারীরা এসে দূর থেকে খাঁচার মধ্যে সিংহ আটকে পড়তে দেখে আনন্দে উল্লাস করছিল। কিন্তু কাছে এসে কেগার মৃতদেহ দেখে বিমর্ষ ও নীরব হয়ে গেল। যাই হোক, খাঁচাটা তারা টেনে নিয়ে গায়ের দিকে নিয়ে যেতে লাগল।

খাঁচাটা গায়ে গেলে কি প্রতিক্রিয়া হয় তা দেখার জন্য টারজানও তাদের পিছু পিছু গাছের ডালে ডালে যেতে লাগল। তারপর গাঁয়ের কাছে একটা গাছ থেকে দেখল, গতকাল শিকারীরা গাঁয়ে গেলে তাদের সঙ্গে কেগা না ফেরায় মবঙ্গা বিচলিত হয়ে পড়ে। তারা খোঁজাখুঁজি করতে থাকে। কিন্তু কোথাও না পেয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ে। আজ সকালে খাঁচাটা গায়ে গেলে তার মধ্যে একটা সিংহের সঙ্গে কেগার বিকৃত মৃত দেহটা দেখে আশ্চর্য হয়ে যায়। এবার তারা উৎসবের জন্য তৈরি হতে লাগল। খাঁচাটার কাছে থেকে দু’জন যোদ্ধা পাহারা দিতে লাগল।

টারজান তখন মনে মনে সিংহটাকে খাঁচা থেকে মুক্ত করার এক ফন্দী আঁটতে লাগল। ও জানে সন্ধ্যে হলেই ওরা সিংহটাকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মারবে। ও ঠিক করল সন্ধ্যে হলেই ও সিংহের চামড়াটা গায়ে পরে সিংহ সেজে ওদের সামনে গিয়ে হাজির হয়ে খাঁচাটা খুলে দেবে।

অন্ধকার হয়ে উঠতেই টারজান সিংহের চামড়া পরে সিংহ সেজে খাঁচাটার কাছে চলে গেল। সিংহের ছদ্মবেশে টারজান সিংহের মত গর্জন করতে করতে খাঁচার কাছে চলে গেল। অন্ধকারে একটা সিংহ দেখে উৎসব ছেড়ে সবাই ছোটাছুটি করতে লাগল। খাঁচার সামনে টারজান মানুষের মত দাঁড়িয়ে খাঁচার দরজাটা খুলে দিয়েই গাছে উঠে পড়ল।

মেয়েরা লক্ষ্য করল বনদেবতা টারজানই সিংহের বেশ ধরে এসে খাঁচা খুলে দেয়। তারা সে কথা যোদ্ধাদের বলতেই তারা টারজনের খোঁজ করতে থাকে। কিন্তু ততক্ষণে খাঁচা থেকে আসল সিংহটা বেরিয়ে গায়ের মধ্যে ছোটাছুটি করে যাকে তাকে আক্রমণ করতে লাগল। যোদ্ধারা হঠাৎ আসল সিংহের গর্জন শুনে বিভ্রান্ত হয়ে পড়ল। ভয়ে তারা ঠিকমত বর্শা চালাতে পারল না। দশ-বারোজন লোককে মেরে ফেলল সিংহটা। এদিকে টারজান তখন গা থেকে অনেক দূরে জঙ্গলের মধ্যে চলে গেছে।

সেদিন রাত্রিতে একটা গাছের উপর শুয়ে আকাশে চাঁদের পানে তাকিয়েছিল টারজান। হঠাৎ কাদের ভয়ার্ত চীৎকার শুনে উঠে বসল টারজান। দেখল অদূরে ছয়জন নিগ্রো আগুন জ্বালিয়ে বসে আছে আর একটা সিংহ তাদের কাছে গিয়ে আক্রমণ করার জন্য উদ্যত হয়ে উঠেছে। মাত্র একজন বাদে সব নিগ্রোগুলো ভয় পেয়ে কাছাকাছি গাছের উপর উঠে পড়ল। কিন্তু তাদের মধ্যে মাত্র একজন নিগ্রো জ্বলন্ত আগুন থেকে একটা কাঠ নিয়ে সিংহটার দিকে ছুঁড়ে মারতেই সিংহটা তার সাথীকে নিয়ে পালিয়ে গেল। কিছুক্ষণ পর আবার এল সিংহটা। কিন্তু এবার নিগ্রোটা জ্বলন্ত কাঠটা এমনভাবে সিংহের মুখে ছুঁড়ে দিল যে সিংহটা আর ফিরে এল না।

গোটা ঘটনাটা প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত দেখল টারজান। তার কাছে আর একটা ডালে টগ শুয়েছিল। টারজান টগকে জাগিয়ে বলল, ঐ যে গোররা দেখছ না, তার মাঝে কালো দাগ রয়েছে। আসলে ঐ দাগগুলো নুমা বা সিংহের চোখ। নুমা গোয়রার দিকে তাকিয়ে আছে। গোরোর চারপাশে আগুন জ্বলছে, ঐ আগুনটা নিভে গেলেই নুমা গোররাকে খাবে।

কথাটা পরে টগ তাদের দলের সবচেয়ে বুড়ো ও বুড়ি গান্টো আর মুমগাকে বলল। তারা দু’জনেই বলল, নুমা নয়, টারজানই একদিন গোরোকে খাবে। সে আমাদের মত বাঁদর নয়, মানুষ। সে সিংহ মেরে আমাদের খাওয়াবার জন্য নিয়ে আসে। সে তেমনি সিংহকে গোরোর কাছে এনেছে। ঐ সিংহই গোররাকে খাবে। টারজানকে বধ করা উচিত। আমরা ওকে বধ করব।

টিকা আর টগ দু’জনেই ছিল টারজনের পক্ষে। টগ বলল, টারজান আমার সবচেয়ে বড় বন্ধু। প্রথম প্রথম আমি তাকে সন্দেহ করতাম। ভাবতাম সে টিকাকে কেড়ে নিতে চায় আমার কাছ থেকে। কিন্তু পরে দেখলাম আমার সন্দেহ ভুল। টারজনের মত এমন বন্ধু আমি পাব না।

তবু অন্য সব বাঁদর-গোরিলারা টারজানকে হত্যা করার এক ষড়যন্ত্র করতে লাগল। গান্টো এই ষড়যন্ত্রকে জোরালো করে তুলতে চাইল। টারজান কিন্তু কিছুই জানত না এই ষড়যন্ত্রের।

সেদিন টারজান তার পশু বন্ধু ট্যান্টরের চওড়া পিঠের উপর পা ছড়িয়ে শুয়েছিল। হঠাৎ তার কি মনে হলো সে শুয়ে শুয়েই হাতিটাকে বলল, ট্যান্টর, তুমি কার্চাকের সেই বাঁদর-গোরিলাদের কাছে আমাকে নিয়ে চল।

দলের কাছাকাছি গিয়ে একটা গোলমালের শব্দ শুনতে পেল টারজান। সে হাতির পিঠ থেকে গাছে চড়ে ডালে ডালে চলে গেল ঘটনাস্থলে। গিয়ে দেখল, একটা নিগ্রো যোদ্ধাকে ঘিরে বাঁদর-গোরিলারা উত্তেজিতভাবে আক্রমণের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। টারজান ভিড় ঠেলে ভিতরে যেতেই একজন গোরিলা বলল, এ গোমাঙ্গানীটা আমাদের দলের মধ্যে এসে পড়েছে।

টারজান বুঝল সেদিন রাতে এই নিগ্রোটাই একা জ্বলন্ত কাঠ দিয়ে সিংহগুলোকে তাড়ায়। এ অত্যন্ত সাহসী। সে দলের বাদর-গোরিলাদের বলল, একে ছেড়ে দাও। এ খুব সাহসী বীর। এ আমাদের কোন ক্ষতি করেনি।

কিন্তু গান্টো ও দলের সবাই বলল, না, গোমাঙ্গানীরা আমাদের শত্রু। ওকে ছাড়া হবে না। ওর সঙ্গে টারমাঙ্গানী টারজানকেও মারা হবে।

এই বলে ওরা টারজানকে আক্রমণ করার জন্য উদ্যত হলো। নিগ্রো যোদ্ধাটি মবঙ্গার দলের একজন যোদ্ধা। সে বনদেবতা টারজনের নামে অনেক কিছু শুনেছিল। আজ টারজানকে এত কাছ থেকে এই প্রথম দেখল। সে দেখল টারজান যেই হোক, সত্যিই খুব ভাল। সে তার ভাষা বুঝতে না পারলেও বুঝতে পারল সে তাকে বাঁচাবার জন্য লড়াই করতে যাচ্ছে তাই সেও বর্শা হাতে টারজনের সাহায্যে এগিয়ে গেল।

একমাত্র টগ ছাড়া সব পুরুষ বাঁদর-গোরিলাগুলো টারজানকে মারার জন্য উদ্যত হলো। টারজান, টগ আর সেই নিগ্রো যোদ্ধাটি তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াল। টারজান জোরে একটা শব্দ করল।

এমন সময় গোলমাল শুনে টারজনের হাতিবন্ধু গাছপালা ভেঙ্গে ছুটে এল। হাতিটা ক্ষিপ্রগতিতে আসতেই সব বাঁদর-গোরিলারা ছুটে পালিয়ে গিয়ে আশ্রয় নিল। টারজান হাতিটাকে বলল, আমাকে তোমার পিঠের উপর চাপিয়ে সমুদ্রের ধারে আমার কেবিনটায় নিয়ে চল।

হাতিটা শুঁড় দিয়ে টারজানকে তার পিঠে চাপালে টারজান বাঁদর-গোরিলাদের বলল, একমাত্র টগ আর টিকা ছাড়া তোমরা কেউ আমার কাছে যাবে না কখনো। আমি তোমাদের দল ছেড়ে চলে যাচ্ছি চিরদিনের মত।

টারজনের পশুসঙ্গীরা (দি বীস্টস অফ টারজান)

লর্ড গ্রেস্টোক একদিন যে বাঁদরদলের রাজা’ নামে পরিচিত ছিল তখন প্যারিসে তার বন্ধু লেফটন্যান্ট পল দার্ণতের বাড়িতে বসে ছিল। সে তখন ভাবছিল তার শত্রু রোকোফের পালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা। তারই সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে এই রোকোফের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়।

টারজান বলল, আমি নিজের জন্য ভাবি না পল। অতীতে তার অনেক কু-অভিসন্ধিই ব্যর্থ করেছি আমি। আমার যতদূর মনে হয় সে আমাকে কায়দা করতে না পেরে আমার স্ত্রী পুত্রের মাধ্যমেই আমার উপর প্রতিশোধ নেবার চেষ্টা করবে এখন। তাই আমাকে ফিরে গিয়ে বাড়িতে থাকতে হবে রোকোফ আবার ধরা না পড়া পর্যন্ত।

টারজান যখন এইভাবে তার বন্ধুর সঙ্গে প্যারিসে বসে কথা বলছিল ঠিক সেই সময়ে লন্ডনের এক বাড়িতে দু’জন কুটিলদর্শন লোক কথা বলছিল নিজেদের মধ্যে। তাদের মধ্যে একজনের মুখে ছিল বড়। দাড়ি আর একজনের মুখে ছিল মাত্র কয়েকদিনের অল্প দাড়ি।

কম দাড়িবিশিষ্ট লোকটি দাড়িওয়ালা লোকটিকে বলল, তোমার দাড়িটা কামিয়ে ফেলতে হবে। এ্যালেক্সি। তা না হলে ওরা তোমায় চিনে ফেলবে। এখন আমাদের এখানেই ছাড়াছাড়ি হবে। এরপর যখন আমাদের কিনসেড জাহাজে দেখা হবে তখন আমাদের সম্মানিত অতিথি দু’জনও এসে পড়বেন। যাদের জন্য আমাদের এই সমুদ্র যাত্রার পরিকল্পনা।

রোকোফ বলল, আমাদের চেষ্টা সফল হলে তাতে আমদের লাভ আর আনন্দ দুই-ই হবে। ফরাসীরা কী বোকা! আমার পালিয়ে যাবার খবরটা জেল কর্তৃপক্ষ গোপন রেখেছে। তার ফলে আমার পরিকল্পনাটা কার্যকরী করার প্রচুর সুযোগ পেয়েছি আমি। এখন বিদায়।

এর তিন ঘণ্টা পরই প্যারিসে পল দার্ণতের বাসায় একখানা টেলিগ্রাম এসে হাজির হলো। টারজান সেটা পড়ে দার্ণতের হাতে দিয়ে বলল, পড়ে দেখ পল।

পল পড়ে দেখল, তাতে লেখা আছে, নতুন চাকরের যোগসাজসে কে আমাদের বাগানবাড়ি থেকে জ্যাককে চুরি করে নিয়ে গেছে। অবিলম্বে চলে এস।-জেন।

লন্ডনের বাড়িতে গিয়ে টারজান তার স্ত্রীর সঙ্গে কিছুক্ষণ এখন কি করা যায় তা নিয়ে আলোচনা করতে লাগল। এমন সময় হঠাৎ তাদের লাইব্রেরী ঘরের টেলিফোন বেজে উঠল।

ওদিক থেকে ফোনে বলে উঠল, কে লর্ড গ্রেস্টোক?

টারজান বলল, হ্যাঁ।

আপনার ছেলে চুরি হয়েছে? আমি আপনার ছেলের উদ্ধারের ব্যাপারে সাহায্য করতে পারি। আমি জানি কারা তাকে চুরি করে নিয়ে গেছে। তবে একটা শর্তে আমি আপনার ছেলেকে উদ্ধার করে দেব। আপনি আমাকে এ ব্যাপারে জড়াবেন না।

টারজান জিজ্ঞাসা করল, কোথায় এবং কখন আপনার সঙ্গে দেখা হবে?

ওপার থেকে উত্তর এল, ডোভারের বন্দরের কাছে নাবিকদের বিশ্রামাগারে। আজ রাত্রেই দশটার সময় চলে আসুন। আপনার ছেলে ততক্ষণ নিরাপদেই থাকবে। স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের গোয়েন্দা বিভাগে কোন কথা জানাবেন না এবং এবিষয়ে আমি লক্ষ্য রাখব। যদি আপনার সঙ্গে কেউ থাকে তাহলে আমি দেখা করব না আপনার সঙ্গে এবং তার ফলে আপনার সন্তানের উদ্ধারের শেষ আশাটিও নির্মূল হয়ে যাবে।

কথাটা তার স্ত্রীকে সঙ্গে সঙ্গে জানাল টারজান। তার স্ত্রী জেন তার সঙ্গে যাবার জন্য জেদ ধরল। টারজান বলল, অচেনা লোকটি বারবার আমাকে একা যেতে বলেছে।

কথাটা বলেই তৎক্ষণাৎ ডোভারের পথে রওনা হলো টারজান। সে চলে যাওয়ার পর জেন তাদের লাইব্রেরী ঘরে চিন্তিত মনে পায়চারি করতে লাগল। তার কেবলি ভয় হতে লাগল ছেলে উদ্ধারের নাম। করে টারজানকে আবার বিপদে ফেলবে না ত? বলা যায় না, তার স্বামী আর সন্তান একই সঙ্গে দু’জনকেই শয়তান রোকোফের কবলে ফেলার চক্রান্ত চলছে না ত?

জেন আর স্থির থাকতে পারল না। সে ঠিক করল টারজনের পিছু পিছু সেও যাবে ডোভারে।

ডোভারে সমুদ্রের কাছে সেই নির্দিষ্ট বাড়িটায় গিয়ে টারজান যখন পৌঁছল তখন রাত্রি ন’টা পঁয়তাল্লিশ বাজে। দুর্গন্ধওয়ালা একটা ঘরে টারজান ঢুকতেই একটা লোক এসে টারজানকে বলল, আসুন স্যার।

লোকটাকে আগে কখনো দেখেছে বলে মনে হলো না টারজনের। লোকটা যে আসলে ছদ্মবেশী রোকোফের সহকারী ও সহচর পলভিচ সেকথা ঘুণাক্ষরেও জানতে পারেনি টারজান।

টারজান বলল, আমার ছেলে কোথায়?

লোকটা বলল, ঐ যে একটা ছোট জাহাজে আলো দেখা যাচ্ছে ঐটাতে আছে। জাহাজটার নাম কিনসেড।

টারজান বলল, ঠিক আছে চল সেখানে।

টারজানকে সঙ্গে করে কিনসেড নামে ছোট জাহাজটাতে নিয়ে গিয়ে লোকটা বলল, ডেকের তলায় এই ঘরটাতে আছে। আপনি নেমে যান ঘরটার মধ্যে।

টারজান তার ছেলেকে দেখার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠেছিল। সঙ্গে সঙ্গে ঘরটার মধ্যে নেমে গেল আর মুহূর্তের মধ্যে দরজাটা বাইরে থেকে বন্ধ করে শিকল দিয়ে দিল লোকটা। টারজান এবার বুঝতে পারল ছলনা করে তাকে ঘর থেকে টেনে এনে বন্দী করল রোকোফ।

এমন সময় টারজান দেখল জাহাজটা ছেড়ে দিল। এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই নারীকণ্ঠের এক ভয়ার্ত চীৎকার শুনে টারজনের মত সাহসী লোকের বুকেও হিমশীতল ভয়ের একটা শিহরণ খেলে গেল।

টারজান সেই লোকটার সঙ্গে কিনসেড জাহাজে চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জেন একটা গাউন পরে আর মাথায় ওড়না দিয়ে নাবিকদের সেই বাড়িতে হাজির হলো। গিয়ে দেখল দশ বারোজন নাবিক সেখানে বসে জটলা পাকিয়ে গল্প করছে। জেন তাদের একজনকে বলল, ভাল পোশাক পরা লম্বা একজন ভদ্রলোক এখানে এসে একজনের সঙ্গে কথা বলছিলেন।

নাবিকটি বলল, হ্যাঁ কিছুক্ষণ আগে তিনি একজনের সঙ্গে কথা বলতে বলতে ঐ জাহাজটার দিকে চলে গেলেন।

জেন দেখল দুটো লোক একটা নৌকায় করে জাহাজটায় গিয়ে উঠছে। তখন সে লোকটাকে বলল, তুমি আমাকে একটা নৌকায় করে ঐ জাহাজটায় নিয়ে চল। তোমাকে আমি দশ পাউন্ড দেব।

লোকটা তখন জেনকে নৌকায় করে জাহাজে তুলে দিলে জাহাজটা ছেড়ে দিল। কিন্তু কোন কেবিনেই তোক দেখতে পেলো না। অবশেষে শেষ প্রান্তে একটা কেবিনের দরজা একটু ঠেলা দিতেই দরজাটা খুলে গেল। ভিতরে একজন লোক ছিল। সে জেনকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে জোর করে তাকে ঘরে টেনে এনে দরজাটা বন্ধ করে দিল।

জেন চিনতে পারল লোকটা নিকোলাস রোকোফ। জেনের মুখ থেকে বেরিয়ে এল, নিকোলাস রোকোফ! মঁসিয়ে থুরান।

সঙ্গে সঙ্গে জেন জোরে চীৎকার করে উঠল এবং সেই ভয়ার্ত চীৎকারটা টারজান তার ঘর থেকে শুনে চমকে উঠল।

রোকোফ বলল, এখন নয়, জাহাজটা কূল থেকে অনেকটা দূরে চলে গেলে তবে চীৎকার করবেন।

এই বলে সে জেনের ঠোঁটের উপর তার হাতটা চাপা দিল। মাথাটা নত করে বলল, আমি হচ্ছি আপনার ভক্ত এবং গুণগ্রাহী।

রোকোফের কথায় কান না দিয়ে জেন বলল, হায়, আমার ছেলে, সে কোথায়? এত নিষ্ঠুর তুমি কি করে হতে পারলে নিকোলাস রোকোফ? বল সে কোথায়? সে কি জাহাজেই আছে? আমাকে আমার ছেলের কাছে দয়া করে নিয়ে চল।

রোকোফ বলল, আমার কথামত আপনি যদি কাজ করেন তাহলে আপনার ছেলের কোন ক্ষতি হবে না।

এই কথা বলে ঘর থেকে বেরিয়ে দরজাটা তালাবন্ধ করে দিল। এরপর পর পর দু’দিন রোকোফকে দেখতে পায়নি জেন। এই সময়ের মধ্যে জেন শুধু একটা সুইডেনবাসী লোককে দেখতে পেল। লোকটা খাবার সময় তাকে খাবার দিয়ে যেত।

টারজান তখনো পর্যন্ত বুঝতে পারেনি জেনও এই জাহাজেই বন্দী হয়ে আছে। যে নাবিকটা জেনকে খাবার দিয়ে যেত, সেই নাবিকটাই টারজানকেও খাবার দিত। টারজান লোকটা তার ঘরে এলেই তার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করত। কিন্তু কোনক্রমেই কোন কথা বলত না লোকটা।

এইভাবে কয়েক সপ্তাহ কেটে গেল। কিন্তু বন্দীরা কেউ বুঝতে পারল না তাদের কোথায় নিয়ে গিয়ে কি করা হবে।

জেনকে সেই ঘরটায় বন্দী করে তালাবন্ধ করে রাখার কয়েকদিন পর রোকোফ একদিন দেখা করল জেনের সঙ্গে। বলল, আমাকে যদি একটা মোটা অঙ্কের চেক দাও তাহলে তোমার ব্যক্তিগত নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে তোমায় ইংল্যান্ডে ফিরে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেব।

কিন্তু জেন বলল, তুমি আমার ছেলে ও স্বামীকে যদি কোন সভ্য দেশের বন্দরে নামিয়ে দাও তাহলে তুমি যা চাইছ তার দ্বিগুণ স্বর্ণমুদ্রা তোমাকে দেব। তা করার আগে তোমাকে একটা কপর্দকও দেব না।

রোকোফ বলল, আমার কথামত যদি চেক না দাও তাহলে তুমি বা তোমার স্বামী বা সন্তান কেউ কোন সভ্য দেশে কোনদিন নামতে পারবে না।

জেন বলল, আমি তোমাকে বিশ্বাস করি না।

রোকোফ ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার জন্য ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, তোমাকে যা বলছি তাই করো। মনে রেখো, তোমার ছেলে আমার হাতে। যদি তুমি তোমার ছেলের আর্ত চীৎকার শোন তাহলে বুঝতে পারবে তোমার গোঁড়ামির জন্যই তোমার ছেলে কষ্ট পাচ্ছে।

অবশেষে জেন একটা মোটা টাকার চেক লিখে রোকোফের হাতে দিল আর রোকোফ মুখে এক তৃপ্তির হাসি নিয়ে বেরিয়ে গেল কেবিন থেকে।

পরদিন পলভিচ টারজনের ঘরে গিয়ে দেখা করল তার সঙ্গে। সে টারজানকে বলল, লর্ড গ্রেস্টোক, আপনি দীর্ঘকাল ধরে রোকোফের সঙ্গে শত্রুতা করে আসছেন এবং তার সব পরিকল্পনা ব্যর্থ করে দিয়েছেন। আপনার জন্যই তাকে অনেক টাকা খরচ করে এই জাহাজ ভাড়া করতে হয়েছে। সুতরাং এর খরচ আপনাকেই বহন করতে হবে। তাহলে আপনার স্ত্রী সন্তান তাদের অশুভ পরিণাম থেকে মুক্ত হবে এবং আপনাকেও মুক্তি দেয়া হবে।

টারজান বলল, কত টাকা তোমরা চাও? তোমরা যে তোমাদের চুক্তি মেনে চলবে তারই বা নিশ্চয়তা কোথায়? তোমাদের মত শয়তানকে বিশ্বাস করাও ত মুস্কিল।

পলভিচ বলল, আমাদের এভাবে অপমান করবেন না। আমরা কথা দিচ্ছি এটাই যথেষ্ট। আমরা আপনাকে এখনি হত্যা করতে পারি, কিন্তু তাতে আপনাকে শাস্তি দেয়ার পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়ে যাবে।

টারজান বলল, একটা কথার উত্তর দাও। আমার ছেলে কি এই জাহাজেই আছে?

পলভিচ বলল, না আপনার ছেলে অন্যত্র নিরাপদেই আছে। আপনি আমাদের দাবি মানতে অস্বীকার করলে আপনাকে হত্যা করা হবে আর আপনাকে হত্যা করা হলেই আপনার ছেলেকেও হত্যা করতে হবে। সুতরাং আমার কথামত চেকটা লিখে দিয়ে আপনার নিজের জীবন ও আপনার ছেলের জীবন রক্ষা করুন।

টারজান বলল, ঠিক আছে। কত টাকা চাও?

পলভিচ বিরাট একটা টাকার পরিমাণ বলল। টারজান তখন চেকে একটা মোটা টাকার অঙ্ক লিখে দিল। কিন্তু অত টাকা তার ব্যাংকে ছিল না।

টারজান চেকটা পলভিচের হাতে দিয়ে বাইরে চোখ মেলে তাকিয়ে দেখল অদূরে জঙ্গলঘেরা তীর দেখা যাচ্ছে। দেখতে দেখতে জাহাজটা উপকূলে গিয়ে ভিড়ল।

জঙ্গলটার দিকে তাকিয়ে পলভিচ বলল, ওইখানে আপনাকে মুক্তি দেয়া হবে।

পলভিচ টারজনের হাত থেকে চেকটা নিয়ে তাকে বলল, নাও, তোমার পোশাকটা খুলে ফেল। কারণ জঙ্গলে পোশাকের কোন দরকার হবে না।

জাহাজ থেকে একটা নৌকায় করে টারজানকে নামিয়ে দেয়া হলো। নাবিকরা টারজানকে কূলে রেখে জাহাজে ফিরে আসার জন্য নৌকাটা ছেড়ে দেবার সময় টারজনের হাতে একটা চিঠি দিয়ে গেল। নৌকাটা চলে গেলে টারজান কুলে দাঁড়িয়ে দেখল জাহাজের ডেকে রোকোফ তার ছেলেটাকে দুহাতে করে মাথার উপর তুলে ধরে টারজানকে দেখাচ্ছে। টারজান তখন বুঝল বিরাট ভুল করেছে সে। ভেবেছিল এ জাহাজে তার ছেলে নেই।

টারজনের পিছনে তখন কতকগুলো ছোট বাঁদর কিচমিচ করছিল। টারজান আপন মনে বলল, থাক, একটা সান্ত্বনা, জেন এখন লন্ডনে আছে। এই সব শয়তানদের কবলে সে এখনো পড়েনি।

পরে সে চিঠিটা খুলে যতই পড়তে লাগল ততই রোকোফদের চক্রান্তের ব্যাপারটা স্পষ্ট হয়ে উঠল তার কাছে। চিঠিটাতে লেখা ছিল, তোমার সম্বন্ধে আমার আসল মতলবটা কি তা এই চিঠিটা পড়ে বুঝতে পারবে। তুমি একদিন জঙ্গলে জন্তু জানোয়ারদের মত নগ্নদেহে বাস করতে। কিন্তু তোমার সন্তান তা করবে না। সে প্রথম থেকে মানুষের সমাজে মানুষের মতই বেড়ে উঠত। কিন্তু তাকে সে সুযোগ দেয়া হবে না। সে নরখাদক এক বর্বর আদিবাসীদের সমাজে পরনে কৌপীন, পায়ে তামার গয়না আর নাকে আংটি পরে তাদের মত বেড়ে উঠবে। আমি তোমাকে হাতে পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই হত্যা করতে পারতাম। কিন্তু তাতে যে শাস্তি তুমি ভোগ করেছ এতদিন আমার হাতে সে শাস্তি দীর্ঘায়িত হত না এতখানি। অথচ এমন একটা জায়গায় তোমাকে নির্বাসন দেয়া হলো যেখান থেকে তুমি তোমার ছেলেকে উদ্ধার করার কোন চেষ্টাই করতে পারবে না। রোকোফের বিরুদ্ধে যাওয়ার এই হলো শান্তি। ইতি-নিকোলাস রোকোফ।

চিঠিটা পড়া শেষ করেই নিজের বাস্তব অবস্থা সম্বন্ধে সচেতন হয়ে উঠল টারজান। সে ঘুরে দেখল। এক দুর্ধর্ষ পুরুষ-গোরিলা তাকে আক্রমণ করতে উদ্যত হয়ে উঠেছে।

টারজান দেখল শুধু একটা নয় প্রায় ডজনখানেক বাঁদর-গোরিলা তার পিছনে রয়েছে। কিন্তু সে বুঝল সব বাদর-গোরিলাগুলো এক সঙ্গে আক্রমণ করে না। তাদের দলের রাজা হিসেবে একটা গোরিলাই তাকে আক্রমণ করবে।

আক্রমণকারী বাঁদর-গোরিলাটা তাকে আক্রমণ করার জন্য এগিয়ে আসতেই টারজান আগের মত সরাসরি তাকে না ধরে সে তার তলপেটে একটা জোর ঘুষি মেরে দিল। গোরিলাটা ঘুরে পড়ে গেল মাটিতে। সে অতি কষ্টে উঠে দাঁড়াতেই টারজান তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। টারজান এবার তার সাদা ঝকঝকে দাঁতগুলো গোরিলাটার লোমশ ঘাড়ের উপর বসিয়ে দিল। গোরিলাটা কামড়াতে এলে টারজান এমন একটা জোর ঘুষি মেরে দিল যে তার মুখটা ভেঙ্গে গেল।

অন্য গোরিলাগুলো টারজানদের চারপাশে দাঁড়িয়ে শ্বাসরুদ্ধ হৃদয়ে তাদের লড়াই দেখতে লাগল। অবশেষে টারজান যখন তাদের রাজার ঘাড়টা মটকে দিল তখন তার শব্দটা শুনতে পেল তারা। তখন তার নিস্পন্দ দেহটার উপর দাঁড়িয়ে উপর দিকে মুখ তুলে চীৎকার করে তার বিজয়-উল্লাস প্রকাশ করল টারজান।

টারজান বুঝল, এরপর গোরিলাদের মধ্য থেকে আর একজন তার কাছে এসে যুদ্ধের আহ্বান জানাবে। হলোও ঠিক তাই। একজন বলিষ্ঠ যুবক গোরিলা টারজনের দিকে এগিয়ে এসে গর্জন করতে থাকলে টারজান বলল, কে তুমি, বাঁদর-দলের রাজা টারজানকে ভয় দেখাচ্ছ?

গোরিলাটা বলল, আমি হচ্ছি আকুৎ। মোনাক মারা গেছে। এখন আমিই হচ্ছি রাজা। এখান থেকে চলে যাও, তা না হলে খুন করব তোমায়।

টারজান বলল, তুমি দেখেছ কত সহজে আমি মোনাককে মেরেছি। আমি যদি রাজা হতে চাইতাম তাহলে আমি তোমাকেও মারতে পারতাম। কিন্তু টারজান আকুৎদের দলের রাজা হতে চায় না। আমি তোমাদের বন্ধু হয়ে শান্তিতে এ দেশে বাস করতে চাই।

আকুৎ বলল, তুমি আকুৎকে মারতে পারবে না। আকুতের সমান শক্তিশালী কেউ নেই।

একথার কোন উত্তর না দিয়ে টারজান আকুতের একটা হাতের কব্জি ধরে হাতটা জোরে ঘুরিয়ে তাকে ফেলে দিল। টারজান তাকে প্রাণে বধ না করে হার মানাতে চাইল শুধু। তাই সে ঘাড়টার উপর চাপ দিয়ে বলল, কা গোদা? অর্থাৎ হার মানছ?

আর একটু চাপ দিলেই আকুতের ঘাড়টা ভেঙ্গে যেত। আকুৎ বলল, কা গোদা অর্থাৎ হার মেনেছি।

টারজান তার ঘাড়টা এবার ছেড়ে দিয়ে বলল, যাও, আমি রাজা হব না, তুমিই হবে রাজা। যদি তোমাকে কেউ বাধা দেয় তাহলে তোমাকে সাহায্য করব।

আকুৎ ধীরে ধীরে উঠে তার দলের কাছে চলে গেল।

এবার টারজান দেখল তার একটা অস্ত্র চাই।

এরপর দিনকতক ধরে অস্ত্র তৈরির কাজে মন দিল টারজান। মরা হরিণের চামড়া দিয়ে তার ধনুকের ছিলা তৈরি করল আর তার কৌপীন তৈরি করতে লাগল। সেই সঙ্গে শুকনো ঘাস দিয়ে একটা লম্বা দড়ি তৈরি করল। সে একটা তৃণ আর বেল্টও তৈরি করল।

একদিন পথে যেতে যেতে টারজান গাছের উপর বসেছিল কিছুক্ষণের জন্য। হঠাৎ সে বাতাসে একদল বাঁদর-গোরিলার গন্ধ পেল। আবার দেখল যে গাছটায় সে বসে আছে সেই গাছেরই নিচের ডালে একটা চিতাবাঘও আছে। কিছুক্ষণের মধ্যে টারজান দেখল বাঁদর-গোরিলাদের দলটা সেই গাছটার কাছে এসে পড়েছে এবং তাদের নেতা আকুৎ সেই গাছের তলায় খুঁড়িতে ঠেস দিয়ে বসে আছে। ঠিক সেই সময় চিতাবাঘটা আকুতের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য উদ্যত হচ্ছে।

কিন্তু চিতাটা সামনের পা দুটো তুলতেই টারজান তার পাথরের ছুরিটা তার গায়ে বসিয়ে দিয়ে তার ঘাড়ে একটা জোর কামড় দিল। আকুৎ উপর দিকে তাকাতেই বুঝতে পারল ব্যাপারটা। এখন চিতাটা আর টারজান দু’জনেই গাছ থেকে মাটিতে পড়ে গেল। টারজান তখন তার পাথরের ছুরিটা বারবার বসাতে লাগল চিতাটার গায়ে। অবশেষে লুটিয়ে পড়ে গেল চিতাটা। তার উপর দাঁড়িয়ে টারজান বিয়জগর্বে একটা বিকট চীৎকার করে উঠল।

টারজান এবার আকুৎকে লক্ষ্য করে বলল, আমি হচ্ছি বাঁদরদলের টারজান। বিরাট শক্তিশালী যোদ্ধা। কিছুদিন আগে আকুতের প্রাণ নিতে নিতে বাঁচিয়ে দিই। আজ চিতার কবল থেকে তাকে রক্ষা করলাম। তোমরা বিপদে পড়লে টারজানকে ডাকবে। আর টারজান যদি কখনো বিপদে পড়ে তোমাদের ডাকে তাহলে তোমরা সবাই ছুটে আসবে। বুঝলে ত?

আকুৎ ও তার দলের সবাই একযোগে বলল, হুঁ।

এরপর তখনকার মত ওদের সঙ্গেই রয়ে গেল টারজান। একযোগে সকলে মিলে শিকারের খোঁজে বেরিয়ে পড়ল।

একদিন পথে যেতে যেতে টারজান দেখল একটা বিরাট গাছ পড়ে গেছে আর তার একটা বড় ডালের। নিচে একটা চিতাবাঘ চাপা পড়ে যন্ত্রণায় চীৎকার করছে।

টারজান ইচ্ছা করলেই চিতাটাকে মেরে ফেলতে পারত তখনি। কিন্তু সে ভাবল সে যখন একটু চেষ্টা করলেই তাকে তার জীবন আর স্বাধীনতা ফিরিয়ে দিতে পারে তখন কেন সে তা করবে না? টারজান কাছে যেতেই মুক্তির আশায় তার পানে সকরুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল চিতাটা। টারজনের চেষ্টায় ডালটা তার দেহের উপর থেকে উঠে যাওয়ায় সে এবার মুক্ত হয়ে উঠে দাঁড়াল।

টারজান ভেবেছিল, চিতাটা মুক্ত হয়েই হয়ত আক্রমণ করবে তাকে দাঁত বার করে। কিন্তু টারজান তার পাশ দিয়ে যখন চলে যাচ্ছিল তখন সে কিন্তু তাকে কামড়াতে এল না। উল্টে তার পিছু পিছু পোষা কুকুরের মত আসতে লাগল।

বিকালের দিকে চিতাটা টারজনের কাছ থেকে একটু সরে গিয়ে একটা ঝোপের মধ্যে বসেছিল শিকারের আশায়। টারজান ছিল একটা গাছের ডালে বসে। গাছের তলায় একটা হরিণকে আসতে দেখেই টারজান তার ঘাসের দড়ির ফাঁসটা হরিণটার গলায় আটকে দিল। তারপর শীতা শীতা’ বলে চিতা বাঘটাকে ডাকতে লাগল। বাঁদর-গোরিলাদের ভাষায় চিতাবাঘকে শীতা বলে।

টারজনের ডাক শোনার সঙ্গে সঙ্গে ঝোপঝাড় ভেঙ্গে হুড়মুড় করে বেরিয়ে এল চিতাটা। ঝাঁপিয়ে পড়ল হরিণটার উপর। হরিণটা মরে গেলে টারজান গাছ থেকে নেমে এসে দু’জনে মিলে তার মাংস খেতে লাগল। এরপর থেকে তাদের দুজনের একজন কোন শিকার পেলেই আর একজনকে তা না দিয়ে খেত না।

একদিন টারজান আর তার সঙ্গী চিতাবাঘটা পথে যেতে যেত আকুতের গোরিলা দলটার কাছে এসে পড়ল। চিতাবাঘটাকে দেখেই আকুত্রা ভয়ে পালিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু টারজান তাদের সাহস দিয়ে ডাকতেই কাছে এল তারা।

একদিন একদিকে চিতাবাঘটা আর একদিকে আকুৎ তার দলবল নিয়ে শিকার করতে গিয়েছিল। টারজান তখন একা একা সমুদ্রের ধারে বেলাভূমির উপর চিৎ হয়ে শুয়েছিল। সে একমনে কি ভাবছিল।

এমন সময় কোথা থেকে একদল নিগ্রো যোদ্ধা টারজনের কাছে এসে পড়ে তাকে লক্ষ্য করতে থাকে। তারা খুব কাছে এসে পড়ায় তাদের পদশব্দ শুনে চমকে উঠে পড়ে সে। নিগ্রো যোদ্ধারাও তাকে আক্রমণ করার জন্য উদ্যত হয়ে ওঠে।

টারজান উঠেই তার হাতের লাঠিটা দিয়ে মাথায় জোর আঘাত করে একজন নিগ্রোকে মেরে ফেলল। তখন অন্যান্য নিগ্রোরা ভয়ে বিহ্বল হয়ে সরে গেল কিছুটা। কিন্তু এরপর ওরা টারজানকে তিন দিক হতে ঘিরে ফেলে তার উপর এক সঙ্গে অনেকগুলো বর্শা ছোঁড়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে উঠল।

টারজান দেখল তার পিছনেই সমুদ্র এবং একমাত্র এই দিকটা দিয়েই পালাতে পারে সে। কিন্তু হঠাৎ তার মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল। সঙ্গে সঙ্গে মুখ দিয়ে জোরে অদ্ভুত একটা শব্দ করে কাদের ডাকতে লাগল।

এমন সময় কোথা থেকে ঝোপঝাড় ভেঙ্গে একদল বাঁদর-গোরিলা আর একটা চিতাবাঘ ছুটে এসেই একযোগে আক্রমণ করল নিগ্রোদের। নিগ্রোদের বর্শার ঘায়ে কয়েকটা বাঁদর-গোরিলা মারা গেল। কিন্তু ক্ষতি হলো নিগ্রোদেরই বেশি।

টারজান অবশেষে দেখল, মাত্র একজন নিগ্রো যোদ্ধা নিরাপদে পালিয়ে গেল সমুদ্রের কূলের দিকে। সেখানে একটা নৌকা ছিল। বাকি সব নিগ্রো যোদ্ধারা মারা গেছে। তাদের মৃতদেহগুলো চিতাটা আর বাঁদর-গোরিলাগুলো ছিঁড়েখুঁড়ে খাচ্ছিল।

টারজনের কি মনে হতে পলাতক নিগ্রো যোদ্ধাটার পিছু পিছু গিয়ে অনুসরণ করতে লাগল তাকে। লোকটা নৌকাটার কাছে যেতেই পিছন থেকে টারজান বলল, আমি তোমাকে মারব না যদি তুমি আমাকে এই দ্বীপটা থেকে অন্যত্র চলে যেতে সাহায্য করো।

মুগাম্বি বলল, হ্যাঁ, সাহায্য করব। কিন্তু তুমি আমার দলের সব লোকদের মেরে ফেলেছ। দাঁড় বাইবার কোন লোক নেই। কি করে নৌকা নিয়ে যাব?

টারজান দেখল, লোকটার স্বাস্থ্যটা খুবই বলিষ্ঠ এবং দৈত্যের মত। তাকে হাতে রাখতে পারলে অনেক কাজ হবে তাকে দিয়ে। সে তাকে বলল, এখন এস আমার সঙ্গে।

মুগাম্বি যখন দেখল টারজান তাকে সেই ভয়ঙ্কর জন্তুগুলোর দিকে নিয়ে যাচ্ছে তখন সে ভয়ে পিছু হটতে লাগল।

কিন্তু টারজান তাদের সকলকে শান্ত করে মুগাম্বির ভয় ভাঙ্গিয়ে দিল।

সেদিন টারজান, মুগাম্বি, শীতা আর আকুৎ এই চারজনে মিলে একটা হরিণ শিকার করল। মুগাম্বি আগুন জ্বেলে তার ভাগের মাংস পুড়িয়ে খেল। কিন্তু টারজান ও আর সকলে কাঁচা মাংস খেল। তারপর মুগাম্বিকে নিয়ে এখান থেকে মূল মহাদেশে যাবার একটা পরিকল্পনা খাড়া করল টারজান।

টারজনের কথায় মুগাম্বির হুঁস হলো। সে বুঝতে পারল, এ জায়গাটা আসলে একটা ছোট দ্বীপ। সারা দ্বীপটাই জঙ্গলে ভরা। তবে মূল মহাদেশটা এই দ্বীপটা থেকে খুব বেশি দূরে নয়।

টারজান ঠিক করে ফেলল মুগাষি আর তার কিছু পশু অনুচরদের সঙ্গে করে নৌকাটা করে মূল মহাদেশে চলে যাবে।

অবশেষে একদিন সে মুগাম্বি, আকুৎ, তারা বারো জন বাঁদর-গোরিলা আর শীতা বা চিতাবাঘটাকে সঙ্গে করে নৌকাটা ভাসিয়ে দিল সমুদ্রে।

এইভাবে ক্রমাগত দশ ঘণ্টা যাওয়ার পর ওরা বনভূমি ঘেরা কুল দেখতে পেল। কিন্তু তখন সন্ধ্যার অন্ধকার অনেকটা ঘন হয়ে ওঠায় ওরা উগাম্বি নদীর মোহানাটা দেখতে পেল না।

নৌকাটা কূলে ভিড়তেই ওরা নেমে পড়ল। আর সঙ্গে সঙ্গে একটা ঢেউ এসে ভাসিয়ে নিয়ে গেল নৌকাটাকে।

টারজান কিন্তু চুপ করে বসে থাকতে পারল না। মুগাম্বিকে সঙ্গে নিয়ে উগাম্বি নদীটা খুঁজতে গেল। কিছুক্ষণের মধ্যেই ওরা একটা বড় নদী দেখতে পেল। সেখান থেকে মাইলখানেক গিয়ে ওরা সেই মোহনাটা দেখতে পেল যেখানে নদীটা সমুদ্রে পড়েছে।

মোহানার কাছে গিয়ে টারজান গতকালের সেই নৌকাটা দেখতে পেল যেটাকে স্রোতে ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। মুগাম্বি বলল, এইটাই আমাদের উগাম্বি নদী। নদীতে তখন ভাটা চলছিল। তবু ওরা নৌকাটাতে উঠে উজান বেয়ে অতি কষ্টে মোহানার উল্টোদিকে এগিয়ে গেল। টারজান ভাবল আগে প্রথমে ওর দলের কাছে গিয়ে দলের সবাইকে নৌকায় উঠাবে। তারপর মুগাম্বিকে নিয়ে ওদের গায়ে গিয়ে রোকোফের খোঁজ করবে। তার ধারণা রোকোফ বেশি দূর জাহাজে করে তার ছেলেকে নিয়ে যাবে না।

যাই হোক, সকলকে নিয়ে নৌকায় গিয়ে উঠল টারজান। দুপুরের দিকে আহার আর বিশ্রামের জন্য বনের ধারে নদীতীরে এক জায়গায় নৌকা থামানো হলো। তখন কিছুটা দূরে গাছের আড়াল থেকে একটা নগ্ন আদিবাসী ওদের দেখেই ছুটে ওদের গায়ে গিয়ে খবর দেয়। বলে, আবার একজন শ্বেতাঙ্গ একটা নৌকায় করে কয়েকজন যোদ্ধা নিয়ে আমাদের গাঁয়ের দিকে আসছে।

ওদের গায়ের নেতার নাম ছিল কাভিরী। এই গাঁয়েই কিছুদিন আগের দাড়িওয়ালা এক শ্বেতাঙ্গ অর্থাৎ রোকোফ এসে খুব খারাপ ব্যবহার করে যায়। তাই আর কোন শ্বেতাঙ্গকে ওদের গায়ে আসতে দিতে চায় না কাভিরী। সে ঢাক বাজিয়ে গায়ের যোদ্ধাদের ডাক দিতে বলল। তারপর বড় ড় বর্শা আর অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে যোদ্ধারা সাতটা ডিঙ্গিতে গিয়ে উঠল। কাভিরী উঠল অন্য একটা ডিঙ্গিতে।

কিছুদূর নদীপথে যাওয়ার পর কাভিরী তার নৌকা থেকে যখন টারজান আর তার পশুসঙ্গীদের দেখল তখন সে ভয় পেয়ে গেল।

দেখতে দেখতে কাভিরীদের নৌকাগুলো চারদিক থেকে ঘিরে ফেলল টারজানদের নৌকাটাকে।

নিগ্রোদের নৌকাগুলো টারজনের নৌকাটার খুব কাছে আসতেই টারজান আকুৎ আর শীতাকে কি বলল। সঙ্গে সঙ্গে তারা নিগ্রোদের দুটো নৌকাতে ঝাঁপিয়ে পড়ল। তারা কয়েকজন নিগ্রো যোদ্ধাকে কামড়ে ঘায়েল করে দিল। কয়েকজন মারা গেল।

টারজান বুঝতে পারল কাভিরীই নিগ্রো যোদ্ধাদের দলনেতা। সে তাই তাকে প্রাণে মারতে চাইল না। সে বেঁচে থাকলে তার থেকে কিছু খবরাখবর পাওয়া যেতে পারে। কাভিরী আহত ও অচেতন হয়ে নৌকার পাটাতনের উপর পড়ে গেলে সে তার হাত পা বেঁধে ফেলল। যে কয়জন নিগ্রো যোদ্ধা বন্দী হয়েছিল তাদেরও হাত পা বেঁধে দিল।

কাভিরীর চেতনা ফিরে এলে সে চোখ মেলে তাকিয়ে দেখল তার পাশে দৈত্যাকার এক নগ্নপ্রায় শ্বেতাঙ্গ আর একটা বিরাট আকারের চিতাবাঘ থাবা গেড়ে বসে আছে। টারজান তাকে বলল, তোমার লোকদের কাছ থেকে জানতে পারলাম তোমার নাম কাভিরী।

কাভিরী বলল, হ্যাঁ।

টারজান বলল, কেন তুমি আমাদের আক্রমণ করতে এলে?

কাভিরী বলল, কিছুদিন আগে অন্য এক শ্বেতাঙ্গ আমাদের গাঁয়ে আসে। আমরা তাকে অনেক উপহার দিয়ে খাতির করলেও সে তার বন্দুক দিয়ে আমাদের কিছু লোককে হত্যা করে আমাদের গায়ের কয়েকজন পুরুষ ও নারীকে ধরে নিয়ে যায়।

টারজান জিজ্ঞাসা কলল, তার সঙ্গে একটা ছেলে ছিল?

কাভিরী বলল, না মালিক। একটা শ্বেতাঙ্গ ছেলে ছিল অন্য দলে।

টারজান আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞাসা করল, অন্য দল! কোন্ দল?

কাভিরী বলল, দুবৃত্ত শ্বেতাঙ্গটা আসার তিনদিন আগে আর একটা দল এসেছিল। সেই দলে ছিল একজন শ্বেতাঙ্গ পুরুষ, একজন শ্বেতাঙ্গ মহিলা, একটা ছেলে আর ছ’জন মুসলমান নাবিক। তারা মনে হয় সেই দুর্বত্ত শ্বেতাঙ্গটার দল থেকে পালিয়ে আসে। তাই দুবৃত্ত শ্বেতাঙ্গটা তাদের খোঁজ করছিল। এই দলটা একটা নৌকা করে এই নদী দিয়ে পালিয়ে যায়।

টারজান বুঝতে পারল পলাতক দলটির মধ্যে যে ছেলেটি ছিল সে-ই জ্যাক, কিন্তু শ্বেতাঙ্গ পুরুষ ও মহিলা কে তা বুঝতে পারল না।

টারজান আর কাভিরীর নৌকা দুটো কাভিরীদের গায়ের কাছে এসে পড়তেই নৌকা থেকে নেমে পড়ল তারা। কাভিরীদের গায়ে এসে টারজান কিছু খাবার খেয়ে কাভিরীর কাছ থেকে তার নৌকা চালিয়ে নিয়ে যাবার জন্য ডজনখানেক লোক চাইল।

কাভিরী বলল, লোক দেব কি বাওনা, আমি ছাড়া গাঁয়ে আর একটি লোকও নেই।

কাভিরী টারজনের সব কথা মেনে নিতে রাজী ছিল, কারণ সে ভাবছিল টারজান তার যত সব ভয়ঙ্কর সঙ্গীদের নিয়ে যত তাড়াতাড়ি তাদের গাঁ থেকে চলে যায় ততই ভাল। কিন্তু টারজনের পশুসঙ্গীদের দেখে গাঁয়ের সবাই জঙ্গলে পালিয়ে গিয়েছিল গা ছেড়ে। যে দু’চারজন কাভিরীর কাছে ছিল তারাও টারজনের কথা শুনে জঙ্গলে পালিয়ে গেল।

টারজান বলল, ঠিক আছে কাভিরী, আমি তোমার পাশে লোকদের সব এনে দিচ্ছি।

এই বলে সে মুগাম্বিকে কাভিরীর কাছে রেখে শীতা আর বাঁদর-গোরিলাদের নিয়ে জঙ্গলে চলে গেল।

কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখা গেল টারজান পালিয়ে যাওয়া লোকদের ভেড়ার পালের মত তাড়িয়ে নিয়ে এল। এবার কাভিরীর সামনে টারজান দাঁড়িয়ে বলল, তোমার সব লোক এসে পড়েছে। এবার তুমি আমার সঙ্গে কারা যাবে তাদের বাছাই করে দাও।

কাভিরী ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে দাঁড়িয়ে তার লোকদের ডাকল। কিন্তু কেউাড়া দিল না তার ডাকে।

টারজান তখন কাভিরীকে বলল, তোমার কথায় কেউ রাজী না হলে ওদের বলে দাও আমি আবার জন্তুদের লেলিয়ে দেব তাদের পিছনে।

এই কথা শুনে গাঁয়ের অনেক লোক কাভিরীর চারপাশে এসে দাঁড়াল। কাভিরী তাদের মধ্যে থেকে বারোজন লোককে বাছাই করে তাদের যেতে বলল টারজনের সঙ্গে। লোকগুলো অনিচ্ছা সত্ত্বেও টারজনের নৌকায় গিয়ে বসল।

একদিন নৌকা থেকে নদীর ধারে নেমে টারজান মুগাম্বি আর আকুৎকে তার পরিকল্পনার কথাটা বুঝিয়ে বলল। বলল, একজন শ্বেতাঙ্গ নৌকায় করে এই পথেই পালাচ্ছে। তাকে ধরতে চায় সে। কিন্তু আদিবাসীরা তাদের দেখে পালাচ্ছে বলে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছে না। তাই সে একাই ওদের গায়ে গিয়ে খোঁজ করতে চায়।

ওদের কূলের উপর রেখে টারজান বলল, দু-একদিনের মধ্যেই তোমাদের কাছে ফিরে আসব আমি।

এই বলে বনের মধ্যে দিয়ে একাই চলে গেল টারজান।

টারজান ভেবে পেল না কিভাবে গঁয়ে গিয়ে যোগাযোগ করবে লোকগুলোর সঙ্গে। অবশেষে সে একটা বুদ্ধি খাটাল। গাছের উপর পাতার আড়াল থেকে চিতাবাঘের মত জোর একটা গর্জন করল সে। তখন গাঁয়ের লোকেরা গেটের কাছে ছুটে এসে গাছটার দিকে তাকাতে লাগল। টারজান তখন গাছ থেকে নেমে আদিবাসীদের ভাষায় বলল, আমাকে তোমাদের গায়ের মধ্যে ঢুকতে দাও। আমি একজন শ্বেতাঙ্গ, তোমাদের বন্ধু। অন্য যে একজন শ্বেতাঙ্গ এখানে এসে তোমাদের অত্যাচার করেছিল তাকে ধরে আমি শাস্তি দিতে চাই।

গাঁয়ের লোকগুলো গেটটা খুলে দিতেই টারজান ভিতরে ঢুকে গাঁয়ের সর্দারকে রোকোফের কথা জিজ্ঞাসা করল। কিন্তু সে যা বলল তার সঙ্গে কাভিরীর কথা মিলল না। গায়ের সর্দার বলল, রোকোফ নামে শ্বেতাঙ্গটা তাদের গায়ে এক মাস ছিল। তবে দ্বিতীয় দলটার কথা দু’জনেরই এক হলো। রোকোফের আগেই একটা দল আসে। সে দলে এক শ্বেতাঙ্গ পুরুষ, এক শ্বেতাঙ্গ মহিলা, এক শিশু আর কয়েকজন মুসলমান মালবাহী কুলী ছিল।

গাঁয়ের সর্দার রাতে শোবার জন্য একটা কুঁড়ে ঘর ছেড়ে দিতে চাইল। কিন্তু টারজান বলল, আমি গাঁয়ের বাইরে ঐ গাছতলাটায় ঘুমাব। তবে আমার দলের লোকরা আগামীকাল নৌকায় করে এখানে এসে পড়বে। দলে কতকগুলো জন্তু থাকলেও তারা তোমাদের কোন ক্ষতি করবে না। সঙ্গে মুগাম্বি নামে। একজন নিগ্রো আদিবাসীও থাকবে।

টারজান কিন্তু ঘুমোল না গাছতলাটায়। সেই রাতেই উগাম্বি নদীর ধারে ধারে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে চলল। পথে দু-একটা আদিবাসী বস্তি দেখতে পেল। তাদের কাছ থেকে জানতে পারল রোকোফ এই পথেই গেছে।

দুদিন এইভাবে যাওয়ার পর উগাম্বি নদীর ধারে একটা বড় গায়ে এসে উঠল টারজান। কিন্তু সে গাঁয়ের সর্দারকে দেখে নরখাদক বলে মনে হলো তার। লোকটাকে দেখে ভাল না লাগলেও অতিশয় ক্লান্ত ও ক্ষুধার্ত হয়ে পড়ায় কিছু আহার ও বিশ্রামের জন্য কয়েক ঘণ্টা কাটাতে চাইল সে সেখানে। তবে সে বুঝল সর্দারটা মুখে তাকে খাতির করলেও ভিতরে ঘৃণা অনুভব করছে তার প্রতি।

টারজান অল্পক্ষণের মধ্যেই একটা কুঁড়ে ঘরের পাশের ছায়ায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। সর্দার টারজনের এই উপস্থিতির ব্যাপারটা একেবারে গোপন রাখল গাঁয়ের লোকদের কাছে। তারপর সে গোপনে। জনকতক লোককে রোকোফকে খবর দেবার জন্য নদীর ধার দিয়ে পূর্ব দিকে পাঠিয়ে দিল।

ঘণ্টা তিনেকের মধ্যেই কতকগুলো ডিঙ্গি এগিয়ে আসতে লাগল গাঁয়ের ঘাটের দিকে। একটা নৌকাতে ছিল রোকোফ আর তার পাঁচজন শ্বেতাঙ্গ সহচর।

রোকোফ নৌকা থেকে নেমেই সর্দারকে জিজ্ঞাসা করল, তোমার লোকরা যার কথা বলল, সেই শ্বেতাঙ্গ কোথায়?

সর্দার বলল, আমাদের গায়েতেই আছে, ঘুমোচ্ছে। সে তোমার বন্ধু না শত্রু জানি না। তবে সে তোমার খোঁজ করছিল।

সর্দারের পিছু পিছু রোকোফ আর তার দলের লোকেরা পা টিপে টিপে টারজান যেখানে ঘুমোচ্ছিল সেখানে গিয়ে হাজির হলো। সর্দার গিয়ে দেখল টারজান তখনো ঘুমোচ্ছে। রোকোফ দেখেই চিনতে পারল টারজানকে। এক কুৎসিত শয়তানি হাসি ফুটে উঠল তার মুখে। সর্দার যখন বুঝতে পারল ঘুমন্ত টারজান রোকোফের শত্রু তখন সে তার লোকদের টারজান জেগে ওঠার আগেই তার হাত পা বেঁধে ফেলার হুকুম দিল। টারজানকে রোকোফ বলল, শুয়োর কোথাকার! রোকোফের পথ থেকে দূরে সরে। দাঁড়াবার মত সুবুদ্ধি এখনো আসেনি তোমার মাথার মধ্যে?

এই কথা বলে টারজনের মুখে একটা লাথি মারল রোকোফ।

টারজান বলল, তোমাকে অভ্যর্থনা করার জন্যই সে বুদ্ধি আমার মাথায় আসেনি।

রোকোফ বলল, ঠিক আছে আজ রাতে আমার নরখাদক ইথিওপ বন্ধুরা তোমাকে খেয়ে ফেলার আগেই তোমার স্ত্রী ও ছেলের কি অবস্থা হয়েছে এবং ভবিষ্যতে কি হবে বলবে তাকে।

যে গাঁটায় হাত পা বাঁধা অবস্থায় বন্দী ছিল টারজান সেই গাঁয়ের দিকে অন্ধকার বনভূমি নিঃশব্দ পদক্ষেপে পার হয়ে একটি চিতাবাঘ তার জ্বলন্ত চোখ দুটো নিয়ে এগিয়ে আসতে লাগল। গন্ধ এঁকে এঁকে সে একটা কুড়ে ঘরের বাইরে এসে হাজির হলো। তারপর ঘরটার চালের উপর উঠে খড়পাতার ছাউনি। সরিয়ে কিছুটা ফাঁকা করে ঘরের মধ্যে লাফিয়ে পড়ল।

টারজানও এতক্ষণ একটা পরিচিত গন্ধ পেয়ে সচকিত হয়ে ওঠে। মেঝের উপর লাফিয়ে পড়ার পর টারজনের গা-টা শুঁকতে লাগল শীতা।

এমন সময় একজন নিগ্রো যোদ্ধা বাইরে উৎসবের জায়গাটা থেকে টারজানকে সেখানে তুলে নিয়ে যাবার জন্য ঘরে এসে ঢুকল। বাইরে তখন উৎসবের জন্য এক বিরাট প্রস্তুতি চলছিল গ্রামবাসীদের।

অন্ধকারে সে চিতাবাঘটাকে দেখতে পায়নি। সে বর্শা দিয়ে টারজনের গায়ে একটা আঘাত করতেই টারজান চীৎকার করে উঠল আর সঙ্গে সঙ্গে চিতাটা আদিবাসীদের বুকের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তার গলাটা কামড়ে ধরল। লোকটা রক্তাক্ত দেহে লুটিয়ে পড়ল মেঝের উপর। চিতাটার গর্জনের সঙ্গে সঙ্গে আহত লোকটার আর্তনাদ শুনতে পেয়ে উৎসব ছেড়ে বাইরের লোকরা ছুটে আসতে লাগল।

প্রথমে রোকোফের দলের দু’জন শ্বেতাঙ্গ একটা টর্চ নিয়ে ঘরের ভিতরটা দেখতে লাগল। আদি বাসীরা ঘরের ভিতরে তাদের একজনকে রক্তাক্ত ও ছিন্ন-ভিন্ন দেহে মরে পড়ে থাকতে দেখে দারুণ ভয় পেয়ে গেল। তারা ভয়ে ঘরের ভিতর কেউ ঢুকল না। এদিকে ঘরের দরজার সামনে অনেক লোক দেখে চিতাটা গর্জন করতে করতে লাফ দিয়ে চালের উপর উঠে সেই ফাঁকটা দিয়ে বেরিয়ে গেল বাইরে।

রোকোফ তখন সর্দারকে বলল, এস, ওকে এবার বাইরে নিয়ে গিয়ে আমাদের কাজ শেষ করে ফেলি। তা না হলে আবার কোন বিপদ ঘটতে পারে।

চারজন নিগ্রো যুবক টারজানকে তুলে নিয়ে গিয়ে সেই নাচের জায়গাটায় একটা খুঁটির সঙ্গে বেঁধে দিল দাঁড় করিয়ে। রোকোফ এবার একজন আদিবাসীর হাত থেকে একটা বর্শা নিয়ে টারজনের দেহে আঘাত করতে গেল। কিন্তু সর্দার তার হাত থেকে বর্শাটা কেড়ে নিয়ে বলল, আমাদের প্রথামত নাচ না হওয়া পর্যন্ত কিছু করা চলবে না। তাছাড়া বন্দীকে আমরা মারব। আমাদের বিধিমত না চললে তোমারও ঐ অবস্থা করব।

রোকোফ সরে গেল। সে টারজানকে বলল, ঠিক আছে, নাচ হয়ে গেলে আমি নিজে তোমার হৃৎপিণ্ডটা খাব।

এবার নরখাদক আদিবাসীদের নাচ শুরু হলো। নাচ শেষ হয়ে এলে ওদের সর্দার প্রথমে তার বর্শার ফলা দিয়ে একটা খোঁচা দিল টারজনের গায়ে। সেই সময় জঙ্গলের ভিতর থেকে কার একটা চীঙ্কার শুনে টারজানও সাড়া দিল সেইভাবে।

আদিবাসীরা ভয়ে ভয়ে তাকাতে লাগল চারদিকে।

কিনসেড জাহাজ থেকে টারজানকে যখন নামিয়ে নৌকায় করে জঙ্গলাকীর্ণ সেই দ্বীপটায় নিয়ে যাওয়া হয় তখন একটা কেবিনের জানালা দিয়ে তা দেখতে পায় ক্লেটন। কিন্তু জায়গাটার নাম কি, কোথায় নিয়ে যাওয়া হয় তা সে জানতে পারল না কোনক্রমেই। একমাত্র সেভেন এ্যান্ডারসন নামে একজন সুইডেনবাসী রাঁধুনি ছাড়া আর কাউকে দেখতে পেল না। এ্যান্ডারসন রোজ দু’বার করে খাবার দিয়ে যেত জেনের কেবিনে। তাকে জেন কোন কথা জিজ্ঞাসা করলে সে শুধু ইংরেজিতে একটা কথাই বলত, আমার মনে হয় এরা শিগগির একটা অঘটন ঘটাবে।

টারজানকে সেই দ্বীপটায় নামিয়ে দেবার তিন দিন পর কিনসেড জাহাজটা সমুদ্র থেকে উগাম্বি নদীর মুখে গিয়ে পড়ল।

সেইদিনই সেখানে জাহাজটাকে থামিয়ে রোকোফ জেনের কেবিনে এসে বলল, আমরা আমাদের গন্তব্যস্থলে এসে পড়েছি। এবার তোমাকে সহজেই মুক্তি আর নিরাপত্তা দুইই দেব। আর আমি তোমাকে ভালবাসি জেন। তুমি শুধু একবার হ্যাঁ বললেই তোমার ছেলেকে ফিরিয়ে দেব।

এবার জেন রোকোফকে বলল, আমি আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছি তোমার কথা শুনে। এতদিন তোমাকে একজন কাপুরুষ আর শয়তান বলে ভাবতাম, কিন্তু এখন দেখছি তুমি নির্বোধ।

রোকোফের চোখ দুটো ছোট হয়ে গেল। রাগে আর লজ্জায় লাল হয়ে উঠল তার মুখখানা। সে জেনের দিকে কিছুটা এগিয়ে ভীতি প্রদর্শনের সুরে বলল, শেষে দেখা যাবে কে বোকা। তোমার সামনে যখন তোমার ছেলের বুকের ভিতর থেকে হৃৎপিণ্ডটা উপরে নেয়া হবে তখন বুঝবে নিকোলাস রোকোফকে অপমান করার অর্থ কি।

জেন বলল, তুমি ভয় দেখিয়ে আমাকে বশীভূত করতে পারবে না।

জেনের অনমনীয় মনোভাব দেখে আরো রেগে গেল রোকোফ।

কিন্তু রোকোফ দমে গেল না। উত্তেজনায় কাঁপছিল সে। জেনের দিকে সে ভয়ঙ্করভাবে এগিয়ে গিয়ে তার দু’হাত দিয়ে গলাটা টিপে ধরল।

এমন সময় কেবিনের দরজাটা ঠেলে এ্যান্ডারসন জেনের খাবার নিয়ে ভিতরে ঢুকলো। রোকোফ তাকে দেখেই বাধা পেয়ে চীৎকার করে উঠল, বিনা অনুমতিতে কেন তুমি ঘরে ঢুকলে? এখনি বেরিয়ে যাও, তা না হলে তোমাকে জলে ফেলে দেব।

এই কথা বলে রোকোফ ভয়ঙ্করভাবে এগিয়ে যেতেই এ্যান্ডারসন তার পোশাকের ভিতর লুকিয়ে রাখা ছুরিটা তার একটা হাত দিয়ে ধরতে গেল।

রোকোফ তা দেখে জেনের দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, ঠিক আছে, আমি তোমাকে আগামীকাল পর্যন্ত সময় দিলাম ভেবে দেখার জন্য। পলভিচ আর আমি ছাড়া এ জাহাজে ইতোমধ্যে কেউ থাকবে না। সকলকেই কূলে পাঠিয়ে দেয়া হবে। আমার ছাড়া এ জাহাজে থাকবে তুমি আর তোমার ছেলে।

রোকোফ কথাগুলো বলল ফরাসী ভাষায়। ভাবল এ্যান্ডারসন তা বুঝতে পারবে না। কথাটা বলেই কেবিন থেকে বেরিয়ে গেল রোকোফ। এ্যান্ডারসন তখন জেনকে বলল, ও ভাবে আমি বোকা। কিন্তু আসলে ও-ই বোকা।

জেন আশ্চর্য হয়ে বলল, তুমি ওর কথা বুঝতে পেরেছ?

এ্যান্ডারসন বলল, হ্যাঁ। আমি বাইরে থেকেও ওর সব কথা শুনেছি। আপনি আমাকে বিশ্বাস করতে পারেন। ও আমাকেও কুকুরের মত জ্ঞান করে। আমি আপনাকে সাহায্য করব।

কথাটা ঠিক বিশ্বাস করতে না পারলেও লোকটার প্রতি কৃতজ্ঞতাবোধ জাগল জেনের। এত সব শত্রুদের মাঝে অন্তত সহানুভূতিশীল একটা বন্ধুকে এতদিনে খুঁজে পেল সে।

সেদিন আর রোকোফের দেখা পেল না জেন। সন্ধ্যের সময় সেভেন এ্যান্ডারসন খাবার দিতে এল। তার উদ্ধারের ব্যাপারে জেন তার সঙ্গে কিছু কথা বলতে চাইলে সেভেন জেনকে বলল, আপনি আপনার জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখবেন, আমি এলেই বেরিয়ে পড়বেন।

জেন বলল, কিন্তু আমার ছেলে? তাকে ছাড়া আমি ত যেতে পারব না।

সেভেন বলল, আমি আপনাকে সাহায্য করছি। এর বেশি কিছু জানতে চাইবেন না।

কিছুক্ষণের মধ্যে দরজা ঠেলে সেভেন এসে হাজির হলো। তার হাতে একটা পুঁটলি আর এক হাতে কাপড় ঢাকা কি একটা জিনিস। সেভেন সেটা জেনের হাতে দিয়ে বলল, এই নিন আপনার ছেলে। কোন শব্দ করবেন না।

কাপড় ঢাকা ছেলেটাকে বুকে চেপে ধরল জেন। আনন্দে দু’ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল তার চোখ থেকে। আর দেরী না করে কেবিন থেকে বেরিয়ে মই বেয়ে জাহাজ থেকে নেমে নৌকাতে উঠে পড়ল। নৌকাতে উঠেই নৌকা ছেড়ে দিল সেভেন। নৌকাটা তীরবেগে ছুটে চলল উগাম্বি নদীর উপর দিয়ে।

রাত তিনটের সময় নদীর ধারে একটুখানি ফাঁকা জায়গায় কতকগুলো কুঁড়ে ঘরের একটা আদিবাসী বস্তি দেখে সেইখানে নৌকা ভেড়াল এ্যান্ডারসন। জেনকে নৌকা থেকে নামিয়ে নৌকাটা একটা গাছের সঙ্গে বেঁধে রাখল। তারপর দুজনে ঘরগুলোর দিকে এগিয়ে এল।

এ্যান্ডারসন বারকতক ডাকাডাকি করতেই সর্দার আর তার স্ত্রী ঘর থেকে বেরিয়ে এসে গাঁয়ের গেট খুলে দিল। এ্যান্ডারসন আবিদাসীদের ভাষায় সর্দারের সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলল। সর্দারের স্ত্রী তাদের থাকার জন্য একটা ঘর দিতে চাইল। কিন্তু ঘরটা নোংরা হবে ভেবে সে বলল, তারা বাইরেই শোবে।

সকালে ঘুম ভাঙ্গলে জেন দেখল তখন বেশ বেলা হয়ে গেছে। আদিবাসী মেয়েরা ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে তার চারদিকে।

সর্দারের নির্দেশে আদিবাসীরা সবাই সরে গেল জেনের কাছ থেকে। এ্যান্ডারসন কিছুটা দূরে কথা বলতে লাগল সর্দারের সঙ্গে। জেন বুঝল এ্যান্ডারসনকে এর আগে যতখানি অযোগ্য ভেবেছিল ততখানি অযোগ্য সে নয়। গত চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে সে তার যোগ্যতা আর বিচক্ষণতার যথেষ্ট পরিচয় দিয়েছে। জেন দেখল ইংরেজি, ফরাসী আর পশ্চিম উপকূলের আদিবাসীদের ভাষায় ভালভাবেই কথা বলতে পারে এ্যান্ডারসন।

এমন সময় জেনের কোলে ছেলেটা কেঁদে উঠতেই কাপড়টা সরিয়ে তার মুখটা দেখল জেন। কিন্তু দেখার সঙ্গে সঙ্গে ভূত দেখার মত চমকে উঠল ভয়ে। তারপরই সেখানে মূৰ্ছিত হয়ে পড়ে গেল।

নিগ্রো যোদ্ধারা তখন সবাই ঘরটার পানে তাকিয়ে দেখল একটা চিতাবাঘ গর্জন করতে করতে এই দিকে আসছে। তার উপর টারজনের গলার স্বর শুনে একদল বাঁদর-গোরিলা জঙ্গল থেকে বেরিয়ে গায়ের দিকে আসছে। গাঁয়ের সর্দারই প্রথমে গোরিলাদের নেতা আকুৎকে দেখতে পাবার সঙ্গে সঙ্গে সে নিজে জঙ্গলের দিকে ভয়ে ছুটে পালাতে থাকে। তার দেখাদেখি গাঁয়ের অন্য সব লোকেরাও প্রাণভয়ে ছুটতে থাকে।

আকুৎ তার দলের গোরিলাদের নিয়ে টারজনের পাশে ছুটে এসে দাঁড়াল। তখন শীতাও এসে পড়েছে। টারজান তখন তার দুই পায়ের বাঁধনগুলো থেকে মুক্ত হতে চাইছিল। কিন্তু ওর কথা বাদর গোরিলারা বা শীতা বুঝতে পারছিল না কেউ।

সারাটা রাত এমনিভাবে কেটে গেল। টারজান হাত পা বাঁধা অবস্থায় দাঁড়িয়ে রইল সেইখানে। গাঁ থেকে সব লোক পালিয়ে জঙ্গলে চলে গিয়েছিল। সকাল হতেই তারা আবার গাঁয়ে আসার চেষ্টা করতে লাগল।

এমন সময় হঠাৎ কোথা থেকে ছুটতে ছুটতে মুগাম্বি এসে হাজির হলো। মুগাম্বি এসেই ছুরি দিয়ে টারজনের সব বাঁধন কেটে দিল। টারজান তখন মুগাম্বিকে সঙ্গে নিয়ে একটা মৃত আদিবাসীর বর্শাটা নিয়ে আদিবাসীদের তেড়ে গেল। আদিবাসীরা আগের থেকে আরো বেশি ভয় পেয়ে গেল। কয়েকজন আদিবাসী বন্দী হলো টারজনের হাতে।

তাদের কাছে টারজান জানতে পারল রোকোফ আগের দিন রাত্রিবেলাতেই তার শ্বেতাঙ্গ সহচরদের নিয়ে নৌকায় করে পালিয়ে গেছে।

টারজান আর বৃথা লড়াই করল না। সে তার দলের সবাইকে নিয়ে নৌকায় করে রোকোফের খোঁজে চলে গেল।

এবারেও টারজান দেখল কোন গাঁয়ে গেলে পশু-সঙ্গীদের ভয়ে কোন আদিবাসী কথা বলছে না তার সঙ্গে। সে তাই এক জায়গায় তার দলের সবাইকে মুগাম্বির হাতে ছেড়ে রেখে একাই বেরিয়ে পড়ল রোকোফের খোঁজে।

একদিন বন পথে যেতে যেতে একটা দৃশ্য দেখে হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল টারজান। একটা ঝোপের মধ্যে একজন অসুস্থ ও রুগ্ন শ্বেতাঙ্গ শুয়েছিল আর একজন নিগ্রো যোদ্ধা তাকে হত্যা করার চেষ্টা করছিল।

টারজান নিগ্রোটার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। তার হাতের বর্শাটা কেড়ে নিল। নিগ্রোটা আত্মসমর্পণ না করায় টারজান তাকে মেরে ফেলল। তারপর দেখল এই শ্বেতাঙ্গটাই রোকোফের কিনসেড জাহাজে রাঁধুনীর কাজ করত। টারজান তাই ভাবল এও নিশ্চয় রোকোফের সঙ্গে ষড়যন্ত্রে যুক্ত ছিল এবং সব খবর জানে। লোকটার নাম সেভেন এ্যান্ডারসন।

টারজান তাকে সরাসরি জিজ্ঞাসা করল, আমার স্ত্রী আর ছেলে কোথায়?

সেভেন কাশছিল। তার বুকে তীরটা তখনো বিধে ছিল। তার বুক থেকে রক্ত ঝরছিল। কাশিটা থামলে সেভেন বলল, আমি তোমার স্ত্রী আর ছেলেকে রোকোফের হাত থেকে উদ্ধার করার জন্য পালিয়ে যাচ্ছিলাম। কিন্তু রোকোফ এসে আমাদের ধরে ফেলে। আমাকে এইখানে ফেলে রেখে তারা চলে যায়। তোমার স্ত্রী ও ছেলে আবার ধরা পড়েছে তার হাতে। তুমি তার খোঁজে চলে যাও।

একটু আগে রাগের মাথায় তাকে হত্যা করতে যাচ্ছিল টারজান। কিন্তু এখন এবার সব কথা শুনে নিজের ভুল বুঝতে পেরে তার কাছে ক্ষমা চাইল। কিন্তু সেভেন একবার জোর কেশে তখনি মারা গেল।

সেদিন সন্ধ্যা হতেই প্রবল বৃষ্টি শুরু হলো। সাত দিন ধরে বৃষ্টি সমানে চলতে লাগল।

সাত দিনের দিন মেঘ কেটে গিয়ে সূর্য উঠল আকাশে। কিন্তু টারজান কোন দিকে রোকোফের খোঁজে যাবে তা ঠিক করতে পারল না।

অনেক ভাবার পর অবশেষে উত্তর-পূর্ব দিকে এগিয়ে যেতে লাগল। পরের দিন সে একটা আদিবাসী গাঁয়ে গিয়ে পৌঁছল। কিন্তু তাকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে গাঁয়ের লোকেরা ছুটে পালাত লাগল। কিন্তু টারজানও ছাড়ল না। সে তাড়া করে একজন যুবককে ধরে ফেলল। যুবকটা তাকে দেখে এতখানি ভয় পেয়ে গেল যে সে তার হাত থেকে সব অস্ত্র ফেলে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল টারজনের পায়ের কাছে।

টারজনের অনেক প্রশ্নের উত্তরে নিগ্রো যুবকটি যা যা বলল তার থেকে বুঝতে পারল টারজান। দিনকতক আগে কয়েকজন শ্বেতাঙ্গ এসেছিল। তারা বলে গেছে এক ভয়ঙ্কর শ্বেতাঙ্গ শয়তান পরে তাদের গাঁয়ে আসবে। তার সঙ্গে থাকবে একদল হিংস্র জন্তু।

কিন্তু টারজনের সঙ্গে কোন হিংস্র জন্তু জানোয়ার না দেখে সাহস হলো যুবকটির।

টারজান যুবকটিকে সঙ্গে করে তাদের গায়ে চলে গেল।

ওদের সর্দারকে ডেকে আনাল। সে দেখল সর্দার লোকটা বেঁটে এবং বলিষ্ঠ চেহারার। তার মুখটা কুটিল প্রকৃতির। টারজান বুঝল এরাও নরখাদক। টারজনের প্রশ্নের উত্তরে সর্দার যা বলল তার থেকে। বোঝা গেল একজন শ্বেতাঙ্গ দিনকতক আগে তাদের গায়ে এসেছিল বটে, কিন্তু তাদের সঙ্গে কোন নারী বা শিশু ছিল না। এতে টারজনের সন্দেহ হলো সর্দার ঠিক বুলছে না। তবু টারজান সে রাতটা তাদের গাঁয়েই কাটাবার কথা বলল।

সর্দার এ কথায় উৎসাহিত হয়ে তার একটা ঘর ছেড়ে দিল। কিন্তু সে ঘরে আর এক বুড়ি স্ত্রী ছিল। বুড়িকে রাত্রিতে ঘর থেকে বার করে দিলে ঠাণ্ডায় কষ্ট হবে তার একথা ভেবে টারজান সেই ঘরে রইল না। সে অন্য ঘরে থাকার জন্য জেদ ধরলে তাকে অন্য একটা ঘর দেওয়া হলো।

সন্ধ্যার পর যখন ওদের নাচ শুরু হলো এবং গাঁয়ের সবাই যখন উৎসবে মেতে ছিল তখন টারজান সেই কুঁড়ে ঘরটার মধ্যে একা বসে ভাবছিল। এমন সময় একটা বুড়ি চুপি চুপি সেই অন্ধকার ঘরটায় ঢুকে টারজানকে চুপি চুপি বলল, আমার নাম তমুদজা। আমি সর্দার মগনওয়াসামের প্রথমা স্ত্রী। আমার কথা শোন। ওরা তোমাকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করেছে। তুমি ঘুমিয়ে পড়লেই ওরা তোমাকে হত্যা করবে।

মূৰ্ছিত জেন চেতনা ফিরে পেয়ে দেখল, ছেলেটাকে কোলে করে বিহ্বল হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে এ্যান্ডারসন। তার মুখখানা বিষাদে ভরা।

জেন বলল, আমার ছেলে কোথায়? এ ছেলে আমার নয়। তুমি তা জানতে। তুমিও রোকোফের মতই শয়তান।

এ্যান্ডারসন আশ্চর্য হয়ে বলল, তা ত জানি না। তাহলে নিশ্চয় দুটো ছেলে ছিল। কিন্তু আমি তার কিছুই জানতাম না।

তার কথা শুনে জেন বুঝতে পারল আসলে এ্যান্ডারসনের সততায় কোন সংশয় নেই। সে ঠিকই বলেছে।

এমন সময় এ্যান্ডারসনের কোলের মধ্যে শিশুটা কেঁদে উঠল। হাত বাড়িয়ে এ্যান্ডারসনের কাছ থেকে সেই অসহায় শিশুটাকে নিজের কোলে তুলে নিল জেন। হতাশার সঙ্গে সঙ্গে তার মনে একটা আশা জাগল, হয়ত বা শেষ মুহূর্তে তার ছেলে জ্যাককে কেউ উদ্ধার করেছে রোকোফের হাত থেকে।

এ্যান্ডারসন বলল, এখন তাহলে কি করব আমরা? আমি কিনসেড জাহাজে ফিরে গেলে রোকোফ আমাকে গুলি করে মারবে। কিন্তু আপনি সেখানে ফিরে যেতে পারেন।

জেন বলল, না আমি মৃত্যুবরণ করব, তবু তার কাছে আর ফিরে যাব না। তার থেকে এই অসহায় শিশুটাকে নিয়ে চল আমাদের সঙ্গে।

আবার তারা এগিয়ে যেতে লাগল।

পথে দু-একজন পথচারীর কাছ থেকে ওরা জানেত পারল একজন লোক তাদের সন্ধানে তাদের পিছনে পিছনে আসছে। তবে এখনো দূরে আছে।

যেতে যেতে এ্যান্ডারসন জেনকে বলল, মাইলখানেকের মধ্যেই একটা গাঁ আছে। আপনি সেখানে ছেলেটাকে নিয়ে চলে যান। গাঁয়ের সর্দারকে আপনি সব কথা বলবেন। সে আপনাকে জাহাজের ব্যবস্থা, করে দেবে যাতে আপনি সভ্য জগতে চলে যেতে পারেন। আমি এইখানে থাকব। রোকোফকে বলল, আপনি মারা গেছেন। তাহলে ও আর আপনার খোঁজ করবে না। বিদায়, আপনি চলে যান। আমার এই রাইফেলটা আর গুলিগুলো নিয়ে যান।

এই বলে রোকোফের হাতে ধরা দেবার জন্য সেখান থেকে চলে গেল সেভেন এ্যান্ডারসন।

আধ ঘণ্টা পরে গাঁটায় পৌঁছল জেন। তাকে দেখে ঘিরে ধরল গাঁয়ের মেয়েরা। ছেলেটা হঠাৎ দারুণ অসুস্থ হওয়ায় সে কথা তাদের কোনরকমে বোঝাল জেন। কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না। মাঝরাতের দিকে জেনের কোলের মধ্যেই মারা গেল শিশুটা।

এমন সময় গায়ের সর্দার মগনওয়াজাম এসে জেনকে নানা কথা জিজ্ঞাসা করতে লাগল। লোকটাকে দেখে কুটিল প্রকৃতির বলে মনে হলো জেনের।

জেন শুনতে পেল গায়ের গেটের কাছে কারা যেন এসেছে বাইরে থেকে। কথাবার্তার শব্দ আসছিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই জেনের কাছে এসে তার নাম ধরে কে ডাকল।

মুখ তুলে আগুনের আলোয় দেখল জেন, তার সামনে রোকোফ দাঁড়িয়ে আছে।

রোকোফ এসেই বলল, ছেলেটাকে এখানে আনার জন্য এত কষ্ট করে এখানে এলে কেন? তার থেকে আমাকে বললেই ত হত। এখন দাও ওকে আমার হাতে।

জেন নীরবে তার হাত থেকে ছেলেটাকে তুলে দিল রোকোফের হাতে। বলল, ও তোমাদের সব পীড়নের বাইরে চলে গেছে।

ছেলেটার মুখ থেকে কাপড় সরিয়ে রোকোফ দেখল, সত্যি সত্যিই ছেলেটা মারা গেছে।

সঙ্গে সঙ্গে এক প্রচণ্ড রাগে জ্বলে উঠল রোকোফ।

তার রাগ দেখে জেন বুঝল এটা যে তার ছেলে নয় রোকোফ তা জানে না। না জানাটাই ভাল, তাহলে তার ছেলে যেখানেই থাক নিরাপদে থাকতে পারবে।

রোকোফ বলল, আমার কাছ থেকে ছেলেটাকে ছিনিয়ে নিয়েছ। তা নাও, এবার তোমার পালা। তোমাকে নরখাদক মগনওয়াজামের হাতে তুলে দেব। তুমি হবে নরখাদকের স্ত্রী।

তারপর রোকোফ জেনকে সঙ্গে করে একজন আদিবাসীকে নিয়ে গা পার হয়ে তার শিবিরের পথে যেতে লাগল।

শিবিরে গিয়ে জেন দেখল সেখানে কিসের গোলমাল চলছে। রোকোফ গিয়ে শুনল, তার দলের আরো কিছু লোক তার অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে পালিয়ে গেছে শিবির থেকে। কথাটা শুনে রাগে চেঁচামিচি করতে লাগল রোকোফ। পরে জেনের হাত ধরে টানতে টানতে তার ঘরের মধ্যে নিয়ে গেল রোকোফ। জেন বাধা দিলে তার মুখে একটা ঘুষি মারল রোকোফ।

হঠাৎ এই সময় ঘরের বাইরে কিসের গোলমাল হতে রোকোফ জেনের উপর থেকে তার দৃষ্টি সরিয়ে বাইরে সেই দৃষ্টি ছড়িয়ে দিল। সেই অবসরে জেন চোখের পলকে রোকোফের বন্দুকটা টান মেরে হাতে নিয়ে তার বাঁট দিয়ে রোকোফের মাথায় সমস্ত শক্তি দিয়ে তাকে আঘাত করল। সঙ্গে সঙ্গে জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গেল রোকোফ। জেন তখন রোকোফের কোমর থেকে লম্বা ছুরিটা দিয়ে তাই নিয়ে তাঁবুর পিছনের খানিকটা কেটে তার পালাবার পথ করে নিল।

এদিকে বুড়ি তম্বুদজা টারজানকে সঙ্গে করে রোকোফের তাঁবুর দিকে এগিয়ে যেতে লাগল। রোকোফের তাঁবুতে গিয়ে দেখল সেখানে খুব গোলমাল চলছে।

সেই দিন সকালে জেন চলে যাওয়ার পর রোকোফের জ্ঞান ফিরে এলে সে দেখে সে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে ছিল এতক্ষণ এবং জেন পালিয়ে গেছে শিবির থেকে। এমন সময় মগনওয়াজামের গাঁ থেকে দূত মারফৎ খবর আসে টারজান ঐ গাঁয়ে আটক ছিল এবং আজ রাতেই তাকে হত্যা করা হত, কিন্তু সে পালিয়ে যায় এবং হয়তো এই শিবিরেই সে আসবে রোকোফের সন্ধানে।

এই খবরটা পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রোকোফের নিগ্রো ভৃত্যরা সব টারজনের আসার খবর পেয়েই শিবির থেকে অনেক জিনিসপত্র নিয়ে পালিয়ে গেল। শিবিরে রয়ে গেল শুধু রোকোফ আর তার সাতজন শ্বেতাঙ্গ নাকিব।

এই সব অবাঞ্ছিত ঘটনার জন্য রোকোফ কিন্তু তার শ্বেতাঙ্গ নাবিকদের দায়ী করতে লাগল। এতে নাবিকরা বিদ্রোহী হয়ে ওঠায় রোকোফ শিবির ছেড়ে পালিয়ে যাবে ঠিক করে ফেলল। শিবির থেকে পালিয়ে যাওয়ার সময় সে দেখতে পায় শিবিরের সামনে দিয়ে টারজান তারই খোঁজে আসছে। তাতে তার ভয় আরো বেড়ে যায়।

এদিকে বুড়ি তদজার সঙ্গে শিবিরে এসে টারজান দেখল রোকোফ বা জেন কেউই সেই শিবিরে নেই। নাবিকদের কাছ থেকে জানতে পারল, বন্দিনী মহিলাটি আগেই পালিয়ে যায়। রোকোফ পালায় তার পরে।

টারজান তখন যে পথে তারা পালিয়েছে সেই পথ ধরে বেরিয়ে পড়ল তাদের খোঁজে।

টারজান জঙ্গলের মধ্য দিয়ে যে পথে যাচ্ছিল সেই পথেই তার সামনে অনেক দূরে জেন তখন একা উগাম্বি নদীর ঘাটের দিকে এগিয়ে চলছিল।

নদীর ঘাটে গিয়ে জেন দেখল একটা নৌকা কাছেই একটা গাছের সঙ্গে বাঁধা রয়েছে। দড়িটা খুলে নৌকাতে উঠতে গিয়ে হঠাৎ তার চোখে পড়ল রোকোফ নদীর পাড়ে এসে পড়েছে এবং সে তাকে থামতে বলছে এবং ভয় দেখাচ্ছে না থামলে তাকে গুলি করে মারবে। অথচ জেন দেখল সে একা এবং তার কাছে কোন অস্ত্র নেই।

নৌকাটা নদীর স্রোতের টানে ছুটে যেতে শুরু করতেই জেন দেখতে পেল রোকোফ কোথা থেকে একটা ছোট ডিঙি নৌকা বার করল ঘাটের পাশ থেকে। জেন বুঝতে পারল রোকোফ ঐ নৌকাটা করে ধরতে আসবে তাকে। রোকোফের হাতে আবার ধরা পড়ার ভয়েতে প্রাণপণ শক্তিতে দাঁড় বাইতে লাগল জেন।

রোকোফের শিবির থেকে বেরিয়ে বনপথে উগাম্বি নদীর দিকে আসতে আসতে মাঝ পথে তার দলের সঙ্গে দেখা হলো টারজনের। কিন্তু তারা জেন বা রোকোফের কথা কিছু বলতে পারল না। অথচ টারজান বাতাসের গন্ধ শুঁকে বুঝতে পারল কিছু আগে জেন আর রোকোফ দুজনেই এই পথে নদীর দিকে গেছে।

তখন টারজান ওদের সঙ্গে করে নদীর ধারে এল। নদীর পারে একটা গাছের উপর চড়ে টারজান দেখতে পেল দূরে একটা ছোট নৌকায় রোকোফ একা দাঁড় বাইছে। টারজান তখন নদীর ধারে ধারে রোকোফকে লক্ষ্য করে উধ্বশ্বাসে ছুটতে লাগল। রোকোফের কাছাকাছি এসে নদীর জলে ঝাঁপিয়ে পড়ল সে। তার দলের সবাই নদীর ধারে এগিয়ে চলল।

এদিকে টারজানকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে সাক্ষাৎ মৃত্যুর মত মনে হতে লাগল রোকোফের। সে দেখল টারজনের সঙ্গে সেই সব ভয়ঙ্কর জন্তুগুলোও রয়েছে।

নদীর জলে ঝাঁপ দিয়ে রোকোফের নৌকার দিকে এগিয়ে যেতে লাগল টারজান। নৌকার কাছে গিয়ে নৌকাটাকে হাত বাড়িয়ে ধরতেই রোকোফ দাঁড়ের কাঠটা দিয়ে টারজনের মাথায় জোর একটা ঘা দিল আর এমন সময় একটা কুমীর টারজনের একটা পা ধরে তাকে জলের ভিতর দিয়ে টেনে নিয়ে যেতে লাগল। রোকোফ দেখল টারজান হঠাৎ জলে ডুবে গেল। সে তখন নৌকাটাকে জোরে চালাতে লাগল। তবু তার ভয় গেল না।

ক্রমে রোকোফের নৌকাটা কিনসেড জাহাজের কাছে এসে পড়ল। জাহাজটা তখনো দাঁড়িয়ে আছে দেখে আশা হলো তার।

ক্ষিপ্ত হাতে দাঁড় বেয়ে জাহাজের কাছে এসে নৌকার উপর থেকে ডাকতে লাগল পলভিচকে। কিন্তু কেউ তার ডাকে সাড়া দিল না। মনে হলো জাহাজে কোন লোক নেই। এদিকে নদীর পাড়ে সেই ভয়ঙ্কর জন্তুগুলো তখনো গর্জন করছিল। তার ভয় হলো নিগ্রোটা হয়ত কোন নৌকা যোগাড় করে জাহাজে গিয়েও তাকে ধরবে।

কিন্তু কোথায় গেল পলভিচ? তবে কি ওরা জাহাজে কেউ নেই।

তবু সাহসে ভর করে জাহাজের কাছে দাঁড় বেয়ে গিয়ে জাহাজের গায়ে লাগানো মইটাকে ধরে ফেলল রোকোফ। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে জাহাজের ডেকের উপর থেকে রাইফেল হাতে জেন চীৎকার করে বলল, খবরদার, জাহাজে ওঠার চেষ্টা করলেই গুলি করে মারব। রোকোফ এবার জেনকে কোনরকম ভয় না দেখিয়ে অনেক অনুনয় বিনয় করল। কিন্তু তাকে কিছুতেই জাহাজে উঠতে দিল না জেন।

রোকোফ তখন কোন উপায় না দেখে নৌকাটাকে কোনরকমে জাহাজের কাছে ফেলে রেখে কূলের দিকে চলে গেল।

এর আগে রোকোফ জেনের নৌকাটা ধরার জন্য খুব জোরে দাঁড় বাইতে থাকলেও জেন তার থেকে দু’ঘণ্টা আগেই অপেক্ষমান কিনসেড জাহাজটাতে গিয়ে ওঠে। সেও জাহাজটাকে দেখে আশান্বিত হয়ে ওঠে। ভাবে রোকোফ এখন সে জাহাজে না থাকায় নাবিকদের টাকা দিয়ে বশ করে সে জাহাজটাকে সভ্যজগতের কোন বন্দরে নিয়ে যেতে বলবে।

তখন নৌকা থেকেই জাহাজের গায়ে ঝুলতে থাকা শিকলটা ধরে ফেলল জেন। তারপর নৌকাটাকে ছেড়ে দিয়ে কোন রকমে মইটাতে উঠে পড়ল। সোজা ডেকের উপর উঠে গিয়ে জেন দেখল সারা জাহাজটার মধ্যে দু’জন নাবিক ছাড়া আর কেউ নেই। তারা মদ খেয়ে নেশার ঘোরে একটা কেবিনের মধ্যে ঘুমোচ্ছিল। জেন, দরজায় শিকল তুলে দিয়ে ডেকের উপর বসে রাইফেল হাতে পাহারা দিতে লাগল।

একঘণ্টা নিরাপদে কেটে গেল। কিন্তু এমন সময় জেন দেখল কিনসেড জাহাজের যেসব নাবিক কয়লা আনার জন্য কূলে গিয়েছিল তারা কূল থেকে একটা নৌকায় করে উজান বেয়ে জাহাজের দিকে আসছে। তাদের দলে পলভিচও ছিল। জেন এবার ভয় পেয়ে গেল।

জেন আরও দেখল নদীর অপর পার হতে একটা নৌকায় করে পাঁচটা ভয়ঙ্কর বাঁদর-গোরিলা, একটা চিতাবাঘকে সঙ্গে করে একটা নিগ্রো যোদ্ধা এদিকেই আসছে।

এখানে আর থাকা যুক্তিসঙ্গত নয় ভেবে নাবিক দুটোকে কেবিন থেকে মুক্ত করে জাহাজ ছেড়ে দেবার কথা বলল। তার কথা না শুনলে তাদের গুলি করবে বলে ভয় দেখাল। তারা জাহাজ ছাড়ার জন্য প্রস্তুত হতে থাকলে জেন আবার ডেকে এসে পাহারা দিতে লাগল।

এদিকে নাবিকদুটো যখন জাহাজের উপর থেকে দেখল তাদের মালিক আর অন্য নাবিকরা একটা নৌকায় করে জাহাজের দিকে আসছে তখন তারা সাহস পেল। তখন তারা অতর্কিতে জেনের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তার হাত থেকে রাইফেলটা কেড়ে নিল।

টারজান যখন দেখল একটা কুমীরে তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে তখন সে তার পাথরের ছুরিটা কুমীরের পেটটার নরম অংশ দেখে তার মধ্যে বার বার ঢুকিয়ে দিতে লাগল।

টারজান দেখল কুমীরটা তার ছুরির আঘাতে হাঁপাচ্ছে এবং কিছু পরেই তার দেহটা শক্ত হয়ে গেল। সে যখন বুঝল কুমীরটা মারা গেছে তখন টারজান নদীর ধারে যে গাছের একটা ডাল জলের উপর ঝুলে পড়ে ছিল সেটা ধরে সেই গাছটার উপর উঠে পড়ল।

গাছটার উপর কিছুক্ষণ বসে থেকে বিশ্রাম করতে লাগল টারজান। সে দেখল নদীর যে পার থেকে সে ঝাঁপ দিয়েছিল জলে সেই পারেই সে উঠেছে। তবে রোকোফের নৌকাটাকে আর দেখতে পেল না। গাছ থেকে নেমে কিছু ঘাস থেঁতো করে পায়ের ক্ষতস্থানটায় লাগিয়ে দিল।

নানারকমের চিন্তা হচ্ছিল তখন তার মনে। তম্বুদজা তাকে কথায় কথায় এক সময় বলেছিল তাদের গাঁয়ে জেনের কোলে একটা বাচ্চা ছেলে ছিল সেটা মারা যায়। টারজান ভাবল সেটা হয়ত তারই ছেলে। আবার ভাবল আসলে হয়ত সে জেন নয় এবং ছেলেটাও তার নয়। জেন হয়ত রোকোফের হাতে ধরা পড়েনি এবং সে এখানে লন্ডনের বাড়িতেই আছে।

নদীর পাড় ধরে বরাবর মোহানার দিকে এগিয়ে চলল টারজান। এইভাবে অনেক দূর যাওয়ার পর সন্ধ্যা হয়ে এল। কূল থেকে টারজান দেখল সমুদ্রের কাছে নদীর বুকের উপর রোকোফের কিনসেড জাহাজটা অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছে। সে বেশ বুঝতে পারল রোকোফ এতক্ষণে নিশ্চয় জাহাজটায় উঠে গেছে।

এমন সময় পরপর দুটো গুলির শব্দ আর সঙ্গে সঙ্গে নারীকণ্ঠের এক আর্ত চীৎকার শুনে থাকতে পারল না টারজান। সে কুমীরের কথা ভুলে গিয়ে নদীর জলে আবার ঝাঁপ দিল।

এদিকে রোকোফ যখন তার দলবল নিয়ে নৌকায় করে কিনসেড জাহাজের দিকে আসছিল তখন। সে অন্য একটা নৌকাতে মুগাম্বি আর তার ভয়ঙ্কর পশু সঙ্গীগুলোকে দেখতে পায়। নৌকা দুটো কাছাকাছি হলে চিতাবাঘটা আবার হাঁ করে তাদের নৌকায় ঝাঁপ দেবার চেষ্টা করে। রোকোফ তখন গুলি করতে বলে। গুলিটা অবশ্য কারো গায়ে লাগেনি। তবে নৌকার ভিতরে যে একজন আদিবাসী মেয়ে ছিল সে চীৎকার করে ওঠে ভয়ে। এই চীৎকারটা আর গুলির শব্দ শুনতে পায় টারজান।

বিদ্রোহী নাবিক দুটো যখন জেনের কাছ থেকে রাইফেলটা কেড়ে নেবার জন্য ধস্তাধস্তি করছিল তখন টারজান মই বেয়ে জাহাজের উপর উঠে পড়ে। সে গিয়ে সরাসরি নাবিক দুটোকে বলে এসব কি হচ্ছে?

এই বলে সে নাবিক দুটোকে ধরে ডেকের উপর থেকে সমুদ্রের জলে ফেলে দিল। তারপর জেনকে দু’হাত বাড়িয়ে জড়িয়ে ধরল।

কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে রোকোফ, পলভিচ আর জনাছয়েক নাবিক সেখানে গিয়ে হাজির হলো। রোকোফ টারজানকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে গুলি করার হুকুম দিল। টারজান জেনকে পাশের একটা কেবিনে ঢুকিয়ে দিয়ে রোকোফকে আক্রমণ করার জন্য এগিয়ে গেল। রোকোফের পিছনে তার লোকেরা ছিল। রোকোফের দু’জন লোক গুলি করল তাদের রাইফেল থেকে। কিন্তু তাদের হাত তখন কাঁপছিল ভয়ে। কারণ তাদের পিছন দিক থেকে একদল ভয়ঙ্কর জন্তু এগিয়ে আসছিল তাদের দিকে। প্রথমে এল পাঁচজন। বাঁদর-গোরিলা, তারপর একটা চিতাবাঘ আর সবশেষে এক দৈত্যাকার নিগ্রোযোদ্ধা। রোকোফের লোকরা গুলি করার কোন অবকাশ পেল না।

রোকোফ ভয়ে পালিয়ে গিয়ে সামনের দিকে একটা ঘরে গিয়ে আশ্রয় নিল। টারজনের বাঁদর গোরিলারা মুগাম্বির নেতৃত্বে রোকোফের লোকদের আক্রমণ করল।

টারজান রোকোফকেই খুঁজছিল। পরে সে দেখল রোকোফ তার নাবিকদের তাড়া খেয়ে বেরিয়ে আসছে ঘর থেকে।

কিন্তু তাকে দেখতে পেয়ে টারজান তার দিকে এগিয়ে যাবার আগেই শীতা ছুটে গেল তার দিকে। তার উপর শীতা ঝাঁপিয়ে পড়তেই রোকোফ চিৎ হয়ে পড়ে গেল। এক ভয়ঙ্কর প্রতিশোধবাসনায় সর্বাঙ্গ জ্বলছিল টারজনের। কিন্তু সে যখন দেখল শীতা তাকে সে প্রতিশোধ গ্রহণের কোন সুযোগ না দিয়ে রোকোফকে ছিঁড়ে খুঁড়ে খাচ্ছে, তখন সে শীতাকে বারকতক ডাকল। কিন্তু শীতা তার প্রভুর কথা শুনল না। শীতা রোকোফের মুখে একটা জোর কামড় বসিয়ে তার বুকটা কামড়াচ্ছিল।

আকুতের বাঁদর-গোরিলাগুলো তখন ভয়ঙ্করভাবে ঘোরাঘুরি করছিল জাহাজে। তারা জেনকে চিনতে না পেরে তার দিকেও দাঁত বার করে এগিয়ে আসছিল। টারজান তখন তাদের জেনের পরিচয়টা দিতে তারা শান্ত হলো।

রোকোফের দলের মধ্যে শুধু পলভিচকে পাওয়া গেল না। যে চারজন ঘরের মধ্যে ঢুকে ছিল তাদের প্রাণে না মেরে বন্দী করে রাখল টারজান। তারা নাবিক, জাহাজ চালনার কাজে লাগতে পারে। বাকি সবাই লড়াইয়ে নিহত হয়েছে।

সেদিন সন্ধ্যায় জেন আর টারজান যখন কিনসেড জাহাজের ক্যাপ্টেনের কেবিনের মধ্যে বসে পরস্পরের অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করছিল তখন তাদের অলক্ষ্যে অগোচরে কূলের উপর দাঁড়িয়ে একটা। লোক এক উন্মত্ত প্রতিহিংসায় জাহাজটার পানে তাকিয়েছিল। লোকটা হলো পলাতক পলভিচ।

সকাল হওয়ার কিছু পরে ঘুম থেকে জেগে উঠল টারজান। সে দেখল ঝড় থেমে গেছে। আকাশ পরিষ্কার সুতরাং জাহাজ ছাড়ার পথে আর কোন বাধা নেই।

টারজান নাবিকদের জাহাজ ছাড়ার নির্দেশ দিল।

জাহাজটা অবশেষে চলতে শুরু করল। উগাষি নদীর মোহানা পার হয়ে সেটা আটলান্টিক মহাসাগরে পড়ল। টারজান আর জেনের মনে তখন শুধু একটাই দুঃখ, তাদের ছেলেটার কোন খোঁজ পাওয়া গেল না।

এমন সময় হঠাৎ একটা প্রবল বিস্ফোরণে একটা কেবিনের ছাদ উড়ে গেল। সবাই আশ্চর্য হয়ে তাকাল সেইদিকে। কিন্তু এই বিস্ফোরণের কারণ কি তা বুঝতে পারল না। কিন্তু সকলেই সন্ত্রস্ত হয়ে ছোটাছুটি করতে লাগল। একমাত্র টারজানই সাহস দিতে লাগল সকলকে। একমাত্র একটা নাবিক বুঝতে পারল এ হলো শয়তান পলভিচের কাজ। রাত্রিবেলায় পলভিচ লুকিয়ে তার কেবিনে ঢুকে জিনিসপত্র নেবার সময় কোন বিস্ফোরক পদার্থ রেখ যায়। কিন্তু সে কথা ভয়ে আর প্রকাশ করতে পারল না নাবিকটা।

টারজান দেখল তাদের বিপদ কাটেনি। জাহাজের কাঠে আগুন ধরে গেছে। কিছুক্ষণের মধ্যে গোটা জাহাজটাই পুড়ে ছারখার হয়ে যাবে। পাম্প করে আগুন নেভানোর চেষ্টা করতে গিয়ে দেখা গেল আগুন কমার থেকে বেড়ে যাচ্ছে আরো। ইঞ্জিন ঘরেও আগুন ধরে গেছে।

তখন টারজান নাবিকদের বলল, জাহাজটাকে আর বাঁচানো যাবে না। সুতরাং এখানে থেকে আর লাভ নেই। আর যে দুটো নৌকা আছে জাহাজে তা নামিয়ে দাও। এখান থেকে কূল বেশি দূরে নয়।

দুটো নৌকায় করে সকল মালপত্র নিয়ে বেলাভূমির দিকে এগিয়ে গেল ওরা। মাটিতে পা দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে আকুতের দলের বাঁদর-গোরিলারা আর শীতা ছুটে জঙ্গলের মধ্যে চলে গেল।

টারজান তাদের লক্ষ্য করে বলল, বিদায় বন্ধু, তোমরা ছিলে আমার বিশ্বস্ত বন্ধু। তোমাদের ভুলতে পারব না জীবনে কখনো।

জেন বলল, ওরা কি আবার ফিরে আসবে?

টারজান বলল, আসতে পারে, আবার নাও আসতে পারে।

উপকূলের উপর নেমে দেখল কিনসেড জাহাজটা তখন সেখানে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে জ্বলছে। এইভাবে দু’ঘন্টা জ্বলার পর জাহাজটা ডুবে গেল একেবারে।

দ্বীপের মধ্যে টারজনের প্রথম কাজ হলো ভাল জলের জায়গার কাছাকাছি শিবির স্থাপন করা। কোথায় জল আছে তা সে জানত এবং সেই জায়গায় শিবির স্থাপন করল। দলের নাবিকরা যখন শিবির স্থাপনের কাজ করছিল টারজান তখন মুগাম্বি আর সেই আদিবাসী মেয়েটিকে জেনের কাছে রেখে বনের মধ্যে শিকার করতে গেল।

দলের মধ্যে কে কি কাজ করবে তা সব ভাগ করে দিল টারজান। ঠিক হলো সারাদিন শিবিরের কাছে একটা বড় পাথরের উপর থেকে একজন সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে থাকবে, কোন জাহাজ আসছে কি না তা দেখবে। কোন জাহাজ দেখতে পেলেই পাহারাদার নাকিবদের কাছ থেকে নেওয়া একটা লাল জামা উড়িয়ে সংকেত দেখাবে। রাত্রিতে সেইখানে শুকনো ডালপালা দিয়ে একটা আগুন জ্বালিয়ে রাখা হলো।

কিন্তু কয়েকদিন কেটে গেলেও দিগন্তে সমুদ্রের উপর কোন জাহাজ দেখতে পাওয়া গেল না। টারজান তখন বলল, জঙ্গল থেকে কাঠ কেটে একটা বড় নৌকা তৈরি করতে হবে। তাই দিয়ে ওরা এই দ্বীপ থেকে মূল মহাদেশে গিয়ে উঠবে। সেখানে কোন জাহাজের দেখা পাওয়া যেতে পারে। টারজান নৌকা তৈরি কিভাবে করতে হয় তা জানে। কিন্তু তাকে সাহায্য করার জন্য লোকের দরকার। এ কাজে প্রচুর পরিশ্রম আর লোকের দরকার। এ ব্যাপারে সারাদিন প্রচুর পরিশ্রম করতে গিয়ে বন্দী নাবিকরা ক্রমে অসন্তুষ্ট হয়ে উঠল।

টারজানদের শিবিরে যখন এইরকম গোলমাল চলছিল তখন তাদের উত্তর-পূর্ব দিকে কিছু দূরে কাউরি নামে একটা ছোট জাহাজ উপকূলভাগের একটা শাড়ির মধ্যে লুকিয়ে থাকতে শুরু করে। কারণ। এই জাহাজের দশজন নাবিক কিছু মুক্তোর লোভে সহসা বিদ্রোহী হয়ে উঠে অফিসারদের হত্যা করে। অফিসারদের পক্ষে কিছু অনুগত নাবিক যোগদান করলে তাদেরও হত্যা করা হয়। বিদ্রোহী নাবিকদের নেতা ছিল তিনজন, গান্ট নামে এক সুইডিশ, মমুলা মাওরি নামে এক নিগ্রো আর কাইশাং নামে একজন। চীনদেশীয় লোক।

যেদিন এই জঙ্গলদ্বীপের উপকূলভাগের খাড়ির মধ্যে কাউরি জাহাজটাকে ওরা লুকিয়ে রাখে তার আগের দিনই ওরা দক্ষিণ দিগন্তে একটা যুদ্ধ জাহাজের চিমনি দিয়ে ধোয়া উড়তে দেখে। যুদ্ধ জাহাজটাকে দেখে ওদের ভয় হয়। ওরা ভাবে ওদের বিদ্রোহ ও অফিসার হত্যার খবর পেয়েই হয়তো। যুদ্ধ জাহাজটা খোঁজ করছে ওদের।

কাইশাং আর মাওরি গান্টকে তাদের জাহাজটা ছেড়ে দিতে বলল ধরা পড়ার ভয়ে। কিন্তু গান্ট বলল, ও জাহাজ আমাদের ধরতে আসবে কেন? আমাদের বিদ্রোহের কথা কেউ জানে না।

একদিন টারজান দুপুরের দিকে হরিণ শিকার করতে যায় মুগাম্বিকে শিবিরে রেখে। মুগাম্বির সঙ্গে জোনস আর সালিভান নামে দু’জন অনুগত নাবিকও ছিল।

টারজান বেরিয়ে যেতেই কাইশাং ও তার দলের পাঁচজন লোককে শিবিরের কাছে এক জায়গায়। লুকিয়ে রেখে স্নাইদার হঠাৎ একসময় ব্যস্ত হয়ে শিবিরে গিয়ে মুগাম্বিকে বলে তার সঙ্গী স্মিথসকে বাঁদর গোরিলারা ধরেছে। তাকে মেরে ফেলবে। তুমি এখনি জোনস আর সালিভানকে সঙ্গে নিয়ে ছুটে যাও।

কথাটা শুনে মুগাম্বি শিবির ছেড়ে বেরিয়ে যেতেই স্নাইদার কাইশাং-এর কাছে চলে গেল। বলল, চলে এস, শিবির ফাঁকা।

কাইশাং গিয়ে প্রথমে জেনকে বলল, চলে এস আমাদের সঙ্গে।

জেন কিছু বুঝতে না পেরে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল। জেন উঠেই স্মিথসকে দেখতে পেল। বুঝল একটা দারুণ ষড়যন্ত্র চলছে। সে স্মিথসকে বলল, এর মানে কি?

স্মিথস বলল, আমরা একটা জাহাজ পেয়েছি। এখন আমরা এখান থেকে মুক্তি পেতে পারি।

জেন স্নাইদারকে বলল, তুমি তাহেল মুগাম্বিকে কোথায় পাঠালে?

স্নাইদার বলল, তারা আসবে না।

তখন কাইশাং-এর লোকজনরা জেন আর আদিবাসী মেয়েটিকে তুলে নিয়ে কাউরি জাহাজটার দিকে চলে গেল। কিছুটা দূরে থেকে গান্ট সব দেখল।

এদিকে মুগাম্বি যখন স্নাইদারের কথামত নির্দিষ্ট জায়গায় গিয়ে দেখল স্মিথস বা কোন বাঁদর-গোরিলা নেই, তখন সে বুঝতে পারল এর পিছনে কোন একটা চক্রান্ত আছে। তখন সে উধ্বশ্বাসে ছুটতে ছুটতে শিবিরে ফিরে এসে দেখল শিবির শূন্য।

এমন সময় হরিণ না পেয়ে টারজান ফিরে এলে তার দুটো কুঁচকে উঠল।

টারজান বলল, কিন্তু জঙ্গলে ওরা জেনকে নিয়ে যাবে কোথায়? পালাবার জাহাজই বা পাবে কোথায়? এখন এস, ওদের খোঁজ করা যাক।

ওরা শিবির থেকে বার হতেই গান্ট এসে টারজনের সামনে দাঁড়াল।

গান্ট সরাসরি টারজানকে বলল, তোমাদের মেয়েদের ওরা চুরি করে নিয়ে পালিয়েছে। যদি তাদের ধরতে চাও তাড়াতাড়ি এস আমার সঙ্গে। তা না হলে কাউরি জাহাজটা এখনি ছেড়ে দেবে।

টারজান বলল, কে তুমি? আমার স্ত্রীর অপহরণের কথা তুমি কি করে জানলে?

গান্ট বলল, আমি নিজে দেখেছি আমাদের দলের কাইশাং আর মমুলা মাওরি তোমাদের দলের দু’জন লোকের সঙ্গে চক্রান্ত করছিল। তাদের কথা আমি সব শুনেছি। কাইশাং আর মাওরি আমাকে তাদের শিবির থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। তারা আমাকে খুন করতে চেয়েছিল। আমি পালিয়ে এসেছি শিবির থেকে।

গান্ট তাদের পথ দেখিয়ে উপকূলের কাছে নিয়ে গেল। কিন্তু সামান্য একটুর জন্য দেরী হয়ে গেছে। কাউরি জাহাজটা এইমাত্র ছেড়ে দিয়েছে। ওরা দেখল জাহাজটা পূর্ব দিকে এগিয়ে চলেছে ধীর গতিতে। জীবনে কখনো কোন ক্ষেত্রে হার মানেনি, আশা হারায়নি টারজান। কিন্তু জীবনে আজ প্রথম যেন হতাশার বেদনা অনুভব করল সে।

টারজান যখন তার শিবিরে ফিরে গেল সবার সঙ্গে তখন সন্ধ্যার অন্ধকার ঘন হয়ে আসছে।

হঠাৎ অন্ধকার বনভূমির মধ্যে একটা চিতাবাঘের ডাক শুনতে পেল ওরা। সে ডাক শুনে টারজানও জন্তুদের মত অদ্ভুতভাবে চীৎকার করে উঠল। কিছুক্ষণের মধ্যেই শীতা এসে হাজীর হলো টারজনের সামনে। টারজান তার গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল।

হঠাৎ সমুদ্রের উপকূলভাগের কাছাকাছি একটা আলো দেখতে পেয়ে বলল, দেখ দেখ, আলো। নিশ্চয় ও আলোটা কাউরি জাহাজের। জাহাজটা এখন দাঁড়িয়ে আছে শান্ত হয়ে। একটা নৌকা যোগাড় করো কোনরকমে। আমরা ও জাহাজে হানা দিয়ে জাহাজটা দখল করে নেব।

গান্ট বলল, কিন্তু ওদের সকলের হাতেই আগ্নেয়াস্ত্র আছে। কিন্তু আমরা মাত্র পাঁচজন।

টারজান তার চিঅবাঘটার দিকে তাকিয়ে বলল, আমার এই শীতা কুড়িটা সশস্ত্র লোকের সমান। এরপর যারা আসবে তারা সব একশোজন লোকের কাজ করবে।

এই বলে টারজান দাঁড়িয়ে মুখ তুলে বাঁদর-গোরিলাদের মত একটা জোর আওয়াজ করল। কিছুক্ষণের মধ্যেই আকুতের সঙ্গে ভয়ঙ্কর একদল বাঁদর-গোরিলা সেখানে এসে গেল। গান্ট তাদের ভয়ে। কাঁপতে লাগল।

একটু খুঁজতেই বেলাভূমির উপর কিছু দূর সরে যাওয়া নৌকা দুটা পেয়ে গেল তারা। আকুৎ ও তার। দলের সবাই আর শীতা নৌকাতে গিয়ে উঠল। এছাড়া ছিল গান্ট, টারজান, মুগাম্বি, সানিভাল আর জোনস। সমুদ্রের শান্ত জলের উপর দিয়ে কাউরি জাহাজের আলোটা লক্ষ্য করে তীর বেগে ছুটে যেতে লাগল নৌকা দুটো।

টারজান যা ভেবেছিল ঠিক তাই। কাউরি জাহাজটাই তখন দাঁড়িয়ে ছিল। ডেকের উপর একটা নাবিক ঝিমোচ্ছিল।

জাহাজের নিচের তলায় একটা কেবিনে তখন স্নাইদার জেনকে বশীভূত করার চেষ্টা করছিল। যে ঘরে জেনকে বন্দী করে রাখা হয়েছিল সেই ঘরের একটা টেবিলের ড্রয়ারে একটা রিভলবার পেয়ে গিয়েছিল জেন। স্নাইদারের হাতে তখন কোন অস্ত্র না থাকায় স্নাইদারকে গুলি করার ভয় দেখিয়ে বেকায়দায় ফেলেছিল জেন।

এমন সময় ডেকের উপর থেকে একটা গোলমালের আওয়াজ আসতেই অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে জেন আর সঙ্গে সঙ্গে রিভলবারটা কেড়ে নেয় স্নাইদার।

ডেকের উপর যে লোকটা পাহারা দিচ্ছিল সে ঝিমোতে ঝিমোতে একটা অচেনা লোককে জাহাজের মই বেয়ে উঠতে দেখে চীৎকার করে ওঠে এবং সঙ্গে সঙ্গে একটা গুলি করে তার রিভলবার থেকে। শব্দ। শুনেই চমকে ওঠে জেন।

কিন্তু প্রহরীর গুলিটা কারো গায়ে লাগেনি বলে সে ভয়ে চীৎকার করে জাহাজের লোকজনদের ডাকতে থাকে। কিন্তু তার আগেই টারজান আর তার জন্তু-জানোয়ারগুলো ডেকের উপর উঠে ঘুরে। বেড়াতে থাকে ভয়ঙ্করভাবে।

কাউরি জাহাজের সশস্ত্র নাবিকরা জন্তু-জানোয়ারগুলোকে দেখে ভয়ে বিহ্বল হয়ে পড়ে। তারা। কম্পিত হাতে গুলি ছুঁড়লেও সে গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে পড়ে স্বাভাবিকভাবে। আকুতের বাদর-গোরিলাগুলো। তাদের দু-এক জনের গলা টিপে ধরতেই তারা ভয়ে পালিয়ে সামনের ঘরটাতে গিয়ে আশ্রয় নিল।

কাইশাং ছুটে পালাচ্ছিল। কিন্তু শীতা একটা নাবিককে শেষ করার পর কাইশংকে ধরল। কিছুক্ষণের মধ্যেই দেহের সব মাংস খেয়ে ফেলল সে।

এদিকে স্নাইদার যখন নিচের তলায় কেবিনটার মধ্যে জেনের অন্যমনস্কতার সুযোগ নিয়ে জেনের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তার রিভলবারটা কেড়ে নিতে যাচ্ছিল ঠিক সইে সময় দরজা ঠেলে ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ল টারজান। আদিবাসী মেয়েটি তখন ভয়ে নতজানু হয়ে জেনের কাছে বসেছিল।

কিছু না বলে পিছন থেকে স্নাইদারের গলাটা টিপে ধরল টারজান। স্নাইদার মুখ তুলে টারজানকে দেখেই ভয়ে স্তম্ভিত হয়ে পড়ল। টারজান এত জোরে গলাটা তার টিপে ধরেছিল যে কোন কথা বলার সুযোগ পেল না সে। তার জিভটা বেরিয়ে আসতে লাগল। মুখটা নীল হয়ে গেল।

স্নাইদারের নিষ্প্রাণ দেহটাকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে জেন আর আদিবাসী মেয়েটিকে নিয়ে কেবিন থেকে বেরিয়ে এল টারজান। এসে দেখল সব লড়াই শেষ। মাত্র চারজন ছাড়া শত্রুদের সবাই খতম হয়েছে। তারা হলো স্মিথ, মাওরি আর তাদের দলের দু’জন নিগ্রো নাবিক।

টারজান তাদের বলল, হয় জাহাজে নাবিকের কাজ করো, না হয় মৃত্যুবরণ করো।

তারা সবাই নাবিকের কাজ করতে লাগল।

টারজনের নির্দেশমত জাহাজটাকে আবার জঙ্গল-দ্বীপের উপকূলে একবার আনা হলো। ঐ উপকূলে জন্তুগুলোকে ছেড়ে দেয়া হলো। তারা আবার জঙ্গলে চলে গেল। এবার জাহাজ চলল লন্ডনের পথে।

তিনদিন পর শোরওয়াটার নামে একটা ব্রিটিশ যুদ্ধজাহাজের সংস্পর্শে এল কাউরি। সেই জাহাজের বেতারের মাধ্যমে লর্ড গ্রেস্টোক তার লন্ডনের বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ করল। জানল, তার ছেলেকে রোকোফ নিয়ে আসতে পারেনি। মোটা টাকার লোভে ছেলেটাকে রোকোফের হাতে তুলে না দিয়ে পলভিচ অন্য একজনের কাছে রাখে ছেলেটাকে। ঠিক করে মোটা টাকার ঘুষ নিয়ে ছেলেটাকে ফিরিয়ে দেবে। তাই সে জ্যাকের পরিবর্তে একই রকমের অন্য একটি ছেলেকে জাহাজে নিয়ে গিয়ে তুলে দেয় রোকোফের হাতে। আফ্রিকার কোন এক আদিবাসীদের গায়ে জেনের কোলে মারা যায় সেই ছেলেটি।

টারজান আর জেন বাড়ি গিয়ে দেখল বুড়ি নিগ্রো নার্স এসমারাল্ডাই জ্যাককে মানুষ করছে পরম যত্নের সঙ্গে।

টারজনের সঙ্গে ছিল তার বিশ্বস্ত সহচর মুগাম্বি আর সেই আদিবাসী তরুণীটি যাকে একদিন একটা নৌকার পাটাতনে শুয়ে থাকতে দেখে। মেয়েটি পরিষ্কার বলে দেয় সে আর বাড়ি ফিরে যাবে না। সে টারজনের বাড়িতেই থেকে যাবে।

টারজনের এখন একমাত্র জীবিত শত্রু পলভিচ যে এখন আফ্রিকার জঙ্গলে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

টারজনের পুত্র (দি সন অফ টারজান)

সেদিন একটা লম্বা নৌকা উগাম্বি নদীর উপর দিয়ে ভাটার টানে মোহানার দিকে ভেসে চলেছিল।

এমন সময় মাঝিরা দেখল নদীর পাড় থেকে ভূতের মত অস্থিচর্মসার একটা লোক হাত বাড়িয়ে তাদের ডাকছে। তার ডাক শুনে মাঝিরা লোকটাকে নৌকায় তুলে নিয়ে আবার মোহানার দিকে এগিয়ে। চলল। সেখানে সমুদ্রের মুখে ম্যাজোরি নামে একটা জাহাজ অপেক্ষা করছে নৌকারোহীদের জন্য।

আসলে লোকটা তার আসল নাম গোপন করে উদ্ধারকারীদের কাছে। সে হলো নিকোলাস রোকোফের সহচর পলভিচ। দশ বছর আগে রোকোফ যখন টারজনের হাতে ধরা পড়ে তখন পলভিচ জঙ্গলের গভীরে পালিয়ে যায়।

ম্যাজোরি জাহাজে আশ্রয় পেয়েও ওদের সেবাযত্ন লাভ করে কিছুদিনের মধ্যে সুস্থ হয়ে উঠল। পলভিচ। এখন আর তার মনে কারো প্রতি কোন প্রতিশোধ বাসনা নেই।

ম্যাজোরি জাহাজটা ভাড়া নিয়ে আফ্রিকার জঙ্গলে এসে এক বিশেষ কাঁচা মালের সন্ধান করতে থাকে একদল ধনী ব্যবসায়ী।

পলভিচকে নিয়ে ম্যাজোরি জাহাজটা অবশেষে সেই দ্বীপের কূলে গিয়ে ভিড়ল। দ্বীপটা নানারকম সারবান গাছের জঙ্গলে ভরা।

একদিন পলভিচ বনে শিকারীদের সঙ্গে গিয়ে একটা গাছতলায় ঘুমিয়ে পড়েছিল। এমন সময় কার স্পর্শে জেগে উঠে দেখে একটা বিরাট বাদর-গোরিলা তার পাশে বসে তার মুখটা খুঁটিয়ে দেখছে। পলভিচ ভয় পেয়ে গেল। পলভিচ বাঁদর-গোরিলাটা তার কোন ক্ষতি করছে না। তাই সে ভাবল একে যদি কোন শহরে নিয়ে যাওয়া যায় তবে তাকে বিক্রি করে অথবা খেলা দেখিয়ে অনেক টাকা পাওয়া যাবে।

নাবিকরা পলভিচের একটা বিরাটকায় বাদর দেখে তাদের দিকে ছুটে এল।

নাবিকরা পলভিচকে বাঁদরটা সম্বন্ধে অনেক প্রশ্ন করতে লাগল।

কিন্তু পলভিচ শুধু সব সময় একটা কথা বলতে লাগল, বাঁদরটা আমার।

এরপর জাহাজের সবাই মিলে বাঁদরটার নাম দিল এ্যাজাক্স।

তারা দেখল এ্যাজাক্সের বয়স হয়েছে। কিন্তু বয়সে বুড়ো হলেও তার গায়ে তখনো প্রচুর শক্তি।

অবশেষে ইংল্যান্ডে গিয়ে জাহাজ ভিড়তেই বাঁদরটার প্রশিক্ষণের জন্য একজন ওস্তাদের কাছে গেল পলভিচ।

হারল্ড মূর নামে এক গৃহশিক্ষক কোন এক ব্রিটিশ লর্ডের বাড়িতে তার ছেলেকে পড়াত। কিন্তু শত চেষ্টাতেও সে ছেলেটির পড়ার কোন উন্নতি ঘটাতে পারছিল না। তাই সে একদিন ছেলেটির মার কাছে তার সম্বন্ধে অভিযোগ করল।

সে বলল, ওর আসল আগ্রহের বস্তু হলো দৈহিক শক্তির চর্চা আর আফ্রিকার জঙ্গলের আবিষ্কার সম্বন্ধে কোন বই পেলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে নিবিষ্ট মনে পড়ে যাবে।

ছেলের মা বলল, আপনি নিশ্চয় এসব বই পড়তে দেন না?

কিন্তু ওরা যার সম্বন্ধে আলোচনা করছিল সেই ছেলেটি ঘরের পাশে একটি গাছের ডালে চেপে বাঁদরের মত হুপ করে একটা শব্দ করে উঠল। তার মা ও গৃহশিক্ষক তাকে দেখে জানালার কাছে যেতে নাযেতে সে গাছ থেকে বারান্দায় লাফিয়ে পড়ে ঘরে চলে এল।

এরপর সে নাচতে নাচতে বলল, শহরের মিউজিক হলগুলোতে একটা আশ্চর্য বাঁদর-গোরিলাকে দেখানো হচ্ছে। কথা বলা ছাড়াও সে মানুষের মত অনেক কিছুই করতে পারে। আমি আজ গিয়ে দেখব মা? দয়া করে আমাকে যাবার অনুমতি দাও।

মা ছেলেটির গাল ধরে আদর করে বলল, না জ্যাক, তুমি ত জান, এসব প্রদর্শনীতে যাবার অনুমতি আমি কখনো দিই না।

হঠাৎ দরজা ঠেলে ছেলেটির বাবা এসে ঘরে ঢুকলো। ছেলেটির বাবা বলল, কোথায়? মা বলল, ও একটা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বাঁদর-গোরিলা দেখতে একটা মিউজিক হলে যেতে চায়। ছেলেটির বাবা বলল, কে এ্যাজাক্স? ছেলেটি ঘাড় নেড়ে বলল, হ্যাঁ। তার বাবা বলল, চল আমিও যাব তোমার সঙ্গে। জেন, তুমিও চল না।

জেন ঘাড় নেড়ে অসম্মতি জানিয়ে গৃহশিক্ষক মূরকে স্মরণ করিয়ে দিল, এখন তাকে পড়ার ঘরে গিয়ে জ্যাককে আবৃত্তি শেখাতে হবে।

মূর আর জ্যাক ঘর থেকে বেরিয়ে গেলে জেন তার স্বামী টারজানকে বলতে লাগল, দেখ জন, যেমন করে হোক জ্যাকের মন থেকে তোমার কাছ থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া প্রবৃত্তিগুলো দূর করে ফেলতে হবে যাতে বন্যজীবনের প্রতি কোন আকাক্ষা দানা বেঁধে উঠতে না পারে।

টারজান বলল, বন্যজীবনের প্রতি একটা আসক্তি উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়ার মধ্যে কোন সত্যিকারের বিপদ আছে বলে আমি মনে করি না।

সন্ধ্যের সময় জ্যাক আবার তার বাবার কাছে এ্যাজাক্সকে দেখতে যাবার কথাটা তুলল। কিন্তু টারজান বলল, তোমার মা যখন এটা চায় না, তখন আমি তোমাকে অনুমতি দিতে পারি না।

সন্ধ্যের পর এক সময় হঠাৎ মূর জ্যাকের ঘরের পাশ থেকে দেখল জ্যাক পোশাক পরে বাইরে যাবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। মূর দরজার কাছে গিয়ে বলল, কোথায় যাচ্ছ জ্যাক।

জ্যাক বলল, আমি এ্যাজাক্সকে দেখতে যাচ্ছি।

মূর বলল, আমি তোমার ব্যবহারে লজ্জিত।

মূর একথা বলতে না বলতেই জ্যাক তাকে জোর করে তুলে নিয়ে তার বিছানার উপর শুইয়ে দিল। তারপর একটা বিছানার চাদর দিয়ে দড়ি করে মূরের হাত পা বেঁধে ফেলল খাটের সঙ্গে। তারপর দরজায় ভিতর থেকে তালাবন্ধ করে দিয়ে জানালা দিয়ে পাইপ বেয়ে নিচে নেমে গেল।

কিছু পরে টারজান ও জেন এসে দরজায় ঘা দিয়ে জ্যাককে ডাকতে লাগল। কিন্তু কোন সাড়া না পেয়ে টারজান দরজা ভেঙ্গে ফেলল। ঘরে ঢুকে দেখল হাত পা বাঁধা অবস্থায় মূৰ্ছিত হয়ে ঘরের মেঝের উপর পড়ে আছে মূর।

মুখে চোখে জল দিতেই মূর চেতনা ফিরে পেয়ে চোখ মেলে তাকাল। তাকিয়েই বলে উঠল, আমি গৃহশিক্ষকতার পদ থেকে অব্যাহতি চাইছি। আমি আপনার ছেলেকে আর পড়াতে পারব না।

টারজান বলল, কিন্তু জ্যাক কোথায়?

মূর বলল, সে আমাকে এইভাবে বেঁধে রেখে এ্যাজাক্সকে দেখতে গেছে।

সঙ্গে সঙ্গে তার গাড়ি বার করতে বলল টারজান। তারপর সোজা মিউজিক হলের দিকে গাড়ি ছুটিয়ে দিল।

মিউজিক হলে টারজানকে দেখে তার মনের মানুষকে খুঁজে পেয়ে তাদের ভাষায় আনন্দ প্রকাশ করতে করতে এ্যাজাক্স ছুটে গেল তার দিকে। টারজানও তাকে চিনতে পেরে স্তম্ভিত বিস্ময়ে দাঁড়িয়ে রইল। তার মুখ থেকে শুধু একটা কথা বেরিয়ে এল, আকুৎ তুমি?

আকুৎ বলল, দীর্ঘদিন ধরে তোমাকেই খুঁজছি টারজান। তোমাকে যখন পেয়ে গেছি তখন আমি তোমাকে নিয়ে আবার জঙ্গলে গিয়ে বাস করব তোমার সঙ্গে।

টারজান নীরবে আকুতের মাথায় হাত বোলাতে লাগল। আফ্রিকার জঙ্গলের সব ঘটনা মনে পড়ল তার একে একে। টারজান আকুৎকে বলল, তুমি আজ ওদের সঙ্গেই যাও আকুৎ। কাল আমি তোমার সঙ্গে দেখা করব।

বাড়ি যাবার পথে তার পূর্ব জীবনের সব কথা সংক্ষেপে বলল টারজান জ্যাককে।

পরদিন পলভিচ আর আকুৎ যেখানে ছিল সেখানে গিয়ে দেখা করল টারজান। টারজান আকুৎকে টাকা দিয়ে কিনতে চাইল। পলভিচ তার উত্তরে বলল, কথাটা ভেবে দেখব।

টারজান বাড়ি ফিরে জেনকে বলল, আমি ভাবছি আকুৎকে কিনে নিয়ে আফ্রিকার জঙ্গলে পাঠিয়ে দেব।

জ্যাক বলল, ওকে কিনে আমাদের বাড়িতে রেখে দাও। আমার বন্ধু হিসেবে থাকবে ও এখানে।

একথা জেন বা টারজান কেউ সমর্থন করতে পারল না।

জ্যাক তখন আকুৎকে দেখতে যাবার অনুমতি চাইল। কিন্তু সে অনুমতি তার বাবা মা কেউ দিল না।

তখন জ্যাক একদিন কোনরকমে ঠিকানা যোগাড় করে খুঁজে খুঁজে শহরের একপ্রান্তে পলভিচের আস্তানায় চলে গেল। সেখানে গিয়ে পলভিচকে কিছু টাকা দিয়ে জ্যাক বলল, আমার বাবাকে একথা বলো না। আমি মাঝে মাঝে এখানে এসে ওকে দেখে যাব। ওর জন্য আমি তোমাকে কিছু করে টাকা দেব।

জ্যাক যখন বলল, সে টারজনের ছেলে তখন পলভিচের মাথায় ষড়যন্ত্রের একটা পরিকল্পনা খেলে গেল। সে ভাবল টারজান রোকোফকে হত্যা করেছে, তাকে অনেক কষ্ট দিয়েছে। তাই তার ছেলের মধ্য দিয়ে টারজনের উপর প্রতিশোধ নেবার প্রতিজ্ঞা করল মনে মনে।

দিন দুইয়েকের মধ্যেই টারজনের কাছ থেকে মোটা টাকা নিয়ে আকুৎকে বিক্রী করতে রাজী হয়ে গেল পলভিচ। ঠিক হলো দু’দিন পর ডোভার থেকে আফ্রিকাগামী একটা জাহাজে তুলে দেবে আকুৎকে পলভিচ।

এই ঘটনার কিছু পরেই জ্যাক এসে কিছু টাকা পলভিচের পকেটে গুঁজে দিয়ে বলল, তোমাকে আর কষ্ট করে ডোভারে যেতে হবে না। আমিই আকুৎকে সঙ্গে করে নিয়ে যাব। আজই সন্ধ্যায় আমার স্কুল বোর্ডিং-এ যাবার কথা। সুতরাং আমি ওভাবে গেলে তাতে বাবার কোন সন্দেহ হবে না। ডোভারে আকুৎকে পৌঁছে দিয়েই আমি স্কুলে চলে যাব।

পলভিচ মনে মনে শয়তানির হাসি হেসে রাজী হয়ে গেল জ্যাকের কথায়।

কিন্তু তার বাবা মা স্টেশান ছেড়ে চলে গেলেই জ্যাক ট্রেন থেকে নেমে সোজা পলভিঢের বাসায় চলে গেল। গিয়ে দেখল আকুৎকে মোটা দড়ি দিয়ে বেঁধে বিছানার উপর ফেলে রাখা হয়েছে। পলভিচ ঘরের মধ্যে অশান্তভাবে পায়চারি করছে।

পলভিচ এবার জ্যাককে বলল, তুমি আমার কাছে এসে পিছন ফিরে দাঁড়াও।

জ্যাক তখন তার সামনে এসে পিছন ফিরে দাঁড়াতেই পলভিচ তার পিছন থেকে একটা মোটা দড়ির ফাঁস তার দুটো হাতের কব্জিতে শক্ত করে লাগিয়ে দিল। মুহূর্তমধ্যে পলভিচের মুখের চেহারা অন্য রকম হয়ে গেল। সে ভয়ঙ্করভাবে ঘুরে দাঁড়িয়ে অতর্কিতে জ্যাককে মেঝের উপর চিৎ করে ফেলে দিয়ে তার বুকের উপর বসল। তারপর দুটো হাত দিয়ে তার গলাটা টিপে ধরে বলল, তোর বাবা আমার সর্বনাশ করেছে। এইভাবে আমি তার প্রতিশোধ নেব।

জ্যাক কিন্তু চীৎকার করল না। সে হাত নাড়তেও পারল না। অসহায়ভাবে শুয়ে রইল সে আর তার গলাটা টিপতে লাগল পলভিচ।

এদিকে আকুৎ হাত পা বাঁধা অবস্থায় শুয়ে সবকিছু দেখছিল। সে এবার তার বন্ধুর অবস্থা দেখে গর্জন করতে লাগল। টানাটানি করতে করতে সে বাঁধনগুলো খুলে যেতেই পলভিচের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল।

মুখ তুলে তাকিয়ে দেখে ভয়ে সাদা হয়ে গেল পলভিচ। আকুৎ এক ঝটকায় জ্যাকের উপর থেকে পলভিচকে ফেলে দিয়ে নখ দিয়ে তার গাটাকে চিরে দিয়ে তার গলায় দাঁত বসিয়ে এক সাংঘাতিক কামড় দিল। সঙ্গে সঙ্গে পলভিচের প্রাণটা বেরিয়ে গেল।

অনেক কষ্টে জ্যাকের হাতের বাঁধনগুলো খুলে দিল আকুৎ। জ্যাক উঠে দাঁড়িয়ে আর অপেক্ষা না করে আকুৎকে সঙ্গে করে ডোভারের পথে চলে গেল।

মাসখানেক পর টারজান খবর পেল স্কুল থেকে জ্যাক সেখানে যায়নি। খোঁজ নিয়ে একটা কথা শুধু জানতে পারল তারা জ্যাককে স্কুলে যাওয়ার জন্য ট্রেনে তুলে দেওয়ার পর ট্রেন ছাড়ার আগেই সে ট্রেন। থেকে নেমে একটা গাড়ি ভাড়া করে পলভিচের বাসায় আসে।

পলভিচের মৃত্যুর পরদিনই ডোভার থেকে একটি ছেলে তার অসুস্থ বুড়ি ঠাকুরমাকে রোগীর গাড়িতে করে জাহাজে চাপিয়ে একসঙ্গে যাত্রা করল।

যাত্রীদের মধ্যে কন্ডন নামে একজন আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বড় বড় শহরগুলোতে অপরাধমূলক কাজ করে বেড়াত। লোকটা দুষ্ট প্রকৃতির। সে একদিন জ্যাকের হাতে বড় এক তাড়া নোটের গোছা দেখে তা চুরি করার জন্য সচেষ্ট হয়ে ওঠে।

এমন সময় জাহাজটা আফ্রিকার জঙ্গলবর্তী এক ছোটখাটো বন্দরে দু-একদিনের জন্য নোঙর করে। এই সময় জ্যাকের বাড়ির জন্য সহসা মন খারাপ করে ওঠে। সে তাই সেই বন্দরে নেমে ইংলন্ডগামী একটা জাহাজে করে বাড়ি ফিরে যাবে ঠিক করে।

বুড়ি ঠাকুরমাবেশী আকুৎকে চেয়ারে করে জাহাজ থেকে নামাবার সময় জ্যাকের পকেট থেকে নোটের তাড়াটা কখন পড়ে যায় তা সে দেখতেই পায়নি। ছোটখাটো একটা হোটেলে একটা ঘর ভাড়া নিয়ে জ্যাক ইংল্যান্ডে জাহাজে করে যাবার জন্য অপেক্ষা করতে থাকে।

সে রাত্রিতে জ্যাক আকুৎকে বুঝিয়ে বলল, তুমি জঙ্গলে চলে যাও আকুৎ, আমি বাড়ি ফিরে যাব। এখান থেকে।

আকুৎ নীরবে মেনে নিল জ্যাকের কথাটা। তারপর ঘুমিয়ে পড়ল বিছানায়। আকুৎ মেঝের উপর শুল।

জ্যাকরা ঘুমিয়ে পড়লে চুপি চুপি দরজাটা খুলে ঘরে ঢুকল কডন। তার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল জ্যাকের প্যান্টের পকেট থেকে নোটগুলো বার করে নেওয়া। কিন্তু কোথাও কোন নোট পেল না। এবার সে গলাটা টিপে ধরতেই জ্যাক জেগে উঠে চোখ মেলে তাকাল। সেও তখন উঠে বসে কন্ডনের হাতের কব্জিটা চেপে ধরল।

এদিকে কন্ডন এতক্ষণ বুঝতে পারেনি ঘরের মধ্যে অন্ধকারে কে খুব নিঃশব্দে পায়চারি করে বেড়াচ্ছিল অশান্তভাবে। এবার তার লোমশ হাতদুটো কন্ডনের ঘাড়ের উপর পড়তেই সে চমকে উঠল।

কন্ডন এবার তার হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে জ্যাকের মুখের উপর একটা ঘুষি মারল। সঙ্গে সঙ্গে আকুৎ তাকে বিছানা থেকে টেনে এনে মেঝের উপর ফেলে দিল। কন্ডন একটা অদ্ভুত গর্জন শুনতে পেল। তার গলাটা কে এক হাতে ধরে তার মুণ্ডুটা ঘোরাচ্ছে। ব্যাপারটা বুঝতে না বুঝতেই চোখে অন্ধকার দেখতে দেখতে সব চেতনা হারিয়ে ফেলল সে আর তার প্রাণহীন দেহটা মেঝের উপর ঢলে পড়ল।

এবার বিছানা থেকে লাফিয়ে উঠল জ্যাক।

মহা বিপদে পড়ল জ্যাক। একে ঘরের মধ্যে মৃতদেহ। মাথার উপর ঝুলছে খুনের দায়! তার উপর। নোটের বান্ডিলটাও খুঁজে পেল না। হোটেলের ভাড়া মেটাবে তারও কোন উপায় নেই। বাড়ি ফিরবে তার জাহাজ ভাড়াও নেই। জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে জ্যাক দেখল ঘরের পাশে একটা গাছ রয়েছে, তার ওপাশ থেকেই জঙ্গল শুরু হয়েছে। সে আকুৎকে তার অনুসরণ করতে বলে জানালা থেকে বিড়ালের মত লাফ দিয়ে গাছটার ডালে গিয়ে উঠে জঙ্গলে চলে গেল।

ফরাসী সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন আর্মন্দ জ্যাক নামে একজন অফিসার মরুভূমির মাঝখানে একটা তালগাছের তলায় পা ছড়িয়ে বসেছিল। সেনাদলের কাছে সাদা পোশাক পরা পাঁচজন আরব দস্যু বন্দী। অবস্থায় বসেছিল। বন্দীদের মধ্যে তাদের সর্দার আচমেত বেন হুদিনও ছিল। এই দস্যুদের ধরার জন্য এক সপ্তা ধরে প্রচুর বেগ পেতে হয়েছে আর্মন্দ জ্যাককে।

সহসা একদল আরব ঘোড়া ছুটিয়ে সোজা ফরাসী সেনাদলের শিবিরের দিকে এগিয়ে আসতে লাগল। একজন ফরাসী সার্জেন্ট এগিয়ে গিয়ে আগন্তুক দলের প্রধানকে ক্যাপ্টেন আর্মন্দের কাছে নিয়ে এল। আগন্তুকের নাম শেখ অরম বেন খাতুর।

আর্মন্দ বলল, বল কি ব্যাপার।

খাতুর বলল, আচমেত বেন হুদিন আমার বোনের ছেলে। তুমি যদি তাকে আমার হাতে ছেড়ে দাও তাহলে সে আর কখনো এ কাজ করবে না।

ক্যাপ্টেন বলল, তা সম্ভব নয়। তাকে আমি সঙ্গে করে নিয়ে যাব। বিচারে দোষী সাব্যস্ত হলে তাকে মরতেই হবে।

যাবার সময় শেখ বলে গেল, মনে রেখ আজ রাতেই আমার বোনের ছেলে পালাবে।

রাগে কাঁপতে কাঁপতে সার্জেন্টকে ডাকল আর্মন্দ। বলল, এই কালো কুকুরটাকে নিয়ে যাও এখান থেকে। আর রাত্রিবেলায় শিবিরের কাছে কোন আরবকে দেখামাত্র গুলি করবে।

এই ঘটনাটা ঘটে তিন বছর আগে। তখন আচমেত হুদিনের বিচার হয় এবং তাতে তার প্রাণদণ্ড কার্যকরী হয়। আর তার এক মাস পরেই ক্যাপ্টেন আর্মন্দের সাত বছরের মেয়ে জা জ্যাক রহস্যজনকভাবে অন্তর্হিত হয়। আরবরা তাকে চুরি করে নিয়ে যায়।

একটি উপনদীর ধারে গভীর জঙ্গলের মধ্যে তালপাতার ছাউনিওয়ালা কুড়িটি কুঁড়ে ঘরে ভরা একটি গাঁ ছিল। সেই কুঁড়েগুলোর মাঝখানে একটা ফাঁকা জায়গায় আধডজন চামড়ার তাঁবুতে কতকগুলো আরব অস্থায়ীভাবে বাস করত।

আরবদের সেই তাঁবুগুলোর একটিতে সেদিন দশ বছরের একটি মেয়ে তার পুতুলের জন্য ঘাসের একটি জামা তৈরি করছিল। তার চোখদুটো এবং মাথার চুলগুলো ছিল কালো এবং গায়ের রংটা ছিল ফর্সা। তার নাম ছিল মিরিয়েম।

জীবনে প্রথম আফ্রিকার জঙ্গলে রাত কাটানোর অভিজ্ঞতাটা কখনো ভুলতে পারবে না জ্যাক।

সকালে সূর্য উঠতে তার মনে আশা জাগল নতুন করে। রাত্রিতে একটা গাছের ডালে আকুতের গায়ে গা দিয়ে রাত কাটিয়েছে। সকাল হতেই জ্যাক আকুৎকে ডেকে বলল, ওঠ, আমার খুব ক্ষিদে পেয়েছে। কিছু খাবারের সন্ধান করতে হবে।

একদিন নদীর ধার দিয়ে যেতে যেতে হঠাৎ তারা একটা আদিবাসীদের গায়ের সামনে এসে হাজির হলো। কতকগুলো ছেলেমেয়ে গায়ের সামনেই ফাঁকা জায়গাটায় খেলা করছিল। কিন্তু ছেলেগুলো জ্যাককে দেখেই ভয়ে গাঁয়ের ভিতর পালিয়ে গেল। তাদের ভয়ার্ত চীৎকার শুনে গাঁয়ের পুরুষ যোদ্ধারা অস্ত্র হাতে বেরিয়ে এল।

ব্যাপার দেখে আকুৎ একটা গাছের উপর উঠে পড়েছে। সে জ্যাককে পালাতে বলল, জ্যাকও হতাশ হয়ে জঙ্গলের দিকে ছুটে পালাতে লাগল। নিগ্রো যোদ্ধারাও তাকে তাড়া করল। কিন্তু জ্যাক গাছের উপর উঠেই আকুতের সঙ্গে গাছের ডালে ডালে জঙ্গলের গভীরে চলে গেল। নিগ্রোরা জঙ্গলের ভিতরে অনেক দূর গিয়ে তাদের খোঁজ করতে লাগল। জ্যাক আকুতের সঙ্গে না গিয়ে গাছে গাছে তাদের অনুসরণ করতে লাগল। সে যখন দেখল নিগ্রো যোদ্ধারা অনেকটা এগিয়ে পড়েছে এবং তাদের একজন একা পিছিয়ে পড়েছে তখন সে গাছের উপর থেকে হঠাৎ লোকটার ঘাড়ের উপর অতর্কিতে লাফিয়ে পড়ে তাকে মাটিতে ফেলে দিয়ে তার গলাটা জোরে টিপে ধরল। শ্বাসরোধ হয়ে লোকটা মারা গেলে সে তার সবকিছু কেড়ে নিয়ে আবার গাছের উপর উঠে পড়ল। তার বর্শাটা হাতে নিল। পরনের চামড়ার কৌপীনটা পরল। ছুরিটা কোমরে গুঁজে নিল। তারপর আকুতের কাছে সেই বেশে গিয়ে হাজির হয়ে গর্বের সঙ্গে বলল, আমি শুধু আমার হাত আর দাঁত দিয়ে একটা লোককে খুন করেছি।

আকুতের সঙ্গে জ্যাক কিছুদূর যাবার পর হঠাৎ কিসের গন্ধ পেল বাতাসে। গন্ধ শুঁকে জ্যাক বুঝতে পারল একদল মানুষ আসছে। তার মনে হলো শ্বেতাঙ্গরা নিশ্চয় কোন বন্দরের দিকে যাচ্ছে। আনন্দে অন্তরটা লাফিয়ে উঠল জ্যাকের।

ধীর গতিতে এগিয়ে আসা দলটাকে জ্যাকই প্রথমে দেখতে পেল। গাছের উপর থেকে সে দেখল সামনে একদল নিগ্রো যোদ্ধা আসছে আর তাদের পিছনে একদল পিঠে মালের বোঝা নিয়ে ধীর গতিতে পথ হাঁটছে। মালবাহী লোকগুলোর দু’ধারে দু’জন ইউরোপীয় শ্বেতাঙ্গ হাতে চাবুক নিয়ে তাদের সঙ্গে হাঁটছে আর মাঝে মাঝে চারদিকে ভয়ে ভয়ে তাকাচ্ছে।

জ্যাক এগিয়ে গেল শ্বেতাঙ্গদের লক্ষ্য করে। জ্যাককে দেখার সঙ্গে সঙ্গে ভীতিসূচক এক চীৎকার ফেটে পড়ল একজন শ্বেতাঙ্গ। সঙ্গে সঙ্গে সে রাইফেল উঁচিয়ে জ্যাককে লক্ষ্য করে গুলি করল। গুলিটা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে একটা গাছের ডালে লাগল।

ব্যাপার দেখে জ্যাক গাছের আড়ালে সরে গিয়ে গাছের উপর উঠে পড়ল। আসলে ঐ দু’জন ইউরোপীয় শ্বেতাঙ্গ হলো কার্ল জেনসেন আর সেভেন মলবিন। ওরা হাতির দাঁতের অনেক বোঝা নিয়ে। আরবদের ভয়ে আতঙ্কিত হয়ে পথ হাঁটছিল।

শেখদের গাঁ থেকে কার্ল জেনসেন আর মলবিন শিবির গুটিয়ে চলে যাবার পর থেকে দু’ছর কেটে গেছে। তখন শেখ বাড়িতে ছিল না। কি একটা কাজে বিদেশে গেছে।

এদিকে জ্যাক আর আকুৎ ক্রমাগত বাঁদর-গোরিলাদের সন্ধানে ঘুরে বেড়াতে লাগল বনের মধ্যে। জ্যাক বর্শা ছেঁড়া শিখে বর্শা দিয়ে চিতাবাঘ, হরিণ, জেব্রা প্রভৃতি শিকার করতে লাগল। পথে যেতে যেতে এইভাবে শিকারের অভিজ্ঞতা বেড়ে যেতে লাগল তার।

একদিন রাত্রিবেলায় একটা বিরাট গাছের উপর শুয়ে ঘুমোচ্ছিল ওরা দু’জনে। এমন সময় জয়টাকের শব্দে দু’জনেরই ঘুম ভেঙে গেল, আকু বলল, বাঁদর-গোরিলাদের ঢাকের শব্দ। ওরা দমদম নাচ নাচছে। এস কোরাক, আমাদের জাতির লোকদের কাছে এস।

কিছুদিন হলো জ্যাকের এক নতুন নাম রেখেছে আকুৎ। জ্যাককে আজকাল কোরাক বলে ডাকে। আকুৎদের ভাষায় কোরাক’ শব্দের মানে হলো হত্যাকারী। ওরা দমদম নাচের বাজনার শব্দ অনুসরণ করে এগোচ্ছিল। কিছুটা গিয়ে ওরা আবার গাছের উপর উঠে ডালে ডালে যেতে লাগল।

নাচের জায়গাটার কাছাকাছি গিয়ে আকুৎ একটা শব্দ করতেই বাঁদর-গোরিলাদের রাজা এগিয়ে এল। আকুৎ বদরদলের রাজাকে বলল, আমি হচ্ছি আকুৎ, বাঁদরদলের রাজা ছিলাম। আর এর নাম কোরাক, এর বাবা টারজান বদরদলের রাজা ছিল। আমরা তোমাদের দলেই থাকব, তোমাদের সঙ্গে শিকার করে বেড়াব, শত্রুদের সঙ্গে লড়াই করব।

বাঁদরদলের নবনির্বাচিত রাজা আকুৎ ও কোরাককে একবার দেখে নিল। ওদের দেখে মনে মনে ভয় হলো রাজার। সে গর্জন করতে করতে বলল, তোমরা চলে যাও, তা না হলে তোমাদের মেরে ফেলব।

কোরাকের মনটা খারাপ হয়ে গেল। সে আকুতের পিছনে দাঁড়িয়েছিল। সে চীৎকার করে বলল, আমি কোরাক। আমি হচ্ছি মহা হত্যাকারী। আমি চলে যাব ঠিক, তবে যাবার আগে দেখিয়ে দিয়ে যাব আমি আমার পিতা টারজনের মতই শক্তিশালী এবং আমি তোমাদের বা তোমাদের রাজাকে ভয় করি না।

বাঁদর-গোরিলাদের রাজা কোরাকের কথা শুনে বিস্ময়ে অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর কোরাকের দিকে গর্জন করতে করতে এগিয়ে এল। কোরাক একটা জোর লাফ দিয়ে বাঁদররাজাকে আক্রমণ করল। সে হাত দুটো বাড়িয়ে কোরাকের গলাটা ধরতে এলে দুটো হাতের ঘুষি সজোরে এক সঙ্গে রাজার তলপেটে মারল। যন্ত্রণায় চীৎকার করতে করতে সে পড়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে অন্য সব বাঁদর গোরিলাগুলো তাদের রাজাকে মারার জন্য কোরাককে একযোগে আক্রমণ করার জন্য এগিয়ে আসতে লাগল। আকুৎ তখন কোরাককে কাঁধে চাপিয়ে একটা গাছের উপর উঠে পড়ল। তারপর ডালে ডালে লাফিয়ে বনের গভীরে চলে গেল। বাঁদর-গোরিলাগুলো কিছুক্ষণ ধরে তাদের পিছু পিছু তাড়া করে গেলেও তাদের ধরতে পারল না।

যেতে যেতে কোরাক দেখল একটা তাঁবুর সামনে একটি শ্বেতাঙ্গ বালিকা বসে একটা পুতুল নিয়ে খেলা করছে আপন মনে। তা দেখে মুখে হাসি ফুটে উঠল কোরাকের, হাতের উদ্ধত বর্শাটা নামিয়ে নিল।

হঠাৎ কোরাক দেখল গাঁয়ের বাইরে কিসের গোলমাল শোনা যাচ্ছে। দেখল গাঁয়ের সর্দার একজন বুড়ো আরব শেখ লোকজন ও উটসমেত দীর্ঘদিন পর গাঁয়ে ফিরল বলে গাঁয়ের লোকেরা সবাই ছুটে দেখতে যাচ্ছে তাকে।

কোরাক দেখল, একজন বৃদ্ধ শেখ কুঁড়েটার দিকে এগিয়ে আসছে। তার মনে হলো ঐ শেখই হয়ত মেয়েটির বাবা।

শেখ এসেই মেয়েটিকে লাথি মেরে ফেলে দিল। তারপর তার অভ্যাসমত সে মেয়েটিকে আবার ধরে হাত উঁচিয়ে মারতে গেল। কোরাক আর স্থির থাকতে পারল না। গাছ থেকে হঠাৎ ঝাঁপিয়ে পড়ে শেখের পাশে এসে দাঁড়াল। তার বা হাতে বর্শা থাকা সত্ত্বেও সে শুধু তার ডান হাত দিয়ে সজোরে ঘুষি মারল শেখের মুখে। অচৈতন্য ও রক্তাক্ত অবস্থায় মাটিতে লুটিয়ে পড়ল শেখ।

এবার মেয়েটির দিকে তাকাল কোরাক। মেয়েটি কোরাককে বলল, ও চেতনা ফিরে পেলেই আমাকে মেরে খুন করবে।

সে আরবী ভাষায় কথাটা বলল। কোরাক তা বুঝতে পারল না। মেয়েটি তখন কোরাকের কাছে এসে তার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ভয়ে কাঁপতে লাগল। মেয়েটির চোখে জল দেখে বিচলিত হয়ে সে মেয়েটির গায়ে হাত বুলিয়ে বলল, এস আমাদের সঙ্গে। তুমি আমাদের সঙ্গে জঙ্গলেই বাস করবে।

আকুৎ একটু দূরে ছিল। আকুৎ দেখল কোরাক একটা মেয়েকে কাঁধে করে বয়ে আনছে। কোরাক আকুতের কাছে এসে বলল, এ আমাদের সঙ্গে যাবে।

কিন্তু আকুতের কাছে এসেই ভয় পেয়ে গেল মিরিয়েম। কিন্তু যখন দেখল আকুৎ তার কোন ক্ষতি করছে না তখন আর ভয় করল না তাকে। ওরা মিরিয়েমকে সঙ্গে নিয়ে চলতে লাগল।

এর পর কয়েক মাস ওদের তিনজনের জীবনে বিচিত্র কোন কিছু ঘটলা না। প্রথম প্রথম অসুবিধা হলেও মিরিয়েম আজকাল বন্যজীবনের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে পেরেছে।

মিরিয়েম যাতে কিছুটা আরামে ও নিরাপদে ঘুমোতে পারে তার জন্য কোরাক একটা মাচা তৈরি করেছিল একটা গাছের উপর।

ওরা দিনের বেলায় যখন শিকার করতে যেত তখন মিরিয়েম তার পুতুলটাকে নিয়ে একা একা খেলা করত আর বনের যত সব ছোট ছোট বাঁদরগুলো তার চারদিকে কিচিরমিচির করত।

একদিন কোরাক আর আকুৎ যখন শিকার করতে গিয়েছিল তখন সে একা একাই খেলা করছিল বাঁদরগুলোর সঙ্গে। দিনের শেষে তার মনে হলো কোরাক আর আকুৎ আসছে। সে ভাবল আজ ঘুমিয়ে থাকার ভান করে সে ঠকাবে কোরাককে।

মিরিয়েম তাই চুপচাপ শুয়ে রইল চোখ বন্ধ করে। কিন্তু চোখ খোলার সঙ্গে সঙ্গে মিরিয়েম দেখল একটা বাঁদর-গোরিলা তাকে হাত বাড়িয়ে ধরতে আসেছ। তার পিছনে আর একটা বাঁদর-গোরিলা। সে তখন লাফ দিয়ে উপরের ডালে উঠে গিয়ে এডাল ওড়াল করে বেড়াতে লাগল। বাঁদর-গোরিলা দুটোও তাকে ধরার জন্য পিছু পিছু তাড়া করল।

এইভাবে এডাল ওডাল করতে করতে গিয়ে একবার একটা সরু ডাল মিরিয়েম ধরতেই ডালটা ভেঙ্গে গেল। আর সঙ্গে সঙ্গে মিরিয়েম মাটিতে পড়ে গেল।

তখন বড় গোরিলাটা মিরিয়েমের অচেতন দেহটাকে কাঁধের উপর তুলে নিয়ে চলে গেল।

শিকার থেকে ফিরে এসে কোরাক দেখল গাছের মাচার উপর মিরিয়েম নেই। আর চারদিকে বাঁদরগুলো কিচিরমিচির করছে। কতকগুলো বাদর বনের একটা দিকে ছোটাছুটি করছে। কোরাক বুঝল বাঁদরগুলো মিরিয়েমের বন্ধু। তার দিকে ছুটছে সেইদিকে নিশ্চয় কেউ মিরিয়েমকে নিয়ে পালিয়েছে।

কোরাকও সেই দিকে গাছে গাছে তীরবেগে যেতে লাগল। কিছুদূর গিয়ে দেখল একটা বাঁদর গোরিলা মিরিয়েমের অচেতন দেহটা কাঁধের উপর তুলে নিয়ে পালাচ্ছে।

কোরাককে দেখে বাঁদর-গোরিলাটা বুঝল কোরাক তার শিকার ছিনিয়ে নিতে এসেছে। সে তাই মিরিয়েমের অচেতন দেহটাকে মাটির উপর নামিয়ে রেখে কোরাককে আক্রমণ করল। কিন্তু তার আগেই কোরাক অতর্কিতে তাকে ধরে তার ঘাড়ে একটা জোর কামড় বসিয়ে দিয়েছে।

সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত অবস্তায় ঘাড়ে কামড় আর কয়েকটা ঘুষি খেয়ে ঘায়েল হয়ে পড়েছিল। বাঁদর গোরিলাটা। এমন সময় মিরিয়েম চেতনা ফিরে পেয়ে কোরাককে দেখেই চীৎকার করে উঠল আনন্দে। বলল, কোরাক, আমার কোরাক, ওকে মেরে ফেল। ও আমাকে নিয়ে পালাচ্ছিল।

কোরাক বর্শাটা তুলে নিয়ে তার ফলাটা তার গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে গোরিলাটার পেটের মধ্যে ঢুকিয়ে দিল। বাঁদর-গোরিলাটা আগেই ঘায়েল হয়েছিল। এবার সে রক্তাক্ত দেহে লুটিয়ে পড়ল মাটিতে।

কোরাক মিরিয়েমকে কি বলতে যাচ্ছিল। এতক্ষণে আকুও চলে আসে সেখানে কিন্তু আকুৎ তাকে ইশারায় কোন শব্দ করতে বারণ করল। ওরা কাদের পদশব্দ শুনতে পেল। প্রথমে দেখল একটা বাঁদর গোরিলা অদূরে একটা ঝোপের ভিতর থেকে মুখ বাড়িয়ে উঁকি মেরে কি দেখছে। তারপর আর একটা গোরিলাও তাই করল। এইভাবে প্রায় চল্লিশটা পুরুষ ও মেয়ে গোরিলা একে একে তাদের কাছে এসে দাঁড়াল। কোরাক বুঝল যে বাঁদর-গোরিলাটাকে ও মেরেছে এরা তারই দলের।

আকুৎ ওদের লক্ষ্য করে বলল, শক্তিশালী কোরাক তোমাদের রাজাকে হত্যা করেছে। এখন সে-ই তোমাদের রাজা। তোমাদের দলে তার থেকে শক্তিশালী আর কে আছে?

একথা শুনে বাঁদর-গোরিলারা নিজেদের মধ্যে কি বলাবলি করতে লাগল। তারপর এক যুবক শক্তিশালী বাদর-গোরিলা এগিয়ে এল কোরাকের কাছে।

বাঁদর-গোরিলাটাই প্রথমে আক্রমণ করল। কোরাক চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। গোরিলাটা তার কাছে হাত বাড়িয়ে তার গলাটা ধরতে এলেই কোরাক জোরে তার মুখে আর একটা জোর ঘুষি মারল। তার চোয়াল থেকে রক্ত ঝরতে লাগল এবং সে পড়ে গেল মাটিতে। এরপর গোরিলাটা যতবার উঠতে চেষ্টা করতে লাগল ততবারই কোরাক একটা করে ঘুষি মারতে লাগল। অবশেষে একেবারে কায়দা হয়ে পড়লে তার ঘাড় ধরে কোরাক বলল, ‘কাগোদা অর্থাৎ হার মেনেছ?

এবার বাঁদর-গোরিলাটা বলল, কাগোদা। অর্থাৎ হ্যাঁ, হার মেনেছি।

কোরাক তখন বলল, তাহলে উঠে চলে যাও। যারা আমাকে একবার দল থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে তাদের দলে গিয়ে আর রাজা হতে চাই না আমি।

কোরাক আকুতের দিকে তাকিয়ে ওদের বলল, তবে এই হবে তোমাদের রাজা।

আকুৎ দীর্ঘদিন পর তার মনের মত এক দল খুঁজে পেয়ে তাদের দলের সঙ্গে বাস করতে ইচ্ছা করছিল। কিন্তু সে বলল, কোরাককে ছেড়ে কোথাও যাবে না। সে কোরাককে ঐ দলেল সঙ্গে থাকতে বলল। কিন্তু কোরাক মিরিয়েমের কথা ভেবে রাজী হলো না।

কোরাক তাই বলল, তুমি ওদের সঙ্গে যাও আকুৎ। আমি তোমাদের কাছাকাছি থাকব। তোমরা যেখানে যাবে আমিও সেখানে যাব। তবে দলে থাকব না।

ফলে আকুৎই ওদের দলের রাজা হলো। অনিচ্ছা সত্ত্বেও আকুৎ তার দলের সঙ্গে ধীরে ধীরে চলে গেল। কিন্তু এমন সময় কোরাকের পিছনে একদল মানুষের চীৎকার শুনে পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখল একদল সশস্ত্র কৃষ্ণকায় মানুষ তাকে আক্রমণ করার জন্য এগিয়ে আসছে। মিরিয়েমের হাতে তখনো বর্শাটা ধরা ছিল।

যে গাঁ থেকে কোরাক আর আকুৎ পালিয়ে আসে এই নিগ্রোরা হলো সেই গাঁয়েরই লোক। এদের সর্দার ছিল কভু। মিরিয়েমকে দেখে কভুন্ডু তার লোকদের বলল, আমি যখন একদিন আরব বস্তিতে এক শেখের ক্রীতদাস ছিলাম তখন শেখের বাড়িতে এই মেয়েটাকে দেখেছি। একে ধরে শেখকে দিতে পারলে সে মোটা পুরস্কার দেবে।

এই বলে সে পর পর দুটো তীর মারল কোরাককে লক্ষ্য করে। তীর দুটো তার ঘাড়ে আর একটা পায়ে লাগল। কোরাক পড়ে যেতেই নিগ্রোদের সর্দার কভুন্ডু কোরাককে বধ করে মিরিয়েমকে নিয়ে পালিয়ে যাবার জন্য এগিয়ে এল।

কিন্তু এমন সময় তাদের চীৎকার ও হৈ চৈ শুনে আকুৎ তার দলবলকে নিয়ে ছুটে এল। বাঁদর গোরিলাদের এক বিরাট দল দেখে কভুডু কোরাককে ছেড়ে দিয়ে শুধু মিরিয়েমকে নিয়ে পালিয়ে গেল।

একটু সুস্থ হয়ে উঠলে মিরিয়েমের খোঁজে অবশেষে কোরাক যখন কভুন্ডুদের গাঁয়ে গিয়ে পৌঁছল তখন সন্ধ্যে হয়ে গেছে। একটা ঘরের কাছে গিয়ে সে বুঝল এই ঘরেই বন্দী আছে মিরিয়েম।

অন্ধকারে গা-ঢাকা দিয়ে ঘরটার সামনের দিকে এসে কোরাক দেখল ঘরখানার ভিতরে হাত পা বাঁধা অবস্থায় শুয়ে আছে মিরিয়েম আর ঘরের দরজার উপর একটা নিগ্রো বসে পাহারা দিচ্ছে।

কোরাক নিঃশব্দে এগিয়ে গিয়ে অতর্কিতে লোকটার গলাটা জোরে টিপে ধরল। ক্রমে তার দেহটা অসাড় হয়ে ঢলে পড়ল। কোরাক তখন ঘরে ঢুকেই মিরিয়েমের হাত-পায়ের সব বাঁধন কেটে দিল।

কিন্তু কোরাক নিঃশব্দে মিরিয়েমকে কাঁধের উপর তুলে ঘর থেকে বেরিয়ে আসতেই একটা কুকুর কোরাককে দেখেই ঘেউ ঘেউ করে উঠল। তখন সেই শব্দে গাঁয়ের লোকেরা সচকিত হয়ে ছুটে এল ঘরখানার দিকে। ততক্ষণে কোরাক মিরিয়েমকে কাঁধে নিয়ে পালিয়ে গেছে।

এরপর তারা কোরাক যে পথে গিয়েছিল সেই পথে তাড়া করল তাকে। কভুন্ডুর লোকেরা কিছুক্ষণের মধ্যেই ধরে ফেলল তাদের। তখন কভুন্ডু তাদের লোকদের বলল, আমাদের দরকার শুধু মেয়েটাকে, ওকে কেড়ে নিয়ে লোকটাকে তাড়িয়ে দাও। ওকে মারার দরকার নেই।

মিরিয়েমের হাত পা বেঁধে আবার ওকে ওরা গায়ের ভিতরে নিয়ে গিয়ে তাদের সর্দার কভুন্ডুর ঘরের মধ্যে রেখে দিল।

কিন্তু মিরিয়েম জানত না কভুন্ডু তাকে আর গাঁয়ের মধ্যে বেশি দিন রাখতে চায় না। সে শেখের কাছে দূত পাঠিয়েছে। মিরিয়েমকে তার হাতে তুলে দিলে সে কি পুরস্কার তাদের দেবে একথা জানতে চেয়েছে।

এদিকে কভুন্ডু জানতে পারেনি তার দূত কার্ল জেনসেন আর মলবিনের হাতে ধরা পড়ে। কার্লদের ক্রীতদাসদের কাছে কভুন্ডুর দূত মিরিয়েমের কথাটা ফাঁস করে দেয়। এরপর কার্লরা মিরিয়েমকে পাবার জন্য কভুন্ডুদের গায়ের দিকে রওনা হলো।

কিন্তু ওদের গায়ে গিয়ে বন্দিনী মিরিয়েম সম্পর্কে কিছু বলল না কার্লরা। তবে কভুন্ডুর সঙ্গে একথা সেকথা বলতে গিয়ে মলবিন শেখের মৃত্যুর খবরটা দিয়ে ফেলল। কভুন্ডু আশ্চর্য হয়ে মাথা চুলকাতে লাগল। মলবিন বলল, সেকি! তুমি জান না?

কভুন্ডু তখন দেখল বন্দিনী মেয়েটার আর দাম নেই। শেখের হাতে মোটা পুরস্কারের বিনিময়ে তুলে দেবার জন্যই ও রেখেছিল মেয়েটাকে। সে তাই কার্লদের বলল, তোমরা কিনবে মেয়েটাকে?

জেনসেন বলল, পথে ওকে নিয়ে যেতে আমাদের কষ্ট হবে, তাছাড়া মেয়েটা বুড়ি।

কভুন্ডু বলল, আমি তোমাদের দেখাব। ও মোটেই বুড়ি নয়, তরুণী এবং সুন্দরী।

এই বলে কভুন্ডু ওদের ঘরটার মধ্যে নিয়ে গিয়ে মিরিয়েমকে দেখল। তার বাঁধন খুলে দিল। তারপর কভুন্ডু মিরিয়েমকে বিক্রি করে ওদের শিবিরে পাঠিয়ে দিল।

ওদের কথাবার্তা মিরিয়েম বুঝতে না পারলেও একটা কথা বুঝতে পারল। বুঝল মলবিন লোকটা খারাপ এবং তার কবল থেকে জেনসেন তাকে উদ্ধার করেছে। জেনসেন তাকে বলল, যদি ও কখনো তোমার কোন ক্ষতি করতে যায় তাহলে আমাকে চীৎকার করে ডাকবে।

মিরিয়েম তখন জেনসেনকে বন্ধু ভেবে বলল, আমাকে মুক্ত করে দাও, আমি কোরাকের কাছে যাব।

কিন্তু জেনসেন বলল, তুমি নিজেকে মুক্ত করার চেষ্টা করলে শাস্তি পাবে।

রাত্রিটা শিবিরে কাটিয়ে পরদিন সকালে যাত্রা শুরু করল ওরা। এইভাবে তিন দিন কেটে গেল।

একদিন মিরিয়েমকে রেখে জেনসেন ও মলবিন শিকার করতে গেল। কিন্তু কিছুক্ষণ পরে মলবিন শিকার না করেই ফিরে এল। তাকে দেখে ভয়ে চমকে উঠল মিরিয়েম। মলবিন তাকে ধরতে গেলে জেনসেনের নির্দেশমত সে জেনসেনকে ডাকতে লাগল চীৎকার করে।

এমন সময় কার্ল জেনসেন শিকার থেকে ফিরল। মিরিয়েমের আর্ত চীৎকার সে শুনতে পেয়েছিল।

জেনসেনকে দেখেই ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল মলবিন। সে তার রিভলবারটা বার করে গুলি করল জেনসেনকে লক্ষ্য করে। জেনসেন লুটিয়ে পড়ল মেঝের উপর।

কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে তাবুর ভিতর এক লম্বা চেহারার অচেনা শ্বেতাঙ্গ ঢুকেই মলবিনের ঘাড়ের উপর হাত রাখল। শ্বেতাঙ্গ লোকটি বনের মধ্যে শিকার করতে থাকাকালে মিরিয়েমের আর্ত চীৎকার শুনে এই তাঁবুতে এসে হাজির হয়। সে মিরিয়েমকে জিজ্ঞাসা করল, ব্যাপারটা কি?

মিরিয়েম আরবী ভাষায় বলল, এরা আমাকে জোর করে ধরে নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে।

এরপর মলবিনকে দেখিয়ে মিরিয়েম বলল, এই লোকটা আমার ক্ষতি করতে যাচ্ছিল। যে লোকটা এই মাত্র মারা গেছে সে এই লোকটাকে বাধা দিতে গেলে তাকে হত্যা করে এই বদ লোকটা।

অপরিচিত শ্বেতাঙ্গ লোকটি মলবিনকে বলল, মৃত্যুই তোমার যোগ্য শাস্তি। অবশ্য আমি তোমায় এখন মারব না। তবে তোমাকে এখনি আমাদের এই দেশ ছেড়ে চলে যেতে হবে। না গেলে এর পর বুঝবে আমি কে।

মলবিন বলে গেল সেই অপরিচিত শ্বেতাঙ্গ মিরিয়েমকে বলল, তুমি একা এই জঙ্গলে কোথায় খুঁজবে তোমার সাথীকে। তার চেয়ে তুমি আমাদের সঙ্গে আমার বাড়িতে চল। সেখানে আমার স্ত্রীর কাছে থাকবে। সে তোমাকে পেয়ে খুশি হবে।

রক্তাক্ত ও ক্ষতবিক্ষত দেহে কোরাক জঙ্গলের মধ্যে এসে বেবুনদের খোঁজে এগিয়ে যেতে লাগল।

বেবুনদের রাজা কোরাককে চিনতে পেরে বলল, তুমি কোরাক। এস আমরা একসঙ্গে শিকার করব। আমি তোমার বন্ধু।

কোরাক বলল, আমি এখন শিকার করতে পারব না। গোমাঙ্গানী অর্থাৎ নিগ্রোরা আমার মিরিয়েমকে চুরি করে নিয়ে গেছে। চল আমরা একযোগে গোমাঙ্গানীদের গাঁ আক্রমণ করে মিরিয়েমকে উদ্ধার করি। তারা তাকে সাহায্য করতে রাজী হলো।

তখন একযোগে তারা সকলে মিলে কভুন্ডুদের গায়ের দিকে যাত্রা শুরু করল। পার্বত্য বেবুনদের সংখ্যা প্রায় দু’তিন হাজার হবে। ওরা যখন কভুন্ডুদের গায়ের কাছে গিয়ে পৌঁছল তখন ভর দুপুর।

বেবুনদের চীৎকার শুনে কভুন্ডুদের গায়ের নিগ্রোরা বেরিয়ে এল। মেয়েরা তাদের ছেলেদের নিয়ে গা ছেড়ে ভয়ে পালাতে লাগল।

কোরাক তখন প্রতিটা ঘর খুঁজে দেখল। কিন্তু মিরিয়েমকে কোথাও পাওয়া গেল না।

বেবুনরাও তখন ক্লান্তদেহে এক জায়গায় বসে বিশ্রাম করতে লাগল। অবশেষে মিরিয়েমকে না পেয়ে হতাশ হয়ে কিছু নিগ্রোকে বন্দী করে তাদের সঙ্গে নিয়ে গেল।

নতুন বাড়িতে এসে মিরিয়েমের দিনগুলো ভালই কাটতে লাগল। বাড়ির মালিক যে তাকে উদ্ধার করেছে তাকে সে আরবী ভাষায় বাওনা’ বলে ডাকত। মালিক ও তার স্ত্রী ইংরেজিতে কথা বলত। কিছুদিন পরে মরিসন বেনেস নামে এক ইংরেজ যুবক তাদের বাড়িতে বেড়াতে আসে জঙ্গলে শিকারের আশায়। মিরিয়েমের বেশ ভাব হয়ে যায় তার সঙ্গে।

সেদিন মিরিয়েম আর বাওনা বাংলোর বারান্দাতে বসেছিল। এমন সময় দূরে একজন শ্বেতাঙ্গ অশ্বারাহী বাংলোর গেটের কাছে এসেই বাওনাকে অভিবাদন জানিয়ে বলল, আমি দক্ষিণ থেকে আসছি। শিকার আর ব্যবসার জন্য আফ্রিকার এ অঞ্চলে এসেছি আমি। আমার লোকজন দক্ষিণাঞ্চলে এক শিবিরে আছে। আমি আপনার নাম শুনেছি। আপনার অনুমতি ছাড়া এখানে কেউ শিকার করতে পায় না। আমি কয়েক সপ্তাহ এর অঞ্চলে শিবির স্থাপন করে শিকার করতে চাই।

বাওনা বলল, আপনি তাহলে নদীর ধারে আমার খামারের কাছাকাছি শিবির স্থাপন করতে পারেন এবং সেখান থেকে শিকার করে বেড়াতে পারেন।

আগন্তুক বলল, আমার শিবির যেখানে আছে সেখানেই থাক, কারণ আমার লোকেরা বড় ঝগড়াটে।

আগন্তুক তার নাম বলল, হ্যানসন।

ক্রমে হ্যানসন পরিবারের বন্ধু হয়ে দাঁড়াল।

হ্যানসন প্রায়ই বাংলোর ফুলবাগানে এসে একা একা বেড়াত। বলত সে খুব ফুল ভালবাসে।

একদিন রাত্রিবেলায় ঘুম আসছিল না মিরিয়েমের। আজ সন্ধ্যার সময় মরিসন বেনেস তার কাছে তার প্রেমের কথাটা আবার তোলে। ফলে সেকথা ভাবতে গিয়ে ঘুমোতে পারেনি সে। সে তাই একা একা বাগানে চলে আসে। এসে দেখে হ্যানসন বাগানে এক জায়গায় শুয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে।

কিছুক্ষণের মধ্যে একটা ঘোড়ার পায়ের শব্দ শুনতে পেল মিরিয়েম। দেখল বেনেস ঘোড়ায় চেপে তার দিকে এগিয়ে আসছে। মিরিয়েম বলল, আমার ঘুম আসছে না। চল জঙ্গলে গিয়ে একটু বেড়িয়ে আসি।

ফাঁকা মাঠ পার হয়ে জঙ্গলের ধারে গিয়ে মিরিয়েম বলল, চল বনের ভিতর যাই, বনের এদিকটা বেশ ফাঁকা ফাঁকা, কোন অসুবিধা হবে না।

বেনেসের ভয় লাগলেও সে বলল, হ্যাঁ, তাছাড়া এ অঞ্চলে মানুষখেকো সিংহের বড় একটা দেখা পাওয়া যায় না।

কোরাক দেখল একজন শ্বেতাঙ্গ একজন শ্বেতাঙ্গ মেয়ের সঙ্গে কথা বলছে। কিন্তু মেয়েটি যে। মিরিয়েম এটা সে বুঝতে পারল না। তবে দেখতে পেল ঝোপের উপর একটা সিংহ ওৎ পেতে আছে। সে যাই হোক, মেয়েটিকে ক্ষুধার্ত সিংহের কবল থেকে রক্ষা করার জন্য হাতি নিয়ে অপেক্ষা করছিল সে। এবার সিংহটা হঠাৎ গর্জন করে উঠতেই তার উপর চোখ পড়ল তাদের।

মিরিয়মে ছুটে গিয়ে তার ঘোড়াটার উপর চাপতেই সিংহটা লাফ দিয়ে তাকে ধরার জন্য আর সঙ্গে সঙ্গে কোরাকও হাতির পিঠ থেকে একটা বর্শা ছুঁড়ে সিংহের একটা কাঁধ বিদ্ধ করল। মিরিয়েম ততক্ষণে ঘোড়ার পিঠ থেকে এক লাফে একটা গাছের উপর উঠে পড়েছে। বেনেসও তার ঘোড়ার উপর চড়ে তীর বেগে পালিয়ে গেল। কোরাক বর্শাটা ছুঁড়েই হাতির পিঠে চড়ে চলে গেছে।

এদিকে সিংহটা আহত হবার সঙ্গে সঙ্গে আবার প্রচণ্ডভাবে আক্রমণ করল মিরিয়েমকে। কিন্তু সে গাছের উপর উঠে যাওয়ায় তার আর নাগাল পেল না। সিংহটা তবু আবার লাফ দিতেই তার পিছন থেকে। হ্যানসন তার রাইফেল থেকে একটা গুলি করল সিংহটাকে লক্ষ্য করে। সিংহটা সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে পড়ে মরে গেল।

হ্যানসন তখন মিরিয়েমের নাম ধরে ডাকতেই মিরিয়েম গাছের উপর থেকে সাড়া দিল। বলল, এই যে, আমি এখানে। সিংহটা মরেছে?

হ্যানসন বলল, হ্যাঁ, নেমে এস। খুব বেঁচে গেছ। রাত্রিতে জঙ্গলে আর বেড়িও না। তোমার এতে শিক্ষা হওয়া উচিত।

সিংহটা মরে যেতে বেনেস ওদের কাছে এগিয়ে এল। তখন তিনজনে বাংলোর পথে রওনা হলো।

এদিকে ওদের জন্য বাংলোর বারান্দাতে তখন বাওনা অধীর আগ্রহে এবং গভীর উদ্বেগের সঙ্গে অপেক্ষা করছিল। হ্যানসনের রাইফেলের গুলির আওয়াজ শুনে তার হঠাৎ ঘুমটা ভেঙ্গে যায়। উঠে দেখে বাড়িতে মিরিয়েম বা মরিসন কেউ নেই। তাদের ঘোড়া দুটোও নেই। বাংলোর গেট খোলা।

কিছুক্ষণের মধ্যে ওরা তিনজন বাংলোতে এসে পড়ল। হ্যানসন ঘটনার যে বিবরণ দিল তাতে সন্তুষ্ট হলো না বাওনা। মিরিয়েম দেখল বাওনা খুব রেগে গেছে। বাওনা তাকে বলল, তোমার ঘরে যাও মিরিয়েম।

তারপর বেনেসকে বাওনা বলল, আমার পড়ার ঘরে এস, একটা কথা আছে।

এই বলে বাওনা হ্যানসনের দিকে মুখ ফিরিয়ে বলল, তুমি কোথায় এবং কি করে দেখলে হ্যানসন?

হ্যানসন বলল, আমি রাত্রিতে মাঝে মাঝে ফুলবাগানে এসে বসে থাকি। আজও ছিলাম। এমন সময় দেখি ওরা ঘোড়ায় চেপে দু’জনে বেরিয়ে গেল। এত রাতে এভাবে বেড়াতে যাওয়া মোটেই নিরাপদ নয় ভেবে আমিও গোড়ায় করে অনুসরণ করতে লাগলাম ওদের। তারপর ওরা যখন বনের ধারে এক জায়গায় বসে গল্প করছিল তখন হঠাৎ একটা সিংহ ওদের আক্রমণ করে। আমি তখন সিংহটাকে গুলি করে মারি।

হ্যানসন আরও বলল, সন্ধ্যের সময় প্রায়ই বাগানে আসায় ওদের অনেক কথাই শুনতে পাই। বেনেস মেয়েটিকে নিয়ে পালিয়ে যাবার একটা পরিকল্পনা করছিল। আমি বলি কি, আগামীকাল সকালে আমি যখন এখান থেকে উত্তরাঞ্চলে চলে যাচ্ছি তখন আপনি ওকেও আমার সঙ্গে যেতে বলুন।

বাওনা বলল, শুধু এই তথ্যের উপর ভিত্তি করে বেনেসের উপর আমি কোন অভিযোগ আনতে পারি না। সে আমার অতিথি।

এরপর পড়ার ঘরে গিয়ে বনেসকে বাওনা বলল, কাল সকালে হ্যানসন উত্তর দিকে রওনা হচ্ছে। সে বলছিল তুমি যদি তার সঙ্গে যাও ত সে খুশি হবে।

পরদিন হ্যানসন যখন বেনেসকে সঙ্গে করে তার শিবিরের দিকে নিয়ে যাচ্ছিল তখন বেনেস এক নীরব গাম্ভীর্যে স্তব্ধ হয়ে ছিল।

এক সময় হ্যানসন বলল, আমি হলে মেয়েটাকে কিছুতেই ছাড়তাম না। তবে এ ব্যাপারে আমার সাহায্যের যদি দরকার হয় তাহলে বলবে। মেয়েটি যদি তোমাকে ভালবাসে তাহলে অবশ্যই সে তোমার সঙ্গে যাবে।

বেনেস বলল, এখানে তা সম্ভব নয়। চারদিকে ওর লোকজন পাহারায় আছে। ধরে ফেলবে আমাদের।

হ্যানসন বলল, না ধরতে পারবে না। আমিও এ অঞ্চলে দশ বছর ধরে ব্যবসা করছি। আমারও জানাশোনা কম নেই এখানে। আমি বলছি তুমি একটা চিঠি লিখে দাও। আমি একটা লোক পাঠিয়ে দিচ্ছি। তুমি মেয়েটিকে লিখে দাও ও এসে পত্রপাঠ যেন দেখা করে তোমার সঙ্গে।

কথাটা মানতে মন চাইছিল না বেনেসের। তবু সে বুঝল হ্যানসন ঠিকই বলেছে। সে তখন একটা চিঠি লিখল মিনিয়েমকে। একটা লোক মারফৎ চিঠিটা পাঠিয়ে দিল হ্যানসন। তারপর আবার এগিয়ে চলল ওরা।

পথের ধারে একটা গাছ থেকে ওদের দেখে চিনতে পারল কোরাক। সে বুঝতে পারল বেনেস নামে ইংরেজ যুবকটাকে মেরিয়েমের মত দেখতে সেই মেয়েটির সঙ্গে ঘুরে বেড়াতে দেখেছে সে। মেয়েটা দেখতে ঠিক মিরিয়েমের মত। তাকে দেখলেই মিরিয়েমকে মনে পড়ে যায় তার। কোরাক তাই ভাবল এই যুবকরা কোথায় শিবির স্থাপন করে তা সে লক্ষ্য রাখবে।

এদিকে মিরিয়েম সেদিন সন্ধ্যায় বাংলোর বারান্দাতে অশান্তভাবে পায়চারি করছিল আর বেনেসের কথা ভাবছিল।

চাঁদের আলোয় বাগানে বেড়াতে বেড়াতে বেড়ার কাছে চলে গেল। সহসা কার চাপা পদশব্দ শুনতে পেয়ে থমকে দাঁড়ালো। সে চাঁদের আলোয় দেখতে পেল একটা নিগ্রো বেড়ার ওধার থেকে একটা চিঠি দিয়ে চলে গেল। চিঠিটা কুড়িয়ে নিয়ে সেটা পড়ে দেখল মিরিয়েম। তাতে বেনেস লিখেছে, তোমার সঙ্গে একবার দেখা না করে আমি যেতে পারছি না। কাল সকালে বনের ধারে ফাঁকা জায়গাটায় এস। একা আসবে।

পরদিন সকাল না হতেই শিবির থেকে বেরিয়ে পড়ল বেনেস ঘোড়ায় করে। বেলা ন’টার সময় সে সেই ফাঁকা জায়গাটায় পৌঁছল। এদিকে কোরাকও তাকে গাছে গাছে অনুসরণ করে সেই জায়গায় পৌঁছল। অনেকক্ষণ ধরে সেখানে অপেক্ষা করে ক্লান্ত হয়ে পড়ল বেনেস। কোরাকও গাছের উপর সমানে বসে রইল।

অবশেষে মিরিয়েমের ঘোড়াটা দেখা গেল বাংলোর গেটের কাছে। ক্রমে সে এগিয়ে এল। তার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে দুটি মানুষ।

মেয়েটি কাছে এলে তাকে চিনতে পারল কোরাক। সে-ই মিরিয়েম। তার বুকটাকে যেন কে বিদ্ধ করল। মিরিয়েম তাহলে বেঁচে আছে, মরেনি। একবার ভালব একটা বিষাক্ত তীর মেরে ইংরেজ যুবকটির প্রাণনাশ করবে সে। কিন্তু আবার ভাবল মিরিয়েম যাকে ভালবাসে তাকে হত্যা করবে না সে কখনো।

কিছুক্ষণের মধ্যেই বেনেস ঘোড়া ছুটিয়ে তার শিবিরের দিকে চল গেল। কোরাকও তাকে অনুসরণ করে শিবিরের কাছে একটা গাছের উপর উঠে বসে রইল। সে ভাবল নিশ্চয় আজ রাতে বেনেস আবার সেই ফাঁকা জায়গাটায় মিরিয়েমকে আনতে যাবে। কিন্তু সন্ধ্যে হতেই সে দেখল বেনেসের পরিবর্তে অন্য এক শ্বেতাঙ্গ এক নিগ্রো ভৃত্যকে সঙ্গে নিয়ে ঘোড়ায় চেপে রওনা হলো।

রাত্রি প্রায় নটার সময় মিরিয়েম তার ঘোড়ায় চেপে হ্যানসনের কাছে এল। বেনেসকে দেখতে না পেয়ে বিস্ময়ে অবাক হয়ে গেল সে। হ্যানসন বলল, বেনেস ঘোড়া থেকে পড়ে গিয়ে পায়ে আঘাত পেয়েছে। আজ রাতটা সে বিশ্রাম করবে। তাই আমাকে পাঠিয়ে দিল। নাও, তাড়াতাড়ি করো, তা না হলে আমরা ধরা পড়ে যাব।

পরের দিন দুপুরের দিকে ওরা বন পার হয়ে একটা নদীর ধারে এসে পৌঁছল। নদীর ওপারে একটা শিবির দেখা গেল। শিবিরটা দেখে মনে আশা হলো মিরিয়েমের। নদীটা পার হয়ে মিরিয়েম বলল, বেনেস কোথায়?

হ্যানসন শিবিরের একটা ঘর দেখিয়ে বলল, ঐ ঘরে।

কিন্তু ঘরের মধ্যে ঢুকে বেনেসকে দেখতে না পেয়ে ভয় পেয়ে গেল মিরিয়েম। হ্যানসনের মুখে এক ক্রুর হাসি ফুটে উঠল।

মিরিয়েম বুঝতে পারল হ্যানসন তাকে ঠকিয়েছে। হ্যানসন ক’দিন ধরে দাড়ি কামায়নি বলে তার মুখে বেশ দাড়ি গজিয়ে উঠেছে। এবার তার মুখপানে তাকিয়ে মিরিয়েম বেশ বুঝতে পারল আসলে এই হ্যানসনই শয়তান মলবিন।

যে নিগ্রো ভৃত্যটিকে বনের প্রান্তে দাঁড় করিয়ে রেখে মিরিয়েমের সঙ্গে দেখা করতে যায় মলবিন সে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। রাত গভীর পর্যন্ত অপেক্ষা করেও সে যখন দেখল তার মালিক হ্যানসন ফিরে এল না তখন সে একটা গাছের উপর উঠে পড়ল।

এদিকে মরিসন বেনেস সারারাত একটুও ঘুমোতে পারেনি। বেনেস বুঝতে পারল মেয়ে চুরির জন্য বাওনা অবশ্যই তাদের খোঁজ করবে। তাই সে অনিচ্ছাসত্ত্বেও শিবির তুলে দিয়ে রওনা হলো।

দুপুরের দিকে হ্যানসনের সঙ্গী সেই নিগ্রো ভৃত্যটি ঘর্মাক্ত দেহে ওদের কাছে এসে হাজির হলো। এসেই সে অন্যান্য নিগ্রো ভৃত্যদের হ্যানসনের শয়তানির কথা সব বলল।

তার কথা শুনে সবাই হ্যানসনের উপর রেগে গেল। বেনেস সব কথা শুনে হ্যানসনের বিশ্বাস ঘাতকতার কথা বুঝতে পারল। বুঝল তাকে এতখানি বিশ্বাস করা উচিত হয়নি।

সেই নিগ্রো ভৃত্যটিকে ডেকে বেনেস বলল, তোমার মালিক কোথায় গেছে তা তুমি জান? সেখানে তুমি আমাকে নিয়ে যেতে পারবে?

ভৃত্যটি বলল, হ্যাঁ, পারব মালিক। অনেক দূরে একটা বড় নদীর ধারে সে তার কিছু লোককে পাঠিয়ে দিয়ে এক নতুন শিবির গড়ে তুলেছে।

এরপর বেনেস সর্দারকে বলল, তোমরা উত্তর দিকে যাও। আমি পরে ফিরে যাব।

এদিকে কোরাক যখন গাছের উপর উঠে দেখল ইংরেজ যুবক বেনেস সকালবেলায় উল্টো দিকে যাত্রা করল তখন সে একাই মিরিয়েমকে দেখার জন্য সেই বনের ধারে ফাঁকা জায়গাটার কাছে গিয়ে হাজির হলো। কিন্তু সেখানে মিরিয়েমকে দেখতে পেল না।

মিরিয়েম মলবিনের সঙ্গে লড়াই করতে করতে হঠাৎ তার রিভলবারটা হাতে পেয়ে যায়। কিন্তু রিভলবারে কোন গুলি ছিল না। তখন মলবিন তাকে আবার ধরে ফেলে। কিন্তু নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে মলবিনের রাইফেলটা তুলে নিয়ে তার বাঁট দিয়ে মাথায় সজোরে আঘাত করতেই অচেতন হয়ে পড়ে যায় সে।

সঙ্গে সঙ্গে শিবির থেকে বেরিয়ে বনের দিকে ছুটতে থাকে মিরিয়েম। সে ভাবল আবার তার বাওনার কাছে ফিরে যাবে। কিন্তু সে অনেক দূরের ও অনেক দিনের পথ।

এই ভেবে সে আবার শিবিরের কাছাকাছি গিয়ে গাছ থেকে দেখল মুখ থেকে রক্ত মুছতে মুছতে মলবিন তার সব লোক নিয়ে শিবির থেকে বেরিয়ে গেল। শিবিরে কেউ নেই দেখে সে সোজা শিবিরের মধ্যে চলে গেল। তাঁবুর কোণে একটা বাক্সের মধ্যে কিছু গুলি, একটি বাচ্চা মেয়ের ফটো আর কিছু খবরের কাগজের কাটা টুকরো পেল। এই সব কিছু তার পকেটে ভরে নিল সে। কিন্তু তার এই ছেলেবেলাকার ফটোটা মলবিনের কাছে কি করে এল, কি করেই বা তা খবরের কাগজে ছাপা হলো তা সে বুঝতে পারল না।

এমন সময় মলবিনের গলা শুনতে পেল। ও তাঁবুর দিকে ফিরে আসছে। তখন মিরিয়েম তাঁবুর পিছন থেকে ত্রিপলটা উঠিয়ে গুঁড়ি মেরে বাইরে চলে গেল। তারপর ভৃত্যদের ঘরের পাশে যে একটা বড় গাছ। ছিল তার উপর উঠে পড়ল।

সেখান থেকে লক্ষ্য করল মিরিয়েম নদীর ঘাটে দু-তিনটে ছোট ডিঙ্গি নৌকা রয়েছে। নদীর ওপারে ঘন বন। নদীটা পার হয়ে সেই বনে যেতে পারলে সে অনেকটা নিরাপদ হবে। ভাবল এখন দিনের শেষ। অন্ধকার হলেই নদীটা পার হবে সে।

সে দেখল মলবিন আর একবার তার খোঁজ করে তার লোকদের নিয়ে দুটো নৌকায় করে ওপারে চলে গেল। একটা নৌকা রয়ে গেল।

ওদিকে মলবিন ওপারে গিয়ে লক্ষ্য রাখছিল নৌকাটার উপর। সে জানত আজ হোক কাল হোক ঐ নৌকাটা করে মিরিয়েম নদী পার হয়ে পালাবে। হটাৎ সে দেখল সত্যিই মিরিয়েম নৌকায় করে নদীর প্রায় মাঝখানে এসে পড়েছে।

তখনি মলবিন তার লোকদের নিয়ে নৌকায় চেপে মিরিয়েমের নৌকাটাকে ধরতে গেল। মিরিয়েমের নৌকাটা কূলের কাছাকাছি যেতেই নৌকা থেকে নেমেই মিরিয়েম জঙ্গলের দিকে ছুটতে লাগল। মলবিন যখন দেখল মিরিয়েমকে ধরার আর কোন উপায় নেই তখন সে তার রাইফেলটা নিয়ে তাকে লক্ষ্য করে গুলি করল। কিন্তু গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হলো। মিরিয়েম জঙ্গলের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল।

এদিকে বেনেস সেই ভূত্যকে নিয়ে নদীটার ধারে এসে পড়ল। ভৃত্যটি বলল, আমরা এসে পড়েছি মালিক। কিছুক্ষণ আগেই তারা মলবিনের রাইফেরের গুলির আওয়াজ শুনতে পেয়েছে। নদীর ধারে এসে বেনেস বলল, নদীটা পার হব কি করে?

নিগ্রো ভূত্যটি তখন নদীর কোলের কাছে একটা গাছের তলায় একটা ছোট ডিঙ্গি নৌকা দেখতে। পেল। ওরা দু’জনে নৌকাটায় উঠতেই নৌকাটা তীর বেগে ছুটে যেতে লাগল ওপারের দিকে। নদীর মাঝখানে গিয়ে বেনেস দেখতে পেল ওপারের ঘাটে একটা নৌকা থেকে কয়েকজন লোক নামছে। প্রথমে যে নামল সে হলো মলবিন।

এবার মলবিনও দেখতে পেল মাঝ নদীতে একটা নৌকাতে করে বেনেস ও একজন নিগ্রো লোক তাদের দিকে আসছে।

তাই মলবিন চীৎকার করে বলল, কি চাও?

বেনেস উত্তরে বলল, শয়তান কোথাকার, কি চাই?

এই বলে সে রিভলবার থেকে গুলি করল মলবিনকে লক্ষ্য করে। মলবিনও তার রাইফেল থেকে গুলি করল বেনেসকে লক্ষ্য করে। মলবিনের একটা গুলি বেনেসের নিগ্রো ভৃত্যটির কপালে বিদ্ধ হওয়ায় সে সঙ্গে সঙ্গে মারা গেল। বেনেসের নৌকাটা স্রোতের টানে ভেসে চলল। বেনেস আবার গুলি করল এবং তার আঘাতে নদীর ঘাটে পড়ে গেল মলবিন।

ক্রমে, নদীর বাঁকে অদৃশ্য হয়ে গেল বেনেসের নৌকাটা।

গাঁয়ের পথ অর্ধেকটা পার হবার আগেই কতকগুলো সাদা পোশাক পরা নিগ্রো পাশের কুঁড়েগুলো থেকে অকস্মাৎ লাফিয়ে উঠল। মিরিয়েম পালাবার চেষ্টা করতেই একজন তাকে ধরে ফেলল। মুখ ঘুরিয়েই মিরিয়েম দেখল তার সামনে সেই বুড়ো শেখ দাঁড়িয়ে আছে। ভূত দেখে যেন চমকে উঠল মিরিয়েম।

শেখ বলল, তাহলে আবার ফিরে এসেছ তুমি আমার কাছে। এসেছ খাদ্য আর আশ্রয়ের সন্ধানে।

মিরিয়েম বলল, না, আমি কিছুই চাই না। আমি শুধু আমার বড় বাওনার কাছে ফিরে যেতে চাই।

শেখ বলল, বড় বাওনার কাছেই তুমি তাহলে এতদিন ছিলে? বড় বাওনাই নদী পার হয়ে এখন তোমাকে খুঁজতে আসছে।

মিরিয়েম বলল, না, যে সুইডিস লোকটাকে তুমি একদিন গাঁ থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিলে এবং যে একদিন আমাকে চুরি করে নিয়ে যাওয়ার জন্য মবিদার সঙ্গে চক্রান্ত করেছিল ও হচ্ছে সেই।

সঙ্গে সঙ্গে শেখ তার লোকদের হুকুম দিল তারা যেন নদীর ধারে মলবিনকে দেখতে পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তাকে মেরে ফেলে।

কিন্তু শেখ সদলবলে নদীর দিকে যাবার আগেই মলবিন পালিয়ে যায়। সে মরেনি। বেনেসের নৌকাটা অদৃশ্য হয়ে যাবার পর সে উঠেই শেখকে দেখতে পায়। শেখকে সে দারুণ ভয় করত। তাই মুহূর্তের মধ্যে গা-ঢাকা দেয়।

মলবিনকে না পেয়ে শেখ মিরিয়েমকে বন্দী করে তার গায়ের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে।

দু’দিন ক্রমাগত পথ চলার পর শেখ তার গায়ে গিয়ে পৌঁছল।

গাঁয়ে যেতেই অনেক লোক ভিড় করে এল মিরিয়েমকে দেখার জন্য। মিরিয়েম এখন অনেকটা বড় হয়েছে।

অচৈতন্য বেনেসকে নিয়ে নৌকাটা স্রোতের টানে ভেসে চলছিল। চেতনা ফিরে পেয়ে বেনেস দেখল তখন রাত্রিকাল। আহত অবস্থায় নৌকাতে সে সম্পূর্ণ একা।

সে কোনরকমে একটু বসে হাত দিয়ে জল কেটে নৌকাটাকে কূলের দিকে নিয়ে যেতে লাগল।

কিন্তু বনের কাছে কোন রকমে যেতেই একটা সিংহের গর্জন শুনতে পেল সে। তার মনে হলো সিংহটা নদীর পারে যেন তারই জন্য দাঁড়িয়ে আছে। কুলের কাছে একটা গাছের ডাল দেখতে পেয়ে নৌকার উপর থেকে ডালটা ধরে ফেলল বেনেস। কিন্তু নৌকাটা থেকে পা দুটো তুলতেই নৌকাটা স্রোতের টানে চলে গেল। সে ঝুলতে লাগল। একবার ভাবল নদীতেই সে ঝাঁপ দেবে। কিন্তু পায়ের কাছে একটা কুমীরের হাঁ দেখে ভয়ে হিম হয়ে গেল সে। এমন সময় তার হাতের উপর একটা মাংসল বস্তু অনুভব করল। সঙ্গে সঙ্গে কে যেন তাকে ধরে গাছের উপর তুলে নিল।

এদিকে কোরাক বনের মাঝে হাতির দল নিয়ে ঘুরতে ঘুরতে সেই গাছটার উপর শুয়েছিল। সেদিন সে এই গাছটার উপর যখন শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল তখন একটা সিংহের ডাকে তার ঘুম ভেঙ্গে যায়। সে দেখতে পায় নদীর পাড়ে একটা সিংহ গর্জন করছে আর নদীর উপর সেই গাছটার একটা ডাল ধরে একটা লোক ঝুলছে। লোকটা অসহায় ভেবে সে তাকে গাছের উপর তুলে নেয়।

বেনেস ভাবল একটা উলঙ্গ গোরিলা তাকে ধরেছে। সে রিভলবারটা খাপ থেকে বার করে গুলি করতে যাচ্ছিল এমন সময় কে তাকে মানুষের ভাষায় জিজ্ঞাসা করল, কে তুমি?

বেনেস বলল, হা ভগবান! তুমি মানুষ? আমি ত ভেবেছিলাম তুমি গোরিলা।

কোরাক বলল, তুমি কে?

বেনেস বলল, আমি এক ইংরেজ। নাম বেনেস। কিন্তু তুমি কে?

কোরাক বলল, আমাকে ওরা কোরাক বলে, তার মানে হত্যাকারি। আচ্ছা তুমিই কি সেই লোক যে বনের ধারে ফাঁকা জায়গাটায় একটি মেয়েকে নিয়ে গল্প করছিলে আর ঠিক তখনি একটা সিংহ তোমাদের আক্রমণ করে?

বেনেস বলল, হ্যাঁ।

এখানে কি করছিলে?

মেয়েটিকে চুরি করে নিয়ে গেছে। আমি তাকে উদ্ধার করার চেষ্টা করছি।

কোরাক আশ্চর্য হয়ে বলল, কে তাকে চুরি করেছে?

কোরাককে তখন সব কথা খুলে বলল বেনেস। হ্যানসনের শিবিরটা কোথায় তাও বলল।

কোরাক তখন বলল, আমি তার শিবিরে যাচ্ছি।

এই বলে কোরাক রওনা হয়ে পড়ল গাছ থেকে নেমে। কোরাক অনেক দূর চলে গেলে বেনেস তার পিছু পিছু যেতে লাগল। বেনেস হঠাৎ তার পিছনে একটা ঘোড়ার খুরের শব্দ শুনে পাশের একটা ঝোপে লুকিয়ে রইল। আড়াল থেকে দেখল সাদা আলখাল্লা পরা একটা আরব ঘোড়া ছুটিয়ে চলে গেল উত্তর দিকে। কিছুক্ষণ পর আবার অনেকগুলো ঘোড়ার খুরের শব্দ শুনতে পেল। কিন্তু এবার আর পথের ধারে লুকোবার কোন ঝোপ বা আড়াল পেল না।

বেনেস যখন পথ থেকে সরে যাচ্ছিল তখন আরবরা ঘোড়া থেকে নেমে তাকে ধরে ফেলল। তারা আরবী ভাষায় বেনেসকে কি বলল। কিন্তু বেনেস তা বুঝতে পারল না। তখন আরবদের সর্দার দু’জনকে হুকুম দিল তারা যেন বেনেসকে বেঁধে শেখের বাড়িতে নিয়ে যায়। বাকী আরব অশ্বারোহীরা কোরাকের খোঁজে চলে গেল।

ততক্ষণে বেনেসের নির্দেশমত কোরাক সেই নদীটার ধার দিয়ে চলতে চলতে হ্যানসনের শিবিরটার উল্টো দিকে এসে পড়েছে। কিন্তু নদীটা পার হবে কি করে? এমন সময় একটা হাতির ডাক শুনতে পেয়ে তাকে ডাকল কোরাক।

হাতিটা কাছে এলে কোরাক বলল, আমাকে নদীটা পার করে ঐ শিবিরে নিয়ে চল।

কোরাককে হুঁড় দিয়ে পিঠে তুলে সাঁতার কেটে নদী পার হয়ে শিবিরে নিয়ে হাজির হলো হাতিটা।

হ্যানসন তখন আহত অবস্থায় বাইরে শুয়েছিল। হাতিটা তার দিকে এগিয়ে যেতে থাকলে সে ভয় পেয়ে গেল।

কোরাক হাতিটাকে সেখানে থামতে বলে পিঠের উপর থেকে হ্যানসনকে জিজ্ঞাসা করল, মেয়েটি কোথায়?

হ্যানসন শুয়ে শুয়েই বলল, এখানে কোনো মেয়ে নেই।

কোরাক বলল, শ্বেতাঙ্গ মেয়েটি কোথায়? মিথ্যা কথা বলো না। তুমি তাকে তাদের বন্ধুদের কাছ থেকে ভুলিয়ে এনেছ।

মলবিন বলল, আমি নই, বেনেস নামে একজন ইংরেজ তাকে চুরি করে লন্ডনে নিয়ে যেতে চেয়েছিল।

কোরাক বলল, আমি তার কাছ থেকেই আসছি। মেয়েটি তার কাছে নেই। সে আমাকে পাঠিয়েছে। মেয়েটিকে নিয়ে যাবার জন্য। মিথ্যা কথা বলো না।

এই বলে হাতির পিঠ থেকে নেমে মলবিনের কাছে এগিয়ে গেল ভীতিবিহ্বল ভঙ্গিতে।

মলবিন বলল, আমার কোন ক্ষতি করো না, আমি তোমাকে সব কথা খুলে বলছি। মেয়েটিকে আমি এখানেই এনেছিলাম। কিন্তু সে নদী পার হয়ে পালিয়ে যায়। পরে শেখের হাতে ধরা পড়ে। আমি তাকে উদ্ধার করতে গেলে শেখ আমাকে তাড়িয়ে দেয়।

কোরাক আশ্চর্য হয়ে বলল, সে তাহলে শেখের মেয়ে নয়? তাহলে কার মেয়ে?

মলবিন বলল, তুমি তাকে আগে খুঁজে বার করো। তারপর আমি সব বলব। কিন্তু আমাকে যদি মেরে ফেল তাহলে তার কথা কিছুই জানতে পারবে না।

কোরাক বলল, আমি এখন শেখের গাঁয়ে যাব। সেখানে সে না থাকে ফিরে এসে তোমাকে হত্যা করব।

মলবিনকে দেখার পরই হাতিটার মনে সন্দেহ জাগে। তখন সে তার দেহটা শুঁকে বুঝতে পারল এই লোকটাই কয়েক বছর আগে তার সাথীকে হত্যা করে। হাতিরা কখনো তাদের শত্রুকে ভোলে না, সে তাই একবার রাগে গর্জন করে মলবিনের দেহটা শুড় দিয়ে জড়িয়ে ধরে তাকে তুলে নিল। মলবিন ভয়ে চীৎকার করে কোরাককে বলল, আমাকে বাঁচাও, মেরে ফেলল।

কোরাক ছুটে এসে হাতিটাকে বিরত করার চেষ্টা করলেও হাতিটা তার গুঁড় থেকে মলবিনকে মাটিতে ফেলে দিয়ে পা দিয়ে মাড়িয়ে দিল। তারপর তার রক্তাক্ত মাংসপিণ্ডটা তাঁবুর উপর ছুঁড়ে ফেলে দিল।

শেখের বাড়িতে বেনেসকে বেঁধে তার লোকেরা ধরে নিয়ে গেলে শেখ বেনেসকে ফরাসী ভাষায় জিজ্ঞাসা করল, কে তুমি?

বেনেস বলল, আমি লন্ডনের মরিসন বেনেস।

শেখ বলল, তুমি আমার দেশে কি করছিলে?

বেনেস বলল, তার বাড়ি থেকে অপহৃতা এক তরুণীর খোঁজ করছিলাম আমি। পথে তোমার লোকেরা আমাকে ধরে।

শেখ বলল, তরুণী? তবে কি এই মেয়েটা?

মিরিয়েম তখন তাদের পিছনের সেই তাঁবুরই এক দিকে বসেছিল। তাকে চিনতে পেরে বেনেস ডাকল, মিরিয়েম।

মুখ ঘুরিয়ে মিরিয়েম বলল, মরিসন!

বেনেস বুঝতে পারল না মিরিয়েম হ্যানসনের কাছ থেকে এখানে কিভাবে এল।

শেখ তখন তার লোকদের বেনেসকে একটা ঘরে বন্দী করে রাখার হুকুম দিল। তারা হাত দুটো বেঁধে একটা ঘরে নিয়ে গিয়ে মেঝের উপর ফেলে দিল।

এমন সময় বেনেস শুনতে পেল পাশের ঘরে একজন পুরুষের সঙ্গে মিরিয়েমের জোর কথা কাটাকাটি আর ধস্তাধস্তি চলছে। তা শুনে আর থাকতে পারল না বেনেস। সে অনেক চেষ্টা করার পর একটা হাতের বাঁধন খুলে ফেলল। পাশের ঘরে যাবার জন্য ঘর থেকে বার হতেই একটা নিগ্রো প্রহরী তার পথ রোধ করে দাঁড়াল।

এদিকে কোরাক তার সেই হাতির পিঠে চেপে মিরিয়েমের খোঁজে শেখের গায়ের কাছে এসে হাতির পিঠ থেকে নেমে পড়ল। তার কাছে একটা লম্বা দড়ি আর একটা ছুরি ছাড়া আর কিছু ছিল না। তারপর মিরিয়েমের খোঁজে আরবদের তাঁবুগুলো দেখতে দেখতে এগিয়ে চলল। তখন অনেক আরব খাওয়ার পর তামাক খাচ্ছিল তাঁবুর ভিতরে বসে।

শেখ তখনও ঘুমোয়নি। খাওয়ার পর মিরিয়েমকে ডাকল শেখ।

শেখ মিরিয়েমকে বলল, আমি বুড়ো হয়েছি। আর বেশিদিন বাঁচব না। আমি তাই তোমাকে আমার ভাই আলি বেন কাদিনের হাতে তুলে দিচ্ছি। তুমি এবার থেকে তারই কাছে থাকবে।

এই কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে আলি বেন মরিয়েমকে টানতে টানতে তার ঘরে নিয়ে গেল। মিরিয়েম প্রাণপণে তাকে বাধা দিচ্ছিল।

বেনেস তার ঘর থেকে বার হতেই একজন নিগ্রো প্রহরী তাকে বাধা দিল। বেনেস তাঁর গলাটা টিপে ধরতেই সে একটা ছুরি দিয়ে বেনেসের কাঁধে আঘাত করে। বেনেস তখন হাতের কাছে একটা পাথর পেয়ে তাই দিয়ে প্রহরীটার মাথায় আঘাত করতে থাকায় সে পড়ে গেল। তারপর মিরিয়েম যে তাঁবুতে ছিল সেই দিকে এগিয়ে গেল।

কোরাক তার আগেই সেই তাঁবুতে ঢুকে পড়েছে। আলি বেন তখনো মিরিয়েমের হাতটা ধরে ছিল। মিরিয়েম কোরাককে দেখার সঙ্গে সঙ্গে চিনতে পারল।

কোরাক নীরবে আলি বেনের গলাটা ধরে বুকের উপর ছুরি মারল। আলি বেনের নিষ্প্রাণ দেহটা লুটিয়ে পড়ল মেঝের উপর। এমন সময় রক্তাক্ত দেহে টলতে টলতে বেনেস ঘরে ঢুকল। তখন শেখের লোকজন খবর পেয়ে তাঁবুর দিকে ছুটে আসছিল।

কোরাক বেনেসকে দেখে চিনতে পারল। বলল, তোমরা পালিয়ে যাও।

মিরিয়েম বলল, আর তুমি?

কোরাক বলল, পরে যাব আমি।

এই বলে যারা তাঁবুতে আসছিল তাদের সঙ্গে লড়াই করতে লাগল কোরাক। বেনেস মিরিয়েমকে নিয়ে বেরিয়ে গেল।

সঙ্গে সঙ্গে দলে দলে আরবরা এসে ঘিরে ধরল কোরাককে। সে একা অনেকক্ষণ ধরে লড়াই করল অনেকের সঙ্গে। কিন্তু ক্রমে সংখ্যায় ওরা অনেক বেড়ে যাওয়ায় আর পেরে উঠল না। তখন ওরা ওর হাত পা বেঁধে শেখের কাছে ধরে নিয়ে গেল।

শেখ তার লোকদের বলল, ওকে পুড়িয়ে মার।

একজন আরব শেখকে খবর দিল গাঁয়ের বাইরে গেটের কাছে একটা হাতি ঘোরাফেরা করছে। এমন সময় কোরাক একবার চীৎকার করল অদ্ভুতভাবে এবং হাতিটাও তার উত্তর দিল। ওরা কেউ কিন্তু এর মানে বুঝতে পারল না। গাঁয়ের মাঝখানে একটা খুঁটি পোঁতা ছিল।

কোরাককে সেই খুঁটিতে বেঁধে তার পাশের কাঠের গাদায় আগুন লাগিয়ে দেয়া হলো। আগুন দাউ দাউ করে জ্বলতে জ্বলতে তার দিকে এগিয়ে আসতে লাগল। কোরাক আবার চীৎকার করে হাতিটাকে সঙ্কেত জানাল। হাতিটা ততক্ষণে প্রবল গর্জন করতে করতে কাঠের গেটটা জোরে ঠেলা দিতে গেটটা ভেঙ্গে গেল। তারপর উন্মত্তভাবে কোরাকের কাছে ছুটে গেল। তারপর শুড় দিয়ে খুঁটিটাকে জড়িয়ে ধরে তাকে পিঠের উপর তুলে নিয়ে ছুটে এসে গা থেকে বেরিয়ে যেতে লাগল। শেখ একটা রাইফেল তুলে হাটিতার সামনে পথের উপর দাঁড়িয়ে গুলি করল হাতিটাকে। কিন্তু গুলিটা লাগল না। তখন হাতিটা রেগে গিয়ে শেখকে ফেলে দিয়ে পা দিয়ে মাড়িয়ে গেল।

বেনেস আর মিরিয়েম গাঁয়ের বাইরে গিয়ে কোরাকের জন্য অপেক্ষা করছিল। তারা এক সময় দেখল হাতিটা কোরাককে পিঠে চাপিয়ে ছুটে পালাচ্ছে আর গাঁয়ের লোকগুলো ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে ছোটাছুটি করছে। এই অবসরে তারা সুযোগ বুঝে দুটো ঘোড়া নিয়ে তার উপর চেপে সোজা বড় বাওনার বাংলোর দিকে যেতে লাগল।

ওরা উত্তর দিকে ক্রমাগত সারারাত ধরে ঘোড়া ছুটিয়ে চলল। সকাল হতেই দেখল বড় বাওনা নিজেই একদল নিগ্রো যোদ্ধা নিয়ে তাদের খোঁজে এগিয়ে আসছে। বেনেসকে দেখেই রাগে কুঞ্চিত হয়ে উঠল বাওনার দুটো। কিন্তু মিরিয়েমের মুখ থেকে সব কথা না শোনা পর্যন্ত মুখে কিছু বলল না।

মিরিয়েমের কাছ থেকে সব কথা শুনে বাওনা কোরাকের জন্য চিন্তিত হয়ে উঠল।

বাওনা তখন তার প্রধান ভূত্যকে বলল, মিরিয়েম আর বেনেসকে বাংলোতে নিয়ে যাও। আমার ঘোড়াটাও নিয়ে যাও। আমি জঙ্গলে যাচ্ছি।

মিরিয়েম প্রথমে তার ঘোড়ায় করে বাওনার লোকদের সঙ্গে বাংলোর দিকে এগিয়ে চলল। কিন্তু কোরাকের কথাটা কিছুতেই ভুলতে পারল না সে। সে নিগ্রো ভৃত্যদের সর্দারকে বলল, আমি বাওনার সঙ্গে জঙ্গলে যাচ্ছি।

কিন্তু সর্দার আপত্তি জানালে মিরিয়েম ঊর্ধ্বশ্বাসে শেখের গাঁয়ের দিকে গাছে গাছে যেতে লাগল। অনেক দূর যাওয়ার পর সে বাতাসে হাতির গন্ধ পেল।

মিরিয়েম দেখল কোরাক হাতির পিঠে চেপে তার পথেই আসছে। কাছে আসতে গাছের উপর থেকে ডাকল কোরাককে। কোরাক আসতেই মিরিয়েম তার দিকে ছুটে গেল তার বাঁধন খোলার জন্য। কিন্তু হাতিটা শত্রু ভেবে খুঁড় উঁচিয়ে তেড়ে এল মিরিয়েমকে। কোরাক চীৎকার করে বলল, চলে যাও মিরিয়েম, ও তোমাকে মেরে ফেলবে।

কোরাক আবার বলল, তুমি এখন চলে যাবার ভান করো। আমি হাতিটাকে নদী থেকে জল আনতে পাঠাব। তখন তুমি এসে আমার বাঁধন খুলে দেবে।

হাতিটা প্রথমে চলে গেল। কিন্তু ওরা ভীষণ চালাক। কিছুটা যাওয়ার পর দেখল মিরিয়েম গাছ থেকে নেমে কোরাকের কাছে এল। হাতিটা যেতে যেতে হঠাৎ থেমে একবার অপেক্ষা করল। তারপর মিরিয়েমের দিকে ছুটে গেল। মিরিয়েম প্রাণ ভয়ে গাছটার দিকে ছুটে যেতে লাগল। কিন্তু হাতিটা উন্মত্ত হয়ে ছুটতে লাগল। কোরাক দেখল মিরিয়েমকে এখনি ধরে ফেলবে হাতিটা। তার বাঁচার আর কোন আশা নেই।

এমন সময় একটা গাছ থেকে এক দৈত্যাকার শ্বেতাঙ্গ হাতিটার সামনে নেমে পড়ে হাত বাড়িয়ে থামতে বলল তাকে। হাতিটা মন্ত্রমুগ্ধের মত থেমে গেল। মিরিয়েম নিরাপদে গাছে উঠে পড়ল। মিরিয়েম শ্বেতাঙ্গকে চিনতে পেরে বলে উঠল, বাওনা!

বাওনা এবার কোরাকের দিকে মুখ করে বলল, জ্যাক!

কোরাক বলল, বাবা! ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, তুমি এসে পড়েছিলে। তুমি ছাড়া আর কেউ হাতিটাকে থামাতে পারত না।

এবার টারজান নিজের হাতে জ্যাকের হাত পায়ের বাঁধন কেটে মুক্ত করে দিল।

হঠাৎ হাতিটা চীৎকার করে তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করল। ওরা সবাই দেখল বনের একদিক থেকে কতকগুলো বাঁদর-গোরিলা টারজনের দিকে এগিয়ে আসছে। তাদের সকলের সামনে আছে আকুৎ। আকুৎ অভিবাদন জানাল টারজানকে। তাদের ভাষায় বলল, জঙ্গলের রাজা টারজান আবার ফিরে এসেছে।

বাংলোর কাছাকাছি সেই মাঠটায় পৌঁছতে ওদের দু’দিন লেগে গেল।

বাংলোতে গিয়ে টারজান তার স্ত্রী জেনকে সুখবরটা দিয়ে বলল, ছেলে আর মেয়ে দুটোকেই পাওয়া গেছে।

হারানো ছেলে আর মেয়ের মত মিরিয়েমকে ফিরে পাওয়ার আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠল জেন।

কোরাক আর মিরিয়েম আসতে দু’হাত দিয়ে দুজনকে জরিয়ে ধরল জেন। তারপর মিরিয়েমকে বলল, একটা দুঃখের বিষয় বেনেস সেই অসুখেই মারা গেছে।

জেন একবার তার ছেলের দিকে তাকাল। তার ছেলেই একদিন লর্ড গ্রেস্টোক হবে। মিরিয়েমের যোগ্যতা সম্বন্ধে কোন সন্দেহ নেই তার। সে শুধু জানতে চায় জ্যাক মিরিয়েমকে সত্যিই ভালবাসে কি না।

কিন্তু জ্যাকের চোখেই এ কথার উত্তর খুঁজে পেল জেন।

জেন বলল, আজ আমি আমার সত্যিকারের মেয়েকে পেলাম।

নিবটবর্তী কোন চার্চে বিয়েটা হবার পরই ওরা দেশে ফিরল। ওরা লন্ডনের বাড়িতে ফিরলে পর টারজনের বন্ধু দার্ণতের চিঠি নিয়ে একদিন জেনারেল আর্মন্দ জ্যাকৎ এসে দেখা করল টারজনের সঙ্গে।

জেনারেল জ্যাকৎ একটা ফটো দেখিয়ে টারজানকে তার মেয়ে চুরি যাওয়ার ঘটনার কথা সব বলল। তারপর বলল, সপ্তাহখানেক আগে আবদুল কামাক নামে এক আরব তার কাছে গিয়ে বলে তার মেয়েকে মধ্য আফ্রিকার এক আরব শেখ তার ঘরে বন্দিনী করে রেখেছে। তাই আমার মেয়ের উদ্ধারের ব্যাপারে আপনার সাহায্য চাই।

ফটোটা দেখে টারজান মিরিয়েমকে তাদের কাছে ডেকে পাঠাল।

মিরিয়েম তাদের কাছে এলে জ্যাকৎ তাকে চিনতে পারল। বলল, কিন্তু ও হয়ত আমায় চিনতে পারবে না।

এই বলে মিরিয়েমকে বলল, আমার মেয়ে, তুই আমার মেয়ে।

মিরিয়েমও এবার তার বাবাকে চিনতে পেরে বলল, আমার বাবা। এবার আমি চিনতে পেরেছি। সব কথা মনে পড়েছে আমার।

এই বলে সে তার বাবাকে জড়িয়ে ধরল। মিরিয়েম তার বাবা মাকে ফিরে পাওয়ায় তারা সবাই খুশি হলো।

টারজান ও ওপারের ধনরত্ন (টারজান এ্যাণ্ড দি জুয়েলস অফ ওপার)

লর্ড গ্রেস্টোক, ওরফে টারজান একদিন তার আফ্রিকার বিরাট জমিদারী তদারক করে ফিরে আসার পরই বাংলো থেকে দেখতে পেল একদল লোক জঙ্গল প্রান্তের ফাঁকা মাঠটা পার হয়ে তার বাংলোর দিকেই এগিয়ে আসছে।

আধ ঘণ্টার মধ্যে মঁসিয়ে ফ্রেকুলত নামে একজন ভদ্রলোক টারজনের বাংলোতে এসে বলল, আমি জঙ্গলের মধ্যে পথ হারিয়ে ফেলেছি। আমার ভাগ্যবলে আমি ঈশ্বরের বিধানে এখানে এসে পড়েছি।

ঠিক হলো মঁসিয়ে ফ্রেকুলত তার লোকজন নিয়ে কিছুদিন এই বাংলোতে থাকবে। তারপর টারজনের লোকেরা তাকে পথ দেখিয়ে দিয়ে আসবে। এইভাবে একজন ভদ্র শিকারীর ছদ্মবেশে টারজানকে ঠকিয়ে ওয়ারপার আশ্রয় পেয়ে গেল তার বাংলোতে।

ওয়ারপার আসার পর থেকে এক সপ্তাহ কেটে গেল। কিন্তু তার পরিকল্পনা কার্যকরী করার কোন উপায় খুঁজে পেল না। কিন্তু একদিন একটা ঘটনা ঘটল যাতে সে একটা আশার আলো খুঁজে পেল।

সেদিন বিকেলে টারজান জেনের সঙ্গে আলোচনা করতে লাগল তার পড়ার ঘরে বসে। ওয়ারপার বারান্দা থেকে তাদের কথাবার্তা শুনতে পেল।

টারজান বলল, এত সহজ পথ আর নেই। এখন ওপারে গিয়ে সেখানকার গুপ্তভাণ্ডার থেকে কিছু সম্পদ আনতেই হবে। তবে খুবই সাবধানে একাজ করব। ওপারের অধিবাসীরাও আমার যাওয়ার ব্যাপারটা জানতে পারবে না।

পরদিন সকালে ওয়ারপার টারজানকে বলল, সে এবার ফিরে যাবে। টারজান তাতে রাজী হয়ে গেল সঙ্গে সঙ্গে।

পরদিন ওয়ারপার তার দলবল আর একজন ওয়াজিরি পথ-প্রদর্শক নিয়ে রওনা হয়ে গেল বাংলো থেকে। কিছুদূর যাওয়ার পরই ওয়ারপার অসুস্থতার ভান করে এক জায়গায় শিবির স্থাপন করে রয়ে গেল। তারপর টারজনের ওয়াজিরি পথ-প্রদর্শককে বলল, এখন তুমি যাও। আমি সুস্থ হলে তোমাকে ডেকে পাঠাব।

ওয়ারপার তখন আচমেতের একজন বিশ্বস্ত নিগ্রো ভৃত্যকে ডেকে বলল, তুমি টারজনের গতিবিধি লক্ষ্য করে এস।

পরের দিন দূত ফিরে এসে ওয়ারপারকে বলল, টারজান তার পঞ্চাশজন ওয়াজিরি অনুচর নিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে যাত্রা করেছে সেই দিনই সকালে।

কথাটা শোনার পর আচমেত জেককে একটা চিঠি লিখে লোক মারফৎ আচমেত জেকের কাছে চিঠি পাঠিয়ে দিল। তারপর ছয়জন কুলি আর ছয়জন সাহসী বলবান যোদ্ধা সঙ্গে নিয়ে গোপনে টারজনের পিছু পিছু তাকে অনুসরণ করে যেতে লাগল একটু দূর থেকে।

সেদিন রাত্রিতে টারজান পথের ধারে লতাপাতা ও কাঁটাগাছের একটা শিবির তৈরি করে ঘুমিয়ে পড়ল।

পরদিন সকালে যখন টারজান তার দলবল নিয়ে যাত্রা শুরু করল তখন ওয়ারপারও রাত্রির বিশ্রামের পর তার শিবির থেকে তাকে অনুসরণ করার জন্য বেরিয়ে পড়ল।

অনেকটা পথ যাওয়ার পর বনের প্রান্তে এক শূন্য উপত্যকায় এসে উপনীত হলো টারজান। সেই উপত্যকাটার ওপারে অনেক সোনার গম্বুজওয়ালা ওপার নগরী। টারজান ঠিক করল রাত্রিবেলায় সে একা গিয়ে কোথায় সোনা আছে তার সন্ধান করে আসবে।

রাত্রি হতেই টারজান তার দল নিয়ে একটা পাহাড়ে উঠে পাহাড়টার ওপারে চলে গেল।

ওয়ারপার লক্ষ্য করল টারজান একটা খাড়াই উঁচু পাথরের উপর উঠে পড়ল। পরে ওয়ারপার অতি কষ্টে উঠল সেখানে।

ওয়ারপার দেখল বড় পাথরটার ওদিকে কতকগুলো পাথরের সিঁড়ি রয়েছে। সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে গিয়ে একটা অন্ধকার সুড়ঙ্গের মুখ দেখতে পেল।

এদিকে টারজান সেই অন্ধকার সুড়ঙ্গপথটা ধরে অনেকটা এগিয়ে যাবার পর একটা কাঠের দরজার সামনে এসে হাজির হলো। দরজাটা চাপ দিয়ে খোলার সঙ্গেই সঙ্গে ধনাগারটা পেয়ে গেল সে। টারজান দেখল ঘরটার চারদিকের দেওয়ালে অসংখ্য সোনার তাল সারবন্দীভাবে সাজানো আছে থরে থরে।

টারজান তার লোকদের ডাকার জন্য একবার ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। ওয়ারপার তাকে দূর থেকে লক্ষ্য করে অন্ধকারে সরে গেল।

সুড়ঙ্গপথ পার হয়ে পাহাড়টার উপরে উঠে সিংহের গর্জনের মত জোর চীৎকার করে তার ওয়াজিরি লোকদের ডাকল। কিছুক্ষণের মধ্যেই দূর থেকে ওয়াজিরি সর্দার বাসুলি চীৎকার করে সাড়া দিল তার ডাকে।

টারজান আবার সেই ধনাগারে ফিরে এসে সোনার তালগুলো বয়ে নিয়ে গিয়ে সুড়ঙ্গপথের প্রান্তে সেই পাথরটার উপর রাখল। সে ভাবল বাসুলিয়া এসে পৌঁছবার আগে যতদূর সম্ভব কাজ এগিয়ে রাখবে।

বাসুলি নগর প্রাচীরের ওধারে এসে পড়লে টারজান দড়ি দিয়ে তাদের পাথরের উপর তুলে নিল। তারপর তাদের সকলকেই ধনাগারে নিয়ে গেল। এবার টারজান ওয়াজিরিদের প্রত্যেকের হাতে সোনার তাল দিয়ে শেষ বারের মত ধনাগারটা একবার ভাল করে দেখে নিল। তারপর যে বাতিটা সে হাতে করে এই ঘরে জ্বেলেছিল সে বাতিটা নিভিয়ে দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে ঘরের দরজাটা বন্ধ করে দিল।

এদিকে টারজান ধনাগার থেকে বার হয়ে সুড়ঙ্গপথে কিছুটা এগোতেই পিছন থেকে অদৃশ্যভাবে ওয়ারপার ধনাগারে ঢুকে সেই সোনার তালগুলোকে আশ্চর্য হয়ে দেখতে লাগল।

এমন সময় অকস্মাৎ বজ্রপাতের মত জোর একটা শব্দ হলো। টারজান তখন সুড়ঙ্গপথে যাচ্ছিল। সহসা সেই জোর শব্দের সঙ্গে সঙ্গে ছাদ ভেঙ্গে একটা পাথর তার মাথার উপর পড়ায় তার মাথার কিছুটা কেটে গেল আর সঙ্গে সঙ্গে সে অচৈতন্য হয়ে পড়ে গেল মাটির উপর।

আসলে তখন অল্প সময়ের মধ্যে জোর একটা ভূমিকম্প হয়।

ওয়ারপার প্রথমে টারজনের রেখে যাওয়া মোমবাতিটা জ্বালল। তারপর বাতিটা হাতে ধরে দরজার বাইরে আসতেই দেখল টারজনের অচৈতন্য দেহটা পড়ে রয়েছে সামনে। বাতির আলোতে আরও দেখল ভূমিকম্পের ফলে সুড়ঙ্গপথে অনেক বড় বড় পাথর পড়ে থাকায় পথ একেবারে বন্ধ।

তখন ওয়ারপার নিরুপায় হয়ে ধনাগারের মধ্যে ঢুকে অন্য কোন দরজা আছে কি না তার খোঁজ করতে লাগল। হঠাৎ দেখতে পেল ঘরটার পিছন দিকের দেওয়ালে একটা দরজা আছে। সেই দরজাটা খুলে একটা অন্ধকার সুড়ঙ্গপথ পেল সে। সেই পথে যেতেই সামনে একটা পাঁচিল পেল। পাঁচিলটার ওপারেও এই পথটা নিশ্চয় চলে গেছে। এই ভেবে বাতির আলোয় ওয়ারপার দেওয়ালটা পরীক্ষা করে দেখল পাথরের কতকগুলো হঁট সাজানো আছে দেওয়ালটাতে। ওয়ারপার কতকগুলো ইট সরিয়ে তার ওপারে যাবার মত পথ করে নিল।

আবার এগিয়ে চলল ওয়ারপার। অল্প কিছুটা গিয়েই সে দেখল তার সামনে একটা ঠাকুরের বেদী রয়েছে। বেদীটা পাথরের এবং তার উপরে রক্তের দাগ রয়েছে। বুঝল এখানে অতীতের অনেক মানুষকে বলি দেয়া হয়েছে। সে আরও দেখল বেদীর পিছন দিকে কয়েকটা দরজা রয়েছে।

কিন্তু একটা দরজা খুলে ওয়ারপার বাইরে বেরোতে যেতেই এক সঙ্গে প্রায় একডজন দরজা খুলে গেল আর সঙ্গে সঙ্গে অনেকগুলো বেঁটে বেঁটে ভয়ঙ্কর আকৃতির লোক বাইরে থেকে ঢুকে পড়ল উঠোনটায়।

ভয়ে চীৎকার করতে করতে যে পথে এসেছিল সেই পথে পালাবার চেষ্টা করল ওয়ারপার। কিন্তু তার মতলব বুঝতে পেরে সেই সব ভয়ঙ্কর চেহারার পুরোহিতরা ধরে ফেলল তাকে। তারা ওয়ারপারকে বেঁধে ফেলে মন্দিরের ভিতরের দিকের ঘরটার মেঝের উপর ফেলে দিল। এরপর প্রধান পূজারিণী না। খগড় হাতে বেদীর সামনে এসে দাঁড়াল। ওয়ারপার বুঝতে পারল একটু পরেই তার দেহনিঃসৃত রক্ত ওদের অমানবিক রক্ত পিপাসা নিবৃত্ত করবে।

এমন সময় একটা ভয়ঙ্কর গর্জন শুনে চমকে উঠল ওয়ারপার। অনেকে ভয়ে পালিয়ে গেল। প্রধানা পূজারিণীর হাত থেকে খগড় পড়ে গেল, সে ওয়ারপারের পাশে মূৰ্ছিত হয়ে পড়ল। ওয়ারপার কোনরকমে পাশ ফিরে চোখ মেলে তাকিয়ে দেখল মন্দিরের মাঝখানে কোথা থেকে একটা সিংহ এসে একজন পুরোহিতকে ধরেছে।

ছাদ থেকে ধসে পড়া পাথরের আঘাতে টারজান অনেকক্ষণ মরার মত শুয়ে রইল। মাথায় জোর আঘাত লাগায় মাথা থেকে রক্তক্ষরণ হচ্ছিল তার। আর অতীতের কথা সব ভুলে গিয়েছিল সে।

ধীরে ধীরে উঠে বসল টারজান। কিন্তু এখানে কখন কিভাবে এল, সে কে তার কিছুই মনে করতে পারল না।

টারজনের কোমরে একটা থলি ছিল। সেই থলিটাতে যতগুলো পারল রংবেরঙের মণি-মাণিক্য ভরে নিল। তারপর সেই ঘরটা পেরিয়ে আবার সুড়ঙ্গ পথটা ধরে এগিয়ে যেতে লাগল। সুড়ঙ্গ পথটা যেখানে শেষ হয়েছে টারজান সেখানে গিয়ে কয়েকটা সিঁড়ি পেল। সিঁড়ি দিয়ে উঠে যেতেই একটা সিংহের গর্জন শুনতে পেল সে। সঙ্গে সঙ্গে অনেকগুলো নর-নারীর সমবেত ভয়ার্ত চীৎকার কানে এল তার। টারজান তার বর্শাটা হাতে শক্ত করে ধরল।

টারজান দেখল একটা সিংহ মন্দিরের মাঝখানে বেদীর উপর শোয়ানো হাত পা বাঁধা এক হতভাগ্য বন্দীর সামনে দাঁড়িয়ে আছে আর মন্দিরের পুরোহিত ও পূজারিণীরা প্রাণ ভয়ে ছোটাছুটি করছে। টারজান দেখল তার সামনে বেদীর ধারে একজন মহিলা পূজারিণী দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু সে যে প্রধান পূজারিণী লা তার স্মৃতিবিভ্রম ঘটায় সে বুঝতে পারল না।

ওয়ারপার হাত পা বাঁধা অবস্থায় শুয়ে শুয়ে দেখল সিংহটা তার উপর ঝাঁপ দেবার জন্য উদ্যত হয়েছে। টারজানও সঙ্গে সঙ্গে তার বর্শটা সিংহের বুকটাকে লক্ষ্য করে ছুঁড়ে দিল। সিংহটা গর্জন করতে করতে বর্শার ফলাটা নিয়ে কামড়াকামড়ি করতে করতে তার নতুন শত্ৰু টারজানকে আক্রমণ করল। এবার টারজান সিংহের উপর উঠে তার ঘাড়টা জড়িয়ে ধরে ছুরিটা বার বার তার পাঁজরে বসিয়ে দিতেই সিংহটা লুটিয়ে পড়ল।

ওয়ারপার এবার টারজানকে চিনতে পারল।

টারজান একে একে লা ও ওয়ারপারকে খুঁটিয়ে দেখল। কিন্তু সে কাউকে চিনতে পারল না।

এদিকে প্রধান পূজারিণী লা টারজনের পানে ভাল করে তাকিয়ে আশ্চর্য হয়ে বলল, টারজান তুমি? তুমি অবশেষে আমার কাছে ফিরে এসেছ?

টারজান বলল, আমি টারজান? ঠিক আছে নামটা ভালই মনে হচ্ছে। কিন্তু আমি তোমাকে চিনি না। আমি তোমার জন্য এখানে আসিনি। কেন আমি এখানে এসেছি তা আমি জানি না। কোথা থেকে এসেছি তাও জানি না।

ওয়ারপার এবার ব্যাপারটা বুঝতে পারল। বুঝল টারজনের মাথায় আঘাত লাগায় পূর্ব স্মৃতি তার একেবারে লোপ পেয়েছে।

ওয়ারপার তাই টারজনের প্রশ্নের উত্তরে বলল, কোথা থেকে তুমি এসেছ তা ত আমি বলত পারব না। তবে আমি শুধু এইটুকুই বলতে পারি যে এখান থেকে আমরা যদি এখনি বেরিয়ে না যাই তাহলে আমাদের দুজনকেই মরতে হবে।

তখন টারজান ওয়ারপারের বাঁধন কেটে দিয়ে বলল, চল তাহলে আমরা এখনি পালিয়ে যাই।

এই বলে একটা দরজা দিয়ে টারজান বার হতেই প্রতিটা দরজার মুখেই কয়েকজন করে ভয়ঙ্কর চেহারার বেঁটে বেঁটে পুরোহিত পথ আগলে দাঁড়াল। টারজনের সামনে যে লোকটা দাঁড়িয়েছিল পথরোধ করে টারজান তার বর্শা দিয়ে তার মাথায় জোর একটা আঘাত করতে তার মাথাটা ভেঙ্গে গেলে। এরপর যেই কাছে আসতে লাগল টারজান তাকেই বধ করতে লাগল।

অনেক খোঁজাখুঁজির পর নগরপ্রাচীরের মধ্যে একটা বার হবার পথ পেল টারজান। স্মৃতিবিভ্রমটা তখনো কাটেনি টারজনের। সে কে এবং কোথা থেকে এসেছে, কোথায় তাকে যেতে হবে কিছুই জানে না সে। ওয়ারপর তাকে কোনরকমে বুঝিয়ে বাংলোর পথে নিয়ে যেতে লাগল।

সেদিন রাত্রিতে তাদের ছোট্ট শিবিরে আগুনের আলোয় টারজান তার থলিটা খুলে সেই রত্নগুলো আবার দেখতে লাগল। ওয়ারপর তাকে জিজ্ঞাসা করল সে কোথায় ওগুলো পেয়েছে। টারজান তার উত্তরে বলল, ওপার নগরীর মন্দিরের তলায় একটা ঘরে সে এগুলো পেয়েছে। কিন্তু ওগুলো রংবেরঙের কতকগুলো পাথর ছাড়া আর কিছুই নয়।

ওয়ারপার দেখল টারজান ঐসব রত্নগুলোর দাম জানে না। এ বিষয়ে তার কোন ধারণা নেই। ফলে সেগুলো তার কাছ থেকে নিয়ে নেয়া সহজ হবে। ওয়ারপার টারজানকে বলল, আমাকে ওগুলো একবার দেখতে দাও।

টারজান তখন সেগুলোর উপর একটা হাত চাপা দিয়ে পশুর মত দাঁত বার করে তেড়ে এল ওয়ারপারকে।

ওয়ারপার ভাবল, সে যেমন করে হোক টারজনের দৃষ্টি এড়িয়ে আচমেত জেকের কাছে চলে যাবে। দুটো কারণে সে যেতে পারছিল না। প্রথম কথা, তার হাতে মাত্র একটা খঙ্গ ছাড়া আর কোন অস্ত্র নেই। এই ভীষণ জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে বিনা আগ্নেয়াস্ত্রে পথ চলা অসম্ভব। তাছাড়া মূল্যবান ধাতুগুলো ছেড়ে যেতে মন সরছিল না তার।

ওপার থেকে বার হবার পর তিন দিনের দিন টারজান পথে যেতে যেতে তাদের পিছন দিক থেকে আসতে থাকা কিছু লোকের পায়ের শব্দ শুনতে পেল।

ঝোপের আড়াল থেকে তারা দেখল পঞ্চাশজন কৃষ্ণকায় নিগ্রো দুটো করে হলুদ রঙের সোনার তাল বয়ে নিয়ে আসছে। ওয়ারপর তাদের দেখে বুঝতে পারল এই লোকগুলোকেই টারজনের সঙ্গে ওপার নগরীর পথে যেতে দেখেছে সে। কিন্তু সে দেখল টারজান বাসুলি ও ওয়াজিরিদের চিনতে পারল না।

ওয়ারপার ভাবল, ওয়াজিরিরা ঠিক টারজনের বাংলোর দিকে যাবে এবং সোনার তালগুলো বাংলোর কাছাকাছি কোথাও রাখবে। সেই জায়গাটা ও দেখে নেবে। তাহলে আচমেত জেককে নিয়ে এসে সেই সোনা সহজেই উদ্ধার করে নিয়ে যেতে পারবে।

এইভাবে অনেকক্ষণ ধরে অনুসরণ করে বাংলোটার কাছে গিয়ে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল ওয়ারপার। বাংলোটার এখানে সেখানে কিছু ধ্বংসস্তূপ ছাড়া আর কিছুই দেখতে পেল না সে। বিরাট খামারবাড়িরও কোন চিহ্ন নেই। সে যেন নিজের চোখকে নিজেই বিশ্বাস করতে পারছিল না। কিন্তু টারজান কিছুই চিনতে পারল না।

বাংলোর কাছে গিয়ে তার অবস্থা দেখে বাসুলি আর ওয়াজিরিরাও হতবুদ্ধি হয়ে গেল।

বাসুলি তার লোকদের বলল, আরবরাই নিশ্চয় এ কাজ করেছে।

একজন ওয়াজিরি বলল, আমাদের লেডী কোথায়?

টারজনের স্ত্রী লেডী গ্রেস্টোককে তারা লেডী বলত। বাসুলি বলল, আমাদের মালিকের স্ত্রী ও আমাদের স্ত্রীদের ধরে নিয়ে গেছে আরবরা।

ওয়াজিরিরা তখন প্রতিশোধ বাসনায় উন্মত্ত হয়ে উঠল।

বাসুলি বলল, এখন কাজের সময় বৃথা চীৎকার করে লাভ নেই। এখন কিছু খাওয়ার পর আরবদের সন্ধানে বেরিয়ে যেতে হবে আমাদের। নইলে আমাদের স্ত্রীদেরও উদ্ধার করতে পারব না।

বনের আড়াল থেকে টারজান আর ওয়ারপার দেখল বাংলোর কাছে একটা বড় খাল কেটে সোনার তালগুলো সব পুঁতে রাখল ওয়াজিরিরা। তারপর একটা অস্থায়ী শিবির গড়ে তুলে বিশ্রাম করতে লাগল।

টারজান অনেকক্ষণ অপেক্ষা করল। তারপর যখন বুঝল ওয়ারপার সত্যি সত্যিই ঘুমিয়ে পড়েছে। তখন মাটি খুঁড়ে তার মধ্যে রত্নভরা থলিটা রেখে মাটি চাপা দিয়ে দিল। ওয়ারপার তা দেখল।

অনেকক্ষণ পর ওয়ারপার চোখ মেলে তাকিয়ে দেখল টারজান ঘুমিয়ে পড়েছে। তখন সে তার খড়টা দিয়ে সেই জায়গার মটি খুঁড়ে থলিটা বার করে নিয়ে নিজের পকেটে ভরে রাখল।

ওয়ারপার একবার ভাবল যাবার আগে তার হাতের খটা দিয়ে ঘুমন্ত টারজনের গলাটা কেটে দিয়ে যাবে।

এই ভেবে ঘুমন্ত টারজনের গলার উপরে তুলে ধরল তার হাতের খাটা।

এদিকে মুগাম্বিও আরবদের খোঁজে পথ চলে চলে শিবিরের কাছে এসে দেখে ওয়ারপার ছেঁড়া ময়লা পোশাক পরে হাঁপাতে হাঁপাতে সেই গাছের তলা দিয়ে শিবিরের দিকে যাচ্ছে। প্রথমে সে ওয়ারপারকে দেখেই চিনতে পারে। এই শ্বেতাঙ্গই তাদের মালিক বড় বাওনার বাড়িতে একদিন অতিথি হিসেবে ছিল। তাকে দেখে ডাকতে যাচ্ছিল সে।

কিন্তু মুগাম্বি যখন দেখল ওয়ারপার স্বচ্ছন্দে আরবদের শিবিরে ঢুকে গেল এবং শিবিরে সবাই তাকে চেনে তখন সে বুঝতে পারল আসলে সে বিশ্বাসঘাতক। সে খবর দেয়াতেই বড় বাওনার অনুপস্থিতিতে আরবরা বাংলো আক্রমণ করে তাদের প্রভুপত্নীকে ধরে নিয়ে আসে এবং বাংলো আর খামারটা পুড়িয়ে ছারখার করে দেয়।

আচমেত জেকের তাঁবুতে ওয়ারপার ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে তাকে দেখে আশ্চর্য হয়ে গেল আচমেত। বলল, কি ব্যাপার?

ওয়ারপার টারজনের কাছ থেকে যে মুক্তোর থলিটা চুরি করে আনে তার কথা ছাড়া যা যা ঘটেছিল সব বলল। থলিটা সে সাবধানে লুকিয়ে রেখেছিল। সোনার তালগুলো বাংলোর পাশে ওয়াজিরিরা পুঁতে রেখেছে শুনে আচমেতের লোভ বেড়ে গেল। ওয়ারপার আরো জানাল ওয়াজিরিরা তার শিবির আক্রমণ করতে আসছে।

আচমেত বলল, আগে ওরা