তুরাইফ তার বাহিনী নিয়ে সিউটার উপকূলে এসে পৌঁছলে জুলিয়ান শাহীমহল থেকে বের হয়ে এসে তাকে রাজকীয় অভ্যর্থনা জানালেন। তিনি তুরাইফকে বললেন, ‘শাহীমহলে চলুন, সেখানে এক শাহীকামরায় আপনার থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
‘কাউন্ট জুলিয়ান!’ সেনাপতি তুরাইফ বললেন। আমাদের সেনাপতি তার আয়ত্তাধীন কোন সিপাহীর তুলনায় নিজেকে উত্তম ও উচ্চ মর্যাদার অধিকারী মনে করে না। তাই সে অন্যদের থেকে পৃথক ও উন্নত ব্যবস্থাকে নিজের জন্য অসমীচীন মনে করে। যুদ্ধের ময়দানে সেনাপতি ও সিপাহী একই মর্যাদার অধিকারী হয়ে থাকে। আমাদের ধর্ম মানুষের উঁচু-নীচুর ভেদাভেদ সমর্থন করে না। আপনি যদি আমাদেরকে নামায পড়তে দেখেন তাহলে আপনি পার্থক্য করতে পারবেন না, কাতারে কাতারে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ানো মুসলমানদের মাঝে কে উচ্চপদস্থ ফৌজী, আর কে সাধারণ সিপাহী? কখনও এমনও হয় যে, আমাদের অধীন সাধারণ কর্মচারী সামনের কাতারে দাঁড়ায়, আর আমরা পিছনের কাতারে দাঁড়াই। সেনাপতির সৌভাগ্য শুধু এই যে, তিনি ইমামতির দায়িত্ব আঞ্জাম দিয়ে থাকেন।
‘আপনারাই আন্দালুসিয়া বিজিত কতে সক্ষম হবেন। জুলিয়ান উত্তেজিত কণ্ঠে বলে উঠলেন। এটাই হল ইসলামের শক্তির সেই উৎস, যা আপনি বর্ণনা করলেন, অথচ আমাদের সেনাপতি তার অধীন সিপাহীকে ব্যক্তিগত চাকর মনে করে। তারপরও আমি বলব, আমার মহলের দরজা আপনার জন্য সর্বদা উন্মুক্ত থাকবে।’
কয়েক দিন পরের কথা। এক রাতের আঁধারে জুলিয়ানের ফৌজ এবং তুরাইফের নেতৃত্বাধীন সৈন্যবাহিনী পালতোলা রণতরীতে আরোহণ করল। কিছুক্ষণের মধ্যেই রণতরী আন্দালুসিয়ার উদ্দেশ্যে সিউটার সমুদ্রসৈকত ত্যাগ করবে।
জুলিয়ান তার স্ত্রী ও দুই কন্যা–ফ্লোরিডা ও মেরীকে সাথে নিয়ে সৈন্যদেরকে বিদায় জানানোর জন্য এসেছিলেন। তারা রণতরী থেকে নেমে তীরে উঠে এলো। ফৌজ রওনা হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত ফ্লোরিডা তার বাবার জন্য এক বিরাট সমস্যা হয়ে দাঁড়াল। সে চাচ্ছিল, পুরুষালী পোশাক পরিধান করে সৈন্যদের সাথে আন্দালুসিয়া আক্রমণে অংশ গ্রহণ করবে। সে তার বাবার যুদ্ধবর্ম ও ঢাল-তলোয়ার বের করে এনেছিল। কিন্তু জুলিয়ান তাকে যুদ্ধে যাওয়ার অনুমতি দিচ্ছিল না। তার মাও তাকে বাধা দিচ্ছিল।
ফ্লোরিডা চিৎকার করে বলছিল, আমি কি শাহসওয়ার নই? আমি কি ঢাল-তলোয়ার চালনা করতে জানি না? আমি কি বর্ষা নিক্ষেপ করতে পারি না? আমার ধনুক থেকে নিক্ষিপ্ত তীর কি কখনও নিশানা দে করতে ব্যর্থ হয়েছে?’
বাবা-মা উভয়ে তাকে এই বলে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন যে, তারা সবকিছুই জানেন, কিন্তু দুশমন যখন ঢাল-তলোয়ার আর বর্ষা নিয়ে ময়দানে অবতীর্ণ হয় তখন আত্মরক্ষা করে চতুর্দিকে খেয়াল রেখে, দুশমনের আঘাত প্রতিহত করা এবং তাকে প্রতিঘাত করা অত্যন্ত কঠিন কাজ। যুদ্ধের উত্তেজনাপূর্ণ মুহূর্তে দক্ষ তীরন্দাজের ধনুক থেকে নির্গত তীরও নিশানা ভেদ করতে ব্যর্থ হয়। লড়াই করে মৃত্যুবরণ করা পুরুষের কাজ; মেয়েদের কাজ নয়।
‘শ্লীলতাহানী আমার হয়েছে, ফ্লোরিডা চিৎকার করে বলল। “অত্রব আন্দালুসিয়ার উপর প্রতিশোধমূলক প্রথম আঘাত আমাকেই হানতে হবে।’
ফ্লোরিডা যখন কারো কথাই শুনছিল না তখন জুলিয়ান তাকে এ প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষান্ত করেন যে, মুসলমানরা যখন রডারিককে পরাজিত করবে তখন আমি মুসা বিন নুসাইরের নিকট আবেদন করব, তিনি যেন রডারিককে জীবিত গ্রেফতার করে তোমার হাতে সোপর্দ করে। তখন তুমি তাকে নিজ হাতে হত্যা করতে পারবে।’
বাবার প্রতিশ্রুতি পেয়ে ফ্লোরিডা কিছুটা শান্ত হল। অবশেষে জুলিয়ান মুসলিম সেনাপতি আবু যারুআ তুরাইফ-এর সাথে সাক্ষাৎ করতে এলেন। সেখানে তিনি মুসলিম সেনাপতির সাথে ফ্লোরিডাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন। তখন ফ্লোরিডা শেষ সুযোগ মনে করে তুরাইফকে এই বলে বারবার অনুরোধ করতে লাগল, যেন তিনি তার বাবার কাছ থেকে তার যুদ্ধে যাওয়ার ব্যাপারে অনুমতি আদায় করে দেন।
“তোমার বাবা হয়তো তোমাকে অনুমতি দিয়ে দেবেন, সেনাপতি তুরাইফ বললেন। কিন্তু আমি তোমাকে কিছুতেই অনুমতি দেব না। কারণ, আমরা এমন এক জাতি, যারা আপন স্ত্রী-কন্যার ইজ্জত ও সম্মানের জন্য হাসি মুখে জীবন উৎসর্গ করতে পারে। সুতরাং তোমার মতো একজন নারীকে যুদ্ধের ময়দানে দুশমনের সামনে পাঠানো আমাদের পক্ষে কীভাবে সম্ভব হবে?
সেনাপতি তুরাইফের কথা শুনে ফ্লোরিডার যুদ্ধে যাওয়ার শেষ আশাটুকুও নিঃশেষ হয়ে গেল।
সমুদ্রপথের দূরত্ব ছিল মাত্র বার মাইল। জুলিয়ানের রণতরীর নাবিকরা ছিল অত্যন্ত দক্ষ ও চৌকস। সমুদ্র ছিল প্রশান্ত, আর বাতাস ছিল অনুকূলে। বাতাসের আনুকূল্য পেয়ে পালোলা রণতরী পানিতে ছলাৎ ছলাৎ আওয়াজ তুলে সুতীব্র বেগে গন্তব্যের দিকে এগিয়ে চলল। নাবিকরা কাঙ্ক্ষিত সময়ের পূর্বেই জুলিয়ানের সৈন্যবাহিনীকে আন্দালুসিয়ার সমুদ্রসৈকতে পৌঁছে দিল। সৈন্যবাহিনীর নেতৃত্ব ছিল আউপাসের হাতে।
***
রাতের অর্ধ প্রহর। যুদ্ধ সাজে সজ্জিত রণতরী আন্দালুসিয়ার দক্ষিণ দিক একটি ছোট্ট শহর মেয়দিনস্পনুর বন্দরে নিঃশব্দে নোঙর ফেলল। শহরের বাসিন্দারা তখন গভীর ঘুমে অচেতন। সমুদ্র সন্নিকটবর্তী ফৌজি চৌকিগুলোতে সৈন্যরা অনেকক্ষণ হয় ঘুমিয়ে পড়েছে। যে সকল সৈন্যের পাহারার দায়িত্ব ছিল তারা কোথাও বসে কোথাও দাঁড়িয়ে ঝিমুচ্ছে। তাদের কোন ভয় ছিল না। তারা জানত, সিউটা হল আন্দালুসিয়ার প্রবেশ মুখ। আর সেই প্রবেশ মুখে আছে বড় মজবুত দুর্গ। আর আছে জুলিয়ানের অতন্দ্র প্রহরী সৈন্যবাহিনী।