আবদুল আযীয বিদ্রোহ সৃষ্টির অপরাধে নব্বইজন খ্রিস্টান এবং কয়েকজন ইহুদি নেতা ও তাদের সহযোগীদেরকে হত্যা করেন। ইউরোপিয়ান ঐতিহাসিক লেনপুল ও এইচপি স্কাট তাদের রচনায় আবদুল আযীযের বিরুদ্ধে অনেক বিষোদগার করেন। তারা লেখেন, বিদ্রোহীরা মাত্র ত্রিশজন আরব প্রশাসককে হত্যা করেছিল। প্রতিশোধ হিসেবে আবদুল আযীয প্রায় একশজন খ্রিস্টান ও ইহুদিকে হত্যা করেন। এ সকল লোকদের মধ্যে বেশ কয়েকজন খ্রিস্টান পাদ্রি ও ইহুদি রাব্বী (ইহুদিদের ধর্মীয় নেতা) অন্তর্ভুক্ত ছিলেন।
এজেলুনা আবদুল আযীযকে সবিস্তারে বলেছিল যে, ইহুদিরাই বিদ্রোহের পেছনে ইন্ধন যোগাচ্ছে। তারা মুসলমানদেরকে সবচেয়ে বড় দুশমন মনে করে। মুসলমানদেরকে সাহায্য করার কারণে ইহুদিদেরকে অনেক জায়গির প্রদান করা হয়েছিল। আবদুল আযীয ইহুদিদের থেকে সমস্ত জায়গির ছিনিয়ে নেন এবং সরকারি পদ ও পদবী থেকে তাদেরকে বঞ্চিত করেন। খ্রিস্টানদের শাসনামলে ইহুদিরা যতটা লাঞ্ছিত ও ধিকৃত ছিল, মুসলমানদের শাসনামলে তার চেয়েও বেশি লাঞ্ছনা ও গঞ্জনার শিকারে পরিণত হল। মূলত ইহুদি সম্প্রদায় এমনই লাঞ্ছনা-গঞ্জনার উপযুক্ত ছিল।
যেসকল শহরে বিদ্রোহ দানা বেঁধে উঠছিল, আবদুল আযীয সেসকল শহরে গিয়ে চিরণী অভিযান পরিচালনা করেন এবং অপরাধীদেরকে কঠোর হস্তে দমন করেন। ফলে সকল বিজিত শহর বিদ্রোহীদের কর্মকাণ্ড থেকে মুক্ত হয়ে যায়।
৮. আফ্রিকার সম্মানিত আমীর
০৮.
আফ্রিকার সম্মানিত আমীর মুসা বিন নুসাইরের আন্দালুসিয়া আগমনের কথা শুনে তারিক বিন যিয়াদ অত্যন্ত খুশী হন। আনন্দের আতিশয্যে তিনি সবাইকে ডেকে বলছিলেন:
‘আমার আধ্যাত্মিক নেতা সম্মানিত মুসা বিন নুসাইর আন্দালুসিয়া এসে পড়েছেন। এখন আমি আমার মাঝে আরও বেশি করে আধ্যাত্মিক শক্তি অনুভব করছি। আমি আমার মনিবের পদতলে টলেডুর সওগাত পেশ করতে চেয়েছিলাম। এখন আমি আন্দালুসিয়ার আরও বিস্তৃত অঞ্চল তার কদম মুবারকে পেশ করব।’
এ সময় তারিক বিন যিয়াদ টলেডুতে অবস্থান করছিলেন। টলেডুর আশ-পাশের যেসব অঞ্চল তখনও বিজিত হয়নি, সেগুলো সম্পর্কে তিনি সব ধরনের তথ্য সংগ্রহ করে নিয়েছিলেন। তার সামনে ছিল তিনটি বড় ও গুরুত্বপূর্ণ শহর–মায়েদা, মায়া ও গ্ল্যাশিয়া। তারিক বিন যিয়াদ এই শহর তিনটি বিজিত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। সামনে অগ্রসর হওয়ার জন্য তিনি যে রাস্তা নির্বাচন করেন, সেটি ছিল অসংখ্য জলাভূমিতে পরিপূর্ণ অত্যন্ত দুর্গম একটি রাস্তা।
‘কিন্তু ইবনে যিয়াদ! জুলিয়ান বললেন। সামনে অগ্রসর হওয়ার জন্য আপনি যে রাস্তা নির্বাচন করেছেন, সেটি এতটাই দুর্গম যে, সে রাস্তা অতিক্রম করা কিছুতেই সম্ভব নয়।’
‘আমি জানি, সহজ রাস্তা কোনটি। তারিক বিন যিয়াদ বললেন। আপনারও নিশ্চয় জানা আছে যে, রাস্তাটি সহজ হলেও অনেক দীর্ঘ। আমি সফরের মধ্যে এত দীর্ঘ সময় নষ্ট করতে চাই না। জলাভূমির রাস্তাটি দুর্গম হলেও গন্তব্যে পৌঁছতে অর্ধেকের চেয়েও কম সময় লাগবে। আমার বাবার মুজাহিদগণ এই দুর্গম রাস্তা সহজেই অতিক্রম করতে সক্ষম হবে। আমি আরও অনেক এলাকা বিজিত করে আমীর মুসা বিন নুসাইরের সাথে মিলিত হতে চাই। আমি তাকে এ কথা বলতে চাই না যে, আমি এ জন্য সামনে অগ্রসর হয়নি, কারণ সামনের রাস্তা ছিল অত্যন্ত দুর্গম। আমি সহজ রাস্তা অনুসন্ধান করছিলাম।’
‘সম্মানিত বন্ধু আমার!’ আউপাস বলল। এই রাস্তা এতটাই ভয়ঙ্কর যে, অনেক সিপাহীর প্রাণহানীও ঘটতে পারে। এই সম্ভাবনাও আছে যে, সৈন্যবাহিনী গোলকধাঁধায় আটকা পড়তে পারে।’
‘আউপাস!’ তারিক বিন যিয়াদ বললেন। এমন কোন বিপদ অবশিষ্ট আছে কি, যা আমাদের সামনে আসেনি? রডারিক এক লাখ সৈন্যের এক বিশাল বাহিনী নিয়ে আমাদের উপর আক্রমণ করেছিল। তার বাহিনীর অর্ধেক ছিল অশ্বারোহী। আউপাস! এটা কি আমাদের জন্য কম বিপদজ্জনক বিষয় ছিল? সে সময় আমাদের কাছে কী ছিল? মাত্র বার হাজার সৈন্য ছিল আমাদের কাছে। তাদের মধ্যে অল্প কয়েকজন ছিল অশ্বারোহী, আর সকলেই ছিল পদাতিক। আশা করি, আপনাদের সকলেরই মনে আছে যে, টলেডোর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার কথা শুনে সকলেই চিন্তিত হয়ে পড়েছিলাম। আমি নিজে আতঙ্কিত হয়ে বলেছিলাম যে, এই শহর জয় করা এত সহজ হবে না। আমরা যদি এ কথা ভেবে বসে থাকতাম যে, আমরা মানুষের গড়া এমন দুর্ভেদ্য প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভাঙ্গতে সক্ষম হব না তাহলে এই শহরে আমরা কখনই প্রবেশ করতে পারতাম না। কিন্তু আমরা কী দেখলাম? যখন আমরা আল্লাহ তাআলার উপর ভরসা করে সামনে অগ্রসর হলাম তখন আমরা শহরের ফটক খেলা দেখতে পেলাম। আউপাস! আমরা আল্লাহর ফরমাবরদার সম্প্রদায়। আল্লাহ তাকেই পথের সন্ধান দান করেন, যে নির্ভয়ে তার পথ অবলম্বন করতে চায়।’
জুলিয়ান ও আইপাস তারিক বিন যিয়াদের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। মনে হচ্ছিল, তারা তারিক বিন যিয়াদের মস্তিষ্কের সুস্থতার ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করছিলেন।
***
তারিক বিন যিয়াদের বাহিনী জলাভূমির সীমানায় প্রবেশ করল। জুলিয়ান ও আউপাস তাদের সাথেই ছিলেন। তারিক বিন যিয়াদ টলেডুর প্রশাসনিক কাজের জন্য যেসকল প্রশাসক নিযুক্ত করেছিলেন, তাদের মধ্যে কয়েকজন ছিল ইহুদি। তারিক বিন যিয়াদ মুসলিম প্রশাসকদের মত ইহুদি প্রশাসকদেরকেও সমান মর্যাদা প্রদান করেছিলেন। তিনি ইহুদিদেরকে মুসলমানদের বন্ধু ও হিতাকাক্ষী মনে করতেন। তিনি এখনও জানতে পারেননি যে, ইহুদিরা ইসলাম বিদ্বেষের কারণে তাদের শয়তানী কর্মকাণ্ডের বিস্তার ঘটাচ্ছে এবং তারা অনেক শহরেই বিদ্রোহের আগুন জ্বালাতে সক্ষম হয়েছে।