বিশ্বের জন্য প্রোজ্জ্বল তারকা। যে তারকার আলোয় পথ দেখবে পথহারা মুসলিম জাতি।
“জী ভাইজান! আমিও এমন স্বপ্ন দেখি।” বললেন মুহাম্মদের রত্নগর্ভা মা। আমি সন্তান পেটে ধারণ করার সময় থেকে এ আশাই পোষণ করছি। নিজেকে এজন্য তৈরী করে রেখেছি, একদিন আমার বুকের ধন আমার কোল থেকে আকাশের তারকার মতো দুনিয়া জুড়ে দ্যুতি ছড়াবে।”
“আমি ওকে বসরা নিয়ে যাচ্ছি।” বললেন হাজ্জাজ। সাধারণ সৈনিক ও সামরিক প্রশিক্ষণ সে রপ্ত করেছে বটে; কিন্তু তাকে আরো উন্নত প্রশিক্ষণ নিতে হবে। তাকে এখন প্রশাসনিক কাজে যোগ দিয়ে বাস্তব অভিজ্ঞতা এবং যুদ্ধ কৌশলের বাস্তব জ্ঞান অর্জন করতে হবে। শিখতে হবে প্রশাসনিক নিয়ম-কানুন। রণাঙ্গনে গিয়ে রপ্ত করতে হবে যুদ্ধের বাস্তব জ্ঞান। এজন্য ওকে আমি সেনাবাহিনীর বিশেষ শাখায় ভর্তি করে দেবো।”
হাজ্জাজের প্রশাসনিক সদর দফতর ছিল বসরায়। তার বাসস্থান ছিল একটি রাজপ্রাসাদের মতো। হাজ্জাজের ঔরষজাত সন্তান বলতে ছিল মাত্র একটি মেয়ে। তার নাম যুবায়দা। হাজ্জাজ যখন নিজ গ্রাম তায়েফে বেড়াতে গেলেন, তখন তার একমাত্র মেয়ে বসরায়। তখন সে পূর্ণ কিশোরী। এক রাতে যুবায়দার কক্ষের জানালায় বাইরে থেকে হাল্কা টোকা মারার শব্দ হলো। যুবায়দা বিছানায় শুয়ে শুয়ে জানালায় কড়া নাড়ার শব্দ শোনার জন্য উৎকর্ণ ছিল। তাই সামান্য আওয়াজেই বিছানা ছেড়ে দাঁড়ালো সে। জানালা খুলে বাইরে উঁকি দিলো। জানালা দিয়ে বাইরে যাওয়ার জন্য দু’পা জানালায় রেখে নিজের শরীরের ভার বাইরে অপেক্ষমাণ দুটি হাতের ওপর ছেড়ে দিলো যুবায়দা।
“এখান থেকে চলে বেরিয়ে যাই সুলায়মান। দরজা ভিতর থেকে আটকানো। জানালাটি বন্ধ করে দাও।” বলল যুবায়দা।
সুলায়মান জানালার পাল্লা বন্ধ করে দিয়ে যুবায়দার হাত ধরে প্রাসাদোপম বাড়ির বাগানে ঢুকে পড়ল।
খলিফা ওয়ালিদ বিন আব্দুল মালিকের ছোট ভাই সুলায়মান। আঠারো বছরের টগবগে যুবক সে। হাজ্জাজ তনয়া যুবায়দা সুলায়মানের হৃদয়ে বাসা বেঁধেছে। যুবায়দার বয়সও ষোল বা সতের। শৈশবে একই পাঠশালায় লেখাপড়া করেছে। বেড়ে উঠেছে পাশাপাশি। শৈশবের সোনা ঝরা দিনগুলো তাদের কেটেছে একসাথে খেলাধুলা করে। কিছুটা বড় হওয়ার পর ওদের
মধ্যে দেখা সাক্ষাত কমে যায়। অবাধ মেলামেশার সুযোগ বন্ধ করে দেয়া হয়। দেখা সাক্ষাতে বদনাম হওয়ার আশঙ্কা তেমন ছিল না। শাহী খান্দানের রীতিটাই এমন ছিল। শাহী খান্দানের লোকজনদের নৈতিকতা নিয়ে কথা বলার প্রতি সাধারণদের মধ্যে তেমন আগ্রহ ছিল না। তাদের মধ্যে দেখা সাক্ষাত অবাধ মেলামেশার বড় বাধা ছিল সামাজিক ও পারিবারিক রীতি। তারচেয়েও যুবায়দার জন্য বড় সমস্যা ছিল পিতা হাজ্জাজ। কারণ স্বভাবের দিক থেকে হাজ্জাজ ঘরে বাইরে সর্বক্ষেত্রে কঠোর ও নির্মম ছিলেন তা যুবায়দাকেও প্রভাবিত করেছিল।
“এখানে লুকিয়ে ছাপিয়ে আমরা আর কতো দিন লুকোচুরি খেলব চাঁদ!” যুবায়দার উদ্দেশে বলল সুলায়মান। আবেগের আতিশয্যে যুবায়দাকে চাদ বলে ডাকে সে। আমি ভাইকে বলব যাতে আমাদের বিয়ের ব্যবস্থা করে দেয়।” “তোমার ভাই হয়তো এ বিয়ে মেনে নিতে পারেন; কিন্তু আমি জানিনা, আমার আব্বা এ বিয়েতে সম্মতি দেবেন কি-না!” বলল যুবায়দা।
“কেন সে কি আমীরুল মুমেনীনের ভাইয়ের কাছেও তার মেয়ে তুলে দিতে রাজি হবে না?” সুলায়মান জিজ্ঞাসু স্বরে বলল।
“তুমি কি তার স্বভাবের কথা জানো না? তিনি নিজের সিদ্ধান্ত নিজেই নেন। খলিফার প্রভাবে তিনি কখনও প্রভাবিত হননি।” “তিনি যদি তোমার বিয়ের জন্যে অপর কোন লোক ঠিক করেন তাহলে তুমি কি করবে?” যুবায়দাকে জিজ্ঞেস করলো সুলায়মান।
“তার হুকুম বিনা বাক্য ব্যয়ে মেনে নেব।” “আমীরুল মুমেনীনের ভাইয়ের বউ না হতে পারার জন্যে তোমার কি কোন আফসোস হবে না? আমার বউ হয়ে তুমি যে গর্ব করতে পারবে, আর কারো বউ হলে কি তুমি এতোটা গর্বিতা হবে?”
‘সুলায়মান! শৈশব থেকেই তুমি আর আমি এক সাথে বড় হয়েছি। ছোট্ট বেলা থেকেই আমি তোমাকে ভালোবাসি। এই ভালোবাসার অর্থ এই নয় যে, তখন তুমি আমীরের পুত্র ছিলে। শাহজাদা হিসাবে আমি তোমাকে ভালোবাসিনি। তোমাকে আমার ভালো লাগে তাই। তুমি যদি কোন ভিখারীর ছেলেও হতে, তবুও তোমাকে আমার ভালো লাগতো। তখন হয়তো তুমি একথা ভাবতে না, আমি কার মেয়ে।”
“একথা আমি এখনও ভাবি না যে, আমি শাহজাদা আর তুমি গভর্নরের মেয়ে।”
“তা হয়তো মনে করো না, তবে নিশ্চয়ই একথা ভাবো যে, তুমি আমীরুল মুমেনীনের ভাই। হয়তো এটাও মনে করতে পারো, তোমার এই মর্যাদা ও সম্মানের জন্য আমার গর্ব করা উচিত।”
“একথা শুনে রাখো সুলায়মান! আমি এমন পুরুষকে নিয়েই গর্ববোধ করবো, যার মধ্যে আমার প্রতি টান থাকবে, ভালোবাসা থাকবে। সে এমনটি কখনো ভাববে না, কেমন বাবার পুত্র সে, আর আমি কেমন পিতার মেয়ে।”
আজ তুমি এভাবে কথা বলছ কেন চাদ!” বাহু বন্ধনে আবদ্ধ করে আফসোসের স্বরে বলল সুলায়মান, আজকের মতো এমন একটি আনন্দঘন রাতে তুমি এভাবে কথা বলছো কেন?”
“আমি তোমার কাছ থেকে পালিয়ে যাচ্ছি না সুলায়মান! তোমাকে এড়িয়ে যাওয়ার ইচ্ছা থাকলে এভাবে রাতের আঁধারে আমি তোমার সাথে ঘরের বাইরে বের হতাম না। দেখো তুমি কি আন্দাজ করতে পারো আমি কী ভয়ংকর ঝুঁকি নিয়েছি। ভিতর থেকে দরজার খিল এঁটে আমি জানালা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এসেছি…। আজ আমি তোমাকে একথা বলতে এসেছি যে, এখন আর আমি ছোট্ট নই, আর…সুলায়মান। এ মুহূর্তে আমার মনের অবস্থা তোমাকে বোঝাতে পারবো না। যে কোন মুহূর্তে আমার কারো না কারো বউ হতে হবে। তুমি জানো আমাদের রীতিনীতি!”