শুরুতেই হাজ্জাজ খলিফা ওয়ালিদ বিন আব্দুল মালিকের দর্বলতাগুলো আঁচ করতে পেরেছিলেন। তিনি ওয়ালিদের দুর্বলতার সুযোগে নিজের অবস্থান আরো শক্তিশালী করণে মনোযোগী হলেন। বহুদিন পর একবার হাজ্জাজ জন্মভূমি তায়েফে এলেন। হাজ্জাজের আগমনের সংবাদ শুনে মুহাম্মদ বিন কাসিমের মা তার সাথে সাক্ষাতের জন্য হাজ্জাজের বাড়ি গেলেন। “আরে তুমি এলে কেন? আমি নিজেই তো তোমার সাথে দেখা করতে যাব” ছোট ভাইয়ের বিধবা স্ত্রীর উদ্দেশে বললেন হাজ্জাজ। তুমি ভেবেছিলে যে, আমি তোমার খোঁজ না নিয়ে এবং আমার ভাইয়ের আমানতের খোজ না নিয়েই চলে যাব? আমি তো ভাবছি, তোমাকে বলব, ভাইয়ের রেখে যাওয়া আমানত এখন আমার হাতে দিয়ে দাও। মুহাম্মদ কোথায়? ওকে দেখার জন্য আরো আগেই আমার আসা উচিত ছিল।”
“আল্লাহ্ আমার ভাইজানকে তাঁর রহমতের ছায়ায় রাখুন” বললেন মুহাম্মদের মা। আমি মুহাম্মদকে একটি তাজী ঘোড়া কিনে দিয়েছি। আগে সে সাধারণ ঘোড়া দৌড়াতো। এখন এমন এক ঘোড়া দিয়েছি, দক্ষ অশ্বারোহীরাই কেবল এতে আরোহণ করতে পারে। কাসিম তো এখন অনেক বড় হয়ে গেছে। তাকে এখন যুদ্ধের অশ্বারোহণ রপ্ত করা দরকার।
কে জানে ও নতুন ঘোড় নিয়ে কোথায় চলে গেছে। আল্লাহ্ করুন ও যাতে ঘোড়া বাগে রাখতে পারে, খুবই তেজী ঘোড়া।
“আল্লাহ যাতে ওকে ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে যেতে সাহায্য করেন। কারণ তাঁকে ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে পুনরায় উঠে সওয়ার হওয়াও রপ্ত করতে হবে” বললেন হাজ্জাজ। অশ্বারোহী ঘোড়ার পিঠে নয় ঘোড়ার পায়ের আঘাত খেয়েই অশ্বারোহণ রপ্ত করে। শোন বোন! ও যদি ঘোড়র পিঠ থেকে পড়ে আহত হয়ে আসে, তাহলে তাকে বুকে জড়িয়ে আহ্লাদ করো না। ওর শরীর থেকে যদি রক্ত ঝরতে দেখো, তাহলে আঁচল ছিড়ে পট্টি বেঁধে দিতে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ো না। ওকে মায়া-মমতার জালে বেঁধে ফেলো না। ওর শরীরে প্রবাহিত রক্ত ওকে দেখতে দাও, সে যাতে বুঝতে পারে কাদের রক্ত সে বংশানুক্রমে শরীরে বহন করছে।
“তুমি এখন বাড়ি যাও বোন। আমি এখনই তোমার বাড়িতে আসছি।”
কিছুক্ষণ পর হাজ্জাজ মুহাম্মদ বিন কাসিমের বাড়ির দিকে রওয়ানা হলেন। মুহাম্মদের মা হাজ্জাজের আসার খবর শুনে তাকে স্বাগত জানানোর জন্য ঘর থেকে বেরিয়ে আসলেন। হাজ্জাজ শুধু তার মৃত স্বামীর বড় ভাই নয়, প্রায় আধা মুসলিম জাহানের প্রধান শাসনকর্তা। হাজ্জাজ মুহাম্মদ বিন কাসিমের বাড়িতে প্রবেশ করতে যাবেন, এমন সময় তার কানে ভেসে এলো ধাবমান অশ্বখুরের আওয়াজ। তিনি পিছনে তাকিয়ে দেখলেন এক অশ্বারোহী তীব্র বেগে ঘোড়া হাঁকিয়ে এদিকেই আসছে। তিনি অশ্বারোহীকে দেখার জন্যে দাঁড়ালেন। মুহাম্মদ বিন কাসিমের মা হাজ্জাজের পাশেই দাঁড়ানো।
অশ্বারোহী হাজ্জাজের পাশ দিয়েই অশ্ব হাঁকিয়ে চলে গেল। সে না গতি হ্রাস করলো, না হাজ্জাজের দিকে তাকিয়ে দেখার প্রয়োজনবোধ করল। অবস্থা দৃষ্টে হাজ্জাজের চেহারায় দেখা দিলে উন্মা। স্পষ্টই তার চেহারা দেখে বোঝা যাচ্ছিল, এভাবে তার পাশ দিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে চলে যাওয়াটা তার কাছে ধৃষ্টতা মনে হয়েছে। এতে হাজ্জাজ অপমানবোধ করছেন। কারণ হাজ্জাজ ছিলেন বনী ছাকিফ গোত্রের মর্যাদাবান ব্যক্তি। তায়েফের লোকজন তাকে খুবই সম্মান করে।
“মনে হচ্ছে আমার কবিলার ছেলেরা আমাকে ভুলে গেছে।” মুহাম্মদ বিন কাসিমের মায়ের উদ্দেশে বললেন হাজ্জাজ। মনে হচ্ছে, এ ছেলেটি আমাকে ভয় দেখানোর জন্য আমার পাশ দিয়ে এভাবে ঘোড়া হাঁকিয়েছে। আচ্ছা ছোট বউ! তুমি কি চেনো ছেলেটি কে?”
“এতো আপনারই ছেলে।” বললেন মুহাম্মদের মা। এ..লতা মুহাম্মদ।
“না না। আমাদের মুহাম্মদ এতো বড় হবে কি করে? এই তো সেদিন আমি ওকে এতটুকু রেখে গেলাম।” কিছুদূর অগ্রসর হয়ে মুহাম্মদ বিন কাসিম ঘোড়া ঘুরিয়ে এপথেই ফিরে এলো। ঘোড়র গতি দেখে মনে হচ্ছিল আরোহী থামবে না। কিন্তু মা ও তারপাশে একজন প্রবীণকে দাঁড়ানো দেখে হঠাৎ ঘোড়া থামিয়ে এক লাফে অশ্বপৃষ্ঠ থেকে নীচে নেমে এলো। সে চেহারা দেখেই বুঝে নিলো ইনিই তার সম্মানিত চাচা হাজ্জাজ বিন ইউসুফ। সে দৌড়ে গিয়ে হাজ্জাজকে সালাম করল। হাজ্জাজ বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে ভ্রাতুস্পুত্রকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। জিজ্ঞেস করলেন, “তোমার ঘোড়াটা বেশ ভালো। অবশ্য আরোহী এর চেয়েও ভালো।” চাচার মুখে প্রশংসাবাণী শুনে মুহাম্মদ বলল, “ঘোড়ার গতি আপনাকে দেখানোর জন্যই আমি আগে থামাইনি। আমি আগেই আপনাকে চিনতে পেরেছিলাম।” আল্লাহর কসম! আমি তোমাকে চিনতেই পারিনি। এই বলে হাজ্জাজ বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করলেন।
“এখন তোমার ছেলে বড় হয়েছে বোন।” মুহাম্মদের মাকে বললেন, হাজ্জাজ। একে আমি সাথে নিয়ে যাচ্ছি।”
“একথা শুনে মুহাম্মদ বিন কাসিমের মায়ের চোখে অশ্রু টলমল করতে লাগল। তখনো মুহাম্মদ বিন কাসিমের বয়স আঠারোতে পৌছেনি। তার কাছে ছেলে এখনো শিশু বৈকি। মায়ের চোখে শিশু হলেও মুহাম্মদ অন্য কিশোরদের চেয়ে স্বাস্থ্য-চেহারায় সম্পূর্ণ ভিন্ন। যোল, সতের বছর বয়সের মুহাম্মদকে দেখলে মনে হয় পরিপূর্ণ এক যুবক। “প্রিয় বোন। জানি মুহাম্মদের বিরহ তোমার জন্য খুবই কষ্টকর। কিন্তু বুক বেঁধে তোমাকে এ আমানত জাতির কল্যাণে উৎসর্গ করতে হবে। মুহাম্মদ তোমার ছেলে হলেও সে ইসলামের খেদমতের জন্যে যাচ্ছে, সে শুধু তোমার সেবায় নিয়োজিত থাকবে না, সমগ্র মুসলিম উম্মাহর সেবায় নিজেকে নিবেদন করবে। সে এমন এক পিতার সন্তান যাকে পিতার পথ ধরে জাতির সেবায় অবশ্যই নিজেকে আত্মনিয়োগ করতে হবে। পিতার অবস্থানকে ডিঙিয়ে তাকে আরো বহু দূর অগ্রসর হতে হবে, তাকে হতে হবে মুসলিম