ইবনে রাবাহ। একদিন প্রধান উজিরের উদ্দেশে বললেন খলিফা। আমার সেনাবাহিনীর মধ্যে কি এমন কেউ নেই যে সেনাবাহিনীর মধ্যে নিয়ম-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনে একটি কার্যকর বাহিনীতে পরিণত করবে?
“একজন লোকের প্রতি আমি দৃষ্টি রাখছি আলীজা! বললেন উজির। তাকে একবার পরীক্ষা করে দেখতে হবে।”
“কে সেই লোক?”
“ওর নাম হাজ্জাজ বিন ইউসুফ। তায়েফের লড়াকু বংশের ছেলে সে। সে আমাদের সেনাবাহিনীতেই আছে কিন্তু পদস্থ কোন অফিসার নয় একজন সাধারণ সৈনিক। তবে সে অন্য দশজনের মতো নয়। দেখে শুনে মনে হয় ওর মধ্যে বুদ্ধিজ্ঞান আছে।” “ওকে আমার কাছে পাঠিয়ে দিন” নির্দেশ দিলেন খলিফা।
নির্দেশ পালন করা হলো। হাজ্জাজ বিন ইউসুফ খলিফার সামনে দণ্ডায়মান। হাজ্জাজের চেহারা সুরত তীক্ষ দৃষ্টি ও অঙ্গ-ভঙ্গিতেই খলিফা হাজ্জাজের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে গেলেন।
“ইবনে ইউসুফ! তুমি যদি আমার একটি নির্দেশ বাস্তবায়ন করে দেখাতে পারো তাহলে তোমাকে আমি অনেক বড় পদে পদোন্নতি দেব।”
“কি হুকুম, আমীরুল মুমেনীন।” বলল হাজ্জাজ।
“সেনাবাহিনীকে আমি এমনভাবে প্রস্তুত দেখতে চাই যে, আমি কোন দিকে রওয়ানা হওয়ার সাথে সাথে তারা আমার পিছু পিছু ঘোড়া ছুটাবে। আমার যেন সেনাদের প্রস্তুতির জন্যে অপেক্ষা করতে না হয়। আমি কোথাও যাওয়ার আগে আগে তোমাকে জানাবো।”
সেকথার দুদিন পর খলিফা মালিক বিন মারওয়ান হাজ্জাজকে ডেকে বললেন, “অল্পক্ষণের মধ্যেই আমি বের হবো। অমুক অমুক ইউনিট আমার সফরসঙ্গী হবে।” উজির রূহ বিন রাবাহও তার নিরাপত্তা রক্ষীদের নিয়ে আমার সহগামী হবে। বললেন খলিফা।
এটা ছিল হাজ্জাজ বিন ইউসুফের জন্যে একটা পরীক্ষা। তখন সেনারা ছিল শিবিরে। খলিফার নির্দেশ পেয়ে হাজ্জাজ সেনা শিবিরে গিয়ে বললেন, “আমীরুল মুমেনীনের বাহন সফরের জন্য বের হচ্ছে, অমুক অমুক সেনা ইউনিটকে অশ্বারোহণ করে আমীরুল মুমেনীনের সফরসঙ্গী হতে হবে। হাজ্জাজ দেখলেন, উজির তার সেনা শিবিরে তখনও এসে পৌছেনি। দু’তিনজন কমান্ডারও শিবিরে ছিল না। সৈন্যদের কেউ গল্পগুজবে লিপ্ত। আর কেউ খানা পাকানোর কাজে ব্যস্ত। হাজ্জাজের কথা তাদের কারো কানে গেছে বলে মনে হলো না। হাজ্জাজ চিৎকার করে শিবিরময় তাড়া করছিলেন।
এসো হাজ্জাজ। হাজ্জাজকে তাচ্ছিল্যের স্বরে আহবান করলো এক সিপাহী। শুধু শুধু কেন গলা ফাটিয়ে চেচাচ্ছো? এসো খানা খাও!”
হাজ্জাজ হাতের কাছে পাওয়া একটি হান্টার উঠিয়ে খাবারে আহবানকারী সেনাকে পেটাতে শুরু করলেন। এরপর যে সৈনিককেই বসা দেখলেন, তাকেই হান্টার দিয়ে কয়েক ঘা পিটুনি লাগালেন এবং বললেন, আমি আমীরুল মুমেনীনের নির্দেশ শোনাচ্ছি।” কিন্তু এরপরও সৈন্যদের মধ্যে রওয়ানা হবার কোন তৎপরতা দেখতে না পেয়ে কয়েকটি ছাউনীতে আগুন ধরিয়ে দিলেন। অগ্নি সংযোগকৃত ছাউনীগুলোর একটি ছিল উজিরের নিজস্ব সেনা ইউনিটের। ওদের একজন দৌড়ে গিয়ে অগ্নিসংযোগের জন্যে উজিরের কাছে হাজ্জাজের বিরুদ্ধে অভিযোগ করল। হাজ্জাজের তৎপরতায় উদ্দিষ্ট সেনা ইউনিট নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই প্রস্তুতি সম্পন্ন করে খলিফার সহগামী হলো। কিন্তু উজির তার ইউনিট নিয়ে আসার পরিবর্তে খলিফার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। উজির অভিযোগের স্বরে বললেন
“আমীরুল মুমেনীন! হাজ্জাজ আমার ছাউনীসহ কয়েকটি সেনা ছাউনীতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। কয়েকজন সেনাকে পিটিয়েছে। আমীরুল মুমেনীন নিশ্চয়ই তাকে এমন কোন নির্দেশ দেননি!”
খলিফা হাজ্জাজকে ডেকে পাঠালেন। “একথা কি ঠিক যে তুমি কয়েকটি সেনা ছাউনীতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছো?” জিজ্ঞেস করলেন খলিফা।
“আমীরুল মুমেনীন! আমার মতো গোলামের কি করে এমন দুঃসাহস হবে যে সেনা ছাউনীতে আগুন ধরিয়ে দেবো? আমি কোন ছাউনীতে আগুন দেইনি।
“তুমি কি কয়েকজন সেনাকে প্রহার করোনি?” “জি-না আমীরুল মুমেনীন। আমি কাউকে প্রহার করিনি।”
খলিফাকে জ্বলন্ত ছাউনী দেখানো হলো, সেই সাথে প্রহৃত সেনাদের শরীর খুলে তাদের আঘাত দেখানো হলো।
“ইবনে ইউসুফ! তুমিই যদি না করে থাক, তাহলে কে এসব ছাউনীতে আগুন দিলো, আর কে এদের প্রহার করলো? “আগুন আপনি দিয়েছেন আমিরুল মুমেনীন! আপনিই সেনা ছাউনীতে আগুন দিয়েছেন। আর আপনিই সেনাদের প্রহার করেছেন।”
“চুপ করো! গর্জে উঠলেন খলিফা। কিসব প্রলাপ বকছো। তুমি কি পাগল হয়ে গেছো?”
“আমীরুল মুমেনীন! যা কিছু ঘটেছে, আপনার নির্দেশে ঘটেছে” বললেন হাজ্জাজ। আপনি সেনাবাহিনীকে গতিশীল তড়িৎকর্মা দেখতে চাচ্ছিলেন। এটাই ছিল একমাত্র পন্থা যা দিয়ে আমি আপনার নির্দেশ বাস্তবায়ন করতে পেরেছি। তখন আমার মুখের নির্দেশ ছিল আপনার নির্দেশ, অ, আমার হাতের হান্টার ছিল আপনার হাতের হান্টার। ছাউনীতে ধরানে আগুনও আপনার দেয়া আগুন ছিল, এসন দিয়েই আমি আপনার নির্দেশ বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হয়েছি।”
আল্লাহর কসম! এমন লোকেরই আমার দরকার আবেগাপ্লুত কণ্ঠে বললেন খলিফা। এই ঘটনার পর খলিফা হাজ্জাজকে অপ্রত্যাশিত পদোন্নতি দিয়ে সেনাবাহিনীতে উর্ধতন অফিসার নিযুক্ত করে ফেললেন। সেদিন থেকেই হাজ্জাজের জুলুম ও অত্যাচারের সূচনা হলো।
এমনটিই ছিল হাজ্জাজ বিন ইউসুফ ও তার মেজাজ। কঠোরতা, নির্মমতা ও দুঃসাহসিকতার এক জীবন্ত মূর্তি ছিলেন হাজ্জাজ বিন ইউসুফ। সেই হাজ্জাজের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধান ও পৃষ্ঠপোষকতায় বেড়ে উঠতে শুরু করল তার ভ্রাতুস্পুত্র মুহাম্মদ বিন কাসিম। হাজ্জাজ ভ্রাতুষ্পত্রের শিক্ষা-দীক্ষার দায়িত্ব নিজ কাঁধে নিয়ে বিশেষ এক ধাচে তাঁকে গড়ে তুলতে প্রতিজ্ঞ হলেন। ৭০৫ খৃস্টাব্দে খলিফা আব্দুল মালিক বিন মারওয়ানের মৃত্যুর পর তার বড় পুত্র ওয়ালিদ বিন আব্দুল মালিক মসনদে আসীন হলেন। ওয়ালিদ তার পিতার মতো বুদ্ধিমান ও দূরদর্শী ছিলেন না। ওয়ালিদের সৌভাগ্য এই ছিল যে, তার পিতা প্রশাসনের বিরুদ্ধে মাথা চাড়া দিয়ে ওঠা সকল ধরনের বিদ্রোহ কঠোর হস্তে দমন করেছিলেন। মালিক বিন মারওয়ান খারেজীদেরও গলাটিপে দিয়েছিলেন। তা ছাড়া মালিকের সেনাবাহিনীতে কুতাইবা বিন মুসলিম, মূসা বিন নুসাইর, মুসলিম বিন আব্দুল মালিকের মতো বিজ্ঞ ও পারদর্শী সেনাধ্যক্ষ ছিলেন। ওয়ালিদের সবচেয়ে বড় সৌভাগ্য হলো হাজ্জাজ বিন ইউসুফের মতো দক্ষ ও অত্যাচারী গভর্নর ছিল তার সহায়ক ও পরামর্শদাতা।