মারওয়ানের খেলাফতের বিরুদ্ধবাদীদেরকে দমনে পোড়ামাটি নীতি অবলম্বন করেন। তিনি ব্যাপক ধ্বংস ও হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে মালিক বিন মারওয়ানের খেলাফত বিরোধীদের পরাস্ত করেন। নির্মম ও কঠোর দমননীতির কারণে জালেম ও অত্যাচারী শাসক হিসাবে হাজ্জাজ বিন ইউসুফ ইতিহাসে কুখ্যাত হয়ে রয়েছেন। নিজের নির্মম ও নিষ্ঠুরতার সাক্ষী হিসাবে হাজ্জাজ বিন ইউসুফ আব্দুল্লাহ বিন যুবায়েরকে শহীদ করে তাঁর মৃতদেহ চৌরাস্তায় কয়েকদিন পর্যন্ত ঝুলিয়ে রাখেন। হাজ্জাজ বিন ইউসুফের অত্যাচারের ভয়ে মক্কার লোকেরা আব্দুল্লাহ বিন যুবায়েরের মরদেহকে ঝুলন্ত অবস্থা থেকে নামিয়ে আনার সাহস করেনি। আব্দুল্লাহ বিন যুবায়ের এর বৃদ্ধা ও দৃষ্টিশক্তিহীনা মাতা আবু বকর তনয়া হযরত আসমা লাঠিতে ভর দিয়ে চৌরাস্তায় ঝুলন্ত তাঁর আত্মজের মরদেহে লাঠি দিয়ে ঠোকা দিয়ে কাঁপা কণ্ঠে আবৃত্তি করেন সেই বিখ্যাত পক্তি- “এ কোন্ অশ্বারোহী! এখনো যে অশ্বপৃষ্ঠ থেকে অবতরণ করেনি।”
আব্দুল্লাহ বিন যুবায়েরের শাহাদাতের পর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ উমাইয়া খেলাফতের অধীনতা বরণ করেন। উমাইয়া খলিফা তাকে হেজাযের গভর্নর নিয়োগ করেন। হাজ্জাজ গভর্নর হওয়ার সাথে সাথে হিজাযের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসে। অপরদিকে ইরাকের অধিবাসী খারেজী সম্প্রদায়ভুক্ত লোকেরা বিদ্রোহ ও খলিফার বিরুদ্ধাচরণ করতে শুরু করে। তাদের বিরোধিতা দমনেও খলিফা গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফকে দায়িত্ব দেন। এক পর্যায়ে রক্তাক্ত যুদ্ধের পর খলিফা মালিক বিন মারওয়ান খারেজীদের বিরুদ্ধে বিজয়ী হন।
খারেজীদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়েই হাজ্জাজের আপন ভাই কাসিম মৃত্যুবরণ করেন। ফলে তার ঔরসে জন্মলাভকারী তারকা সন্তানের মুখ দেখা তার পক্ষে সম্ভব হয়নি। ভাই কাসিম ছিলেন হাজ্জাজের ডান হাত। বড় সহযোগী। হাজ্জাজের ভ্রাতুস্পুত্র মুহাম্মদ বিন কাসিম তাঁর ঐকান্তিক সাহসিকতা, ন্যায়পরায়ণতা ও বিজয়কীর্তি দিয়ে চাচা হাজ্জাজের জুলুম অত্যাচারের উপাখ্যানকে কিছুটা হলেও ম্লান করে দিতে সক্ষম হন। বীরত্ব ও সাহসিকতায় মুহাম্মদ বিন কাসিম এমন ইতিহাস রচনা করেন যে, অমুসলিমরা তার আদর্শিকতা ও ন্যায়পরায়ণতার কারণে তাকে পূজা করতে শুরু করে।
মুহাম্মদ বিন কাসিম যখন দুনিয়ার আলো দেখলো তখন তার ঘরে দুঃখের বিষাদ ছেয়ে গেছে! নবজাতক শিশুর পিতার মৃত্যুশোকে তার মা ও
আপনজন শোকাতুর। শিশু জন্মের খবর হাজ্জাজের কানে পৌছা মাত্রই তিনি ছুটে এলেন। হাজ্জাজ এলে শিশুকে তার কোলে তুলে দেয়া হলো। শিশুকে দু’হাতে নিয়ে তিনি ঘরে প্রবেশ করলেন। “এ শিশুর পিতা মৃত্যুবরণ করেছে বটে কিন্তু একে তুমি এতীম মনে করো না। আমি যতোদিন বেঁচে আছি মনে করো ওর বাবাই বেঁচে আছে। ছোট বউ! তুমি হয়তো জানো না, আমার এই ভাইটি আমার কতো প্রিয় ছিল। সে আমার ছোট হলেও আমরা ছিলাম খুবই ঘনিষ্ঠ। তোমার স্বপ্নের কথা এবং ইসহাক বিন মূসার স্বপ্নের ব্যাখ্যার কথা সে আমাকে জানিয়েছে। তুমি মনে রেখো, তোমার এই সন্তান শুধু তায়েফের নয় সারা আরব জাহানের তারকা হবে। তুমি কখনও নিজেকে বিধবা ও একাকী ভেব না। এই শিশুর দাদার খুনের কসম! যে খুন এই শিশুর শরীরে প্রবাহমান। আমি একে এমন শিক্ষা ও দীক্ষা দেব শত শত বছর পরও আরবের লোকেরা তাকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে। যুগের পর যুগ সে বেঁচে থাকবে মানুষের হৃদয়রাজ্যে ও অন্তরের মণিকোঠায়।”
হাজ্জাজ বিন ইউসুফের এসব কথা আবেগতাড়িত বক্তব্য ছিল না। তিনি মুহাম্মদ বিন কাসিমের রাজকীয় লালন-পালন ও শিক্ষা-দীক্ষার ব্যবস্থা করে দিলেন। তার জন্যে বিশেষ শিক্ষক রাখার ব্যবস্থা হলো। শৈশব থেকেই মুহাম্মদকে যোদ্ধা হিসাবে গড়ে তোলার সার্বিক ব্যবস্থা করা হলো। তার খেলার সরঞ্জাম ছিল ছোট্ট ছোট্ট তরবারী, বর্শা ও ঘোড়া। বড় হওয়ার সাথে সাথে তার খেলার সামগ্রীও বড় হতে লাগলো। কৈশোর থেকেই অশ্বারোহণ ছিল তার খেলার গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।
শিশুর পিতার ঘাটতি যথাসম্ভব মা মিটিয়ে দিতে সচেষ্ট ছিলেন। মা হলেও তিনি শিশুকে কখনো নিজের বুকে কোলে জড়িয়ে রাখতেন না। নিজের আঁচলে বেঁধে রাখার বদলে তাকে আদর সোহাগ দিয়ে সুপুরুষ হিসাবে গড়ে তোলার প্রতি সতর্ক যত্ন নিতেন। হাজ্জাজ বিন ইউসুফ মুহাম্মদ এর মাকে বলে রেখেছিলেন তিনি ভ্রাতুস্পুত্রকে কোন সাধারণ সৈনিক নয় সেনাপতি হিসাবেই গড়ে তুলতে সচেষ্ট। শুধু রণাঙ্গনের সেনাপতিই নয় তিনি তাকে গড়ে তুলতে চান একজন দক্ষ সেনাপতি ও শাসক হিসাবে।
হাজ্জাজ নিজেও ছিলেন প্রখর মেধাবী ও তীক্ষ্ণ বুদ্ধি সম্পন্ন বীর পুরুষ। নিজের আজ্ঞা পালনে বাধ্য করতে যে কোন ধরনের জুলুম-অত্যাচারে মোটেও কুণ্ঠাবোধ করতেন না হাজ্জাজ। তার অস্বাভাবিক শাসন শোষণের কারণে
খলিফা আব্দুল মালিক বিন মারওয়ান প্রথমে তাকে হিজাযের ও পরবর্তীতে ইরাক, বেলুচিস্তান ও মাকরানের প্রধান গভর্নর নিযুক্ত করেন। একটি মাত্র ঘটনায় খলিফা হাজ্জাজের অস্বাভাবিক কঠোর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। ঘটনাটি ছিল এমন
খলিফা আব্দুল মালিকের সেনাবাহিনী ছিল বিশৃঙ্খল। শত চেষ্টা করেও আব্দুল মালিক বিন মারওয়ান সেনা বাহিনীতে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করতে পারছিলেন না। সেনাবাহিনীর সবচেয়ে ক্রটি ছিল, তাদেরকে কোন অভিযানের নির্দেশ দিলে অভিযানের প্রস্তুতি নিতেই তারা অনেক সময় ব্যয় করে ফেলতো। অথচ খলিফা জানতেন, মুসলিম বাহিনীর অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল অস্বাভাবিক ক্ষীপ্রগতিতে অভিযান পরিচালনা করা। অধিকাংশ ক্ষেত্রে শত্রুপক্ষের ধারণাতীত কম সময়ে দুশমনদের অপ্রস্তুত অবস্থায় মুসলিম বাহিনী হামলা করে বিজয় ছিনিয়ে আনতো। তখন খলিফা আব্দুল মালিকের প্রধান উজির ছিলেন রূহ বিন রাবাহ।