ইসহাক কথা শেষ না করেই নীরব হয়ে গেলেন। মনে হচ্ছে তিনি কোন কথা নিজের মধ্যে লুকিয়ে রাখতে চান। “আল্লাহর কসম! ইবনে মূসা! আপনার এই থেমে যাওয়া খুবই রহস্যজনক। আমি যে কোন মন্দ খবরও শুনতে প্রস্তুত। আপনি নির্ধিধায় বলুন। আমাকে সংশয়ের মধ্যে না ফেলে আপনি যা বুঝতে পেরেছেন তা সরাসরি বলুন।” “তাহলে শোনা যে তারকা সদৃশ সন্তান তোমার ঘর আলোকিত করবে, সে এমন তারকাদের অন্তর্ভুক্ত যেসব তারকা অল্প সময়ের মধ্যে হারিয়ে যায়,
খসে পড়ে। অবশ্য দৃশ্যত এসব তারকা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলেও এদের আলো থাকে দীর্ঘ সময়। এ সন্তান তোমার ঘরে বেশীদিন না থাকলেও তোমার ঘর অন্ধকার হবে না। মানুষের মনে সে জীবিত থাকবে অনন্তকাল। তোমার ঘর আলোকিত থাকবে সারাজীবন। মানুষ মনমুকুরে তার স্মৃতি ধরে রাখবে, তাকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে।”
“তাহলে আমিও তাকে এমনভাবে লালন-পালন করবো, যাতে সে ইসলামের উজ্জ্বল তারকা হিসাবে নিজেকে আলোকিত করতে পারে।” বলল ভাবী সন্তানের পিতা। “একথাও তোমার জেনে রাখা দরকার, এ সন্তানের লালন-পালনের সুযোগ তোমার হবে না, সে বড় হবে তোমার স্ত্রীর আদর-সোহাগে।”
কেন? আমি তাকে লালন-পালন করতে পারবো না কেন?
“সে কথা আমার পক্ষে বলা সম্ভব নয়। আমার যা বলার ছিল আমি বলে দিয়েছি” বললেন ইসহাক বিন মূসা।
ভাবী সন্তানের সৈনিক পিতা ইসহাক বিন মূসার দরবার ত্যাগ করে স্ত্রীর কাছে ইসহাকের দেয়া স্বপ্নের ব্যাখ্যা সবিস্তারে ব্যক্ত করল।
স্ত্রী স্বপ্নের ব্যাখ্যা শুনে অজানা আশাবাদে উৎফুল্ল হলো বটে, কিন্তু সন্তানের হায়াত কম হবে ভেবে দুশ্চিন্তায় ডুবে গেল। সন্তান প্রসবের দিনক্ষণ যখন ঘনিয়ে এলো, তখন ভাবী সন্তানের সৈনিক পিতাকে সরকারীভাবে গুরুত্বপূর্ণ এক যুদ্ধে অনেক দূরে পাঠিয়ে দেয়া হলো। সেই যুদ্ধে শাহাদাত বরণ করল সে। পিতার মৃত্যুতে ইসহাক বিন মূসার আশঙ্কাই বাস্তবরূপ লাভ করল যে, ভাবী সন্তানকে তার পিতা লালন-পালন করার সুযোগ পাবে না। পরবর্তীতে ইসহাক বিন মূসা এ ঘটনার ব্যাখ্যায় বলেন, ভাবী সন্তানের মা স্বপ্নের প্রথমে যে অন্ধকার দেখেছিল, তা ছিল ভাবী সন্তানের পিতা ও তার স্বামীর মৃত্যুজনিত অন্ধকার, যে অন্ধকারে আলোকবর্তিকা হয়ে ঘর আলোকিত করবে এ সন্তান।
পিতার মৃত্যু হলো তায়েফ থেকে বহু দূরে। মৃত্যু সংবাদ স্ত্রীর কাছে পৌছার কিছুদিনের মধ্যেই মৃত সৈনিকের ঘর আলোকিত করে জন্ম নিলো এক দীপ্তিময় পুত্র সন্তান। নবজাতক শিশু খুব নাদুস নুদুস। শিশুর চওড়া কপাল, দ্যুতিময় দুটো চোখ, উন্নত নাসিকা, কান্তিময় চেহারা, প্রগাঢ় দৃষ্টি আর আকর্ষণীয় অঙ্গভঙ্গি দেখে যে কারো মনে হতো এ শিশু সাধারণ কোন শিশু নয়, এ অন্য শিশুদের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন।
অকস্মাৎ মৃত্যুবরণকারী সৈনিকের নাম ছিল কাসিম বিন ইউসুফ। আর নবজাতক শিশুর নাম রাখা হলো মুহাম্মদ বিন কাসিম। এই মুহাম্মদ বিন কাসিমই পরবর্তীকালে জগৎ বিখ্যাত ভারত বিজয়ী মুহাম্মদ বিন কাসিম ইতিহাসের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র হিসাবে পরিচিত। কাসিম বিন ইউসুফ আর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ ছিলেন আপন ভাই। তখন খলিফা ছিলেন আব্দুল মালিক বিন মারওয়ান। কাসিম ও হাজ্জাজ ছিলেন যুদ্ধ বিদ্যা ও রণকৌশলে খুবই পারদর্শী। খলিফার সেনাবাহিনীতে উভয়েই উচ্চ পদে অধিষ্ঠিত। সময়টি ছিল এমন যখন মুসলমানদের মধ্যে পারস্পরিক সৌহার্দ বিলীন হয়ে যাচ্ছিল। ক্ষমতা ও প্রভাব বিস্তারের জন্য ভ্রাতৃঘাতী সংঘাতে লিপ্ত ছিল মুসলিম সম্প্রদায়। ইসলামী খেলাফতেও তখন দেখা দিয়েছিল ভাঙন। দুভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে ইসলামী খেলাফত। ইসলামী খেলাফত সিরিয়া ও মিসরে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। আব্দুল্লাহ বিন যুবায়ের ইরাক ও হিজাযে স্বাধীন হুকুমত প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি উমাইয়া খেলাফতের আনুগত্য করতে অস্বীকৃতি জানান। ফলে উমাইয়া শাসকদের সাথে তার দেখা দেয় সংঘাত।
আব্দুল্লাহ বিন যুবায়ের ইসলামের প্রথম খলিফা হযরত আবু বকরের খ্যাতিমান দৌহিত্র। তিনি ইয়াযীদ বিন আমীরে মুআবিয়ার আনুগত্য করতেও অস্বীকৃতি জানান এবং হিজায ও ইরাকের মুসলমানদের একত্রিত করে পাল্টা সরকার গড়ে তোলেন। ইয়াযীদের পুত্র মুআবিয়া বিন ইয়াযীদ যখন শাসন কাজ থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করার ঘোষণা করেন, তখনই উমাইয়া শাসনের সূচনা ঘটে। সেই সাথে নবী বংশ তথা ফাতেমীদের বিরুদ্ধে শুরু হয় জুলুম অত্যাচার। আব্দুল্লাহ বিন যুবায়ের ফাতেমীদের ওপর জুলুম অত্যাচারের বিরুদ্ধে পাহাড়ের মতো দৃঢ় মনোবল নিয়ে রুখে দাঁড়ান। উমাইয়া শাসকরা আব্দুল্লাহ বিন যুবায়েরের শাসনের পতন ঘটানোর জন্য প্রথমে ইরাকে সেনাভিযান চালায়। ইরাক কব্জা করার পর পবিত্র হিজাযেও সৈন্য প্রেরণ করে এবং আক্রমণ চালায় মক্কা শরীফে। উমাইয়া শাসকদের হয়ে উভয় অভিযানেই সেনাপতির দায়িত্ব পালন করেন হাজ্জাজ বিন ইউসুফ। মদিনা শরীফের অবরোধ ভেঙে ফেলার জন্য হাজ্জাজ বিন ইউসুফ বাইতুল্লাহ শরীফের ওপরও মিনজানিক থেকে ভারী পাথর নিক্ষেপ করেন। ফলে বাইতুল্লাহ শরীফের ইমারত ক্ষগ্রিস্ত হয়। অবশেষে আব্দুল্লাহ বিন যুবায়ের জুলুমের বিরুদ্ধে আপোসহীন সংগ্রামে নিজের জীবন উৎসর্গ করেন। হাজ্জাজ বিন ইউসুফ খলিফা আব্দুল মালিক বিন