“বিন আউফ! কোন প্রস্তাব নিয়ে এসেছ, নাকি অন্য কোন উদ্দেশ্য আছে?” জিজ্ঞেস করলেন রাসূল সাঃ।
‘আমি আপনার ধর্মে দীক্ষা নিতে এসেছি” বলল মালিক বিন আউফ। ঠিক সেই মুহূর্তেই ছাকিফ গোত্রপতি মালিক বিন আউফ নবীজীর হাতে হাত রেখে ইসলাম ধর্মে দীক্ষা নিলেন। মালিক বিন আউফ কেন ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন ইতিহাস এ ব্যাপারে নীরব। মালিক বিন আউফ যখন রাসূল সাঃ-এর হাতে হাত রেখে স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে ইসলামে দীক্ষা নিলেন, তখন তার ওপর কোন ধরনের চাপ ছিল না। দৃশ্যত সে তখন বিজয়ী গোত্রের সেনাপতি। বস্তুত মালিক বিন আউফের ইসলাম গ্রহণের কোন যৌক্তিক কারণ ছিল না। হতে পারে হাওয়াযিন গোত্রের প্রতিনিধিদের প্রতি সদয় হয়ে রাসূল সাঃ তাদের নারী ও শিশুদের মুক্ত করে দেয়া এবং হাওয়াযিন গোত্রের সকল লোক ইসলাম গ্রহণের ব্যাপারটি মালিক বিন আউফকে প্রভাবিত করেছিল। ইসলাম গ্রহণের পর ছাকিফ গোত্রের এই বীরযোদ্ধা ইসলামের পক্ষে অনেকগুলো যুদ্ধে বীরত্বের সাথে লড়াই করেন। আজো তায়েফ ইতিহাসের জীবন্ত সাক্ষী হয়ে রয়েছে।
আজ থেকে এক হাজার চারশ বছর আগে রাসূল সাঃ তায়েফ শহর অবরোধ করেছিলেন। তায়েফবাসীদের জীবনপণ মোকাবিলার কারণে শেষ পর্যন্ত মুসলিম বাহিনীকে অবরোধ প্রত্যাহার করে ফিরে আসতে হয়েছিল।
আল্লাহ তাআলা সেই অবরোধের চৌষট্টি বছর পর তায়েফকে এমন এক সৌভাগ্যে উদ্ভাসিত করলেন যা ইতিহাসের পাতায় চিরকাল মাইল ফলক হয়ে থাকবে। আর সেই সৌভাগ্যের প্রথম মাইল ফলক ছিল বনী ছাকিফ গোত্রের বীর পুরুষ মালিক বিন আউফের ইসলাম গ্রহণ। ৬৯ হিজরী সনের ঘটনা। তায়েফের অধিবাসী এক তরুণীবধু সন্তান সম্ভবা হলেন। তরুণির স্বামী ইসলামী সালতানাতের একজন তুখোড় সৈনিক। সেনাবাহিনীতে সে উচ্চ পদে অধিষ্ঠিত। ছুটির অবসরে সেই সেনা বাড়িতে এলে স্ত্রী লাজনম্রকণ্ঠে স্বামীকে জানালো অন্তঃসত্তা সে। অনাগত সন্তানের চেহারা দেখার আশায় সে বুক বেঁধে রয়েছে।
সেই সাথে স্ত্রী এও জানালো, ভয়ংকর একটি স্বপ্ন দেখে সে ভীত হয়ে পড়েছে। তার স্বপ্নময় প্রত্যাশার আশপাশে উঁকি দিচ্ছে কতগুলো ভীতিকর ভূতুড়ে শঙ্কা। তরুণী স্বামীকে জানালো- আমি স্বপ্নে দেখেছি হঠাৎ আমার ঘরটি ঘুটঘুটে অন্ধকারে ছেয়ে গেছে, এমন ঘন অন্ধকার যে, আমি নিজের হাত-পা পর্যন্ত দেখতে পারছিলাম না। ভয়ে আতঙ্কে আমি জড়সড় হয়ে গেলাম। আমার ভয় হচ্ছিলো ভয়ংকর কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। কিন্তু কি হচ্ছে তা আমি বুঝতে পারছিলাম না। আমি ঘরে একা ছিলাম। খুব জোরে চিৎকার করে কাউকে ডাকতে চাচ্ছিলাম; কিন্তু আমার মুখ থেকে একটুও শব্দ বের হচ্ছিলো না। মনে করছিলাম ঘর থেকে দৌড়ে বের হয়ে যাই, কিন্তু তাও পারছিলাম না। শত চেষ্টা করেও আমার পা এক কদমও উঠাতে পারছিলাম না।
গভীরভাবে ব্যাপারটি ভাবতে চেষ্টা করি কিন্তু সব চিন্তা-ভাবনাই কেমন যেন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিল। কোন কিছু বুঝে উঠতে পারছিলাম না…।
কিন্তু মনে মনে আল্লাহ্ আল্লাহ্ করছিলাম। আর নানা দোয়া-কালাম পাঠ করছিলাম। এতোটুকু বোধ আমার অক্ষুন্ন ছিল। এমন সময় দূর আকাশের এক কোণে একটি তারা দেখা দিলো, তারাটি প্রথমে আবছা আলো আঁধারে অস্পষ্ট ছিল। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই তারাটি ঝকমকে দীপ্তিমান হয়ে উঠল। ধীরে ধীরে আসমানের তারাটি আমার দিকে নেমে এলো। আঁধার ধীরে ধীরে সরে যেতে লাগল। দেখতে দেখতে আলোকিত তারাটি আমার ঘরে এসে পড়ল, এতে আমার ঘরটি আলোয় ভরে গেল। এ যেন জমিনের কোন আলো নয়, অন্য রকম আসমানী নূর। এ আলোয় আমার ভয় ভীতি সব দূর হয়ে গেল। মনটা এক ধরনের প্রশান্তিতে ভরে গেল। ঠিক এ সময়ই আমার ঘুম ভেঙে গেল।”
“মন্দ কোন স্বপ্ন দেখোনি। মনে তো হয় ভালোই দেখেছে” বলল তরুণির সৈনিক স্বামী।
“কিন্তু অন্ধকারটা কি দেখলাম?” অন্ধকারটার কথা মনে হলে আমার কেমন যেন ভয় লাগে। আচ্ছা, তুমি কি এমন কোন আলেম চেনো যে স্বপ্নের তা’বীর ভালো বলতে পারে?” “ভাগ্যে যা লেখা রয়েছে তা কেউ বদলাতে পারে না। স্বপ্নের তাবীর যদি ভালো না হয়, তা কি তুমি বদলাতে পারবে?” বলল স্বামী।
“মন্দের কথা মুখে এনো না। আমার বিশ্বাস ভালোই হবে। আগে তুমি জিজ্ঞেস তো করবে? জিজ্ঞেস না করে নিজে নিজেই কেন ব্যাখ্যা দিচ্ছো? স্বপ্নের ব্যাখ্যা জানার জন্য এ সেনা অফিসারের যুবতী স্ত্রী স্বামীর কাছে জিদ ধরল। স্ত্রীর সন্তুষ্টি বিধানে অবশেষে সৈনিক স্বামী তায়েফের সমকালীন শ্রেষ্ট বুযুর্গ ইসহাক বিন মূসার শরণাপন্ন হলো। ইসহাক বিন মূসার কাছে ব্যক্ত করল স্ত্রীর স্বপ্নের আদি অন্ত। ইসহাক বিন মূসা স্বপ্নের ব্যাখ্যায় পারদর্শী ছিলেন। তিনি স্বপ্নের বর্ণনা শুনে গভীর চিন্তায় ডুবে গেলেন। অনেকক্ষণ নীরবে বসে থাকতে দেখে অনাগত সন্তানের সৈনিক পিতা বলল, “বলুন ইবনে মূসা! স্বপ্নের ব্যাখ্যা যদি মন্দও হয়, তবুও আমাকে বলুন। তাতে আমি ঘাবড়ে যাবো না।”
“না না। তাবীর মোটেও মন্দ নয়” বললেন ইসহাক বিন মূসা। তোমার স্ত্রীর গর্ভে এমন এক ছেলে জন্ম নেবে আকাশের উজ্জ্বল তারকার মতো যার দ্যুতি সারা জগতে ছড়িয়ে পড়বে। সে আল্লাহর দ্বীনের আলো দুনিয়ার দিকে দিকে বহু জনপদে ছড়িয়ে দেবে। শত শত বছর পরের লোকজনও তার কথা শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করবে। তার নির্দেশে মুসলিম যোদ্ধারা বহু দূর পর্যন্ত ইসলামের বিজয় কেতন উড়িয়ে দেবে। কিন্তু…!”