গোটাতে প্রয়োজনের তুলনায় বেশী সময়ের প্রয়োজন হয়ে পড়ে। তাছাড়া খুব বেশী আহতদের জন্য প্রয়োজন ছিল নিরবচ্ছিন্ন বিশ্রাম। রাসূল সাঃ আহতদের বিশ্রাম ও চিকিৎসার জন্য দুর্গ এলাকা থেকে তাঁবু গুটিয়ে জিরানায় পৌছে তাঁবু ফেলেন।
মুসলমানরা ব্যর্থ হয়ে প্রত্যাবর্তন করছিলেন। তাঁদের প্রত্যাবর্তন শুধু ব্যর্থতার গ্লানিই বহণ করছিল না, বিপুল সংখ্যক সহযোদ্ধাকে হারানো ও আহত হওয়ার যাতনাও তাদের মধ্যে সৃষ্টি করেছিল প্রচণ্ড মনোকষ্ট। তায়েফ নগরী নিত্যদিনের মতোই অপরিবর্তিত ছিল, অজেয় দুর্গপ্রাচীরে যেন মুসলমানদের ব্যর্থতায় উপহাস করছিল। কিন্তু প্রচণ্ড যাতনা, ব্যর্থতার গ্লানিকে ছাপিয়ে গেল আকস্মিক এক ঘটনা। যেন অলৌকিক ঘটনার মতোই ঘটে গেল ব্যাপারটি। জিরানা থেকে মুসলমানরা তখনও তাঁবু গুটিয়ে মদিনার দিকে রওয়ানা হননি, এমন সময় বনী ছাকিফ কবিলার শীর্ষস্থানীয় ক’জন লোক মুসলমানদের শিবিরের দিকে এগিয়ে এলো। তারা শিবিরের কাছে পৌছে প্রহরীদের কাছে রাসূলুল্লাহ সাঃ-এর সাথে সাক্ষাতের অনুমতি চাইলো। তাদেরকে রাসূল সাঃ-এর কাছে নিয়ে গিয়ে কয়েকজন শক্তিশালী সাহাবী নাঙ্গা তরবারী ও বর্শা নিয়ে সতর্ক প্রহরা দিতে লাগলেন।
কারণ প্রবল শত্রু পক্ষের এই লোকগুলোকে কোন অবস্থাতেই মুসলমানরা নিরাপদ ভাবতে পারছিলেন না। কেননা, বেশ কয়েকটি অমুসলিম গোত্র নবীজী সাঃ-কে হত্যা করার অব্যাহত চক্রান্ত করছিল। হাওয়াযিন গোত্রের জন্য সমূহ বিপদ সৃষ্টি করেছিল মুসলমানদের হাতে বন্দি তাদের কিছু সংখ্যক নারী ও শিশু। দুর্গ অবরোধের আগে এক যুদ্ধে ওদের পরাজয় ঘটে। তাতে কিছু সংখ্যক হাওয়াযিন নারী ও শিশু মুসলমানদের হাতে বন্দি হয়। তখনকার নীতিতে এরা ছিল যুদ্ধ বন্দি। পরাজয় কিংবা বিজয় অথবা সামরিক চুক্তি ছাড়া তাদের পক্ষে মুসলমানদের হাতে বন্দি হওয়া নারী শিশুদের ফিরে পাওয়ার কোন পথ ছিল না। এদিকে রাসূল সাঃ ঘোষণা করে দিলেন যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার পরও যদি শত্রু পক্ষের কোন ব্যক্তি ইসলাম গ্রহণ করে, তাহলে তার সকল সম্পদ ফিরিয়ে দেয়া হবে।
হাওয়াযিন গোত্রের আগত লোকদের মধ্য থেকে নেতৃস্থানীয় এক লোক বলল “হে মুহাম্মদ! আমাদের কবিলার লোকসহ সবাই আপনাকে আল্লাহর রাসূল হিসাবে মেনে নিয়েছে। আমাদের কবিলার সবাই আপনার ধর্মে দীক্ষা নিয়েছে।”
আল্লাহর কসম! তোমরা কল্যাণের পথ অবলম্বন করেছ। এটাই “সীরাতে মুস্তাকীম” বললেন রাসূল সাঃ।
কবিলার সর্দার বলল, “হে মুহাম্মদ! আপনি তো আল্লাহর রাসূল! আপনি কি আমাদের নারী শিশু ও সহায়-সম্পদ ফিরিয়ে দেবেন?” “আমাদের সাথে যুদ্ধ করে এবং আমাদের লোকজনকে হত্যা করে যে সব জিনিস তোমরা হারিয়েছ, সেগুলো ফিরে পাওয়ার কোন অধিকার তোমাদের নেই” বললেন রাসূল সাঃ। তবে যে একক ও অদ্বিতীয় আল্লাহকে তোমরা মহান প্রভু ও রব হিসাবে মেনে নিয়েছ, তার সম্মানে তোমাদের আমি হতাশ করবো না। তোমাদের কাছে নারী শিশু নাকি সহায়-সম্পদ বেশী প্রিয়?
“আপনি আমাদের নারী শিশুদের অন্তত ফিরিয়ে দিন।” বলল প্রতিনিধি দলের নেতা। রাসূল সা, হাওয়াযিন কবিলার নারী শিশুদেরকে মুক্ত করে দেয়ার নির্দেশ দিলেন।
হাওয়াযিন গোত্রের নেতাদের কাছে রাসূল সাঃ-এর এই উদারতা ছিল আশাতীত। রাসূলের এই উদারতায় গোটা হাওয়াযিন গোত্রের লোক ইসলামে দীক্ষা নিলো। এ ঘটনার দুই তিনদিন পর অজ্ঞাত পরিচয় এক ব্যক্তি মুসলমান শিবিরে অনুপ্রবেশ করতে চাইলো। লোকটির মাথা ও চেহারা ছিল কাপড়ে ঢাকা। চোখ দুটো ছাড়া তার কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। নিরাপত্তারক্ষী সাহাবায়ে কেরাম যখন তার প্রবেশ পথ আগলে দাঁড়ালেন, তখন সে নিজের পরিচয় না বলেই রাসূল সাঃ-এর সাথে সাক্ষাতের আগ্রহ প্রকাশ করল।
“তুমি কি তায়েফ থেকে আসনি? জিজ্ঞেস করলেন একজন নিরাপত্তারক্ষী।
“হ্যাঁ, তায়েফের দিক থেকেই এসেছি আমি।” বলল আগন্তুক। কিছু সংখ্যক মুসলমান যোদ্ধা ফকীর ও উট চারকের বেশে তায়েফ দুর্গের আশে পাশে বিচরণ করছিলেন, ওদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণের জন্য। কারণ অবরোধ তুলে নিয়ে প্রত্যাবর্তনকালে মুসলমানদের দুর্বলতার সুযোগে ওরা কোন অতর্কিত হামলা করে কি-না এ বিষয়টি আগে ভাগেই জানার জন্য রাসূল সা, এ গোয়েন্দা ব্যবস্থা করেছিলেন। এসব সাহাবীদের কয়েকজন দুর্গফটক পেরিয়ে এই লোকটিকে মুসলিম শিবিরের দিকে অগ্রসর হতে দেখে ওর পিছু
নেন। শিবিরের নিকটবর্তী হলে তার পথ রোধ করে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করলে সে নিজের পরিচয় না বলেই নবীজীর সাথে সাক্ষাতের আগ্রহ প্রকাশ করে।
“আমরা তোমাকে তায়েফ দুর্গ থেকে বের হতে দেখেছি বললেন এক সাহাবী। আল্লাহর কসম! তুমি সংকল্পে সফল হতে পারবে না।” “যে সংকল্প নিয়ে এসেছি তা পূর্ণ করেই যাব।” বলল আগন্তুক। তোমরা কি আমাকে রাসূলুল্লাহ সাঃ-এর কাছে যেতে দেবে না?”
“কিভাবে দেবো? তুমি এখনো পর্যন্ত আমাদেরকে তোমার চেহারাই দেখাচ্ছ না।” একটানে চেহারা থেকে কাপড় সরিয়ে ফেলল আগন্তুক। আল্লাহর কসম! তুমি তো মালিক বিন আউফ। তোমার পথ রোধ করার শক্তি আমাদের নেই। দুই তিনজন সাহাবী মালিক বিন আউফকে নবীজীর সকাশে নিয়ে গেলেন।