“শোন! তোমরা সমর্থন না করলেও আমি মায়াকেই বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি।” গম্ভীর কণ্ঠে ঘোষণা করল রাজা। তোমরা কি চাও, আমি রাজ্যপাট ত্যাগ করে জঙ্গলে চলে যাব, বাকী জীবন বনবাসে কাটিয়ে দেব? তোমরা যদি আমার রাজত্বে কোন কষ্ট করে থাকো, আমি যদি তোমাদের কষ্ট দিয়ে থাকি, তাহলে বলো আমি কাকে কি কষ্ট দিয়েছি।”
সভা নীরব হয়ে গেল। সবার দিকে চোখ বুলিয়ে রাজা বলল, “আমার শাসনকালে আমি কি কারো ওপর কোন জুলুম করেছি? করে থাকলে বলো।”
সবাই মাথা নীচু করে ফেলল।
“আমি মায়ার সাথে শুধু বিয়ের আনুষ্ঠানিকতাই পালন করব, কখনো আমাদের মধ্যে দাম্পত্য সম্পর্ক স্থাপিত হবে না।” বলল রাজা।
“তাহলে কোন অসুবিধা নেই মহারাজ! আওয়াজ এলো এক কোণ। থেকে। দেখাদেখি সবাই এ কথায় সায় দিল।”
এ ঘটনার তিনদিন পর রাজা দাহির সহোদর বোন মায়ারাণীকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিয়ে করল। নেতৃস্থানীয় প্রজা ও সভাসদদের উপস্থিতিতে আবেগ উত্তেজনা ও আমোদ প্রমোদহীন অনাড়ম্বর পরিবেশে অনুষ্ঠিত হলো রাজা দাহিরের সাথে মায়ারাণীর বিয়ের পর্ব। লোকজন এই বিয়ের কথা শুনে নাক ছিটকালো, কানে আঙুল দিল। কিন্তু রাজার বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে কিছু বলার সাহস কারো ছিল না।
এভাবে ঘটে গেল আমার বিয়ে অনুষ্ঠান। বেলালকে বলল রাণী। আপন ভাইয়ের জন্য আমি নিজ আগ্রহেই এ ত্যাগ স্বীকার করেছি। কারণ সিংহাসন থেকে ভাইকে বঞ্চিত করতে চাই না আমি। তাছাড়া আমার কানে যখন একথাগুলো এলো যে, আমার হবু স্বামী আমার ভাইকে খুন করে মসনদ দখল করবে, তখন আর বিয়ের প্রতি আমার কোন আগ্রহ থাকেনি।
“তোমার হয়তো জানাই ছিল না, কার সাথে তোমার বিয়ে হচ্ছে?” বেলাল জানতে চাইলো।
“জানা ছিল।” সেও রাজা ছিল। ভাটি’ নামের এক রাজ্যের রাজা ছিল সে। তার নাম ছিল সোহান রায়। আমি তখন ব্রাহ্মণাবাদে আমার অপর ভাই মিহির সেনের এখানে। সেই ভাই আমাকে রাজা দাহিরের কাছে এ পয়গাম দিয়ে পাঠাল যে, আমাকে যেন অতি তাড়াতাড়ি রাজা সোহান রায়ের সাথে বিয়ের ব্যবস্থা করা হয়। আমার ভাই মিহির সেন আমার বিয়ের যৌতুক হিসাবে পাঁচশ ঘোড়া ও পাঁচশ মটকি ভর্তি মাল-সামানও দিয়েছিল। তাছাড়া একটি দুর্গও দিয়েছিল যৌতুক হিসাবে।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, রাজা দাহিরের অপর ভাই মিহির সেন যখন জানতে পারে রাজা দাহির বোন মায়াকেই বিয়ে করেছে তখন সে দাহিরের প্রতি রেগে আগুন হয়ে গেল। জরুরী পয়গাম পাঠাল। পয়গাম পাওয়া মাত্র মায়াকে সোহান রায়ের কাছে পাঠিয়ে দিতে। কিন্তু রাজা দাহির তার বিয়ে করার কারণ, গণকদের গণনা ও উজিরের পরামর্শ এবং ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার সমস্যা জানিয়ে ফেরত পয়গাম পাঠাল কিন্তু তাতে মিহির সেনের ক্ষোভ প্রশমিত হলো না। সে রাজা দাহিরের বিরুদ্ধে সেনাভিযান করল। অবরোধ করল রাজা দাহিরের দুর্গ। কয়েকদিন অবরোধের মধ্য থেকে রাজা দাহির তার সৈন্যদের অবরোধ ভাঙার নির্দেশ দিল। রাজার হুকুম পেয়ে দাহিরের সেনারা অবরোধ ভাঙতে যখন দুর্গের বাইরে বেরিয়ে এলো তখন মিহির সেন বুঝতে পারল দাহিরের সৈন্য সংখ্যা অনেক বেশী তাই মোকাবেলায় প্রবৃত্ত না হয়ে রাজা দাহিরের কাছে পয়গাম পাঠাল, তুমি দুর্গের বাইরে এসে আমার সাথে সাক্ষাত করো। তোমার ও আমার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কথা হবে।
রাজা দাহির উল্টো খবর পাঠাল আমার তো যাবার প্রয়োজন নেই। তুমিই তো আসতে পারো, আমি তোমাকে স্বাগত জানাব। অবশেষে মিহির সেন নিজেই হাতি সাজিয়ে তাতে আরোহণ করে দাহিরের প্রাসাদে উপস্থিত হয়ে বলল, দুর্গের বাইরে চলো, তোমার সাথে আমার একান্ত কথা আছে। ভাই মিহির সেনের প্ররোচনায় দুর্গের বাইরে যেতে রাজি হয়ে গেল রাজা দাহির। দাহির সেনের হাতিতে সাজানো হলো হাওদা। দাহির বসল হাওদায় আর মিহির বসল হাতির সামনে মাথার কাছে। রাজা দাহিরের উজির বুদ্ধিমান : ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে রাজার হাতির পিছু পিছু যেতে লাগল। হাতি যখন দুর্গ ফটকের কাছাকাছি পৌছলো তখন উজিরের কানে কানে কে যেন এসে ফিস ফিস করে কি কথা বলল আর অমনি উজির রাজাকে ইশারা করে বুঝাল,
আপনি দুর্গের বাইরে যাবেন না বিপদ আছে। অনন্যোপায় হয়ে দুর্গের প্রধান ফটক দিয়ে হাতি বের হওয়ার সময় রাজা দাহির হাওদায় দাঁড়িয়ে গেটের নীচে ঝুলে থাকা গাছের ডালে ঝুলে পড়ল। হাতি প্রধান ফটক পেরিয়ে গেলে সৈন্যসামন্ত এসে রাজাকে নামাল। দুর্গফটক পেরিয়ে রাজা মিহির সেন পিছনের দিকে তাকিয়ে দেখল রাজা দাহির হাওদাতে নেই। হতাশ সে। তার পরিকল্পনা ভণ্ডুল হয়ে গেল। রাজা দাহির অনিবার্য বিপদ থেকে রক্ষা পেল।
ঐতিহাসিকগণ লিখেছেন, প্রাসাদে ফিরে গিয়ে রাজা উজিরকে জিজ্ঞেস করল, উজির! তুমি আমাকে ফেরালে কেন? উজির বলল মহারাজ! আমার গোয়েন্দারা একেবারে শেষ মুহূর্তে আমাকে খবর দেয়, আপনার ভাই আলোচনার নামে চক্রান্ত করে দুর্গের বাইরে নিয়ে আপনাকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করেছিল।
ঐতিহাসিকগণ লিখেছেন, রাজা মিহির সেন রাজা দাহিরকে হত্যা করার জন্যই দুর্গের বাইরে নিয়ে যেতে চাচ্ছিল। কিন্তু যখন দেখল দাহির তার হাত ছাড়া হয়ে গেছে আর তার সৈন্যবাহিনীও দাহিরের বিপুল সৈন্য সংখ্যার সাথে মোকাবেলায় পেরে উঠতে পারবে না, তখন অবরোধ তুলে নিয়ে স্বরাজ্যে ফিরে আসার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। কিন্তু অত্যধিক মনোকষ্ট ও গরমে রাজা সেন জ্বরে আক্রান্ত হলো। গরমে সারা শরীরে ফুস্কা পড়ে গেল। কয়েকদিন জ্বরে ভুগে দাহিরের দুর্গের বাইরেই সে মারা গেল। ৬৭২ খৃস্টাব্দের ঘটনা সেটি। তখন রাজা মিহির সেনের বয়স ছিল মাত্র বত্রিশ বছর।