“অবশ্য এটা পরিষ্কার বোঝা যায় মহারাজ, মায়ার স্বামী বাইরে থেকে আসবে না, সে হবে স্থানীয়।” বলল অপর এক গণক। “এমন তো নয়, যে আমার বোনের স্বামী হবে সেই আমাকে হত্যা করবে?” জানতে চাইলো রাজা।
“এ ব্যাপারটিও পরিষ্কার নয় মহারাজ! বলল প্রধান গণক। এটা পরিষ্কার যে-ই হবে মায়ার স্বামী সেই হবে সিন্ধু অঞ্চলের রাজা।” “আমরা এটা কর্তব্য মনে করেছি মহারাজ। মহারাজের যে কোন সমস্যা। সংকট সম্পর্কে আগে ভাগেই আপনাকে অবগত করান।” বলল প্রধান ঋষি। যাতে মহারাজ বিপদ আসার আগেই প্রতিকার ব্যবস্থা নিতে পারেন।”
রাজা দাহির পণ্ডিত ও গণকদের পেট থেকে একথা বের করার সম্ভাব্য সব চেষ্টাই করল, বোনের বিয়ের পর তার ভাগ্যে কি ঘটবে। কিন্তু পণ্ডিত ও গণকরা এ ব্যাপারে তাকে স্পষ্ট কিছুই বলল না। পূর্বে দেয়া বক্তব্যের বাইরে আর কোন কথাই বলল না পণ্ডিত ও গণকদল। রাজা দাহির পণ্ডিত ও গণকদের কথা শতভাগ সত্য বলে বিশ্বাস করত। তাই চিন্তায় পড়ে গেল রাজা। রাজা দাহির ছিল কট্টর ব্রাহ্মণ ঘরের সন্তান। গণক ও পণ্ডিতদের কথার বাইরে কোনকিছু চিন্তা তার দেমাগে মোটেও প্রবেশ করেনি।”
রাজাকে চিন্তার সাগরে ভাসিয়ে বিদায় নিল পণ্ডিত ও গণকদল। পণ্ডিত ও গণকদল চলে যাওয়ার সাথে সাথে রাজার স্বস্তি ও সুখ বিদায় নিল। আকাশ পাতাল চিন্তা করে রাতে একরতিও ঘুমাতে পারল না রাজা। অগত্যায় সে তলব করল তার প্রধান উজির বুদ্ধিমানকে। “প্রধান উজির শুধু নামেই বুদ্ধিমান ছিল না। তার জ্ঞান বুদ্ধির ওপর রাজা দাহিরের ছিল অগাধ আস্থা। প্রকৃত পক্ষেও যে কোন উদ্ভূত সমস্যার সমাধানে বুদ্ধিমানের কোন জুড়ি ছিল না। রাজার নির্দেশ পেয়ে হন্তদন্ত হয়ে হাজির হলো উজির। রাজার শয়নকক্ষে প্রবেশ করে নমস্কার ও কর্নিশ করে হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে বলল, এতো রাতে কেন অধমকে তলব করেছেন মহারাজ?” রাজা দাহির উজির বুদ্ধিমানকে পণ্ডিত ও গণকদের সবকথা জানাল এবং বলল, “উজির! ব্যাপারটি তুমি গভীরভাবে চিন্তা করো তারপর আমাকে বলো, আমি কি করতে পারি?” অচিরেই আমার বোনের বিয়ে হচ্ছে। তাহলে কি আমি নিজে থেকেই এই রাজ্যপাট ভগ্নিপতিকে দিয়ে দেব? এতে অন্তত আমি বেঁচে থাকতে পারব—তাছাড়া আর কি করার আছে আমার?”
“মহারাজ! দেশের প্রজা, সেনাবাহিনী ও দেশের শাসনক্ষমতা থেকে স্বেচ্ছায় রাজার বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া মোটেও ঠিক হবে না। জগতের পাচটি জিনিস এমন রয়েছে যেগুলো পাঁচটি জিনিস থেকে বিচ্ছিন্ন হলে পরিণতি ভালো হয় না। রাজা রাজ্য ত্যাগ করলে, উজির উজারতি ছেড়ে দিলে, পীর মুরীদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করলে, শিশু মায়ের কোল থেকে বিচ্ছিন্ন হলে, আর দাঁত মুখের পাটি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে কোনটারই কোন মূল্য থাকে না।
আপনি একটু গভীরভাবে চিন্তা করে দেখুন মহারাজ! আমি আপনাকে রাজ্যপাট ত্যাগ করার কথা কোন্ মুখে বলব!”
“আমি তোমার কাছে কোন ব্যাখ্যা চাচ্ছি না। আমি তোমার কাছে জানতে চাই এখন আমাকে কি করতে হবে?”
মহারাজ! এমনটিই আপনাকে করতে হবে যেমনটি কোনদিন কেউ করেনি।” বলল উজির। মায়াকেই আপনি বিয়ে করে নিন এবং তাকে রাণী করে ফেলুন। তবে বিয়ে হলেও তার সাথে আপনার ভাই-বোনের সম্পর্কই অক্ষুন্ন রাখতে হবে, নয়তো তা হবে মহাপাপ। এতে রাজত্বে কোন ঝুঁকি থাকবে না।
“বুদ্ধিমান! তোমাকে ধন্যবাদ। বড় দামী পরামর্শ দিয়েছ তুমি, বলল রাজা। এ ছাড়া আমার আর কোন পথ নেই। কিন্তু এতে যে লোকজন খুবই সমালোচনা করবে। মানুষ আমার বদনাম করবে এবং নানা কল্পকাহিনী তৈরী করবে।”
“মহারাজ। বদনাম ও লোকজনের সমালোচনার ব্যাপারটি বেশীদিন থাকবে না। কারণ কোন ব্যাপারেই লোকজনের আগ্রহ বেশীদিন থাকে না। কিছুদিন আগের ঘটনা। একলোক তার একটি ভেড়ার পশমের ওপর কিছু মাটি ঢেলে দিয়ে মাটিতে পানি ঢেলে ভিজিয়ে দিল। পানিতে ভিজে মাটি ভেড়ার গায়ে লেপ্টে যায়। মালিক এতে কিছু কলাই বীজ ছিটিয়ে দিয়ে পানি দিতে থাকে। কিছুদিন পর কলাই অংকুরোদগম হয়ে ভেড়ার গায়ে কলাই গাছ জন্ম নেয়। অতঃপর মালিক সেটিকে বাজারে নিয়ে গেলে ভেড়াটি দেখার জন্য লোকজনের ভীড় লেগে যায়। এ ভীড় থাকে কয়েকদিন। সপ্তাহান্তে দেখা গেল আর কেউ ভেড়া দেখার প্রতি আগ্রহ দেখাচ্ছে না। এর সপ্তাহখানিক পর ভেড়ার পাশ দিয়ে হেটে গেলেও ভেড়ার দিকে কেউ তাকিয়েও দেখেনি…। মহারাজকেও এ বিষয়টি বুঝতে হবে যে, মানুষ কিছু দিন এ নিয়ে কানাঘুষা করবে ঠিক, তবে তা বেশী দিন নয়। তাছাড়া মহারাজের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে সমালোচনা করার দুঃসাহস কার আছে?”
রাজা দাহিরের মাথায় ক্ষমতার মোহ চেপে বসল। ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য উজির বুদ্ধিমানের দেয়া পরামর্শেই আপন বোনকে বিয়ে করল রাজা। অবশ্য বিয়ের আগেই উজির বুদ্ধিমানকে বলল, রাজার কাজকর্ম দেশের প্রজারা আদর্শ হিসাবে গ্রহণ করে এবং সেটি নীতিতে পরিণত হয়। রাজা দাহির ছিল প্রজা বৎসল। এ কারণে সে দেশের নেতৃস্থানীয় পাঁচশ প্রজাকে রাজপ্রাসাদে দাওয়াত করে এনে গণকদের গণনা ও উজিরের পরামর্শ সম্পর্কে
জানিয়ে তাদের মতামত চাইল। হঠাৎ এক কোণ থেকে মৃদু কণ্ঠে শোনা গেল, “না মহারাজ! এমনটি হতে পারে না।” এরপর অপর একজন, তারপর আরো কয়েকজন রাজার এ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করলে শুরু হয়ে গেল তুমুল প্রতিবাদ। সবাই একবাক্যে এ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে মুখরিত হয়ে উঠল।