দীর্ঘ সময় একান্তে কাটিয়ে বেলাল ও রাণী যখন সবুজ শ্যামল নৈসর্গিক বেলাভূমি থেকে বেরিয়ে এলো, তখন দুপুর গড়িয়ে প্রায় বিকেল হয়ে গেছে। জঙ্গলের বৃক্ষগুলো বিকেলের আলোয় দীর্ঘ ছায়া ফেলেছে। বেলালের সঙ্গীরা দরের একটি উঁচু জায়গায় বসে এদিকে দৃষ্টি রাখছিল। তারা ভাবছিল অবশ্যই দুর্গ থেকে সেনাবাহিনী এসে জায়গাটিকে ঘিরে ফেলবে এবং বেলালকে ধরে হত্যা করবে নয়তো গ্রেফতার করে নিয়ে যাবে। কিন্তু দুপুর গড়িয়ে গেলেও এমন কোন দৃশ্য তাদের চোখে পড়ল না। অনেকক্ষণ পর বেলাল যখন তার সঙ্গীদের কাছে এলো তখন সে নেশাগ্রস্তের মতো। সে এসে সঙ্গীদের সাথে এমনভাবে কথা বলছিল, দেখে তাকে নেশাগ্রস্তের মতো মনে হচ্ছিল। তার সঙ্গীরা তাকে যা জিজ্ঞেস করছিল সে জবাব দিচ্ছিল তার উল্টো। সে শুধু রাণীর প্রশংসা করছিল। সঙ্গীরা ওকে গালমন্দ করার পর চৈতন্যোদয় হলো।
“আল্লাহর কসম! আমি তোমাদের সবার জন্যই ঠিকানার ব্যবস্থা করতে পারবো।” বলল বেলাল। রাণী আমাদেরকে মর্যাদার সাথেই তার দুর্গে রাখবে। আগামীকাল আবার আসবে রাণী।
পরদিন আগের জায়গায় আবার রাণীর সাথে দেখা করতে গেল বেলাল। রাণী ও বেলাল পাশাপাশি এভাবে বসল যে, একজন অপরজনের মধ্যে হারিয়ে যাবে। রাণী ও বেলাল বৃক্ষশাখায় লীলারত কপোত কপোতির মতো একজন অপরজনের প্রেমে হারিয়ে যাচ্ছিল। “এখনও কি তুমি আমাকে সন্দেহ কর?” বেলালকে জিজ্ঞেস করল রাণী। নিজের বিবেকের কাছে জিজ্ঞেস করো, এখনও কি তোমার মনে হয় আমি তোমাকে ধরিয়ে দেব?”
“এ সন্দেহ এখন আর আমার নেই। তবে আমি এ প্রশ্নের কোন জবাব পাচ্ছি না। তুমি এভাবে আমার সাথে প্রেম করে তোমার স্বামীকে কেন ধোকা দিচ্ছ? কেন তার সাথে বিশ্বাস ঘাতকতা করছ?” সে এতো বিশাল রাজ্যের রাজা। তাছাড়া যতটুকু শুনেছি, সে একজন সুস্থ সবল মানুষ। দেখতেও বিশ্রী নয়। বয়স্কও নয়। তারপরও তুমি তাকে ভালোবাসার অযোগ্য মনে করছ কেন?”
“তাকে আমি ভালোবাসি না একথা ঠিক নয়। এতোটাই আমি তাকে ভালোবাসি যে, তার জন্য আমি আমার জীবন বিলিয়ে দিতে প্রস্তুত। তার শরীরে একটা কাঁটা বিদ্ধ হোক তাও আমি সহ্য করতে পারি না” বলে নীরব হয়ে গেল রাণী। দীর্ঘক্ষণ নীরব থেকে রাণী বেলালের উদ্দেশ্যে বলল, তুমি হয়তো বিশ্বাস করবে না বেলাল। আমি তোমাকে এমন কথা শোনাব যা কখনো তুমি শোননি।
“বেলাল! রাজা দাহির আমার স্বামী বটে; কিন্তু আমি তার সহোদর বোন।” একথা শুনে আঁৎকে উঠলো বেলাল। “বলল কি? এমনটি কি করে সম্ভব?”
“তুমি বিশ্বাস করো আর নাই করো, আমি যা বলছি তাই সত্য। আমি রাজা দাহিরের সহোদর বোন, তবুও সে আমার স্বামী। অন্য দশটি হিন্দু বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা যেভাবে হয়ে থাকে সে ধরনের আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়েই আমাদের বিয়ে হয়েছে। মন্দিরের বড় পণ্ডিতই আমাদের বিয়ের মন্ত্র পড়িয়েছে। আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে স্বামী স্ত্রী কিন্তু শারীরিকভাবে ভাই-বোন। আমাদের কোন সন্তান হবে না। রাজা দাহির নিঃসন্তান অবস্থায় মারা গেলে আমাকেও জীবন্ত তার চিতায় মৃত্যুবরণ করতে হবে।” “এ বিয়ে কিভাবে সম্ভব হলো?” জিজ্ঞেস করল বেলাল। কেন তোমাদেরকে এমন বিয়ে করতে হলো?”
“তাহলে শোন বলছি, বলে মায়ারাণী রাজা দাহিরের সাথে তার বিয়ের কারণ সবিস্তারে জানাল।
মায়া বেলালকে বিয়ের যে কাহিনী শোনালো তা ভারতের ইতিহাসে একটি ঐতিহাসিক বাস্তবতা। পুরনো ইতিহাস ঘাটাঘাটি করলে এই বিয়ের সত্যতা পাওয়া যায়। ইতিহাস থেকে জানা যায়, দাহির সিন্ধু অঞ্চলে রাজা হওয়ার পর সারা দেশের প্রজাদের অবস্থা ঘুরে ঘুরে দেখে। সেই সাথে নিজ দেশের সীমান্ত এলাকা সম্পর্কেও সে প্রত্যক্ষ ধারণা লাভ করে। কয়েক
মাসের পর্যবেক্ষণ শেষে রাজা দাহির যখন রাজধানী আরুরে ফিরে এলো তখন রাজধানীর প্রজারা তার গমন পথে ফুল বিছিয়ে দিলো এবং তার ওপর ছিটিয়ে দিলো ফুলের পাপড়ী। রাস্তার দু’পাশে নারী পুরুষ সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে রাজাকে রাজধানীতে স্বাগত জানাল।
রাজা দাহির রাজধানীবাসীর আনুগত্যে মুগ্ধ হয়ে সেদিনই বিকেলে রাজপ্রাসাদে সাধারণ সভা আহবান করল। তাতে রাজধানীর শীর্ষস্থানীয় নাগরিকদেরকে পুরস্কারে ভূষিত করল এবং অভ্যাগত সবাইকে ভূরিভোজনে আপ্যায়িত করল। সভা ভেঙ্গে যাওয়ার পর শহরের বড় দুই পণ্ডিত তার কাছে গিয়ে তার খুবই প্রশংসা করল এবং রাজাকে দেবতার আসনে সমাসীন করল।
“আমরা মহারাজ ও মহারাজের বোন মায়াদেবীর ভাগ্য গণনা করিয়েছিজ্যোতিষীদের হয়ে বলল এক ঋষি। মহারাজের ভবিষ্যত আমরা যা দেখেছি তাতে কোন অসুবিধা নেই, সব ঠিকই আছে তবে একটু…। মায়ার ভাগ্য গণনা করতে গিয়ে আমরা পেয়েছি, যে ব্যক্তির সাথে মায়ার বিয়ে হবে সেই সিন্ধু অঞ্চলের রাজা হবে।”
“নিশ্চয়ই তা হবে আমার মৃত্যুর পর?” জিজ্ঞাসু কণ্ঠে বলল রাজা দাহির।
“না, মহারাজ! এবার এগিয়ে এসে বলল জ্যোতিষী। মহারাজের জীবদ্দশাতেই সে রাজা হবে।”
“কে হবে সেই রাজা? কোথেকে আসবে সে?” জিজ্ঞেস করল দাহির।
“এ বিষয়টি অস্পষ্ট মহারাজ! বলল জ্যোতিষী। ভাগ্য যেক্ষেত্রে অস্পষ্ট থাকে, সেক্ষেত্রে জ্যোতিষী ও গণকরাও অক্ষম। তারাও কিছু বলতে পারে না।”