সুলায়মানের নিযুক্ত নতুন সিন্ধু শাসক ইয়াজিদ বিন কাবশা সিন্ধুতে পদার্পন করল। সাথে নিয়ে এলো পূর্বাঞ্চলীয় শাসক ইয়াজিদ বিন মাহলাবের ভাই মুআবিয়া বিন মাহলাবকে। ইয়াজিদ এসেই হুকুম করল- “বিন কাসিম। মুআবিয়া বিন মাহতাব তোমাকে গ্রেফতার করে দামেস্ক নিয়ে যাবে। একাজের জন্যই খলিফা তাকে আমার সাথে পাঠিয়েছেন।’ কোন কথা না বলে স্বেচ্ছায় নিজেকে গ্রেফতারের জন্য পেশ করলেন বিন কাসিম। সিন্ধু বিজয়ী, পৌত্তলিক ভারতে ইসলামের আলো প্রজ্জ্বলনকারী, অসংখ্য মসজিদের প্রতিষ্ঠাতা, লক্ষ লক্ষ বঞ্চিত নিপীড়িত মূর্তিপূজার অন্ধকারে থাকা ভারতবাসীকে সত্য সুন্দর তৌহিদের পথ নির্দেশকারী ইতিহাসের ক্ষণজন্মা কিশোর সেনানী অপোবদনে হাতকড়া পরানোর জন্যে দু’হাত প্রসারিত করে দিলেন। তার শরীরের পরিধেয় কাপড় খুলে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত অপরাধীদের কাপড় পরিয়ে দেয়া হলো। হাত-পায়ে বাধা হলো ডান্ডা বেড়ি।
আফসোস, হিংসুটে সুলায়মান একবারও ভাবল না, সে শুধু একজন বিন কাসিমকে হাতকড়া পরিয়ে বন্দি করছে না, ইসলামের বিজয় অভিযান ও সম্প্রসারণকে স্তব্ধ করে দিচ্ছে। প্রাণ প্রিয় সেনানায়কের এই করুণ পরিণতি তার সহযোদ্ধারা মর্মজ্বালা নিয়ে দেখছিলেন, তাদের সবার দুচোখ গড়িয়ে বুক ভেসে যাচ্ছিল অনুতাপ, দুঃখ আর যন্ত্রণায়। সিন্ধুর আকাশ সে দিন
প্রত্যক্ষ করছিল ইতিহাসের নির্মমতা। বন্দীত্ববরণ করে সিন্ধু বিজয়ী বিন কাসিম সহযোদ্ধাদের দিকে তাকিয়ে উচ্চ আওয়াজে বলেছিলেন একটি আরবী পংক্তি। “আফসোস! ওরা আমাকে ধ্বংস করে দিল, এরা কতো জোয়ানকে ধ্বংস করেছে যারা রণাঙ্গনে বীর ছিল, সীমান্তের ছিল অতন্ত্র প্রহরী।”
বিন কাসিমকে বন্দী করে বাগদাদ নিয়ে গেলে সুলায়মান তার মুখোমুখি হলো না। সুলায়মানের শিখণ্ডি খীরাজের নবনিযুক্ত শাসক খারেজী সালেহ বিন আব্দুর রহমান সৈন্যদের নির্দেশ দিলো, ওকে ওয়াসতা বন্দিশালায় বন্দি করে রাখো, যেখানে হাজ্জাজের খান্দান ও তার জ্ঞাতি গোষ্ঠীকে বন্ধি করে রাখা হয়েছে। বন্ধিশালার দরজায় দাঁড়িয়ে বিন কাসিম বললেন-“তোমরা আমাকে জেলখানায় বন্দি করে এবং আমার হাতে পায়ে জিঞ্জির দিয়ে আমাকে বেকার করে দিয়েছে বটে কিন্তু আমার সেই সম্মান ও সাফল্যকে ম্লান করতে পারবে
আমি ছিলাম সেই বিন কাসিম, যাকে দেখলে সুলায়মানের মতো কাপুরুষ যোদ্ধাদের অন্তরাত্মা কেঁপে উঠত, আর আমি ইসলামের শত্রুদের শুধু হত্যাই করিনি তাদের জন্য ছিলাম জীবন্ত ত্রাস। বিন কাসিম আফসোস করে সর্বশেষ বলেন, হে সময়! বড় দুঃখ হয়; তুই মর্যাদাবানদের প্রতি খুবই অবিশ্বস্ত।
অতঃপর জেলখানায় বিন কাসিমকে একের পর এক শাস্তি দেয়া শুরু হলো। সীমাহীন ধৈর্য ও সহিষ্নুতায় বিন কাসিম নীরবে সব যন্ত্রণা সহ্য করে যেতে লাগলেন। সুলায়মান প্রতি দিনই বিন কাসিমদের মৃত্যু সংবাদ শোনার জন্য উদগ্রীব থাকতো। অবশেষে একদিন বিন কাসিমকে হত্যার ইঙ্গিত দিলো সুলায়মান। সুলায়মানের ইঙ্গিতে সালেহ বিন আব্দুর রহমান জেলখানাতেই বিন কাসিমকে আকীল গোত্রের হাতে তুলে দিলো। আকীল গোত্রের লোকেরা দলবেধে বিন কাসিমকে পেটাতে শুরু করল। বহুজনের প্রহারে বিন কাসিম সম্বিত হারিয়ে জীবন্ত লাশে পরিণত হলেন। প্রহারের ধকল সহ্য করতে না পেরে একদিন মৃত্যু আলীঙ্গন করলেন বিন কাসিম। তখন তাঁর বয়স বাইশ বছর।
যে বীর ইসলামের শত্রুদের হাত থেকে অস্ত্র ছিনিয়ে নিতেন, সেই বীর সেনানী নির্মমতার শিকার হয়ে স্বজাতির গাদ্দারদের হাতে নিহত হলেন। বিপন্ন বিন কাসিমের লাশ দেখে সেকালের কবি হামজা বিন রিয়াজ কাব্য করে বলেছিলেন
“সে তো দীপ্ত পৌরুষ, লৌহমানব, প্রসারিত জীবনের প্রতিচ্ছবি ছিল। সতেরো বছর বয়সে সৈন্য পরিচালনা করেছে। সে তো ছিল জন্মগত স্বভাবজাত সেনাপতি। অন্য এক কবি বলেছিলেন
“সতেরো বছর বয়সে সে ছিল রণাঙ্গনের সেনানী
তার বয়সের ছেলেরা খেলে ফিরে সারা দিন।”
ভারতের জমিনে চমকে দিয়েছিল যে সিতারা সে হঠাৎ নিভে গেল। সে দিন থেকেই ইসলামের ইতিহাসে শুরু হলো ক্ষমতার সংঘাত আর ভোগবাদীদের রাজত্বের খেলা। প্রতিপক্ষকে হত্যা ও নিঃশেষ করে দেয়ার জঘন্য রাজনৈতিক রীতি। এখনো মুসলিম দুনিয়া ক্ষমতা লিপ্সু ভোগবাদী রাজন্যবর্গের কব্জা থেকে মুক্ত হতে পারেনি। যার ফলে ইসলামের আলোক মশাল বিভা হারিয়ে অন্ধকারে চাপা পড়ে আর্তনাদ করছে। আর অপেক্ষা করছে এমন একজন ঈমানদীপ্ত ত্রাণকর্তার, যে সকল অন্যায় অন্ধকার দু’পায়ে ঠেলে ইসলামের আলো পুনর্বার দুনিয়া জুড়ে ছড়িয়ে দেবে।
সমাপ্ত