নয়। মায়া যে জায়গার কথা বলেছিল বেলাল চললো সেদিকে। রাণী পৌছার আগেই নির্দিষ্ট জায়গায় বেলাল পৌছে গেল। জায়গাটি খুবই সুন্দর। চতুর্দিকে ছোট বড় গাছপালা। থোকা থোকা লতাগুল্মে জংলী ফুলের সমারোহ। বিশাল ময়দানের মাঝখানে একটি ছোট ঝিলের মতো। স্বচ্ছ স্ফটিক পানির মধ্যে শাপলা, পদ্মফুল ফুটে একটা মনোরম পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। গাছে গাছে অসংখ্য নাম না জানা পাখির কলকাকলী। অসংখ্য ঝোপ ঝাড়ের পিছনে দু’দশজন মানুষ লুকিয়ে থাকা কোন ব্যাপারই নয়। বেলাল ঘোড়া দৌড়িয়ে পুরো এলাকাটি একটু দেখে নিল। সে বুঝতে চাইলো রাণীর কোন লোক কোথাও লুকিয়ে রয়েছে কি-না। কিন্তু অশ্বশুরের শব্দে পাক পাখালীর ছুটাছুটি ছাড়া কোথাও কোন জনমানুষের চিহ্ন সে খুঁজে পেল না। গোটা এলাকাটি পর্যবেক্ষণ শেষ করে বেলাল ঝিলের পাড়ে পৌছলে মায়ারাণীকেও আসতে দেখা গেল। মায়া বেলালকে দেখেই এক লাফে ঘোড়া থেকে নেমে বেলালের প্রতি একটা মুচকি হাসি দিল। বেলালও ঘোড়া থেকে নেমে ধীরে ধীরে নির্মোহভাবেই মায়ার দিকে অগ্রসর হলো।
বেলাল কাছে পৌছলেই হঠাৎ করে মায়া বেলালের একটি হাত তার দু’হাতের মুঠোয় নিয়ে চুমু দিল এবং বেলালের হাতটি তার কাঁধে নিয়ে বেলালের শরীরের সাথে নিজের শরীর মিশিয়ে দিল। বেলালের পাঁজর তার পাঁজরকে স্পর্শ করছে। বেলাল নিজেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে মায়ার বাহুবন্ধন থেকে নিজেকে মুক্ত করে নিল। নিজেকে সরিয়ে নিলে কেন? আমাকে কি তোমার ভালো লাগেনি?” বেলালকে মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করল মায়া। তুমি কি আমাকে এদেশের রাণী ভেবে ভয় পাচ্ছ? না, কোন ভয় পাওয়ার কারণ নেই। আমি ভালো করেই বুঝতে পেরেছি, তুমি আরবের কোন বেদুঈন নও, তুমি কোন না কোন বাহাদুর সর্দারের ছেলে। আমি জানি, আরব দেশ থেকে পালিয়ে যারা এসেছে তারা সাধারণ নাগরিক নয়, সবাই ওখানকার নেতৃস্থানীয় লোক, নয়ত নেতৃস্থানীয় লোকজনের সন্তান। তুমি তাদের মতোই একজন।” “আমি তোমাকে ভয় পাচ্ছি না রাণী। আমি এটা দেখে অবাক হচ্ছি যে, তুমি এদেশের রাণী হয়েও একাকী দুর্গের বাইরে এতোদূর এসেছে? না-কি তোমার দেহরক্ষীরা তোমার পিছনে পিছনে আসছে?”
“না, এখানে আমার কোন দেহরক্ষী আসবে না। আমি অন্য দশজন রাণীর মতো নই। অন্যসব রাণী তো প্রজাদের মধ্যে সমীহ সৃষ্টি করার জন্য বিশাল নিরাপত্তা প্রহরী বেষ্টিত হয়ে প্রাসাদের বাইরে বের হয়।”
“রাজা একাকী তোমাকে দুর্গের বাইরে বের হতে বাধা দেয়নি?”
“না। তুমি জেনে আশ্চার্যান্বিত হবে যে, মহা ভারতের কোন রাণী সাধারণত দুর্গের বাইরে যায় না, কিন্তু আমার ব্যাপারটি ভিন্ন।”
“এটা আবার কেমন ব্যাপার?”
“এটা পরে বলব। আমি আগে বুঝতে চাই, তোমার হৃদয়ে আমার প্রতি কোন ভালোবাসার উদ্রেক হয়েছে কি-না। তোমার প্রতি ভালোবাসা-ই আমাকে একাকী এখানে টেনে এনেছে। আচ্ছা! তুমি কি আমাকে ভালোবাসার যোগ্য মনে করো না?”
“অবশ্যই যোগ্য মনে করি। কিন্তু সেই সাথে আরো অনেক কিছুই মনে করছি আমি। আমার মনে হচ্ছে তুমি আমার জন্য একটি মায়াবী ফাদ তৈরী করছ!”
“আমি জানতাম, আরবের লোকেরা না-কি আমাদের দেশের লোকদের চেয়ে বেশী বুদ্ধিমান ও দূরদর্শী হয়। কিন্তু তোমার মধ্যে তো কোন বুদ্ধি বিবেক দেখছি না। তুমি এটা কি করে ভাবতে পারলে যে, আমাদের সেনাবাহিনী তোমাদের মতো পাঁচজন ভবঘুরেকে গ্রেফতার করতেও অক্ষম। তোমাকে যদি গ্রেফতার করারই ইচ্ছা থাকত, তাহলে রাতে কয়েকজন সেনা পাঠিয়ে দিলেই তো তোমাদের ধরে নিয়ে যেতে পারত।”
“তুমি আমার মধ্যে ভালোবাসার কি দেখলে রাণী?” এদেশে কি আমার চেয়ে কোন ভালো মানুষ তুমি পাওনি?”
“বেলাল। আমি এদেশের রাণী। এটা তো খুবই সম্ভব যে, তোমার চেয়েও আরো সুশ্রী সুন্দর টগবগে যুবক আমাকে পাওয়ার স্বপ্নে বিভোর হয়ে আছে। কিন্তু ভালোবাসার কথা মুখে উচ্চারণ করার দুঃসাহস পাচ্ছে না। কারণ দেশের রাণীকে সাধারণ প্রজারা দেবীতুল্য মনে করে। রাণীকে সাধারণ প্রজারা পূজা করে…। কিন্তু তোমার সৌভাগ্য বেলাল! এদেশের রাণী আজ তোমার মতো এক অজ্ঞাত বিদেশী যুবকের কাছে প্রেম নিবেদন করছে, ভালোবাসার ভিখারী সেজে একটু মমতা ভিক্ষা করছে। বেলাল! আমার দৃঢ় বিশ্বাস পূর্বজন্মে অবশ্যই আমরা একসাথে ছিলাম।”
“মৃত্যুর পর মানুষ আবার দুনিয়ায় পুনর্জন্ম লাভ করে, এ বিশ্বাস আমার ধর্মে নেই।”
“ভালোবাসার মধ্যে ধর্ম বিশ্বাস টেনে এনে দেয়াল সৃষ্টি করোনা বেলাল। একটু সময় আমার পাশে বসো, আমার হৃদয় ভেঙে দিয়ে তুমি চলে যেয়ো না।”
“নিজের একান্ত পাশে বেলালকে বসালো রাণী। বেলাল ছিল একজন সুদর্শন সাহসী যোদ্ধা। প্রখর মেধাবী ও তীক্ষবুদ্ধি সম্পন্ন সুদর্শন যুবক। হিন্দুস্তানের যে কোন রাণীই এই যুবককে দেখলে আকৃষ্ট হবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। অবশ্য মায়ারাণীও ছিল রূপবতী, সুন্দরী। যে কোন যুবকের পক্ষে মায়ার রূপ লাবণ্য ও সৌন্দর্য এড়িয়ে যাওয়ার মতো ছিল না। তাছাড়া মায়ার তীক্ষ্ণ ধী, প্রখর দৃষ্টি ও বাচনভঙ্গী যে কোন সুপুরুষকেই মায়ার বাঁধনে জড়ানোর জন্য যথেষ্ট। যে কোন যুবককেই প্রেমের বাঁধনে নিজের গোলামে পরিণত করার মতো গুণের অধিকারী ছিল মায়া।