কোন অভিযান ছাড়া নিষ্ক্রিয় অবস্থায় আরো কিছুদিন অতিবাহিত হলো। একদিন বিলাল বিন হিশাম নামের এক ব্যক্তি দামেশক থেকে সিন্ধুতে এলেন। দীর্ঘ বিরতিহীন সফরের ক্লান্তি তার চোখে মুখে। তাছাড়া রাজ্যের বিষন্নতা তার চেহারায়। বিন কাসিম তখন খীরাজ রাজ্যের এক জায়গায় ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শাবান ছাকাফীর সাথে কথা বলছিলেন। আগন্তক বিলাল বিন হিশাম তাদের পাশে গিয়ে ঘোড়া থেকে নামলেন। প্রথমে তিনি মুহাম্মদ বিন কাসিম ও পরে শা’বান ছাকাফীর সাথে কোলাকুলি
করলেন। কোলাকুলী করা অবস্থাতেই বিলাল হুহু করে কান্নায় ভেঙে পড়লেন। দুজনে ধরাধরি করে তাকে বিন কাসিমের কক্ষে নিয়ে বসালেন।
বিন কাসিম! আপনি যদি প্রাণে বেঁচে থাকতে চান তাহলে স্বাধীন খেলাফতের ঘোষণ দিন, দৃঢ় প্রত্যয়ী কণ্ঠে বললেন বিলাল বিন হিশাম। যে বিশাল এলাকা আপনি জয় করেছেন, আপনি নিজেকে এটির স্বাধীন সুলতান ঘোষণা করুন। আর যতোক্ষণ সুলায়মান বাগদাদের খলিফা থাকবে ততো দিন খেলাফতের সাথে সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করে রাখুন। হয়েছে কি, তুমি এসব কেন বলছো? ওখানকার অবস্থা কি তা বলো? উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন বিন কাসিম।
হয়েছে কি, না বলে বলুন কি হয়নি সেখানে? বললেন বিলাল। বাগদাদে এখন চলছে সুলায়মান বিন আব্দুল মালিকের বারীর শাসন। মরহুম খলিফা ওয়ালীদ বিন আব্দুল মালিক ও হাজ্জাজের সহযোগী ও সমর্থকদের নির্বিচারে হত্যা করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে তাদের অধিকাংশ নিহত হয়েছে। উচ্চ পদে যারা আসীন ছিলেন তাদের সবাইকে পদচ্যুত করা হয়েছে। তাদের নামে এমন লজ্জাকর অভিযোগ আনা হয়েছে যে, তাদের পক্ষে সমাজে মুখ দেখানোর উপায় নেই। যে কারো প্রতি একবার ইঙ্গিত করে যদি কেউ বলে দেয় এই লোকটি হাজ্জাজের সহযোগী কিংবা সমর্থক ছিল ব্যস, তার কোন প্রমাণের দরকার নেই। সুলায়মান তাকে হত্যা করাচ্ছে। ইবনে কাসিম সুলায়মান এতোটাই বেপরোয়া ও অপরিনামদর্শী বিনাসী তৎপরতায় মেতে উঠেছে যে, চীন বিজয়ী কুতাইবা বিন মুসলিম এবং স্পেন বিজয়ী মুসা বিন নুসায়েরকে ডেকে এনে গ্রেফতার করে তাদের পায়ে ডান্ডাবেড়ি পরিয়ে দিয়েছে। তাদের পরিবার পরিজনকে পথের ভিখারীতে পরিণত করেছে। শুনেছি, ক্ষণজন্মা এই দুই বিজয়ী সেনাপতিকে সে নির্মম শাস্তি দিয়ে হত্যা করবে।
অবশ্য পরবর্তীতে তাই ঘটেছিল। স্পেন বিজয়ী মূসা বিন নুসায়েরকে সুলায়মান পঙ্গু বানিয়ে মক্কায় পাঠিয়ে দিয়েছিল এবং মক্কায় আগত হজ্জব্রত পালনকারীদের কাছ থেকে ভিক্ষা করতে সে বাধ্য করেছিল।
বাগদাদ সালতানাতের অধীনস্ত সকল আঞ্চলিক আমীর তথা শাসকদের পদচ্যুত করেছে সুলায়মান, বললেন বিলাল বিন হিশাম।
ইয়াযিদ বিন মাহবকে বানিয়েছে পূর্বাঞ্চলীয় শাসক। আপনি হয়তো জানেন, ইয়াযিদ বিন মাহলাব আপনার খান্দানের ঘোতর দুশমন। হাজ্জাজের প্রতি ছিল তার প্রাণনাশী শত্রুতা। ইয়াজিদ বিন মাহতাব এক
খারেজী সালেহ বিন আব্দুর রহমানকে খীরাজের শাসক নিযুক্ত করেছে। সেও আপনার খান্দানের আরেক শত্রু। এরা আমার সামনেই বলেছে, বনী সাকীফকে আমরা ধুলায় মিশিয়ে দেবো…। বিন কাসিম! কোন ছাকাফীকে এরা বেঁচে থাকতে দেবে না। আপনি একজন ছাকাফীর কৃতী সন্তান। আপনাকে বরখাস্তের পয়গাম ইতোমধ্যে তৈরি হয়ে গেছে। আপনার হয়তো জানা আছে, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী খারেজী হওয়ার কারণে হাজ্জাজ বিন ইউসুফ সালেহ বিন আব্দুর রহমানের ভাইকে হত্যা করিয়ে ছিলেন। সালেহ এখন প্রকাশ্যে বলছে, সে তার ভাইয়ের রক্তের প্রতিশোধ নেবে গোটা বনী সাকীফের ওপর। বিন কাসিম! আপনি হবেন এই শত্রুতার প্রথম শিকার। তাই আপনাকে অনুরোধ করছি, বরখাস্তের আগেই আপনি স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে দিন। ‘হ্যাঁ, বিন কাসিম! সমুদ্র তীর থেকে সুরাট পর্যন্ত ছড়িয়ে থাকা সকল সৈন্য আপনার সাথে থাকবে। এদেশের হিন্দুরা পর্যন্ত আপনার আনুগত্য করেছে এবং আপনার প্রতি বিশ্বস্ত, আপনি স্বাধীনতা ঘোষণা করে দিন, বললেন বিন কাসিমের গোয়েন্দা প্রধান দূরদর্শী সেনানায়ক শা’বান ছাকাফী।
না, শাবান ছাকাফী! আমি যদি স্বাধীনতা ঘোষণা করি, তাহলে আমার মতো যেসব জায়গায় সেনাধ্যক্ষরা শাসকের দায়িত্বে রয়েছে তারা সবাই স্বাধীনতা ঘোষণা করবে। ফলে ইসলামী সালতানাত ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে। আমি এমনটি হতে দিতে পারি না।’ বললেন বিন কাসিম। বিন কাসিম একথা বলার আগেই অন্যান্য সেনা কর্মকর্তারাও সেখানে পৌঁছে গিয়েছিলেন। একে একে তাদের সবাই বিন কাসিমকে স্বাধীনতা ঘোষণা করার জন্য অনুরোধ করলেন। কিন্তু বিন কাসিম কারো কথায় সায় দিলেন না। তিনি বারবার বলছিলেন, খেলাফত কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী স্বার্থের খেলা নয়, এটি রাসূল সাঃ-এর পবিত্র আমানত। আমি রাসূল সাঃএর নির্দেশের পরিপন্থী কাজ করতে পারি না।
সকল সহযোদ্ধারা আবেদন নিবেদন করেও বিন কাসিমকে স্বাধীন সিন্ধু শাসক হিসাবে ঘোষণা করাতে পারলেন না। মুসলিম সালতানাতের ঐক্য অটুট রাখতে যে কোন পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে গেলেন বিন কাসিম।
আর এদিকে বাগদাদ ও দামেস্কে সুলায়মানের নির্দেশে তার বিরোধিতা কারীদের রক্ত ফুরাত বইতে শুরু করল। বনী সাকীফের সকল সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীকে প্রথমে সুলায়মান বরখাস্ত করল এবং হত্যা করতে শুরু করল। কোন ছাকাফী নারীও সুলায়মানের নৃশংসতা থেকে রেহাই পেল না। অতঃপর একদিন বিন কাসিমের বরখাস্তের পয়গাম এসে গেল। পয়গামে বিন কাসিমকে বরখাস্ত করে ইয়াযিদ বিন কাবশাকে সিন্ধু অঞ্চলের শাসক নিযুক্ত করা হলো। কি অভিযোগে বিন কাসিমকে সুলায়মান বরখাস্ত করল ইতিহাসে এর কোন উল্লেখ নেই। আসলে কোন অভিযোগের প্রয়োজনই ছিল না। কারণ বিন কাসিমের প্রতি সুলায়মানের ছিল গোষ্ঠীগত, ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ও বিদ্বেষ। ব্যক্তিগত ব্যর্থতা ও কাপুরুষতার জ্বালা মেটানোর জন্য অনুপম সাফল্য ও বিজয়ের অধিকারী বিন কাসিমকে নিঃশেষ করে তার কীর্তিকে স্নান করার হীন চেষ্টা চরিতার্থ করলেন সুলায়মান।