পয়গাম শুনে বিন কাসিম বার্তা বাহককে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি বলতে পারো? ওখানকার পরিস্থিতি কি? কেন এমন নির্দেশ দেয়া হলো?
সেই যুগে সেনাবাহিনীর চৌকস মেধাবী কর্মকর্তাদেরই সাধারণত বার্তাবাহক বা দূতের দায়িত্ব দেয়া হতো। এই দূতও ছিল তেমনই একজন সেনা কর্মকর্তা ও বুদ্ধিদীপ্ত চৌকস ব্যক্তি। বিন কাসিমের প্রশ্নের জবাবে দূত বলল, সম্মানিত আমীরে সিন্ধু! হাজ্জাজ বিন ইউসুফ বেঁচে থাকার সময় যে অবস্থা ছিল বর্তমানে বাগদাদের সেই অবস্থা নেই। খলিফা ওয়ালীদ বিন আব্দুল মালিক মারাত্মক অসুস্থ। এই অসুখ থেকে মনে হয় না খলিফা আর সুস্থ হবেন। খেলাফতের স্থলাভিষিক্ত কে হবে এ নিয়ে এখনই টানা হেঁচড়া শুরু হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে বনি উমাইয়ার শাসক গোষ্ঠী মসনদের আত্মকলহে খুন খারাবী করে নিঃশেষ হয়ে যাবে। খলিফা আব্দুল মালিক বিন মারওয়ান তার বড় ছেলে খলিফা ওয়ালীদ বিন আব্দুল মালিককে তার স্থলাভিষিক্ত করে গিয়েছিলেন। বলেছিলেন ওয়ালীদের পর তার ছোট ভাই স্থলাভিষিক্ত হবে। কিন্তু খলিফা ওয়ালীদ তার বড় ছেলে আব্দুল আযীযকে তার স্থলাভিষিক্ত করার ঘোষণা দিয়েছেন।
বিন কাসিম! আপনার ভবিষ্যতের ব্যাপারে আমার মনে দারুণ শঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। আপনার চাচা হাজ্জাজ ছিলেন খলিফা ওয়ালীদের সমর্থক। তিনি বাগদাদের প্রভাব ও প্রতাপশালীদেরকে আয়ত্তে রেখেছিলেন। তিনি বাগদাদের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের একথাও বলছিলেন, তারা যেন খলিফার অবর্তমানে আব্দুল আযীযকেই খলিফা হিসাবে মেনে নেয়। সুলায়মানের খলিফা হওয়ার ব্যাপারে বিরোধিতা করে। একথা বলার কারণে হাজ্জাজ ও
সুলায়মানের মধ্যে কথাবার্তাও বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তখন সুলায়মানের কোন কর্তৃত্ব ছিল না। ইচ্ছা থাকলেও তার পক্ষে হাজ্জাজের মতো পরাক্রমশালী ব্যক্তির বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপ নেয়া সম্ভব ছিল না। সুলায়মান তখন থেকেই হাজ্জাজকে জানের দুশমন মনে করতো। এখন হাজ্জাজ মুত্যুবরণ করেছেন, সুলায়মান মাথা উঠানোর সুযোগ পেয়েছে। সুলায়মানের ভবিষ্যত সংকল্প খুবই ভয়ানক…। খলিফা ওয়ালীদ দূরদর্শী লোক। তিনি বিছানায় পড়ে থেকেও দূরবর্তী সকল শাসক ও সেনাপতিদের নির্দেশ পাঠিয়েছেন প্রত্যেকেই যেন সেনাবাহিনীকে নতুন অভিযান পরিচালনা থেকে বিরত রাখে। নয়তো বিপদে পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তিনি হয়তো বুঝতে পারছেন, তার জীবন আর বেশী দিন নেই। তিনি হয়তো এই আশঙ্কায় আপনার কাছেও এই পয়গাম পাঠিয়েছেন। এমন না হয়ে যায় আপনি সৈন্যদের নিয়ে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছেন আর ঠিক সেই মুহূর্তে সুলায়মান নির্দেশ পাঠালো লড়াই বন্ধ কর। তার অর্থ হলো পিছু হটে এসো। পরাজয় স্বীকার করে নাও। আমীরে সিন্ধ! পশ্চিম আকাশ মেঘাচ্ছন্ন মনে হচ্ছে। ভয় হচ্ছে কোন মুসিবত আমাদের জন্যে অপেক্ষা করছে।
শৈশব থেকে যার প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে বেড়ে ওঠা সেই হাজ্জাজ বিন ইউসুফ, প্রিয় অভিভাবক আপন চাচা ও পথনির্দেশক হাজ্জাজের মৃত্যু শোক তখনো ভুলতে পারেননি বিন কাসিম। এরই মধ্যে খলিফা ওয়ালীদ বিন আব্দুল মালিকের শয্যাশায়ী ও দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার সংবাদ বিন কাসিমকে উদ্বেগাকুল করে ফেলল। খেলাফতকে ঘিরে উত্তরাধিকারীদের আত্মকলহের খবর বিন কাসিমকে আরো বেশী পেরেশান করে তুলল। সুলায়মান বিন আব্দুল মালিকের কাছ থেকে ভালো কিছু পাওয়ার আশা ছিল।
কারণ সেই কৈশর থেকেই বিন কাসিমের প্রতি সুলায়মান ছিল হিংসা ও বিদ্বেষে শক্ত ভাবাপন্ন। তুমি ঠিকই বলেছ। পশ্চিমাকাশে অন্ধকার ঘনিভূত হচ্ছে, আমাদের ভবিষ্যতও না জানি অন্ধকারে তলিয়ে যায়। আল্লাহ আমাদের সবাইকে রহম করুন।
হাজ্জাজের মৃত্যু ও খলিফার অসুস্থতার সংবাদ দিয়ে দূত ফিরে যাওয়ার কয়েক দিন পরই নতুন এক সংবাদ বাহক খবর নিয়ে এলো, খলিফা ওয়ালীদ
ইন্তেকাল করেছেন। খেলাফতের মসনদে আসীন হয়েছেন সুলায়মান।… এবং নতুন খলিফার আনুগত্য স্বীকার করে বিশ্বস্ততা ও নির্দেশ পালনের লিখিত অঙ্গীকার নামা দেয়ার জন্য আপনার প্রতি নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
বিন কাসিম শঙ্কা ও চাপের পাহাড় মাথায় নিয়ে দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে অঙ্গীকারনামা লিখে দিলেন। তিনি সেনাধ্যক্ষ ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ডেকে তার অঙ্গীকার নামায় স্বাক্ষর দেওয়ার কথা জানিয়ে দিলেন।
বিন কাসিমের সেনাবাহিনীর অফিসারদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন তাঁর চেয়ে দিগুণের চেয়েও বয়সে প্রবীণ। তারা বাগদাদের শাসনতান্ত্রিক অবস্থা ও সামাজিক পরিস্থিতি যতটুকু জানতেন ততটুকু বিন কাসিমের জানা ছিল না। বিন কাসিম ছিলেন আল্লাহ প্রদত্ত সামরিক জ্ঞানে দক্ষ এবং যুদ্ধবিদ্যা ও সেনা পরিচালনায় পারদর্শী। ধন-সম্পদ, বিষয় সম্পত্তি ও রাজনৈতিক মারপ্যাচের কুটিল চালের প্রতি তার কোন আকর্ষণ ছিল না। কোন মানুষ ব্যক্তিগত স্বার্থে জীবন বিসর্জন দেয়, জাতীয় স্বার্থকে জলাঞ্জলি দেয়, ব্যক্তি বা গোষ্ঠী স্বার্থে জাতির উন্নত শীর অবদমিত করে, মানুষের এই হীন দিকটি বিন কাসিমের কাছে উম্মুক্ত ছিল না। তিনি কল্পনাও করতে পারেননি ক্ষমতার মোহ ও মসনদের চক্রান্ত তাকে কেমন গ্যাড়াকলে আটকে ফেলেছে। ফলে খলিফা ওয়ালীদ বিন আব্দুল মালিকের মৃত্যুতে যতোটা না বিন কাসিম উদ্বিগ্ন হলেন এর চেয়ে বেশী চিন্তিত হয়ে পড়লেন তার অধীনস্থ সেনাধ্যক্ষ ও কর্মকর্তাবৃন্দ। যে সেনারা সর্বক্ষণ অগ্রাভিযানের চিন্তায় বিভোর থাকতো, কোন বাধা বিপত্তিই যাদের বিন্দুমাত্র হতোদ্যম করতে পারতো না, সুলায়মানের খেলাফতের মসনদে আরোহণে তারা সবাই কেমন যেনো ঝিমিয়ে পড়ল। রাজ্যের ক্লান্তি অবসাদ আড়ষ্টতা যেন তাদের গ্রাস করল। আকুতোভয় বীর যোদ্ধাদের সব আবেগ উদ্দীপনা উচ্ছাস যেন হাওয়ায় বিলীন হয়ে গেল।