ধরা গলায় বললেন বিন কাসিম। সৌম্য ক্লান্তিময় বিন কাসিমের চেহারা মেঘে ঢাকা চাঁদের মতো কালো হয়ে গেল। হাজ্জাজের ইন্তেকাল শুধু সিন্ধু অভিযানের অগ্রাভিযানই থামিয়ে দিল না, প্রকারান্তরে হাজ্জাজের ইন্তেকালের মধ্যেই শুরু হয়ে গেল বিন কাসিমের ভারত অভিযানের যবনিকা।
বিষন্ন কণ্ঠে বিন কাসিম সেনাধ্যক্ষদের উদ্দেশ্যে বললেন, এখন আর আমরা কন্নৌজ অভিযান শুরু করব না। আশা করি খলিফা ওয়ালীদ বিন আব্দুল মালিক আমাদের সাথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবেন না। আমরা তার পাওনা মিটিয়ে দিয়েছি। বরং তিনি যা খরচ করেছিলেন তার চেয়ে দ্বিগুণ রাজকোষে জমা করেছি। তাছাড়া বিশাল এক রাজত্ব মুসলিম সালতানাতে অন্তর্ভুক্ত করেছি। আশা করি তিনি আমাদের সংকল্পের সামনে কোন প্রাচীর সৃষ্টি করবেন না। তবুও আমাদেরকে সতর্ক হতে হবে। কারণ এখন আর দ্বিতীয় কোন হাজ্জাজের উদ্ভব হবে না, যিনি খলিফার ওপর প্রভাব সৃষ্টি করে তাকে রাজত্বের বিলাসিতা থেকে নিবৃত্ত রাখবেন এবং আমাদেরকে পদে পদে উৎসাহিত উজ্জীবিত ও দিক নির্দেশনা দেবেন। এখন আর আগের অবস্থা নেই। হতে পারে, আমরা শত্রুদের মোকাবেলায় লিপ্ত আর এমন অবস্থায় বাগদাদ থেকে নির্দেশ এসে গেল- থেমে যাও, সিন্ধুর জন্য নতুন আমীর নিযুক্ত হয়েছেন।
আমাদের পক্ষে নির্বিকার বসে থাকাও ঠিক হবে না। বললো এক সেনাপতি। এমনটি দেখলে শত্রুরা আমাদের ওপর চড়াও হতে পারে। ওরা ভাবতে পারে আমরা দুর্বল হয়ে গেছি। অথবা ক্লান্ত হয়ে গেছি কিংবা কোন কারণে আমাদের পক্ষে আর অভিযান করা সম্ভব নয়।
এই অবস্থায় আমরা যদি শোকাবহ পরিবেশ সৃষ্টি করি, তাহলে সৈন্যরা লড়াইয়ের অনুপযুক্ত হয়ে পড়বে, আমাদেরকে কোন না কোন দিকে অভিযান পরিচালনা করতেই হবে বলল আরেক সেনাধ্যক্ষ বিন কাসিম দেখলেন, সেনাধ্যক্ষদের পরামর্শ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই কন্নৌজ অভিযান মুলতবি রেখে অন্যান্য কার্যক্রম তিনি অব্যাহত রাখলেন। যেসব হিন্দু শাসক বিনা যুদ্ধে বিন কাসিমের বশ্যতা স্বীকার করে নিয়েছিল, আজ আর সেসব শহর নগরের অস্তিত্ব নেই। প্রকৃতি সেগুলো বদলে ফেলেছে, অনেক ক্ষেত্রে মানুষ হয়েছে স্থানান্তরিত। কালের বিবর্তনে সেই সময়ের নগর জনপদের নামচিহ্নও বদলে গেছে।
বিন কাসিমের বিজয় অভিযানে বর্তমান ভারতের কিছু অংশও মুসলিম সালতানাতের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। তম্মধ্যে একটি রাজ্যের নাম ছিল খীরাজ। খীরাজ শহরের নাম শুধু বিন কাসিমের ভারত অভিযানের ইতিহাসেই পাওয়া যায়। বর্তমানে এই জায়গাটি কোথায় কি নামে পরিচিত তা উদ্ধার করা কারো পক্ষে সম্ভব হয়নি। ইতিহাস শুধু এতটুকু বলেছে, খীরাজ অভিযানে বিন কাসিম নিজে সৈন্য পরিচালনা করেছিলেন। খীরাজের রাজা ছিল দুবড়া। দুবড়া বিন কাসিমকে মোকাবেলা করার জন্য সৈন্যদেরকে দুর্গের বাইরে নিয়ে এসেছিল এবং নিজে ছিল সৈন্যদের অগ্রভাগে। রাজা দুবড়া এতোটাই দুঃসাহসী ভূমিকায় অবর্তীণ হয়েছিল যে, সে তার সৈন্যদের সারি থেকে এগিয়ে মুসলিম সৈন্যদের সারিতে হামলা করছিল। তার তরবারীর সামনে কোন মুসলিম যোদ্ধাই দাঁড়াতে পারছিল না। যেই তার মুখোমুখি হচ্ছিল তার তরবারী তাকে ধরাশায়ী করছিল। এক পর্যায়ে সে বিন কাসিমের উদ্দেশ্যে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়। রাজা দুবড়ার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে বিন কাসিম তার দিকে এগিয়ে গেলেন কিন্তু বিন কাসিমের একান্ত নিরাপত্তা রক্ষীরা নিজেদের জীবনের চেয়ে তরুণ বিন কাসিমের জীবনকে মূল্যবান মনে করে। চারজন এগিয়ে গিয়ে রাজা দুবড়াকে ঘিরে ফেলে। রাজা দুবড়ারও নিরাপত্তা বলয় ছিল। দুবড়ার নিরাপত্তা রক্ষীরা বিন কাসিমের নিরাপত্তারক্ষীদের ওপর হামলে পড়ল। রাজা দুবড়ার সৈন্যদের আক্রমণ প্রতিরোধ করেও বিন কাসিমের নিরাপত্তা রক্ষীরা রাজা দুষ্ককে বেষ্টনীর মধ্যে আটকে রাখতে চাচ্ছিল। কিন্তু বহু সংখ্যকের আক্রমণে বিন কাসিমের তিন জন নিরাপত্তারক্ষীই প্রতিপক্ষের আঘাতে ধরাশায়ী হয়ে পড়ে। এক পর্যায়ে চতুর্থ নিরাপত্তারক্ষী মুসলিম যোদ্ধা রাজা দুবড়ার ওপর এমন তীব্র আঘাত হানে যে, রাজার পক্ষে সেই আক্রমণ প্রতিহত করা সম্ভব হয়নি। মুসলিম যোদ্ধার আঘাতে রাজা দুবড়া ঘোড়া থেকে মাটিতে ছিটকে পড়ল। নিজেকে শামলে নিয়ে রাজা যখন উঠতে চেষ্টা করছিল ঠিক এমন সময় তারই এক নিরাপত্তারক্ষীর ঘোড়া আহত রাজার উপরে উঠে গেল। আঘাতের কারণেই রাজার মৃত্যু হতো কিন্তু তাড়া খাওয়া ঘোড়ার এক পা পড়ল রাজার বুকে, আর তাতে মুহুর্তের মধ্যেই রাজার দেহ নিথর হয়ে গেল। রাজার মৃত্যুতে খীরাজের সৈন্যরা হতোউদ্যম হয়ে গেল। যে যেদিকে পারল পালিয়ে বাঁচার চেষ্টা করল। রাজাকে সাঙ্গ করে মুসলিম যোদ্ধারা এমন তীব্র আক্রমণ করল যে, অল্পক্ষণের মধ্যেই ময়দান ফাঁকা হয়ে গেল।
মোকাবেলার চেষ্টা ত্যাগ করে নেতৃত্ব শূন্য সৈন্যদের কিছু অংশ দুর্গে আশ্রয় নিল আর অধিকাংশই আহত-নিহত ও চতুর্দিকে পালিয়ে গেল। বিজয়ী বেশে বিন কাসিম খীরাজ দুর্গে প্রবেশ করলেন। খীরাজ বিজয়ের ফলে বিশাল অঞ্চল বিন কাসিমের অধিকারে অন্তর্ভুক্ত হলো।
৯৬ হিজরী সনের জুমাদিউসসানী। হঠাৎ এক দিন বাগদাদের খলিফার পক্ষ থেকে এক দূত বিন কাসিমের কাছে জরুরি বার্তা নিয়ে এলো। খলিফা লিখেছেন, সেনাবাহিনী যে অবস্থানে আছে সেখানেই রাখো, আর কোন দিকে অভিযান করো না।’