হে আরব! আমি জানি তোমরা কেন এসেছ। তবুও আমি তোমার মুখেই শুনতে চাই। আবু হাকিমের উদ্দেশে গুরুগম্ভীর কণ্ঠে বললেন রাজা। রাজা বললেন, বলো তোমরা কি বার্তা নিয়ে এসেছ।
আবু হাকিম শায়বানী রাজার দিকে তার লিখিত পয়গাম বাড়িয়ে দিলেন।
মনে হয় বিভ্রান্তির শিকার হয়ে তোমরা এখানে এসেছ? বিগত দেড়হাজার বছর ধরে এ রাজ্য শাসন করছে আমার খান্দান। আজ পর্যন্ত এই জমিনে কোন বহিঃশত্রু পা রাখার দুঃসাহস করেনি। আর তোমরা আমাকে আমার বাপ-দাদার সনাতন ধর্ম ত্যাগ করে তোমাদের ধর্ম গ্রহণ করার কথা বলার মতো ধৃষ্টতা দেখাচ্ছ। আরো বলছ, আমরা তোমাদের ধর্ম গ্রহণ না করলে তোমাদেরকে জরিমানা দিতে হবে।
সম্মানিত রাজা। সিন্দু রাজা দাহিরও আপনার মতোই কথা বলেছিল। বললেন আবু হাকিম। দাহিরও রাজ সিংহাসনে বসে এমন ভাষায়ই কথা বলতো। কিন্তু আজ দেখুন, কোথায় আজ দাহির। কোথায় আজ তার রাজত্ব! এ ধরনের ধৃষ্টতা প্রদর্শনকারীকে আমরা কখনো ক্ষমা করি না, কঠোর কণ্ঠে বলল রাজা রায় চন্দ্র। ধৃষ্টতা প্রদর্শনকারীকে আমরা এমন নির্মম ও নিষ্ঠুর শাস্তি দিই যে, সেই শাস্তি দর্শনকারী ও শ্রবণকারী ভয়ে কাঁপতে থাকে।
কিন্তু তুমি একজন দূত। দুভাষী সাথে নিয়ে এসেছ। তুমি ফিরে গিয়ে সেনাপতিকে বলো, সাহস থাকলে সে যেন সৈন্য নিয়ে আসে। আমরা তার পয়গামের জবাব তরবারী দিয়েই দিতে চাই।
রাজার কথা শুনে আবু হাকিম শায়বানী মুলতান ফিরে এসে কন্নৌজের রাজার জবাবের কথা জানালেন। তিনি বিন কাসিমকে আরো জানালেন, রাজা তার সাথে কথা বলার সময় অত্যন্ত অহংকার ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ দেখিয়েছে। বিন কাসিম আবু হাকিমের বক্তব্য শোনার পর সেনাবাহিনীকে অভিযানের প্রস্তুতি নিতে নির্দেশ দিলেন।… তবে বলেদিলেন, এবারের প্রস্তুতি যেন মুলতান অভিযানের মতো না হয়। আমরা সেখানে পৌছার পর যেন কোন ধরনের রসদ ঘাটতির মুখোমুখি না হতে হয়। তোমাদের মনে রাখতে হবে কন্নৌজের সেনাবাহিনী পূর্ণউদ্যোমে থাকবে। আল্লাহর শোকর রণক্লান্ত ও সংখ্যায় অপ্রতুল হওয়ার পরও তিনি প্রতিটি যুদ্ধে আমাদের মদদ করেছেন। অবশ্য আমাদেরকে আল্লাহর সাহায্য ও রহমতের ওপরই ভরসা রাখতে হবে। কিন্তু তোমরা বিলক্ষণ জানো, আল্লাহ সেই মুসলমানদেরই সাহায্য করেন, সামর্থের সবটুকু প্রস্তুতি যখন মুসলমানরা সম্পন্ন করে।
হিন্দুস্তানের শাসক ও সৈন্যরা তাদের সংখ্যাধিক্য ও হস্তিবাহিনী নিয়ে খুব গর্ব করে। রায় হরি চন্দ্রের কাছে হয়তো সে খবর পৌছেছে, দাহির আমাদেরকে তার বিশাল হস্তিবাহিনীর ভয় দেখিয়েছিল। কিন্তু দাহিরের হস্তি বাহিনীর ওপর যখন মুজাহিদদের আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল, তখন নিজ সৈন্যদেরকেই জঙ্গি হাতির পদতলে পিষ্ট হতে হলো। দেখবে কন্নৌজ রাজ্যের অহংকার তার হাতিরাই ধূলায় মিশিয়ে দেবে।
শুরু হয়ে গেল কন্নৌজ অভিযানের প্রস্তুতি। রণক্লান্ত মুসলিম যোদ্ধাদেরকে বিশ্রামের জন্য আরো কয়েকদিন অবকাশ যাপনে রাখা জরুরি ছিল, সেই সাথে মুলতান যুদ্ধে আহতদের সুস্থ হয়ে ওঠার জন্যেও দরকার ছিল আরো কিছুদিন। ফলে সপ্তাহ খানিক অভিযান বিলম্বিত করার সিদ্ধান্ত নিলেন বিন কাসিম।
দুই তিনবার বাগদাদ থেকে হাজ্জাজ বিন ইউসুফের দূত এলো। বিন কাসিম আগেই নিরাপত্তা রক্ষীদের জানিয়ে দিয়েছিলেন, বাগদাদ থেকে যখনই কোন পয়গামবাহী আসবে তাকে না আটকিয়ে সাথে সাথে আমার কাছে নিয়ে আসবে। এক পর্যায়ে এটা সাধারণ নিয়মে পরিণত হয়েছিল, হাজ্জাজের যে কোন দূত এসে সরাসরি বিন কাসিমের কাছে চলে যেত। সে দিনও হাজ্জাজের পয়গামবাহী সরাসরি এসে বিন কাসিমের তাবুর সামনে ঘোড়া থেকে নেমে অনুমতি নিয়ে সালাম দিয়ে বিন কাসিমের তাঁবুতে প্রবেশ করল। বিন কাসিম আনন্দচিত্তে বসা থেকে উঠে পয়গাম দেখার জন্য হাত বাড়িয়ে দিলেন। বিন কাসিম মনে করেছিলেন, তিনি যেসব সোনাদানা হাজ্জাজের কাছে পাঠিয়েছিলেন, সেগুলো নিশ্চয়ই পৌছে গেছে এবং তা হাতে পেয়ে হাজ্জাজ তাকে শুভেচ্ছা বার্তা দিয়েছেন।
কিন্তু বিন কাসিম উচ্ছাসে এগিয়ে এলেও পয়গামবাহী ঠায় দাঁড়িয়ে রইল, কারণ তার কাছে লিখিত কোন পায়গাম ছিল না। আগম্ভকের চেহারায় গাঢ় ক্লান্তির ছাপতো ছিলই তার চেয়ে বেশী ছিল বিষন্নতা।
আল্লাহর কসম! এমন কোন ব্যাপার কি ঘটেছে, যা তুমি বলতে দ্বিধা করছো? জী হ্যাঁ, সিন্ধুর শাসক! বলতেই আগন্তুকের কণ্ঠ বাকরুদ্ধ হয়ে এলো এবং তার দু’চোখ বেয়ে অশ্রু নেমে এলো।
বলো কি খবর এনেছ? আমাকে বিজয়ের আনন্দে দুঃখ দাও…। দেরী করো না? কঠোর কণ্ঠে বললেন বিন কাসিম।
আমীরে বসরা হাজ্জাজ বিন ইউসুফ, ইন্তেকাল করেছেন, বলেই সংবাদবাহক হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল। ইন্নালিল্লাহ! বলে দুহাতে মুখ ঢেকে বিন কাসিমও হাজ্জাজের ইন্তেকালের খবর শুনে শিশুর মতো কাঁদতে লাগলেন। একটু পরে নিজেকে সামলে নিয়ে দ্বাররক্ষীকে ডেকে বললেন “সবাইকে ডাকো।”
দ্বাররক্ষী জানতো সবাই বলতে কাকে কাকে ডাকতে হবে।
অল্প সময়ের মধ্যেই সকল সেনাপতি, প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও বিন কাসিমের উপদেষ্টাবৃন্দ তাঁর তাঁবুতে প্রবেশ করল।
আমার মাথার ওপরে সবচেয়ে জরুরি ছায়াদানকারী ব্যক্তিটি আজ আর নেই। হাজ্জাজ বিন ইউসুফ ইন্তেকাল করেছেন।