বিন কাসিমের সিন্ধু অভিযানে মোট কতো ব্যয় হয়েছিল এ নিয়ে ঐতিহাসিকদের মতভেদ দেখা যায়। কেউ বলেন, শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বিন কাসিমের সিন্ধু অভিযানে মোট ছয় কোটি দিরহাম ব্যয় হয়েছিল। কিন্তু যুদ্ধলব্ধ সম্পদ থেকে বাগদাদ খেলাফতকে যা দেয়া হয়েছিল তার পরিমাণ বারোকোটি দিরহামের চেয়েও বেশি ছিল। উল্লেখিত অংকের দাবিদার ঐতিহাসিগণ হাজ্জাজ বিন ইউসুফের একটি চিঠিকে এর প্রমাণ হিসাবে উপস্থাপন করেছেন। তাতে হাজ্জাজ লিখেছেন, আমরা হিন্দুদের মুসলিম হত্যার প্রতিশোধ নিয়েছি এবং এই অভিযানে আমাদের যা খরচ হয়েছে তাও উসূল করে নিয়েছি। বরং ছয় কোটি দিরহাম আরো অতিরিক্ত খেলাফতের ভাণ্ডারে জমা হয়েছে। সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি গাদ্দার রাজা দাহিরের কর্তিক মস্তক বাগদাদ খেলাফতের পদতলে নীত হয়েছে।
বিন কাসিম দাউদ বিন নসর আম্মানীকে মুলতানের কেন্দ্রীয় শাসক এবং মুলতান রাজ্যের অধীনস্থ অন্যান্য ছোট ছোট এলাকার জন্য ইকরামা বিন রায়হান শামী আহমদ বিন খুযাইমা মাদানীকে শাসক নিযুক্ত করলেন। মুলতান রাজ্য ছিল বিশাল এলাকা জুড়ে। এ জন্য গোটা এলাকাকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য খুব চিন্তা ভাবনা করে প্রশানসিক কাঠামো বিন্যাস করলেন বিন কাসিম। বিন কাসিম মুলতান জয়ের পর পঞ্চাশ হাজার অশ্বারোহী সৈন্য নিজের সাথে রাখলেন। আর অশ্বারোহী ও পদাতিক মিশ্রণে অন্যান্য এলাকার নিরাপত্তা রক্ষায় প্রয়োজন মতো সৈন্য মোতায়েন করলেন বিন কাসিম। বিন কাসিমের মুলতান জয়ের ফলে বর্তমানের গোটা পাঞ্জাব ও কাশ্মীরের কিছু অংশ ইসলামী শাসনের অধীনে চলে আসে। মুলতান বিজয়ের পর গোটা এলাকার ছোট ছোট শাসকরা বিন কাসিমের বশ্যতা স্বীকার করে নিয়ে তার অনুগত্যের চুক্তি করে। এরপর বিন কাসিম মূল ভারতের দিকে মনোনিবেশ করেন। মুলতানের পর বিন কাসিমের সামনে মূল ভারতের মধ্যে প্রথম টার্গেট ছিল কন্নৌজ। সে সময় কন্নৌজ ছিল ভারতীয় রাজ্যগুলোর মধ্যে অন্যতম বৃহৎ ও শক্তিশালী রাজ্য। একদিন বিন কাসিম তার সেনা কর্মকর্তাদের ডেকে তার আগামী গন্তব্যের কথা ব্যক্ত করলেন এবং অভিযানের কলাকৌশল নিয়ে কমান্ডার ও কর্মকর্তাদের সাথে সলাপরামর্শ করলেন। সর্বসম্মত প্রস্তাব উঠল, কন্নৌজের
রাজাকে সর্বাগ্রে ইসলামের দাওয়াত দেয়া হবে। এ প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার পর বিন কাসিম সেনাপতি ও কমান্ডারদের ওপর দৃষ্টি ফেরালেন। হঠাৎ এক সেনাপতির ওপর তার দৃষ্টি আটকে গেল।
আবু হাকিম শায়বানী! আল্লাহর কসম! কন্নৌজ রাজার কাছে ইসলামের দাওয়াত ও আমাদের পয়গাম নিয়ে যাওয়ার জন্য তোমাকেই আমার কাছে যথার্থ ব্যক্তি বলে মনে হচ্ছে। ভালো হবে কি মন্দ হবে জানি না বিন কাসিম! তবে আমাকে দায়িত্ব দিলে দায়িত্ব পালন করেই আপনার ধারণার যথার্থতা প্রমাণ করব, বলল শায়বানী। ঠিক আছে, এ অভিযানের দায়িত্ব তোমাকেই দেয়া হলো। দশ হাজার অশ্বারোহী সৈন্য যাবে তোমার সাথে। এছাড়া থাকবে স্থানীয় পথ প্রদর্শক ও সহযোগী দল। রাস্তার অবস্থা ও প্রয়োজনীয় কি জিনিসের দরকার হবে এ ব্যাপারে তুমি খোঁজ-খবর নিয়ে আমাকে জানাও। যা যা লাগবে আমি সংগ্রহ করে নেব’ সম্মানিত সেনাপতি! বলল আবু হাকিম শায়বানী। কন্নৌজের রাজাকে আমার কি বলতে হবে?
তাকে ইসলাম গ্রহণের জন্য দাওয়াত দেবে। ইসলাম গ্রহণের দাওয়াত কাকে কোন ভাষায় দিতে হয় এ বিষয় তুমি ভালোই জানো। সে যদি ইসলাম গ্রহণে অসম্মতি জানায় তাহলে আমাদের অনুগত্য করে বশ্যতা স্বীকার করে নেয়ার প্রস্তাব করবে এবং বলবে এমতাবস্থায় তাকে জিযিয়া দিতে হবে। তাকে জানাবে, ডাভেল থেকে শুরু করে কাশ্মীর পর্যন্ত যেসব রাজা ইসলাম কবুল করেছে, আর কারা কারা ইসলাম গ্রহণ না করে বশ্যতা স্বীকার করে জিযিয়া আদায় করছে। পক্ষান্তরে কোন কোন রাজা ও শাসকরা যুদ্ধ করে নিহত ও রাজ্য হারিয়ে দেশান্তরিত হয়েছে তাও অবহিত করবে।
সে যদি আমাদের প্রস্তাব না মেনে বরং আমাদের সাথে মোকাবেলার জন্য যুদ্ধের আহবান করে, তাহলে আমাকে কি করতে হবে? আমি কি এই দশ হাজার সৈন্য নিয়ে তার মোকাবেলা করবো? বললেন সেনাপতি আবু হাকিম শায়বানী। না আবু হাকিম। প্রথমেই তুমি মোকাবেলায় যাবে না। এই বাহিনী নিয়ে তুমি উদয়পুর পর্যন্ত যাবে। সেখান থেকে একজন দূত সঙ্গে নিয়ে কন্নৌজ রাজার কাছে যাবে। সৈন্যরা উদয়পুরে অবস্থান করবে।
আবু হাকিম শায়বানী দশ হাজার অশ্বারোহী নিয়ে উদয়পুর পৌছে সেখানে সৈন্যদের শিবির স্থাপন করলেন এবং একজন দূত ও কিছু সংখ্যক নিরাপত্তারক্ষী সঙ্গে নিয়ে কন্নৌজ রাজার উদ্দেশে রওয়ানা হলেন।
কন্নৌজের রাজা ছিলেন রায় হরিচন্দ্র। রায় হরিচন্দ্রের কাছে খবর পৌছাল এক আরব সেনাপতি মহারাজের সাথে সাক্ষাত করতে এসেছে। তার সাথে এসেছে উদয়পুরের এক কর্মকর্তা। রায় হরিচন্দ্র খবর পাওয়ার সাথে সাথেই তাদেরকে তার রাজ দরবারে ডেকে পাঠালেন।
আবু হাকিম শায়বানী রাজদরবারে প্রবেশ করে দেখলেন, কন্নৌজের রাজা অত্যন্ত উঁচু একটি সিংহাসনে উপবিষ্ট। তার পিছনে অর্ধনগ্ন সুন্দরী তরুণী ময়ূরের পালকের তৈরি পাখা দিয়ে বাতাস করছে। দুজন চৌকিদার রাজার ডান ও বাম পাশে সশস্ত্র অবস্থায় দাঁড়ানো। আবু হাকিমের সাথে রাজ দরবারে উদয়পুরের একজন কর্মকর্তা ও একজন দুভাষী ছিলেন।