গুপ্তধনের মন্দিরের অবস্থান খুব বেশী দূরে ছিল না। সে সময়কার মুলতানের ভূপ্রকৃতি ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। উঁচু টিলা, খানা খন্দক আর ঝোপঝাড়ে ভর্তি ছিল গোটা মুলতান। একটি নির্জনস্থানে ছিল মন্দির।
বিন কাসিম যখন মুলতান জয় করেন তখন এ মন্দির ছিল পরিত্যক্ত। পূজাপাট তো দূরের কথা কোন জনমানুষ সেই মন্দিরের ধারে কাছেও যেতো না। লোকজন সেটিকে ভূত-পেত্নীর আবাসস্থল বলে মনে করতো। মানুষ বিশ্বাস করতো, পাপীদের আত্মাগুলোকে সেই মন্দিরে নিয়ে শাস্তি দেয়া হয়। মন্দিরের আশেপাশে কোন হিংস্র জন্তু জানোয়ার দেখলে লোকেরা বলতো এগুলোই পাপীদের প্রেতাত্মা। এই বৃদ্ধ পুরোহিতের বাপদাদারা অনেকটা ইচ্ছা করেই এই মন্দির সম্পর্কে জনমনে ভীতিকর পরিস্থিতির জন্ম দিয়েছিল। যাতে ওখানকার গুপ্তধনের খবর কেউ জেনে না যায়। বিন কাসিম সেখানে পৌছে ঘোড়া থেকে নেমে পড়লেন। পুরোহিত কেন জানি অজ্ঞাত এক কারণে বিন কাসিমকে বলল, আপনি একাকী আমার সাথে চলুন!” মন্দিরে হাউজটি ছিল শুকনো। সেটিতে নামার জন্য সিঁড়ি ছিল। পুরোহিত আগে অ। সিঁড়ি ভেঙে নামছিল। তার পিছনে বিন কাসিম সিঁড়ি ভাঙছিলেন। তারা যতোই সামনে অগ্রসর হচ্ছিলেন অন্ধকার গাড়া হচ্ছিল।
হঠাৎ পুরোহিত বাম দিকে অদৃশ্য হয়ে গেল, তার শুধু আওয়াজ শোনা গেল এদিকে। বিন কাসিম বাম দিকে মোড় নিলেন। এই সিঁড়িটি ছিল নীচের দিকে। এখানে এমন এক প্রকট দুর্গন্ধ ছিল যে, তীব্র গন্ধে দমবন্ধ হয়ে আসার জোগাড়। ঠিক সেই সময় ফড়ফড় শব্দ শুরু হলো। সেই সাথে চামচিকার উড়াউড়ির আওয়াজ। বিন কাসিমের মতো সাহসী লোকও এই আওয়াজে কিছুটা ভয় পেয়ে গেলেন। বসে যান’ বলল পুরোহিত। এটা একটা বড় চামচিকা। বিন কাসিম বসতেই চামচিকার দল তার মাথার ওপর দিয়ে বের হতে শুরু করল। নীরব নিথর এই জায়গা নিরাপদ ভেবে চামচিকারা দল বেঁধে এটিকেই আবাসস্থল বানিয়ে ফেলে। হঠাৎ দুজন মানুষের আগমনে ভয় পেয়ে চামচিকাগুলো ভয়ে স্থান ছেড়ে পালানোর জন্য বিক্ষিপ্ত উড়াউড়ি শুরু করে দেয়। বিন কাসিম সিঁড়িতে বসে পড়ায় ওরা পথ পেয়ে পালাতে শুরু করে। এরপর পুরোহিত সিঁড়ি ভেঙ্গে আবারো নিচের দিকে যেতে লাগল।
বিন কাসিম তার অনুসরণ করলেন। এক পর্যায়ে অন্ধকার এমন হলো যে, আর কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। পুরোহিত বিন কাসিমের হাত ধরে তাকে প্রথমে ডানে এবং পরে বামে নিয়ে গেল। হঠাৎ অন্ধকার গর্ত পথে কিছুটা আলোর আভা দেখা দিল। বিন কাসিম কোন মানুষের আবির্ভাব মনে করে তরবারী কোষমুক্ত করে ফেললেন। এক পর্যায়ে একটি কক্ষ পরিষ্কার দেখতে পেলেন বিন কাসিম। সেটি মৃদু আলোকিত। কক্ষটির একটি জানালা। তবে সেটি জালের মতো লোহার তারে আটকানো। কক্ষে একটি লোক দাঁড়ানো। অন্ধকারে তার চেহারা দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু দেখেই বোঝা যায় সে আঘাতহানার জন্য প্রস্তুত।
বিন কাসিম চক্রান্তের চূড়ান্ত মনে করে বিদ্যুৎ গতিতে তরবারী কোষমুক্ত করে লোকটিকে আঘাতের জন্য এগিয়ে গেলেন কিন্তু আঘাতের আগেই পুরোহিত তার বাহু ধরে ফেলল।
থামন আরব সেনাপিত’ এটি কোন জ্যান্তলোক নয়। এটি একটি সোনার মর্তি। যশোবন্ত এটিকে এখানে প্রহরী সাজিয়ে রেখে দিয়েছে। এর নীচেই আছে সব লুকানো ধনরত্ন। এখন আপনি আপনার লোকদের ডেকে এই ধনরাজি নিয়ে যেতে পারেন। কিন্তু এমন লোকদেরই এখানে আনুন। ধনসম্পদ দেখে যাদের ঈমান নষ্ট হয়ে না যায়। ঐতিহাসিক বালাজুরী লিখেছেন, সোনার সেই মূর্তির চোখ ছিল ইয়াকুত পাথরের তৈরি। এ পাথর আলো ছড়াতো।
সে সময়কার মুসলমানদের ঈমান এতটুকু মজবুত ছিল সোনার ঝলক তাদের ঈমানে কোন ফাটল ধরাতে পারতো না। বিন কাসিম মন্দিরের বাইরে গোয়েন্দা প্রধান শা’বান ছাকাফী ও আরো চারজন নিরাপত্তারক্ষীকে দাঁড় করিয়ে এসেছিলেন। নিরাপত্তার স্বার্থে কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে তারাও পা টিপে টিপে বিন কাসিম ও পুরোহিতের পিছু পিছু অগ্রসর হচ্ছিল। বিন কাসিম বিলক্ষণ জানতেন, মন্দিরের এই অন্ধকার প্রকোষ্টে তিনি একা নন। তাঁর আরো পাঁচ সহযোদ্ধা আছে। তিনি একটু সময় নিয়ে হাতে তালি দিলেন। অল্পক্ষণের মধ্যেই পাঁচজন তার কাছে চলে এলো। শাবান ছাকাফীকে বিন কাসিম বললেন, এই মূর্তি সরিয়ে নীচ থেকে সোনাদানা উদ্ধার করতে হবে। গোয়েন্দা প্রধান জানতেন, একাজে কারা যোগ্য এবং বিশ্বস্ত। তিনি তাদের ডেকে আনলেন। মন্দিরের ভিতরে মশাল জালিয়ে দেয়া হলো। সেদিন সন্ধ্যার আগেই সকল গুপ্তধন মন্দিরের বাইরে মুক্ত জায়গায় উঠিয়ে আনা হলো। ফতহুল বুলদানে বর্ণিত হয়েছে, সেই মন্দিরের গোপন কুঠুরী থেকে যে সোনা উদ্ধার করা হয়েছিল এর মোট ওজন ছিল এক হাজার তিন মন।
পর দিনই বিন কাসিম হাজ্জাজের চিঠি পেলেন। এই চিঠিতে তিনি মুলতান জয়ের মোবারকবাদ দিয়ে লিখেছেন, খলিফাকে দেয়া প্রতিশ্রুতি আমি রক্ষা করেছি। আমি হিসাব করে দেখেছি, তোমার বাহিনীর জন্য এ পর্যন্ত আমি ষাট হাজার দিরহাম খরচ করেছি। কিন্তু তুমি এ পর্যন্ত নগদ ও পণ্য মিলিয়ে যা পাঠিয়েছে, তা এক লাখ বিশ হাজার দিরহাম মূল্যমানের হবে। সেই চিঠিতে হাজ্জাজ বিন ইউসুফ একথাও লিখলেন, প্রতিটি শহরে এমন শানদার মসজিদ তৈরির ব্যবস্থা করো, যে মসজিদ ভবিষ্যতের লোকদের কাছে সেখানে ইসলামের দাওয়াত বহণকারী ও ইসলাম প্রচারে আত্মত্যাগকারীদের স্মৃতিবহণ করবে। এখন থেকে জুমআর খুতবায় খলিফার নাম নিতে পারো এবং খলিফার নামে মুদ্রাও প্রচলন করতে পারো। বিন কাসিম হাজ্জাজের কাছে যে এক লাখ বিশ হাজার দিরহাম পাঠিয়েছিলেন তাতে পুরোহিত নির্দেশিত মন্দিরের গুপ্তধনের সোনা রূপা মনিমুক্তা ছিল না। ফলে হাজ্জাজ বিন ইউসুফের চিঠি পাওয়ার পর বিন কাসিম মন্দিরের লুকানো সোনা রূপার এক পঞ্চমাংশ আলাদা করে নৌকা করে ডাভেল বন্দর এবং সেখান থেকে জাহাজে করে ইরাক পাঠিয়ে দিলেন।