আমার কাছে যশোবন্তের যে কাহিনী পৌছেছে তা হলো, তার বাবা ধন সম্পদ জড়ো করার প্রতি বেশী মনোযোগী হয়ে পড়েছিল। যশোবন্তকেও সে এ শিক্ষাই দিয়েছিল। যশোবন্তের বাল্য কৈশোর যৌবন কেটেছে চরম বিলাসিতায়
ও আরাম আয়েশে। সে ছিল মা বাবার কাছে খুবই প্রিয়, সেই সাথে যশোবন্তও তার মা-বাবাকে অনেক ভালোবাসতো। হঠাৎ একদিন তার বাবা মারা গেল। এরপর অল্পদিনের মধ্যেই মারা গেল মা। বাবার মৃত্যুতে সে জ্যোতিষী ও গণকদের বলল, যে তার বাবাকে ফিরিয়ে আনতে পারবে, পুরস্কার স্বরূপ তাকে বাবার ওজনের সমান সোনা দেবে। কিন্তু কেউই তার মৃত বাবাকে পুনরুজ্জীবিত করতে পারল না। এরপর তার মা যখন অসুস্থ হয়ে পড়ল তখন সে আগের মতোই সোনা দেয়ার ঘোষণা দিলো কিন্তু তাতেও কোন কাজ হলো না।
মাকেও মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচাতে পারল না কেউ। সৃষ্টিকর্তা যশোবন্তকে আরো একটা শিক্ষা দিলেন। এক সুন্দরী নর্তকীকে প্রাণাধিক ভালোবাসতো যশোবন্ত। হঠাৎ একদিন এই নর্তকীও অসুস্থ হয়ে পড়ল। এবার যশোবন্ত ঘোষণা করল, যে তার প্রিয় নর্তকীকে সুস্থ করে দেবে, সে চিকিৎসক ও নর্তকীর ওজনের সমান সোনা তাকে পুরস্কার দেবে। একথা শুনে বহু দূর দরাজ থেকে বহু বৈধ্য, সন্নাসী, কবিরাজ এসে চিকিৎসা করল। কিন্তু কারো চিকিৎসা ফলপ্রসূ হলো না। অবশেষে এই নর্তকীও মারা গেল। প্রিয় নর্তকীর মৃতদেহ যখন চিতার আগুনে জালানোর জন্য কাঠখড়ির ওপর রাখা হলো। তখন যশোবন্ত শিশুদের মতো চিৎকার করে কান্না জুড়ে দিল। এই অবস্থা দেখে আমার মতো বৃদ্ধ এক সন্নাসী যশোবন্তকে বুকে জড়িয়ে স্নেহে বলল, মহারাজের রাজভাণ্ডারের সমস্ত সোনাদানা দিয়ে দিলেও কোন মানুষকে এক নিঃশ্বাসের জন্যও বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব নয়।
সোনা দিয়ে এক নিঃশ্বাসের আয়ুও বাড়ানো সম্ভব নয়। তুমি সোনা দিয়ে মানুষের আয়ু কিনতে চাও। দেখো, এই নতকীর রূপ সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে তুমি পাগলের মতো হয়ে গেছে। চেয়ে দেখো এই রূপ জৌলুস সবই পুড়ে ভস্ম হয়ে যাচ্ছে। তোমার রাজভাণ্ডারের সমস্ত সোনাদানা এনেও যদি আগুনে ফেলে দাও, আগুন সব কিছুকেই পুড়িয়ে গলিয়ে দেবে। কিন্তু তোমার নর্তকীকে ফিরিয়ে দিতে পারবে না। তাই এসব ছেড়ে মনকে শান্ত করার জন্যে মন্দিরে চলো। মন্দিরে গিয়ে পূজা-অর্চনা করো। দেবীর পদতলে কপাল ঠেকাও, মনের সব দুঃখ চলে যাবে…। দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে যশোবন্তর মন্দিরে গিয়ে পূজা-অর্চনা শুরু করল। মন্দিরে থাকতে থাকতে তার মন থেকে পৃথিবীর রঙ্গরস ধনসম্পদের মায়া দূর হয়ে গেল। দিনমান সে পূজা-অর্চনায় মগ্ন হয়ে পড়ল। এক পর্যায়ে এখানে এসে সমস্ত সোনারূপা দাফন করে এর ওপর এই মন্দির তৈরি করল। আমি
মানি আপনি যে সৃষ্টিকর্তার ইবাদত করেন তিনি সর্বক্ষেত্রে আপনাকে সাহায্য করেন। আপনি যেখানেই যান সেখানকার লোকজন আপনাকে পেয়ে খুশী হয়ে আপনাকে ভালোবাসতে শুরু করে। কিন্তু তবুও আমি আপনাকে অনুরোধ করবো, এই মন্দিরের সোনাদানা আপনি উঠিয়ে নিন। আমি শুনেছি, মাটির নীচে পুঁতে রাখা সম্পদের সাথে দুর্ভাগ্য এবং নানা ধরনের অমঙ্গল জড়িয়ে থাকে। গচ্ছিত সম্পদ সম্পর্কে এ পর্যন্ত আমি যেসব গল্প কাহিনী শুনেছি, তার সবগুলোই এমন যারা গচ্ছিত ধন-সম্পদ উদ্ধার করতে সমর্থ হয়েছে তাদের সবারই দুঃখজনক পরিণতি বরণ করতে হয়েছে। বললেন বিন কাসিম।
আমার বিশ্বাস, আপনি প্রাপ্ত এই সম্পদ আপনার ব্যক্তিগত আরাম আয়েশে খরচ করবেন না। আমি আপনাকে এই অনুরোধও করব, এই সম্পদ আপনি ব্যক্তিগতভাবে খরচ করবেন না। বলল পুরোহিত।
ওপরে উল্লেখিত গুপ্তধনের কথা কোন কল্পকাহিনী নয়। বাস্তবেই এমন গুপ্তধনের কথা আলোচিত হয়েছে নির্ভরযোগ্য ইতিহাস গ্রন্থ “ফতহুল বুলদান, তারিখে মাসুমী ও চাচনামায়। বিন কাসিম পুরোহিতের কাছ থেকে একটু দূরে সরে গিয়ে গোয়েন্দা প্রধান শাবান ছাকাফীকে আদ্যোপান্ত জানালেন।
‘এটা একটা প্রতারণা হতে পারে ইবনে কাসিম’ বললেন গোয়েন্দা প্রধান। এটা আপনাকে হত্যার একটা মায়াবী চক্রান্তও হতে পারে। সোনা থাকতেই পারে, কিন্তু কিছুতেই আপনি একাকী যাবেন না। অন্তত আরো পাঁচ ছয়জন সঙ্গে নিয়ে যাবেন। বললেন গোয়েন্দা প্রধান। না, তুমি ছাড়া আমার সাথে আর কেউ যাবে না। বললেন বিন কাসিম। তুমি কি এমন কাহিনীর কথা শোননি। কয়েকজন মিলে কোন গুপ্তধন উদ্ধার করতে গিয়ে নিজেরাই গুপ্তধনের মালিকানা কব্জা করতে গিয়ে খুনোখুনিতে মেতে উঠেছে! ধন সম্পদ মানুষের ঈমানকে নষ্ট করে দেয়। আমি চাচার কৃত ওয়াদা পূরণ করতে চাই শাবান। পুরোহিতের এই গুপ্তধনের সন্ধানকে আমি আল্লাহর অনুগ্রহ মনে করছি। শা’বান সাকফীর সাথে কিছুক্ষণ কথা বলে বিন কাসিম বৃদ্ধ পুরোহিতকে জানালেন, তিন-চার দিন পর তিনি পুরোহিতের সাথে ওই মন্দিরে যাবেন।
পুরোহিতের সাথে কথা শেষ করে যেখানে মুলতানের প্রধান মসজিদ তৈরির জন্য সৈন্যরা খনন কাজ করছিল সেখানে গেলেন বিন কাসিম।
প্রত্যক্ষদর্শী তৎকালীন ঐতিহাসিকগণ লিখেছেন, খনন কাজ দেখতে গিয়ে বিন কাসিম কোদাল হাতে নিয়ে নিজেই খনন কাজে শরীক হলেন। কোদাল মারতে মারতে শরীর ঘেমে যখন তার চোখে ঘাম ঝরে পড়ছিল এবং কোদাল চালাতে গিয়ে বারবার তাঁকে চোখ মুছতে হচ্ছিল তখন তিনি হাত থেকে কোদাল ছাড়লেন। খনন স্থান থেকে চার-পাঁচজন সৈন্য ও গোয়েন্দা প্রধান শা’বান ছাকাফীকে সাথে নিয়ে মন্দিরে চলে এলেন। মন্দিরে এসে তিনি বৃদ্ধ পুরোহিতকে ডেকে বললেন, তিনি যেন এখনই তাদের সাথে মন্দিরে চলেন। শা’বান ছাকাফী এই পরিকল্পনা করেছিলেন যে, তিন চার দিন পরের কথা বলে পুরোহিতকে এক ধরনের অন্ধকারে রাখা হোক। এর কিছুক্ষণ পর আকস্মিক ভাবে তখনি পুরোহিতকে মন্দিরে যাওয়ার কথা বললে পুরোহিতের মনে কোন চক্রান্তের বিষবাষ্প থেকে থাকলেও তা আর বাস্তবায়নের আবকাশ থাকবে না।