নয়তো আমাদেরকে গোলামে পরিণত করে অপমানকর কোন শ্রমঘন কাজ করতে বাধ্য করবেন…। এ বয়সে এসে এমন অপমানকর অপ্রত্যাশিত বিড়ম্বনার মুখোমুখি হওয়ার আশঙ্কায় ভীত ছিলাম আমি। এই ভয়ে শহরের অনুন্নত এলাকার একটি ভাঙ্গা ঝুপড়ী ঘরে আমি আশ্রয় নেই। নিজেকে লুকিয়ে ফেলি। আমার দেখা শোনা করার জন্য আমার এক ভক্ত সাথে ছিল। সে ঝুপড়ী থেকে বেরিয়ে শহরের দৈনন্দিন খবর সংগ্রহ করে আমাকে শোনাতো। আমি বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না আপনার সৈন্যদের শহরে প্রবেশের পর শহরের অবস্থা এমন শান্তিময় থাকবে। আমাকে যখন শোনানো হলো বিজয়ী বাহিনী শহরের কোন একটি ঘরও লুটপাট করেনি এবং কোন একজন তরুণী যুবতীও নিখোজ কিংবা ধর্ষণ-শীলতাহানির শিকার হয়নি।
গতকাল আমি ঝুপড়ী ছেড়ে মন্দিরে চলে আসি। এসে দেখি মন্দির যেভাবে ছেড়ে গিয়েছিলাম ঠিক তেমনই রয়ে গেছে। এসে দেখি নিশ্চিন্ত ও নিরুদ্বিগ্ন মনে নারীপুরুষ পূজারীরা মন্দিরে পূজা অর্চনা করছে, আর আলাপ
চারিতায় আপনার ভূয়সী প্রশংসা করছে। শহরের নাগরিকরা আপনার বিজয়কে আশির্বাদ হিসাবে দেখছে। আমাকে তাদের কথাবার্তা শুনে বিশ্বাস করতে হলো, আপনি আসলে মানুষরূপী একজন দেবতা। আপনি আমাকে আমার মন্দির ফিরিয়ে দিয়েছেন। মন্দিরই আমার জগৎ মন্দিরই আমার সবকিছু। গতরাতে আমি শহরের একজন শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তির সাথে সাক্ষাত করে বলেছি আপনার সাথে আমি সাক্ষাত করতে চাই। সে আমাকে আশ্বাস দেয়, আপনার সাথে আমার সাক্ষাতের ব্যবস্থা করে দেবে। কিন্তু কিছুক্ষণ আগে মন্দিরের দুই পুরোহিত আমাকে খবর দেয়, আপনি এদিকে আসছেন। খবর শুনে আমি আপনার সাক্ষাতের জন্য বেরিয়ে এসেছি।
আপনি বলেছিলেন, আমার সাথে আপনি জরুরি কোন কথা বলতে চান; বললেন বিন কাসিম। চতুর্দিকটা একবার দেখে নিয়ে বিন কাসিমের দিকে আরো ঝুকে ক্ষীণ আওয়াজে পুরোহিত বললেন, আপনি এই দুর্গের মানুষের প্রতি, আমার মন্দিরের প্রতি, যে সম্মান ও অনুগ্রহ দেখিয়েছেন এ জন্য আমি আপনাকে এর প্রতিদান দিতে চাই। অনেক দিন আগের কথা। এই এলাকায় এক রাজা এসেছিল। সে ছিল কাশ্মীরের রাজা। তার নাম ছিল যশোবন্ত। সে তার রাজ ভাণ্ডারের সকল সোনাদানা সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিল। পণ্ডিত মহারাজ। নির্মোহ কণ্ঠে বললেন বিন কাসিম। এসব ধনরত্নের কাহিনী অনেক পুরনো। আপনি একজন বিজ্ঞলোক। আপনিও আমাকে সেই পুরনো দিনের গল্প শোনাচ্ছেন। বলুন তো, যে কাহিনী আপনার জন্মের আগে থেকে মানুষ মুখেমুখে শুনে আসছে, সেটি যে সত্যিই হবে একথা আপনি কিভাবে নিশ্চিত বিশ্বাস করেন? ধন ভাণ্ডারের প্রতি নিরাসক্তি বিন কাসিমের স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য। তিনি ছিলেন যথার্থ অর্থেই রণাঙ্গনের লোক এবং দুনিয়া বিমূখ মর্দে মুমিন। কিন্তু এ সময়টাতে তার অর্থের খুব প্রয়োজন ছিল। অর্থাভাবে তিনি বেশ কিছুদিন যাবত দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ছিলেন। কিন্তু তাই বলে গচ্ছিত ধনভাণ্ডারের কাহিনী শুনে এই বুড়ো পুরোহিতের কথায় আসক্ত হবার পাত্র নন বিন কাসিম। কারণ পুরোহিতের এ কথায় প্রতারণা থাকতে পারে। কারণ লোকটি আগাগোড়া সম্মোহনী শক্তির অধিকারী। তার রন্ধ্রে বন্ধ্রে পৌত্তলিকতার অনুসরণ। সে যেকোন মূল্যে মুসলিম এই বিজয়ে প্রতিশোধের ব্যবস্থা নিতে পারে। তাই বিন কাসিম তাকে পরখ করার জন্যে বললেন, পুরোনো দিনের এই পৌরনিক
কাহিনী সে কিভাবে বিশ্বাস করল। এই গল্প তো যুগযুগ ধরে মানুষের মুখেমুখে চলে আসছে?
‘আমার কথা ঠিক নয়’ আপনার এমন সংশয় প্রমাণ করে আপনি যথার্থই বুদ্ধিমান ও দুরদর্শী বললেন, পুরোহিত। কারণ মানুষ গচ্ছিত ধনভাণ্ডারের কথা শুনলেই তা অর্জনের জন্য মরিয়া হয়ে পড়ে। কিন্তু আপনি আমার কথা শুনে সংশয় প্রকাশ করেছেন। অবশ্য আপনি বলতেই পারেন, হে বুড়ো পূজারী! তুমি যদি জেনেই থাকো, কেউ অমুক জায়গায় অঢেল ধনভাণ্ডার পুঁতে রেখে মরে গেছে, তাহলে তুমি তা উত্তোলন করনি কেন? এর জবাবে আমি বলবো, আমি একা মানুষ। এসব ধনরত্ন দিয়ে আমি কি করব! তাছাড়া দুনিয়ার ভোগ বিলাসের আকাক্ষা আমি মন থেকে ঝেড়ে ফেলেছি। আপনি বাদশা। বাদশাহী চালানোর জন্যে ধনভাণ্ডারের প্রয়োজন আছে।
আচ্ছা, কোথায় আপনার জানা ধনভাণ্ডার বললেন বিন কাসিম। বলুনতো কাশ্মীরের রাজা এই ধনরত্ন মাটির নিচে পুতে ফেলল কেন?
এইতো কাছেই। আমি নিজে গিয়ে আপনাকে দেখিয়ে দেবো…। কাশ্মীরের রাজা ছিলেন খুবই ধর্মপরায়ণ। তিনি বেশীরভাগ সময় ধর্মসাধনায় ব্যয় করতেন। এটা এমন সময়ের ঘটনা যখন মুলতান ও কাশ্মীর একই শাসনাধীন ছিল এবং রাজা যশোবন্তই ছিলেন গোটা অঞ্চলের শাসক। অবশ্য কেন তিনি ধন-রত্ন পুঁতে রেখেছেন এ ব্যাপারটা আমি নিশ্চিত করে বলতে পারছি না। তবে এটা ঠিক যে তিনি এখানে এসে এই মন্দিরে ধর্ম সাধনায় বসেছিলেন।
আমার দাদা পরদাদাদের মধ্যে যিনি তখন এই মন্দিরের পুরোহিত ছিলেন, তিনি ছিলেন মহাঋষি। তিনি রাজা যশোবন্তের সাথেই থাকতেন। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে রাজা যশোবন্ত মন্দিরের একটি গোপন কক্ষে সোনাদানা ভর্তি চল্লিশটি মটকি রাখেন। কয়েক মন ওজনের সোনার ইট ও তৈরি অলংকার সেগুলোতে ভর্তি করেন। সোনাদানা ভর্তি মটকিগুলোকে মাটির নিচে পুঁতে সেখানে তিনি সোনার তৈরি একটি মূর্তি বানিয়ে রাখেন, যাতে এর নীচে সোনা দানা আছে মানুষ এমনটি না ভাবতে পারে। জায়গাটির চারপাশে তিনি গাছগাছালি রোপন করেন।