খাজানা ভাণ্ডার তিনি শূন্যই পেয়েছেন, কারণ প্রায় প্রত্যেক দুর্গের শাসকরাই নিজেদের সব ধনরত্ন নিয়ে পরাজয় অবশ্যাম্ভাবী মুহূর্তে পালিয়ে গেছে।
আমরা আগেই জেনেছি, দাহিরে রাজধানী দখলের অনেক আগেই দাহিরের ছেলে ও তার ভাতিজা দাহিরের গচ্ছিত ধন-রত্ন নিয়ে পালিয়ে যায়। ওদের পালিয়ে যাওয়ার অন্যতম কারণই ছিল তাদের ধন-রত্ন যাতে মুসলমানরা কব্জা করতে না পারে। সর্বশেষ বিজিত দুর্গ মুলতানেও তাই ঘটলো। পরাজয় ঘনিয়ে আসতে দেখে বজরা ও তার রাজা কুরসিয়া পালানোর সময় ধনভাণ্ডার নিজেদের সাথে নিয়ে যায়। হাজ্জাজ বিন ইউসুফ লিখিতভাবে খলিফাকে অঙ্গীকার করেছিলেন। অঙ্গীকারের বিষয়টি বিন কাসিম জানতেন। তাই সিন্ধু এলাকার অধিকাংশ বিজয় হয়ে যাওয়ার পরও প্রতি অর্থ অপূর্ণ থাকার বিষয়টি তাকে খুবই পীড়া দিচ্ছিল।
বিন কাসিম ছিলেন আল্লাহর পথে জিহাদকারী সেনাপতি। এই জিহাদে তাঁর কোন ব্যক্তিগত উচ্চাশা উচ্চাভিলাষ ছিল না। আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে বিন কাসিম তাঁর জীবন ও যৌবনকে উৎসর্গ করেছিলেন। তাঁর ঐকান্তিক বাসনা ও নিষ্ঠার কারণে আল্লাহ তাআলা প্রতিটি রণাঙ্গনেই তাকে প্রত্যাশিত সাহায্যে সফলকাম করেছেন। এই মুলতান দুর্গ জয়ের আগে যদি বাইরের পানির প্রবাহের ব্যাপারটি বিন কাসিম জ্ঞাত হতে না পারতেন তবে শেষ মুহূর্তে এসে মুলতান রণাঙ্গনে তার বাহিনীকে শোচনীয় পরাজয়ের মুখোমুখি হতে হতো। এ পর্যায়ে এসেও খলিফাকে দেয়া প্রতি অর্থ সরবরাহ না করতে পারার জন্য তার মধ্যে এই আশঙ্কা দেখা দিলো। কিন্তু জয়ের তাৎপর্য দূরে রেখে এটিকে অনর্থক ঝামেলা মনে করে যদি খলিফা তার অগ্রাভিযান বন্ধ করার নির্দেশ দিয়ে দেন, তাহলে তার বাহিনীর এই সীমাহীন কুরবানী তীরে এসেও তরি ডুবাবে। এ চিন্তা-ভাবনায় আরো কিছুদিন চলে গেল। মুলতান শহরের পুনর্গঠন ও শাসন ব্যবস্থা ইতোমধ্যে ঠিকঠাক হয়ে গেল। এক দিন বিকেলে আশ্বারোহণ করে বিন কাসিম শহরের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করার জন্য বের হলেন। গোয়েন্দা প্রধান শা’বান ছাকাফী তার পাশাপাশি। তাদের পিছনে চারজন অশ্বারোহী নিরাপত্তারক্ষী। বিন কাসিম মুলতান শহর জয় করার পরদিনই বলেছিলেন, এখানে এমন একটি মসজিদ তৈরি করতে হবে ভবিষ্যত প্রজন্ম যেটিকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে। মসজিদের জন্য জায়গাও নির্ধারণ করা হয়েছিল এবং নির্মাণকাজের জন্য খননকাজও শুরু করে দিয়েছিল নির্মাণকারীরা।
শহরের প্রধান মন্দিরের কাছে পৌছলে তিনি দেখতে পেলেন, মন্দিরের প্রধান দুই পুরোহিত মন্দিরের বাইরে দাঁড়ানো। বিন কাসিমকে দেখে তারা উভয়েই দৌড়ে মন্দিরের ভিতরে চলে গেল। বিন কাসিম যখন মন্দিরের সম্মুখ পথ অতিক্রম করে সামনে অগ্রসর হচ্ছিলেন, তখন মন্দিরের শীর্ষ পুরোহিত বেরিয়ে এলো। এই পুরোহিত ছিল সম্মোহনী চেহারার অধিকারী। মন্দিরটি একটি টিলাসম উঁচু জায়গায় অবস্থিত। মন্দিরের মূল বেদীতে উঠতে দশপনেরোটি সিঁড়ি ভাঙতে হয়। প্রধান পুরোহিত মন্দির থেকে বেরিয়ে এভাবে বেদীর সিঁড়ি ভেঙে নীচে নামছিল। তার নামা দেখে মনে হচ্ছিল সে বিন কাসিমকে কিছু একটা বলতে আগ্রহী। পুরোহিতের এই মনোভাব দেখে বিন কাসিম তার ঘোড়া থামালেন। পুরোহিত ধীরে ধীরে সিঁড়ি ভেঙে নিচে নেমে বিন কাসিমের ঘোড়ার সামনে এসে থামল এবং তার পাশে রেকাবীতে থাকা বিন কাসিমের পা ধরে তার মাথা বিন কাসিমের পায়ে ঠেকাল। পায়ে মাথা ঠেকাতে দেখে বিন কাসিম দ্রুত তার পা সরিয়ে নিলেন। অতঃপর পুরোহিত দু’হাত ওপরে তুলে বিড়বিড় করে কি যেন বলল। একজন দুভাষী সব সময়ই বিন কাসিমের সাথে থাকত। দুভাষী দ্রুত এগিয়ে এসে পুরোহিত ওপরের দিকে তাকিয়ে কি বললো তা জানালো। দুভাষী জানালো, পুরোহিত আপনার সাথে একান্তে জরুরি কথা বলতে চায়। বিন কাসিম একথা শুনে ঘোড়া থেকে নেমে পড়লেন এবং বয়োবৃদ্ধ পুরোহিতের সাথে সিঁড়ি ভেঙ্গে কয়েক ধাপ ওপরে উঠে বৃদ্ধ পুরোহিতকে একটি সিড়িতে বসিয়ে দিয়ে নিজে একধাপ নিচের সিড়িতে বসে পড়লেন। তার ইশারায় দুভাষী তাঁর কাছে গিয়ে বসল এবং দুভাষীর মাধ্যমে দুজনের মধ্যে কথাবার্তা শুরু হলো।
নিজ চোখে দেখেও বিশ্বাস করতে পারছি না। কে বিশ্বাস করবে একজন সাধারণ প্রজা ওপরে আর বাদশা তার নীচে বসতে পারে?
কেউ বিশ্বাস না করলেও মুসলমানরা বিশ্বাস করতে পারে, বললেন বিন কাসিম। তিনি পুরোহিতের উদ্দেশে বললেন, এসব হালকা স্তুতিবাক্য ছাড়া যে জরুরি কথা বলার জন্য আপনি আমাকে থামিয়েছেন সেই কথা বলাটাই কি ভালো হয় না? আমি আপনার বিস্ময় ও হতবাক হওয়ার জবাব দিয়ে দিচ্ছি। আমার নীচে বসাটা মোটেও বিস্ময়কর বিষয় নয়, কারণ আপনি আমার চেয়ে বয়সে অনেক বড়, আমি আপনার নাতিপুতিদের বয়সের মানুষ।
বিন কাসিমের এ কথায় পুরোহিত হতচকিয়ে গেল। কিছুটা পিছিয়ে গেল সে।
‘আমি আপনাকে একটি গোপন কথা বলতে বাধ্য হচ্ছি। আমি যে কথা আপনাকে বলতে চাচ্ছি, তা আপনার জন্য বড় ধরনের একটা পুরস্কার। বার্ধক্যের কারণে আমি যদি অপ্রাসঙ্গিক কোন কথা বলে ফেলি তাহলে আমাকে ক্ষমা করে দেবেন। যে দিন আপনি বিজয়ী বেশে দুর্গে প্রবেশ করছিলেন সেদিন প্রথম আপনাকে আমি দেখি। আমি শুনেছিলাম, আরব সেনাপতি খুবই অল্প বয়স্ক। তাতে আমি মনে করেছিলাম, আপনার বয়স হয়তো ত্রিশ-পয়ত্রিশের মাঝামাঝি হবে। কিন্তু আপনাকে প্রত্যক্ষ দেখে আমি অবাক হয়েছি। আমি ভেবেছি, আরে! এতো বাচ্চা। এ বাচ্চা হয়তো কোন শাহজাদা হবে এবং রাজকুমারদের মতোই আনাড়ীপনা করবে। আমি মন্দিরের অন্যান্য পুরোহিতদের বলেছি, শহরের নাগরিকদের বলে দিয়ে, প্রত্যেকই যেন তাদের যুবতী ও কুমারী মেয়েদের লুকিয়ে রাখে নয়তো জীবন্ত পুঁতে ফেলে। আমি শহরের লোকজনকে এ পয়গামও দিয়েছি, সবাই যেন তাদের সোনারূপা মূল্যবান ধন সম্পদ মাটির নীচে লুকিয়ে ফেলে। আমি এ আশঙ্কাও করেছিলাম এই মন্দির হয়তো ধ্বংস করে দেয়া হবে। ধ্বংস না করলেও বন্ধ করে দেয়া হবে এবং আমাদেরকে আপনি পাইকারীহারে হত্যা করার জন্যে সৈন্যদের নির্দেশ দেবেন।