আমরা তোমাদেরকে একথাই বলতে এসেছি যা তোমাদের কেউ জানেনা। বললেন বিন কাসিম। আমি তোমাদের যে কথা বলতে চাচ্ছি সেটি আমার ব্যক্তিগত কথা নয়, আমাদের ধর্মের নির্দেশ। আমাদের ধর্মে কেউ রাজা আর কেউ প্রজা হতে পারে না। আমাদের ধর্মের দৃষ্টিতে রাজত্ব শুধুই আল্লাহর। আমরা আল্লাহর নির্দেশ মতো তাঁর নির্দেশ বাস্তবায়নে প্রতিনিধিত্ব করছি মাত্র। তোমরা নিজেদেরকে কখনো পরাধীন মনে করো না। তোমরা স্বাধীন মতো নিজেদের ধর্মকর্ম করতে পারবে। তোমরা তোমাদের মন্দিরের দরজা নিঃসংকোচে খুলে রাখতে পারবে, কোন মুসলমানকে তোমাদের মন্দিরে প্রবেশের অনুমতি দেয়া হবে না।
আপনি কি আমাদেরকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণে বাধ্য করবেন না? বিনীত কণ্ঠে জানতে চাইলো একজন অভিজাত হিন্দু।
আমরা কিছুতেই তোমাদেরকে ইসলাম গ্রহণে বাধ্য করব না, বললেন বিন কাসিম। আমাদের ধর্মই এমন সুন্দর তোমরা যখন নিজের চোখে আমাদের ধর্মের কার্যক্রম দেখবে, তখন তোমরাই এই ধর্ম গ্রহণে উদ্বুদ্ধ হবে। তোমরা শহরের সকল অধিবাসীদের জানিয়ে দাও, তারা যেন মন থেকে সব ধরনের ভয় আতঙ্ক দূর করে স্বাধীনভাবে নির্ভয়ে জীবনযাপন করতে থাকে। তবে তাদেরকে একথাও জানিয়ে দিও, আমাদের এই অবারিত সুযোগের অপব্যবহার করে কেউ যদি আমাদের বিরুদ্ধে কোন ধরনের গাদ্দারি করে, কোন নাশকতা কিংবা দুস্কৃতির চেষ্টা করে তবে তাকে কঠিন শাস্তি ভোগ করতে হবে। এখন আমি তোমাদের একটা কথা জানিয়ে দিতে চাই, আমরা এখন শহরের অধিবাসীদের কাছ থেকে একটা কর আদায় করবো। এ করকে আমরা জিযিয়া বলে থাকি। এটা এতো স্বল্প পরিমাণ হবে যে, শহরের যে কোন গরীব লোকের পক্ষেও তা আদায় করা কঠিন হবে না। জিযিয়া প্রাপ্তির পর শহরের সকল অধিবাসীর সার্বিক নিরাপত্তা ও সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করা আমাদের কর্তব্য হয়ে পড়বে এবং মানুষ হিসাবে আমাদের ধর্মের স্বীকৃত সব অধিকার তোমাদের দিতে আমরা বাধ্য থাকব।
ঠিক আছে, আপনি জিযিয়া ধার্য করে দিন, আমরা যথাশীঘ্র আপনার জিযিয়া আদায় করে দেবো। বলল শীর্ষস্থানীয় এক ব্যবসায়ী।
এই কর আমি নিজে আদায় করব না, আমি এ কাজের জন্য যাকে যাকে নিয়োগ দেবো, সে তা আদায় করবে। কিন্তু এই শহরের যারা বিত্তশালী এবং যারা বড় ব্যবসায়ী আমি তাদের কাছ থেকে কিছু অতিরিক্ত টাকা আদায় করতে চাই। এই অতিরিক্ত পয়সা এ জন্য নিচ্ছি, এই দুর্গ জয় করতে আমাদেরকে খুব বেশী মূল্য দিতে হয়েছে এবং আমার শিবিরে আহতের সংখ্যা অনেক বেশী। এটাকে তোমরা জরিমানা বলো আর যুদ্ধ ব্যয় বলল, যাই বলো না কেন, পয়সাটা আমাকে দিতেই হবে। তবে এর পরিমাণ আমি নির্ধারণ করে দেবো না। তোমাদের বিত্তশালীরাই ঠিক করবে কি পরিমাণ দিতে পারবে তোমরা। ঐতিহাসিক বালাজুরী লিখেছেন, এক সপ্তাহের মধ্যে মুলতান দুর্গের সকল হিন্দু অধিবাসী জিযিয়া আদায় করে দিল এবং শহরের বিত্তশালীরা জিযিয়ার অতিরিক্ত টাকাও দিল। তাদের দেয়া অতিরিক্ত টাকার পরিমাণ ছিল প্রায় ষাট হাজার দিরহাম। বিন কাসিম এই ষাট হাজার দিরহাম তার
সকল সেনাদের মধ্যে বণ্টন করে দিলেন। ৯৫ হিজরী সনে মুলতান বিন কাসিমের শাসনাধীনে নত হলো।
ঐতিহাসিকগণ লিখেছেন, বিন কাসিমের শাসনে মুলতানের অধিবাসীরা যেমন নিরাপত্তা, শান্তি ও নিশ্চিন্ত জীবন যাপনের পরিবেশ প্রত্যক্ষ করেছে, এর আগে মুলতানবাসী কখনো তা প্রত্যক্ষ করেনি। বিন কাসিমের প্রশাসনের পূর্ণ নিরাপত্তা ও প্রজাহিতৈষী কর্মকাণ্ডে নিশ্চিন্ত হয়ে মুলতানের ব্যবসায়ী, কৃষক ও নানা পেশার লোকজন নিজ নিজ কাজ-কর্মে মনোনিবেশ করে। মুলতানের শাসন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে বিন কাসিম আরো সামনে অভিযানের পরিকল্পনা চূড়ান্ত করার প্রতি মনোযোগ দিলেন। ইত্যবসরে তিনি রাজা কাকসা ও সিককার কাছ থেকে আদায়কৃত জিযিয়া এবং অন্যান্য জায়গার আদায়কৃত জিযিয়া একত্রিত করে হাজ্জাজ বিন ইউসুফের কাছে পাঠিয়ে দিলেন।
খলিফাকে দেয়া হাজ্জাজ বিন ইউসুফের প্রতিশ্রুতি বিন কাসিমকে চিন্তায় ফেলে দিচ্ছিল। হাজ্জাজ বিন ইউসুফ খলিফা ওয়ালীদ বিন আব্দুল মালিকের কাছ থেকে এই শর্তে সিন্ধু অভিযানের অনুমতি নিয়েছিলেন, সিন্ধু অভিযানে খেলাফতের কোষাগার থেকে যে পরিমাণ অর্থ খরচ হবে অভিযান শেষে তিনি এর দ্বিগুণ অর্থ রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দেবেন। মুলতান অভিযানের পর কিছু দিন অবকাশ যাপনকালে বিন কাসিম হিসাব করছিলেন, এ পর্যন্ত কেন্দ্রীয় কোষাগারে তিনি কী পরিমাণ অর্থ প্রেরণ করেছেন। তার হিসাবমতে বাগদাদে প্রেরিত অর্থের পরিমাণ তেমন ছিল না। তার ধারণা এ পর্যন্ত সিন্ধু অভিযানে বাগদাদের কোষাগার থেকে যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় হয়েছে এর চেয়ে অনেক কম তিনি প্রেরণ করেছেন। এর অন্যতম কারণ হলো, শাসক হিসাবে বিন কাসিম ছিলেন উদারচিত্তের অধিকারী। তিনি যথাসম্ভব কম জিযিয়া ধার্য করতেন, যাতে তা আদায়ে মানুষের কষ্ট না হয়। তাছাড়া তিনি যদি জানতে পারতেন, যে কর তিনি ধার্য করেছেন তাও প্রজাদের দিতে কষ্ট হচ্ছে। কিংবা কোন কোন জনগোষ্ঠী তা দিতে সক্ষম নয়। তখন তিনি গোটা জিযিয়া মাফ করে দিতেন এবং তার ব্যাপারে আরেকটি কথাও বেশ প্রসিদ্ধ ছিল, তিনি পারত পক্ষে কারো ওপর জরিমানা ধার্য করতেন না। যেসব দুর্গ তিনি জয় করেছেন, সেগুলোতে প্রচুর ধন-সম্পদ থাকার কথা। কিন্তু বাস্তবে তিনি যেসব দুর্গ জয় করেছেন, সেগুলোর শাসকদের