একথা বলার পর আমীরুল মুমিনীন হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুমাকরান থেকে মুসলিম সেনাবাহিনী ফিরিয়ে আনার নির্দেশ দেন। অতঃপর মাকানের কিছু অংশ কব্জায় রেখে বাকী অংশ ত্যাগ করে মুসলিম বাহিনী সেখান থেকে ফিরে আসে।
মহাভারতে মুসলমানদের অভিযান শুধু মাকরানেই সীমাবদ্ধ ছিল না। ওমর ফারুকের শাহাদাতের পর হযরত উসমানের সময়ও মহাভারতের পশ্চিমাঞ্চলে মুসলমানদের বিজয়াভিযান অব্যাহত ছিল। হযরত উসমানের শাহাদাতের পর হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু-এর খেলাফত কালেও যথারীতি তা অব্যাহত থাকে। তখন মুসলমানরা কিলাত পর্যন্ত অগ্রাভিযান চালিয়েছিলেন। হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু-এর শাহাদাতের পর খেলাফত বনী উমাইয়াদের হাতে চলে যায়। বনী উমাইয়ার শাসনামলেও মহাভারতের পশ্চিমাঞ্চল মুসলমানদের শাসনাধীনে ছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে ইসলামের কেন্দ্রভূমিতেই দেখা দেয় গোযোগ। ক্ষমতার লোভ খেলাফতের মধ্যে সৃষ্টি করে অস্থিরতা। সত্য আর মিথ্যা, হক ও বাতিলের মধ্যে অনিবার্য হয়ে ওঠে সংঘাত। যারা ছিলেন হক এর পক্ষে তাদের বলা হয় বিদ্রোহী। এতে করে খেলাফত দু’ভাগে বিভক্ত
হয়ে পড়ে। দ্বিখণ্ডিত হয়ে যায় বিজয়ী সেনাবাহিনী। জুলুম ও অত্যাচারের যুগ শুরু হয়ে যায়। শাসকদের মধ্যে জুলুম অত্যাচারে সবচেয়ে বেশী খ্যাতি লাভ করেন হাজ্জাজ বিন ইউসুফ। ক্ষমতালোভীরা ইসলামের পতাকা ও তাকবীরকে দ্বীনের পরিবর্তে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করতে শুরু করেন।
উমাইয়া শাসক আব্দুল মালিক বিন মারওয়ানের শাসনামলে তিনি কঠোর হস্তে সকল ধরনের বিদ্রোহ দমন করেন এবং উমাইয়া শাসনকে পাকাপোক্ত করেন। সেই বিদ্রোহের সময় অন্তত পাঁচশ প্রথম শ্রেণির যোদ্ধা আরবভূমি ত্যাগ করে মহাভারতের এক অংশের পৌত্তলিক শাসক রাজা দাহিরের আশ্রয় গ্রহণ করে। রাজা দাহির দেশত্যাগী এসব মুসলমানদেরকে মাকরান অঞ্চলে বসতি স্থাপনের অনুমতি দেয়। দাহিরের আশ্রয় প্রার্থীদের অধিকাংশই ছিলেন আলাফী বংশের। এ গোত্র যুদ্ধবাজ হিসাবে ছিল বিখ্যাত। বিলাল বিন উসমানও বিদ্রোহজনিত কারণে চারজন সঙ্গী নিয়ে দাহিরের কাছে আশ্রয়ের আশায় ভারতের মাটিতে পৌছে। কিন্তু এলাকা অপরিচিত থাকা এবং রাজা পর্যন্ত পৌঁছানোর কোন মাধ্যম না পাওয়ার কারণে তারা ঠিকানাহীন ঘুরে ফিরছিল। বিলাল এ কথাও জানতো যে, বিদ্রোহীদের আশ্রয় দিয়ে রাজা দাহির খেলাফতের সাথে শত্রুতা তৈরী করেছে। তাছাড়া দাহিরের পিতা মাকরান অভিযানে মুলমানদের প্রতিপক্ষ রাজা চন্দকে সামরিক সহযোগিতা করাও ছিল শত্রুতার অন্য কারণ। এজন্য বেলাল ভয় করছিল রাজা দাহির তাদের গ্রেফতার করে কয়েদখানায় বন্দি করতে পারে।
দুর্গ থেকে কিছুটা দূরের একটি জায়গায় পরদিন মায়ারাণী বেলালকে সাক্ষাত করতে বলেছিল। পরদিন বেলাল যখন মায়ারাণীর সাথে সাক্ষাত করতে যাবে, তখন তার সঙ্গীরা তাকে বাধা দিলো। রাতে এ নিয়ে তাদের মধ্যে বিস্তর কথাবার্তা হলো। বেলালের সঙ্গীরা তাকে বুঝাতে চেষ্টা করল, মায়া তোমাকে ধোকা দিতে পারে, তোমাকে গ্রেফতার করতে পারে। বেলালের মনেও এ আশঙ্কা ছিল। কারণ মায়া তাকে বলেছিল, তোমাকে আমার গোয়েন্দা মনে হয়। বেলাল সাথীদের এ কথা বলার পর সাথীরা তাকে মায়ারাণীর সাথে সাক্ষাত করার ব্যাপারে জোরালো বাঁধা দেয়। কিন্তু বেলালের মনে দৃঢ় আস্থা জন্মে মায়া তাকে গ্রেফতার করবে না, তার সাথে প্রতারণা করবে না।
“তোমরা কি করবে? সবাইকে আমার সাথে দেখলে মায়া আমার সাথে সাক্ষাত করবে না। তা ছাড়া ওর মনে যদি কোন দূরভিসন্ধি থাকে তাহলে একসাথে গেলে সবারই গ্রেফতার হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এরচেয়ে বরং এটাই ভালো হবে, তোমরা এখানে থাকো, আমাকে ঝুঁকি নিতে দাও। তাতে গ্রেফতার হলে আমি একাই হবো। যদি সন্ধ্যা পর্যন্ত আমি ফিরে না আসি, তাহলে বুঝবে আমি কোন বিপদে পড়ে গেছি, তোমরা তখন এখান থেকে পালিয়ে যাবে।” বেলালের পরামর্শ সঙ্গীরা মানতে পারল না। শেষ পর্যন্ত তারা সিদ্ধান্ত নিলো সবাই যাবে। তবে বেলাল যাবে অশ্বারোহণ করে, যাতে কোন বিপদের আশঙ্কা দেখলে পালাতে পারে। আর তার সাথীরা বেলাল ও মায়ার সাক্ষাত স্থল থেকে দূরে লুকিয়ে থাকবে। কোন বিপদ দেখলে তারা বেলালের সাহায্যে এগিয়ে যাবে। নিজের ঘোড়ায় আরোহণ করে হাতে বর্শা নিয়ে রওয়ানা হলো বেলাল। মায়ারাণী যে জায়গায় তাকে সাক্ষাত করতে বলেছিল, জায়গাটি তাদের অবস্থান স্থল থেকে দুই আড়াই মাইল দূরে। কিভাবে যাবে কখন যাবে সবই মায়া বেলালকে বলে দিয়েছিল।
টিলা, পাহাড়ী উপত্যকা ও গিরিখাদ পেরিয়ে বেলাল যখন ভোলা জায়গায় পৌছলো, তখন বেলালের চোখে পড়লো ঘন সবুজ একটি ময়দান। ঘন উঁচু ঘাসে ভরা জায়গাটি, মাঝে মাঝে ঝোপঝাড়। মাঝে মধ্যে কিছু গাছও রয়েছে। গাছগুলো খুবই তরতাজা, সবুজ পত্রপল্লব ও ফলফুলে ভরা। বেলাল এই ঘন ঘাসপূর্ণ মাঠ পেরিয়ে যখন সামনে অগ্রসর হলো, তখন দেখতে পেল একজন অশ্বারোহী দ্রুত ঘোড়া ছুটিয়ে এদিকে আসছে। কালো বর্ণের ঘোড়াটিকে দূর থেকে দেখেই বোঝা যায় শাহী আস্তাবলের বিশেষ ঘোড়া সেটি।
দূর থেকেই বেলালের বুঝতে অসুবিধা হলো না, অশ্বারোহী কোন পুরুষ নয়, নারী। কিন্তু বেলাল সেদিকে ভ্রক্ষেপ করল না। বেলাল পাকা যোদ্ধা। মায়ারাণীর দেহ সৌন্দর্যে নিজেকে মোটেও আকৃষ্ট করেনি বেলাল। সে জানে নারী সব সময়ই ঝুঁকিপূর্ণ। বিশেষ করে হিন্দুস্তানের হিন্দুরা নারীকে শত্রুদের ঘায়েল করতে ব্যবহার করে এ ব্যাপারটি সে পূর্বেই অবগত ছিল। সে তার ঘোড়াকে চাবুক দিয়ে আঘাত করলো, উড়ে চললো ঘোড়া। কিন্তু মায়ার দিকে