সত্যিই সেটি ছিল একটি নাটকীয় ও ঐতিহাসিক ঘটনা। বন্দি হিন্দু কমান্ডার দুর্গের নারী-শিশুদেরকে পিপাসার তাড়নায় মরতে দেখে আবেগ প্রবণ হয়ে গোয়েন্দা প্রধান শা’বান সকাফীকে দুর্গপ্রাচীরের এমন একটি জায়গার কথা বলে দিল, যে জায়গাটি ছিল সবেচেয়ে দুর্বল। এই জায়গার দুর্গপ্রাচীরে ভাঙন দেখা দিয়েছিল। জায়গাটি ছিল দুর্গের ভিতরে প্রবেশকারী নালার দিকে। বিন কাসিমকে এ তথ্য জানানোর পর তিনি বড় মিনজানিকগুলো সেদিকে নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন। সব বড় বড় মিনজানিক থেকে এক সাথে পাথর নিক্ষেপ শুরু হলো। কিছুক্ষণের মধ্যে ভগ্ন দেয়ালে বিরাট ভাঙন দেখা দিল এবং ওপরের দিকে দেয়াল ভেঙ্গে গেল। কিন্তু এই ভাঙন দেয়ালের এতোটা ওপরে ছিল যে এত ওপর দিয়ে ঘোড়া দুর্গে প্রবেশ করতে পারত না।
এবার নীচের দিকে পাথর নিক্ষেপের নির্দেশ দিলেন বিন কাসিম। কিছুক্ষণের মধ্যেই দেয়ালের নীচের দিকেও ভাঙন শুরু করল এবং ওপরের দিকের ভাঙন আরো নীচের দিকে প্রলম্বিত হতে লাগল। তখন বিন কাসিম সৈন্যদের একটি অংশকে নির্দেশ দিলেন তোমরা পানি প্রবাহ ছেড়ে দাও। দুর্গের পানি প্রবাহ ছেড়ে দেয়ার পর মানুষ যখন দেখলো নালা দিয়ে পানি দ্রুত প্রবাহিত হচ্ছে, তখন পিপাসার্ত সকল মানুষ পানি সংগ্রহের জন্য F.31
ঝাপিয়ে পড়ল। যেসব সৈন্য দুর্গপ্রাচীরের নিরাপত্তা রক্ষায় নিয়োজিত ছিল। পিপাসায় এরাও ছিল কাতর। পানি আসার খবর শুনে তারাও দুর্গপ্রাচীর ছেড়ে পানি সংগ্রহে লিপ্ত হলো। মোট কথা পানি আসার খবরে গোটা দুর্গ জুড়ে চরম হৈ হুল্লোড় পড়ে গেল। তখনো অনেকটা উঁচু রয়ে গিয়েছিল দেয়াল। মিনজানিকের আঘাতে তখনো দেয়ালকে সম্পূর্ণ ভেঙে মাটির সমান করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু দুর্ধর্ষ ও অশ্বচালনায় পটু আরব অশ্বারোহী যোদ্ধারা ভগ্ন উঁচু দেয়ালের ওপর দিয়েই ঘোড়া ছুটাল। প্রশিক্ষিত ঘোড়াগুলো লাফিয়ে লাফিয়ে দেয়াল টপকে দুর্গে প্রবেশ করতে শুরু করল। দুর্গের সশস্ত্র সৈন্যরা মুসলিম যোদ্ধাদের মোকাবেলায় প্রবৃত্ত হলো। অবশ্য এর আগেই বিন কাসিম নির্দেশ দিলেন দুর্গের কোন নারী-শিশু ও বেসামরিক লোককে আঘাত করবে না। কিন্তু কোন সামরিক সৈন্যের প্রতি বিন্দুমাত্র দয়া প্রদর্শন করবে না।
দুর্গের সৈন্যরা প্রতিরোধ চেষ্টা করলো বটে কিন্তু ক্ষিপ্ত ও ক্ষুব্ধ মুসলিম যোদ্ধাদের মোকাবেলায় পিপাসায় কাতর হিন্দু সৈন্যরা দাঁড়াতেই পারল না। ইতিহাসগ্রন্থ চাচনামায় লেখা হয়েছে, সেদিন মুলতান দুর্গের অন্তত ছয় হাজার হিন্দু সৈন্য মুসলমানদের হাতে নিহত হয়েছিল। প্রধান ফটক খুলে দিলে বিজয়ী বেশে বিন কাসিম দুর্গে প্রবেশ করেই ঘোষণা দিলেন, শহরে একথা প্রচার করে দাও, কোন সাধারণ বাসিন্দা যেন দুর্গ ছেড়ে পালানোর চেষ্টা না করে এবং কেউ যেন কোন হিন্দু সৈন্যকে আশ্রয় না
দেয় এবং সকল অধিবাসী যেন নিজ নিজ বাড়ীর গেট খোলা রাখে। সেই সাথে রাজপরিবারের কোন লোককে যেন শহরের কোন অধিবাসী নিজ বাড়ীতে আশ্রয় না দেয়। মুসলিম সৈন্যদের কেউ কারো বাড়িতে প্রবেশ করবে না। সবার সহায়-সম্পদ, মান সম্ভ্রমের পূর্ণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে।
স্থানীয় লোকদের দৌড়ঝাপ তবুও বন্ধ ছিল না। এর মধ্য দিয়েই মুসলিম শিবিরের সৈন্য ও অন্যান্যরা দুর্গে প্রবেশ করছিল। যে ফটক দিয়ে মুসলমানরা প্রবেশ করছিল ভয়ে আতঙ্কে দুর্গ ছেড়ে পালানোর জন্য অন্য ফটকের দিকে দৌড়াচ্ছিল হিন্দু অধিবাসীরা। অবস্থা দেখে মুসলমান সৈন্যরা দুর্গ ফটকগুলো বন্ধ করে দিল। কিন্তু ততক্ষণে বেশ কিছু হিন্দু অধিবাসী শহর থেকে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। এদের মধ্যে বাজরা ও তার খান্দানের লোকজনও ছিল। ‘ পিপাসায় কাতর মানুষ পানির জন্য যেসব আধারে পানি এনে জমা করা হচ্ছিল সেগুলোতে ঝাপিয়ে পড়ল। ঘর-সম্পদের নিরাপত্তার ব্যাপারটির
চেয়েও তখন তাদের কাছে জীবন বাঁচানোটাই বেশী গুরুত্বপূর্ণ ছিল। জনসাধারণের মধ্যে এই উদ্বেগ ছিল বিজয়ী বাহিনী তাদের ধন-সম্পদ লুট করবে এবং তাদের যুবতী মেয়েদের ধরে নিয়ে যাবে। কিন্তু পানি সংগ্রহ করে ঘরে ফেরা মানুষ চরম বিস্ময়ে লক্ষ করল, দরজা খোলা থাকার পরও কোন মুসলিম সৈন্য তাদের কারো ঘরে প্রবেশ করেনি এবং কোন যুবতী তরুণির প্রতি চোখ তুলে তাকায়নি কোন বিজয়ী সৈনিক। বিন কাসিমের বাহিনী শহরের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার পর বিন কাসিম শহরের শীর্ষ কর্মকর্তাদের তলব করলেন এবং শহরের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী ও গণ্যমান্য লোকদেরকে তার কাছে হাজির করার নির্দেশ দিলেন।
কিছুক্ষণ পর শহরের সকল গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ বিন কাসিম সকাশে এসে হাজির হলো। তিনি তাদেরকে সসম্মানে বসার নির্দেশ দিয়ে বললেন, তোমাদের শহরে যে পরিবর্তন এসেছে তোমরা নিজ চোখে দেখেছ। আমরা বিজয়ী বটে। কিন্তু আমরা তোমাদেরকে পরাজিত প্রজা মনে করি না। আমি নিজেকে তোমাদের বাদশা মনে করি না এবং তোমাদেরকে আমার প্রজা মনে করি না।
আমরা আপনার অনুগত প্রজা সম্মানিত সেনাপতি! দু’হাত প্রসারিত করে মাথা ঝুকিয়ে বিন কাসিমের উদ্দেশ্যে বলল এক অভিজাত ব্যবসায়ী। সে আরো বলল, আমরা সবসময়ই প্রজা হিসাবেই থেকেছি। আপনার একজন অনুগত প্রজা হিসাবে থাকব। আমরা আপনার আগমনকে একজন রাজার বিদায়ে আরেকজন রাজার আগমন হিসাবে দেখছি।