তাজা ফুরফুরে। ভোলা ময়দানে এগুলো ইচ্ছামতো চরে বেড়াতে এবং পর্যাপ্ত ঘাসপানি আহার করে তাজা-তাগড়া হয়ে উঠেছিল।
এদিনের যুদ্ধে শত্রুপক্ষের এক কমান্ডার আহত অবস্থায় মুসলমানদের হাতে বন্দি হলো। ওদের সৈন্যরা দিন শেষে দুর্গে ফিরে গেলেও বেশী আহত হওয়ায় ওর পক্ষে দ্রুত ফিরে যাওয়া সম্ভব হচ্ছিল না। ওর পোশাক দেখে মুসলিম যোদ্ধারা ওকে কয়েদ করে নিয়ে এলো। এই বন্দি মুসলমানদের কাছে ছিল মূল্যবান হাতিয়ার। তাই তাঁবুতে নিয়ে এসে ওর ক্ষতস্থানে ব্যান্ডেজ করে ওষুধ দেয়া হলো। এরপর গোয়েন্দা প্রধান শা’বান ছাকাফী ওর কাছ থেকে তথ্য বের করার জন্যে জিজ্ঞাসাবাদ করতে এলেন। তিনি বন্দির কাছে জানতে চাইলেন, তোমাদের দুর্গের অবস্থা কি? তোমরা আর কত দিন প্রতিরোধ চালিয়ে যেতে পারবে? দুর্গে আর কি পরিমাণ সৈন্য আছে? তোমাদের সামরিক আয়োজন কি পরিমাণ এখনো অবশিষ্ট আছে?
“হে আরব বন্ধু! আমি কোন সাধারণ সিপাহি হলে তোমাকে হয়তো অভ্যন্তরীণ অবস্থা বলে দিতাম। আমি মুলতানের সেনা বাহিনীর একজন কমান্ডার। তাছাড়া বংশে আমি একজন ব্রাহ্মণ। তুমি হয়তো জানো না, হিন্দুদের মধ্যে ব্রাহ্মণ সবচেয়ে সম্মানিত জনগোষ্ঠী। ব্রাহ্মণ ছাড়া হিন্দুদের কেউ মন্দিরের পুরোহিত হতে পারে না। রাষ্ট্র ও ধর্মের কর্ণধার হওয়ার অধিকার ব্রাহ্মণদের জন্যেই সংরক্ষিত। এমতাবস্থায় তুমি এই আশা করতে পারো না যে, আমি জাতি, রাষ্ট্র ও ধর্মের সাথে গাদ্দারী করে তোমাকে আমাদের দুর্বলতা ও আমাদের গোপন তথ্য বলে দেবো।
তুমি না বললেও তোমাদের অন্য কেউ ঠিকই বলবে, বললেন শাবান ছাকাফী। তবে এরপর আর তুমি আমাদের কাছে কোন ধরনের সহমর্মিতা ও সৎ ব্যবহারের আশা করতে পারো না। কারণ আমরা তোমাকে ক্ষমা করতে পারি না। তোমাদের কারণে ইতোমধ্যে আমাদের বহু সহযোদ্ধা নিহত হয়েছে।
এই দেশ, এই দুর্গ আর ধর্মের জন্য আমি জীবন বিলিয়ে দিতে প্রস্তুত, বলল বন্দি হিন্দু কমান্ডার। তোমরা আমাকে যা ইচ্ছা সেই শাস্তি দিতে পারো। সব শাস্তিই আমি মাথা পেতে মেনে নেব এবং খুশী মনে জীবন ত্যাগ করব। তুমি কিন্তু আমার কথা শেষ করার সুযোগ দাওনি। আমরা
এমনিতেই খুব কষ্টে ছিলাম, এখন আরেক কষ্টের শিকার হলাম। আমাকে কিছু সময় একান্তে চিন্তা করার অবকাশ দাও। ঠিক আছে, কি তোমার অসমাপ্ত কথা, আমাকে বলো, নিশ্চয়ই আমি তোমাকে চিন্তা করার সুযোগ দেবো। বললেন, গোয়েন্দা প্রধান। দুর্গে প্রচণ্ড পানি সংকট চলছে। পিপাসায় এখনো মৃত্যুর সংখ্যা বেশী না হলেও এই অবস্থা আর দুই তিন দিন অব্যাহত থাকলে মানুষ পানির অভাবে মরতে শুরু করবে বলল, হিন্দু কমান্ডার। পানি প্রবাহ তোমরা বন্ধ করে দিয়েছে। এটিই ছিল দুর্গবাসীর পানির একমাত্র উৎস। দুর্গের ভিতরে মাত্র কয়েকটি কূয়া সচল আছে, এগুলোর পানি সৈন্য ও যুদ্ধে ব্যবহার করার জন্যে বণ্টন করে দেয়া হয়েছে। সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা হওয়ার কারণে আমি তেমন পিপাসিত নই বটে কিন্তু পিপাসার যাতনায় যখন আমি দুইটি অবোধ শিশুকে মরতে দেখেছি, তখন থেকেই আমার মনে হচ্ছে, আমি যেন ওদের হত্যা করেছি।
আমি তো জানতে পেরেছি, দুর্গের পানি সংকট দূর করতে কূপ খননের কাজ চলছে? বললেন শা’বান ছাকাফী। সেই চেষ্টা অবশ্য চলছে। কিন্তু এখানকার মাটির অবস্থাই এমন যে, এখানে কূপ খনন করে পানি বের করা সহজ নয়। ব্যাপক চাহিদা মতো কূপ খনন করে পানি সরবরাহ করতে করতে বহু মানুষ মৃত্যু মুখে পতিত হবে। আমি যে কোন মূল্যে এসব নিরীহ লোকদের প্রাণ বাঁচাতে চাই। আমি সেনা কর্মকর্তা হয়ে পানি পান করছি, আর দুর্গের শিশুরা পানির অভাবে মৃত্যু বরণ করছে, মায়েরা পানি পান করতে না পারায় তাদের কোলের শিশুকে বুকের দুধ পর্যন্ত খাওয়াতে পারছে না। এজন্য নিজেকে খুব অপরাধী মনে হচ্ছে। “এমনই যদি অবস্থা হবে তারপরও তোমাদের সৈন্যরা আত্মসমর্পণ করছে না কেন? জানতে চাইলেন শাবান ছাকাফী। সৈন্যরা আত্মসমর্পণ করবে না। আমি একথা তোমাকে হলফ করেই বলতে পারি। তবে তোমাকে বলছি, গত রাতে কুরসিয়া এই দুর্গ থেকে চলে গেছে। সে যাওয়ার সময় তার আত্মীয় পরিবার সবাইকে নিয়ে গেছে।
কোন পথে গেছে কুরসিয়া? জানতে চাইলেন ছাকাফী। সে হয়তো আগে থেকেই এ ব্যাপারে খোজ-খবর নিয়েছে এবং পর্যবেক্ষণ করেছে। যে দিকে তোমাদের লোক কমছিল অথবা ফাকা ছিল
সেই জায়গা দিয়েই বেরিয়ে গেছে কুরসিয়া। তুমি জান কি-না জানি না। সেই কিন্তু দুর্গের সেনাপ্রধানের দায়িত্ব কাঁদে নিয়েছিল। বন্দি কমান্ডার বলল।
বজরা কোথায়? সে তো এখনো দুর্গেই আছে? জানতে চাইলেন গোয়েন্দা প্রধান। বজরা এখনো সৈন্যদেরকে তার নিয়ন্ত্রণে রেখেছে। বলল বন্দি কমান্ডার। কিন্তু তোমরা তাকে ধরতে পারবে না। তোমরা দুর্গে প্রবেশ করলে সে ঠিকই দুর্গ থেকে বেরিয়ে যাবে…। তোমরা আমার একটা কথা শোনো…। আমি জানি তোমরা দুর্গবাসীদের পানি প্রবাহ খুলে দেবে না। তা ঠিক। কিন্তু তুমি যদি ফিরে গিয়ে দুর্গের ফটক খুলে দিতে পার তাহলে আমি কথা দিচ্ছি, আমরা পানি প্রবাহ ছেড়ে দেবো। আমি গিয়েও দুর্গফটক খুলে দিতে পারব না। বলল বন্দি কমান্ডার। তবে আমি তোমাদের দুর্গে প্রবেশের একটা পথ বলে দিতে পারি। আর এটা আমি করছি, আমার দুর্গ ও জাতি ধর্মের শিশুরা যাতে পানির অভাবে মৃত্যুবরণ না করে এজন্য। তোমরা পানি প্রবাহ ছেড়ে দিয়ে দুর্গে প্রবেশের রাস্তা করতে পারো। এজন্য তোমাদেরকে আগে পানি প্রবাহ খুলে দিতে হবে।