উদ্দেশ্য ছিল উপমহাদেশে যেসব আরব বণিকের জাহাজ যাতায়াত করে, তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য একটি বন্দর কব্জায় রাখা।
এটিই ছিল ভারতে মুসলমানদের প্রথম অভিযান। অভিযান সফল হয়। কিন্তু এ অভিযানে আমীরুল মুমেনীনের অনুমোদন ছিল না বলে বন্দরের কব্জা বহাল রাখা হয়নি। ঐতিহাসিক বালাযুরী লিখেছেন-সেনাপতি উসমান বিন আবু আস যখন মালে গনীমতের অংশ মদিনায় প্রেরণ করেন তখন ভারত অভিযানের সংবাদে হযরত ওমর সেনাপতি বরাবর অনুমতি ছাড়া অভিযান পরিচালনার জন্যে কঠোর পয়গাম পাঠান।
হযরত ওমর লিখেন— “ভাই উসমান! তোমার এ অভিযান খুবই ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। তুমি যে পরিমাণ সৈন্যবল নিয়ে অভিযান পরিচালনা করলে, এরা তো একটি কীটের চেয়ে বেশী ছিল না, যে কীটকে তুমি একটি কাষ্ঠখণ্ডে বসিয়ে সমুদ্রে ফেলে দিয়েছিলে। তুমি এতোদূরে গিয়ে অভিযান পরিচালনায় ব্যর্থ হয়ে যদি বিপদে ফেঁসে যেতে, তাহলে আমার পক্ষে তোমাকে কোন সহযোগিতা করার উপায় ছিল না। আর যদি সেখানে সৈন্য ক্ষয় করে আসতে, তাহলে আল্লাহর কসম! আমি তোমার কবিলা থেকে এতো সংখ্যক লোক সেনাবাহিনীতে নিয়ে নিতাম।” এর কিছুদিন পর আমীরুল মুমিনীনের অনুমতিক্রমে উসমান বিন আবু আস সিন্ধু অঞ্চলে আরেকটি অভিযান পরিচালনা করেন। সেই অভিযানে তিনি তার সেনাবাহিনীকে দু’ভাগে ভাগ করেন। এক অংশের নেতৃত্বে ছিলেন সেনাপতি উসমান নিজে, আর অপর অংশের নেতৃত্ব তার ভাই মুগীরাকে দেন। উসমানের এ বাহিনী সামুদ্রিক জাহাজে করে ডাভেল অঞ্চলের সমুদ্র উপকুলে অভিযান চালায়।
সে সময় ডাভেলের রাজা ছিল চচন্দ। ডাভেলে সামা নামের এক বীর পুরুষ ছিল রাজা চন্দ এর সেনাপতি। সে দুর্গের বাইরে সেনাবাহিনীকে নিয়ে এসে মুগীরার বিপরীতে শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ে তোলে। তবুও মুগীরা শত্রু পক্ষের পেটে ঢুকে সামাকে হুমকি দিলেন। এক পর্যায়ে উভয় পক্ষের সেনাপতিদ্বয় মুখোমুখি হয়ে গেল। মুগীরা ‘আল্লাহু আকবার’ বলে তকবীর দিয়ে সামার ওপর হামলে পড়লেন। সামা আহত হলো, কিন্তু সে প্রতিপক্ষকে এমন আঘাত করল যে, মুগীরার পক্ষে সেই আঘাত সামলানো সম্ভব হলো না। মারাত্মক আহতাবস্থায় শাহাদাত বরণ করলেন মুগীরা রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু।
অবশেষে বিজয়ী হলো মুসলিম বাহিনী। কিন্তু সেই বিজয়ে মূল্য দিতে হয়েছিল খুব বেশী। শেষ পর্যন্ত নানা কারণে সেখানে আর মুসলমানরা কব্জা বহাল রাখেনি। এ ঘটনার ছয় বছর পর সেনাপতি আব্দুল্লাহ বিন আমের বিন রবিয়া ইরান জয় করেন। ইরান জয়ের পর তিনি সিস্তান আক্রমণ করেন। সিস্তানের শাসক মিরখান হাতিয়ার ত্যাগ করে আত্মসমর্পণ করেন। সিস্তান দখল হওয়ার পর সেনাপতি আব্দুল্লাহ সেনাপতি তামিম তাগলিবীকে মাকরান অভিযানে প্রেরণ করেন। তখন মাকরানের শাসক ছিল রাজা রাসেল। রাসেল সিন্ধের রাজা চচন্দের সাহায্য প্রার্থনা করলে চচন্দ রাসেলের সাহায্যে বিরাট সেনাবাহিনী পাঠালো। উভয় সেনাবাহিনী একত্রিত হলে মুসলিম বাহিনীর বিপরীতে হিন্দুদের সৈন্য সংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে গেল, তবুও মুসলমানরাই বিজয়ী হলেন। মাকরান মুসলমানদের কব্জায় নীত হলো।
অবশ্য এর আগেও একবার হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু-এর খেলাফত কালে ইরাকের শাসক আবু মূসা আশআরী রবিয়া বিন যিয়াদ নামের একজন সেনাপতিকে মাকরান অভিযানের নির্দেশ দিয়েছিলেন। তখন মাকরান তাঁদের অধীনে এসেছিল। কিন্তু বিজয়ের পর মুসলিম সেনাবাহিনীকে কব্জা ত্যাগ করে ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়।
সেই অভিযানে অর্জিত মালে গনীমতের অংশ ভিন্ন করে বাইতুল মাল মদিনায় প্রেরণ করলে সরকারী অংশ মদিনায় নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল অভিজ্ঞ সেনানায়ক শিহাব আবদীকে।
বাইতুল মালের অংশ নিয়ে আমীরুল মুমিনীন হযরত ওমরের কাছে সমর্পণ করলে তিনি বললেন
“আল্লাহ তাআলা তোমাদের বিজয়কে মোবারক করুন।” তোমাদের ওপর আল্লাহ্ তাআলা রহম করুন। আচ্ছা শিহাব! আমাকে বলো তো মাকরানের অবস্থান কিরূপ? ওখানকার ভৌগোলিক অবস্থা কেমন?”
“আমীরুল মুমিনীন! বলল শিহাব। মাকরানের জমিন খুবই শুষ্ক। সেখানে কোন ফল ফুল জন্মে না। দু’চারটি ফলজ বৃক্ষে যা ফল পাওয়া যায়, সেগুলো খাওয়ার অযোগ্য। ওখানকার অধিবাসীরা লুটতরাজে অভ্যস্ত। একজন অপরজনকে লুট করেই এরা জীবিকা নির্বাহ করে। এরা বেঁচে থাকার প্রয়োজনেই অপরজনকে খুন করে। আমরা যদি সেখানে অল্পসংখ্যক সেনাবাহিনী মোতায়েন করি, তাহলে তাদের ওরা লুটতরাজ করে নিঃশেষ
করে দেবে, আর যদি বেশী পরিমাণে সৈন্য মোতায়েন করা হয়, তাহলে খাদ্যাভাবে মারা যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।”
“আল্লাহ্ তোমার ওপর রহম করুন।” শিহাব আবদীর কথার প্রেক্ষিতে বললেন হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু। তুমি তো কাব্য করছ, ওখানকার প্রকৃত অবস্থা আমাকে বলো।”
“আমীরুল মুমিনীন! আমি যা দেখেছি, হুবহু তাই আপনার কাছে ব্যক্ত করলাম। আল্লাহর কসম! আমি কেন; যেই সেখানে যাবে সে একথাই বলবে। সত্যকে ও বাস্তবতাকে কিছুতেই অস্বীকার করা যায় না আমীরুল মুমিনীন!”
“না, শিহাব আবদী। তোমার ধারণা ঠিক নয়।” বললেন ওমর। ইসলামের সৈনিকদেরকে ক্ষুৎপিপাসা কখনো মেরে ফেলতে পারে না। কায়সার ও কিসরাকে অস্ত্রসমর্পণে বাধ্যকারী মুজাহিদদের বেলায় একথা বলা যায় না যে, তারা ঘুমিয়ে থাকবে আর ডাকাতেরা সহায় সম্পদ লুটে নিয়ে যাবে। তাদের বেলায় একথাও বলা হবে অপমানকর যে, তারা ক্ষুধা পিপাসায় ধুকে ধুকে মারা যাবে।”