“আরব বিদ্রোহীরা এদেশে এসেছিল সে তো অনেক আগের কথা, কিন্তু এতোদিন পরে তোমাকে কেন আসতে হলো?” জিজ্ঞেস করল মায়া।
“আমি আসলে ওইসব বিদ্রোহীদের কেউ নই, যাদের বিরুদ্ধে প্রথম ধরপাকড় হয়েছিল- বলল বেলাল। বিদ্রোহের সময় আমিও বিদ্রোহীদের সাথে ছিলাম, কিন্তু কিছুদিন পরে আমি ভাবলাম, পরস্পর যুদ্ধ করা মোটেও ঠিক নয়। এই বোধ থেকে আমি তৎকালীন খেলাফতের বিশ্বস্ত হয়ে গেলাম। কিন্তু খেলাফতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহীদের সংখ্যা এখনো সেদেশে নিঃশেষ হয়ে যায়নি। বিদ্রোহীদের পক্ষ ত্যাগ করার কারণে আমি ওদের শত্রুতে পরিণত হই, খেলাফতের পক্ষে চলে যাওয়ার কারণে বিদ্রোহীরা আমাকে হত্যার হুমকি দেয়। এদিকে বিদ্রোহীদের সঙ্গ দেয়ার জন্যে খেলাফতের মধ্যে
অনেকেই আমাকে অবিশ্বাস ও সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখে। ঘরে বাইরে আমি শত্রুবেষ্টিত হয়ে পড়ি, সেখানে আমার বেঁচে থাকাটাই মুশকিল হয়ে পড়ে। এ কারণে চার সাথীকে নিয়ে আমি দেশ ত্যাগ করে চলে আসি।
এখনও আমি সন্দেহ সংশয়ের মধ্যে রয়েছি। আমি কোন পক্ষ অবলম্বন করবো স্থির সিদ্ধান্তে পৌছতে পারছি না। কখনও মনে হয় বিদ্রোহীদের পক্ষাবলম্বন করাই হবে আমার কর্তব্য।”
বেলালের কথা শুনতে শুনতে মায়ারাণীর চেহারার রং বদলে যেতে লাগলো। কোন কিশোরী প্রেমে পড়লে প্রেমিকের সংস্পর্শে গেলে চেহারার যে অবস্থা হয় মায়ারাণীর চেহারাও তদ্রুপ। প্রেমিকা যেমন প্রত্যাশ্যা করে প্রেমিক সারা জীবন তার সামনে বসে থাকুক, আর কথা বলুক, মায়ার অবস্থাও হলো তাই।
“তুমি কি আমাকে বিশ্বাস করো?” রাণীকে জিজ্ঞেস করল বেলাল। তোমাদের দুর্গে আমার কোন একটা চাকুরী হলেই হলো। এ মুহূর্তে আমার সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন একটা নিরাপদ আশ্রয়। একটা নিশ্চিন্ত ঠিকানা পেলে আমি ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করতে পারতাম আমি ভুল পথে আছি কি-না?”
“আমি তোমাদের জন্য একটা কিছু করবো।” বলল রাণী।
তুমি কি আমার ওপর আস্থা রাখতে পারবে? জিজ্ঞেস করল মায়া। আমার মনে হয় আমাদের মধ্যে আর একবার দেখা হওয়া উচিত।”
“তুমি যেখানকার কথা বলবে, আমি সেখানেই চলে আসব।” বলল বেলাল। মায়ারাণী বেলালকে রাজা দাহিরের দুর্গের পার্শ্ববর্তী একটি জায়গার কথা বলল। আগামীকাল অমুক সময় তুমি সেখানে থাকবে, আমি তোমার কাছে আসব।” এই বলে মায়া চলে গেল। “বেলাল মায়ার কাছ থেকে বিদায় হয়ে একটি উঁচু টিলার ওপর তার চার সঙ্গীর কাছে চলে গেল। বেলাল সঙ্গীদের কাছে গিয়ে বলল, রাজা দাহিরের কাছে পৌছানোর জন্যে ক’দিন যাবত যে চেষ্টা করছিলাম, ঘটনাক্রমে আজ সে ব্যবস্থা আল্লাহ করে দিয়েছেন। বেলালের জন্য এভাবে মায়ার মুখোমুখি হওয়া যদিও ঝুঁকিপূর্ণ ছিল, তবুও ঝুঁকি নিয়েছিল বেলাল। কিন্তু মায়ারাণী তার কথায় এতোটা প্রভাবিত হয়ে যাবে তা ছিল আশাতীত।
সিন্ধু অঞ্চলে দেশ ত্যাগী পাচ আরব মুসলমানের উপস্থিতি কোন আশ্চর্য ঘটনা ছিল না। কারণ মুহাম্মদ বিন কাসিমের জন্মের বহু পূর্বেই আরবের বহু মুসলমান ভারত ভূখণ্ডে পৌঁছে গিয়েছিলেন। অনেকেই ভারতের ভুখণ্ডে বসতি স্থাপন করেছিলেন। সর্বপ্রথম মুসলমানরা মালাবার অঞ্চলে আসেন। অবশ্য ইসলামের আগে থেকেই আরব বণিকদের এ অঞ্চলের সাথে যোগাযোগ ছিল। যেসব মুসলমান মালাবার অঞ্চলে এসেছিলেন, তারা ছিলেন মূলত নৌচালক ও বণিক। মুসলমানরা এখানে আসার সময় ভারতে বৌদ্ধ, হিন্দু, খৃস্টান ও ইহুদি এই চার ধর্মের অস্তিত্ব ছিল। অবশ্য অধিকাংশ মানুষ ছিল পৌত্তলিক ধর্মে বিশ্বাসী হিন্দু।
ইতিহাস সাক্ষী দেয় রাসূল সাঃ-এর জীবদ্দশায়ই ইসলাম ভারতের মালাবার অঞ্চলে পৌঁছে গিয়েছিল। হেরা গুহার অন্ধকারে যে আলোক রশ্মি উদিত হয়েছিল, তা আরব বণিকদের মাধ্যমে উপমহাদেশের মালাবার অঞ্চলে রাসূলে আরাবী সাঃ-এর জীবদ্দশাতেই পৌঁছে গিয়েছিল। আরব বণিকদের হাতে বহু ভারতীয় ইসলাম ধর্মে দীক্ষা নিয়েছিলেন।
মালাবারের অদূরেই ছিল সরন্দ্বীপ যা বর্তমানে শ্রীলঙ্কা নামে পরিচিত। মুসলমান বণিকরা যখন জাহাজে করে বিভিন্ন পণ্য নিয়ে এ অঞ্চলে আসতো, তারা শুধু পণ্যই নিয়ে আসত না, সাথে নিয়ে আসত ইসলামের পবিত্র আলো। মুসলমান বণিকদের সাথে যখন শ্রীলংকা ও মালাবারের লোকদের সখ্যতা গড়ে উঠলো, তখন তারা মুসলমানদের উন্নত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও সততায় আকৃষ্ট হলো। পরে যখন তারা ইসলামের তাবলীগ শুরু করলেন, তখন তাদের উন্নত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও সততায় মুগ্ধ হয়ে বহু লোক ইসলামে দীক্ষা নিল।
ভারতের লোকজন যখন দেখল ইসলামে কোন রাজা প্রজার বিভেদ নেই, মানুষ হিসাবে সবাই সমান। সবাই এক আল্লাহর বান্দা। আরব মুসলমানদের সংস্পর্শে এসে তৎকালীন শ্রীলঙ্কার উপকূল ও মালাবারের রাজাও ইসলাম ধর্মে দীক্ষা নিয়েছিলেন। এমন কি মালাবারের রাজা যামুরান ইসলাম ধর্ম গ্রহণের পর রাসূল সাঃ-এর সাথে সাক্ষাতের জন্য হিজাযে রওয়ানা হয়েছিলেন। কিন্তু আরব উপকূলে সামুদ্রিক ঝড়ে জাহাজ ডুবে তার মৃত্যু ঘটে। মৃত যামুরানকে ইয়েমেনের তীরে দাফন করা হয়।
হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু-এর খেলাফতের সময় সেনাপতি উসমান বিন আবু আস বোম্বাই এর নিকটবর্তী থানা বন্দর আক্রমণ করেছিলেন। তার আক্রমণের