“তুমি কি জানতে আমি কে?” ক্ষীণ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল রাণী।”
“না আমি জানতাম না যে তুমি রাজা দাহিরের স্ত্রী। তোমার ঘোড়ার গাড়ি ও পিছনের নিরাপত্তা রক্ষীদের দেখেই বুঝতে পেরেছিলাম তুমি শাহী খান্দানের কেউ হবে।”
“এখনতো জানলে? এখন কি আমাকে তোমার ভয় হচ্ছে না?”
“না, ভয় করছি না। তোমাদের এখানে ভয় করার অর্থ এক রকম, আর আমাদের দেশে ভয় এর অর্থ অন্যরকম।
আমরা শুধু আল্লাহকেই ভয় করি। আমরা মুসলমান। আমাদের দেশে কোন রাজা মহারাজা নেই। সেখানে কেউ রাজা-বাদশাহ হয় না।”
“তুমি এখানে কেন এসেছিলে?” যুবককে জিজ্ঞেস করলো মায়ারাণী।
“আমি একটি অপরাধ করে এসেছি। এখন যদি সেই অপরাধের কথা তোমাকে বলি, সেটি হবে আরেকটি অপরাধ। অবশ্য তোমাকে একথা বলতে পারি, আমি এখানে কোন অপরাধ করতে আসিনি। আশ্রয় নিতে এসেছি।”
মায়ারাণী রথচালককে ইশারায় আহবান করলো। রথচালক দৌড়ে এলো। রথচালক এলে মায়া বললো, হরিণের গা থেকে বর্শাটা খুলে এখানেই রেখে দাও, আর হরিণটি গাড়িতে করে নিয়ে যাও। রথচালক রাণীর নির্দেশ পালন করে যখন যেতে লাগল, তখন আবার ডাকলো মায়ারাণী। রাণী এগিয়ে গিয়ে ফিসফিস করে বলল, কোন আশঙ্কা নেই সংগ্রাম। আমি এর কাছ থেকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহ করছি। এ লোক আমাদের কাজে আসতে পারে। তোমরা একটু দূরে চলে যাও।”
“মহারাণী! আপনার যে জ্ঞান আছে তাতে আমার কিছু বলার নেই। আমি শুধু আপনাকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি, মুসলমানদের বিশ্বাস করা যায় না। একটু সতর্ক থাকবেন।”
“তোমার কোন চিন্তা করতে হবে না। যাও। এ লোক আমার কোন ক্ষতি করতে পারবে না।”
চলে গেল রথচালক। রাণীর নিরাপত্তা রক্ষীরাও আরো দূরে সরে গেল। রাণী পুনর্বার আরব যুবকের সামনে গিয়ে দাঁড়াল।
“তুমি কি নিজের সম্পর্কে আমাকে আর কিছু বলবে না?” আরব যুবককে জিজ্ঞেস করলো মায়া।
“নিজের সম্পর্কে আর কিছু বলার আগে আমি তোমাকে কিছু প্রশ্ন করতে চাই।”
“ঠিক আছে, যা জিজ্ঞেস করার তা করো।”
“আমি তোমাদের দেশ সম্পর্কে জানি। এদেশের রাজা বা রাণী সাধারণ মানুষের সাথে এভাবে কথা বলে না, যেভাবে তুমি আমার সাথে বলছ। তোমাদের এখানে তো মানুষ মানুষের দেবতায় পরিণত হয়েছে।”
“আমি তোমাকে সাধারণ কোন ব্যক্তি মনে করছি না।” বলল মায়ারাণী। আমার মনে হয় তুমি কোন শাহী খান্দানের লোক। আচ্ছা, তুমি আমাদের ভাষা শিখলে কোত্থেকে?” তুমি কি আমাদের দেশ সম্পর্কে আরো বিশেষ কিছু জানো?”
রাণী কিছুক্ষণ নীরব থেকে আরব যুবকের দিকে তাকিয়ে বলল, তোমার সাথে আমার কঠোর স্বরে কথা বলার কোন দরকার নেই, কারণ আমি তোমাকে জানাতে চাই যে, এ মুহূর্তে তুমি আমার নিরাপত্তা রক্ষীদের বেষ্টনীর মধ্যে রয়েছে। আমি তোমাকে আরব গোয়েন্দা বলে সন্দেহ করছি। তুমি কি আমার সন্দেহ নিরসন করতে পারবে?”
“না, তোমার এ সন্দেহ নিরসন করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তবে আমি তোমাকে সন্দেহাতীতভাবে জানিয়ে দিচ্ছি আমি কারো গোয়েন্দা নই। আমার নাম বেলাল বিন উসমান। আমি আমার খেলাফতের বিদ্রোহী। আমি জানতে পেরেছিলাম এখানে আরবের অনেক লোক আশ্রয় নিয়েছে, এদের সবাই ছিল বিদ্রোহী।”
“যা, তোমার কথা ঠিক।” বলল মায়ারাণী। আমরা হাজার হাজার বিদ্রোহী আরবকে আশ্রয় দিয়েছি। তুমি ওদের কাছে যাওনি কেন?”
“আমার কাছে তাদের কোন ঠিকানা নেই। তাছাড়া আমি একা নই, আমার সাথে আরো চারজন রয়েছে। আমরা চার পাঁচ দিন যাবত এখানে লুকিয়ে রয়েছি। আমরা বুঝতে পারছি না, কিভাবে রাজা পর্যন্ত আশ্রয়ের জন্যে যাওয়া যাবে। তুমি জানতে চেয়েছিলে তোমাদের ভাষা আমি কি করে শিখেছি। ছোট্ট বেলায় আমি আমার পিতার সাথে এদেশে এসেছিলাম এবং ছিলাম প্রায় পাঁচ ছয় বছর। তখনই আমি তোমাদের দেশের ভাষা শিখেছি।”
“তুমি কি তখন সিন্ধু অঞ্চলে থাকতে?”
“না, আমি প্রথমে গিয়েছিলাম সন্দ্বীপে। তুমি কি জানো, ওখানে অনেক আগে থেকেই মুসলমানরা বসবাস করে?” “হ্যাঁ, একথা আমি জানি। আমি জানি অনেকদিন আগে থেকেই আরব বণিকরা যাতায়াত করত। এদের অনেকেই সেখানে বসতি গড়ে তোলে। আমি একথাও জানি যে, মালাবারে যেসব মুসলমানরা বসবাস করে, তারা ইসলামও প্রচার করে। তারা এ অঞ্চলের অনেক বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীকে মুসলমানও বানিয়েছে।” “আমার পিতাও একজন ধর্মপ্রচারক। অবশ্য তিনি ব্যবসাও করতেন। আমি সেই সুবাদে পিতার সাথে এদেশে এসেছিলাম। আব্বার সাথে আমি হিন্দুস্তানের বহু জায়গায় গিয়েছি। তখনই আমি এদেশের ভাষা শিখেছি। আমার পিতা আমাকে একজন ধর্ম প্রচারক হিসাবে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন, কিন্তু আমার আগ্রহ ছিল সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়ার। আবু তখন আমার আগ্রহের কথা বিবেচনা করে সামরিক প্রশিক্ষণের জন্য অভিজ্ঞ উস্তাদের কাছে পাঠান। আমি বড় হওয়ার পর তিনি আমাকে আরব দেশে পাঠিয়ে দেন। আমি খলিফার সেনাবাহিনীতে যোগ দিলাম কিন্তু কিছুদিন পর সেনাবাহিনী ও খেলাফতের মধ্যে দেখা দিল বিরোধ। যেসব সেনা সদস্য ও নাগরিক তৎকালীন খলিফার বিরোধী ছিল তারা খলিফার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করল। কিন্তু খলিফার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ব্যর্থ হয়ে গেল এবং বিদ্রোহীরা গ্রেফতার ও মৃত্যুর সম্মুখীন হতে লাগল। এখানকার রাজা যাদের আশ্রয় দিয়েছেন, তারা সেই খলিফা বিদ্রোহী আরব। আমি যেহেতু বিদ্রোহীরই সন্তান, তাই আমাকেও পালাতে হলো।”