হরিণ টিলার ফাঁকে ফাঁকে নীচু দিয়ে দৌড়ে পালাচ্ছিল। আর আঁকাবাঁকা পথে এগুচ্ছিল। রাণী এরপরও হরিণের পিছু ছাড়লো না। হরিণ যেদিকে মোড় নিতো মায়ার ঘোড়ার গাড়িও সেদিকে ঘুরতে গিয়ে মাঝে মধ্যে উল্টে যাওয়ার উপক্রম হত। এমতাবস্থায় আবারো তিনটি তীর নিক্ষেপ করলো মায়া। কিন্তু কোনটিই হরিণকে স্পর্শ করল না। এ সময় সামনে ঘন টিলাময় জায়গা এসে গেল। হঠাৎ একটি টিলার ওপাশ থেকে এক অশ্বারোহী বেরিয়ে এলো। আরোহীর হাতে বর্শা। আরোহী তার ঘোড়া ধাবমান হরিণের পিছনে ছুটালো। মায়ারাণীর গাড়িও ততক্ষণে খোলা জায়গায় এসে গেছে। মায়ারাণীর রথচালক হরিণের পিছু ধাবমান অশ্বারোহীকে চিৎকার করে বলল, সামনে থেকে সরে যাও! এটা মহারাণীর শিকার। কিন্তু অশ্বারোহীর কানে রথচালকের চিঙ্কার প্রবেশ করেছে বলে মনে হলো না। সে যথারীতি হরিণের পিছনে ছুটতে লাগল।
“মহারাণী! তীর ধনুক আমার হাতে দিন! হরিণের আগে আমি এই বেকুবকেই খতম করে ফেলব।” বলল রথচালক।
“মনে হচ্ছে, অশ্বারোহী আমাদের দেশের নয়।” বলল মায়ারাণী।
এমন সময় হরিণ একটু ঘুরে দৌড়াতে লাগলো, অশ্বারোহীও ঘুরে গেল সেদিকে। এখন স্পষ্টই অশ্বারোহীর চেহারা দেখা গেল।
“দেখে মনে হচ্ছে এ কোন আরব।” বলল রথচালক। বুঝতে পারছি না, এদিকে আসার সাহস ও কিভাবে পেল! রথ তখনো আগের মতোই এগুচ্ছিল। মায়ারাণী আবারো কয়েকটি তীর ছুড়ল কিন্তু পূর্ববৎ এগুলোও লক্ষ্যভেদ করতে পারল না। এমন সময় অশ্বারোহী পদানীর ওপর দাঁড়িয়ে তার হাতের বর্শাটি হরিণের দিকে নিক্ষেপ করলে নিক্ষিপ্ত বর্শা গিয়ে পড়ল হরিণের কাঁধে। বর্শা বিদ্ধ হওয়ায় হরিণটি লাফ দিয়ে লুটিয়ে পড়ল মাটিতে। অশ্বারোহী লুটিয়ে পড়া হরিণের পাশে গিয়ে দাঁড়াল। এদিকে ধাবমান মায়ার ঘোড়ার গাড়িও ততোক্ষণে পড়ে থাকা হরিণের পাশে গিয়ে থেমে গেল। অশ্বারোহী মায়ার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসছিল। রথচালক অশ্বারোহীর প্রতি রাগে ফুঁসতে ফুসতে সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।
“তুমি সেইসব আরবদের কেউ যাদেরকে মহারাজা আশ্রয় দিয়েছেন? স্বদেশী ভাষায়ই জিজ্ঞেস করল রথচালক। তুমি কি জানো না, কি অপরাধ করেছছ? মহারাণী ইচ্ছে করলেই তোমাকে আমার গাড়ির পিছনে বেঁধে ঘোড়া দৌড়িয়ে দেয়ার নির্দেশ দিতে পারেন। তুমি আরব হয়েও এভোটা বেকুব ও বেআদব হলে কি করে?”
“না, আমি মহারাজের আশ্রিত আরবদের কেউ নই। তাছাড়া আমি কোন বেআদবীও করিনি, বেকুবও নই।”
“আরে! তুমি আমাদের ভাষাও জানো! আশ্চর্যান্বিত কণ্ঠে বলল রথচালক।
“মায়ারাণীর রাগান্বিত হওয়াটাই ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু সে রাগান্বিত হলো না। ঘোড়ার গাড়ি থেকে নেমে মায়া গিয়ে দাঁড়াল অশ্বারোহীর সামনে। গভীরভাবে তাকালো আরোহীর চোখের দিকে। অজ্ঞাত আরব অশ্বারোহীর বয়স ছিল ত্রিশের কোঠায়। উজ্জ্বল ফর্সা গায়ের রং, একহারা শরীরের গড়ন। শক্ত গাঁথুনী শরীরের। গাঢ় কালো চোখের তারায় হাসির ঝিলিক। চেহারার মধ্যে এক ধরনের মায়া মায়া ভাব। প্রগাঢ় ব্যক্তিত্বর ছাপ আরোহীর চেহারায়। মায়া যুবকের দিকে তাকিয়ে তার
সম্মোহনীতে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল। আরব যুবকের মুচকি হাসি মায়ারাণীর প্রতি যেন এক ধরনের বিদ্রুপ করছিল।
এমন সময় অশ্বখুরের আওয়াজ শোনা গেল। মুহূর্তের মধ্যে সেদিকে দৌড়ে এলো ছয়জন অশ্বারোহী। এরা ছিল মায়ারাণীর নিরাপত্তারক্ষী।
“সগ্রাম, নিরাপত্তা রক্ষীদের আমার কাছে আসতে দিয়ো না। ওদেরকে দূরেই থামিয়ে দাও। আর তুমিও রথ নিয়ে যাও। এর ভাগ্যের ফায়সালা আমি একাকীই করব।” চালক রথ নিয়ে চলে গেল এবং নিরাপত্তা রক্ষীদের দূরেই থামিয়ে দিলো।
“এখানে কেন এসেছ?” আরোহীকে জিজ্ঞেস করল মায়ারাণী। হরিণ শিকারের জন্যে এসেছিলে? আমার অনুমতি ছাড়া তো তুমি হরিণ নিয়ে যেতে পারবে না।”
“এটা যদি আমি নিজের জন্যে শিকার করতাম, তাহলে মরে যাওয়ার আগেই আমি সেটিকে জবাই করতাম। আমি এটিকে তোমাদের জন্যই শিকার করেছি। আমি জানি তোমরা মরা জীবজন্তু খেয়ে থাকো।” “আমাদের জন্য তুমি কেন শিকার করলে? তুমি কি আমাকে নারী মনে করে ভেবেছিলে আমি এটিকে শিকার করতে পারবো না?” জিজ্ঞেস করল মায়া। তুমি কি আমার সাথে ঠাট্টা করেছ? না আমাকে এর পিছনে আসতে দেখোনি?”
“আমি তোমাকে নারী হিসেবে দেখেছি ঠিক, কিন্তু শিকারের ব্যাপারে তোমাকে আমি আনাড়ী মনে করিনি। আমি এ টিলার ওপরে দাঁড়িয়ে ছিলাম। তুমি যখন থেকে হরিণের পিছু নিয়েছ, তখন থেকেই আমি তোমাকে দেখছি বারবার তুমি হরিণের দিকে তীর নিক্ষেপ করছ, কিন্তু রথ এদিক সেদিক হওয়ার কারণে তোমার ছোড়া তীর লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এদিকে হরিণটিও বাঁচার জন্যে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়াচ্ছে। এদিকের মাটি অসমতল হওয়ার কারণে তোমার রথ যেভাবে হেলে যাচ্ছিল এবং হোচট খাচ্ছিল তাতে মনে হচ্ছিল রথ না আবার উল্টে যায়। এজন্য আমি ভাবলাম তোমার জন্য হরিণটি শিকার করে দেবো, যাতে তোমার ঝুঁকির আশঙ্কায় পড়তে না হয়।”
সুদর্শন আরব যুবক বলে যাচ্ছিল স্মিত হাস্যে।
মায়ারাণী মন্ত্রমুগ্ধের মতো যুবকের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। যেন যুবক তাকে যাদু করে ফেলেছে। তার মুখ থেকে কোন কথাই আর বের করতে পারল না।