অভিজাত যুবকদ্বয়ের এ যুদ্ধ এতে শেষ হয়নি। সুলায়মান ঘোড়া থেকে নেমে পড়ায় বিন কাসিমও লাফ দিয়ে ঘোড়া থেকে নেমে পড়ল এবং উভয়েই কোষমুক্ত করলো তরবারী। এবার পরস্পরের মধ্যে শুরু হলো অসিযুদ্ধ। শুরু হলো যুবকদ্বয়ের প্রচণ্ড মোকাবেলা। তরবারীর ঝলকানি ও আঘাতের শব্দে সারা ময়দানে শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা। উভয়েই সমানে সমান। আঘাতের তীব্রতা দেখে দর্শকদের মনে হচ্ছিল হারজিত নয় একে অপরকে মৃত্যুঘাটে পৌছে না দিয়ে এদের কেউ ক্ষান্ত হবে না। সুলায়মান বিন কাসিমের উদ্দেশে বলল, “বিন কাসিম! পরাজয় মেনে নাও। নয়তো তুমি যদি পড়ে যাও, অথবা তোমার তরবারী যদি পড়ে যায়, তাহলে কিন্তু আমি তোমার বুকে তলোয়ার বিদ্ধ করবো।” সুলায়মান ছিল আবেগ তাড়িত। সে যুবায়দাকে পাওয়ার জন্য খেলাচ্ছলে বিন কাসিমকে হত্যা করতেই উদ্যত ছিল। সুলায়মানের হুমকিতে মুহাম্মদ বিন কাসিম জবাব দেয়ার কোন প্রয়োজন বোধ করলো না।
হঠাৎ মুহাম্মদ বিন কাসিম সুলায়মানের বিরুদ্ধে আক্রমণ তীব্রতর করে তুলল। সুলায়মান তখন প্রতিঘাতের বিপরীতে আঘাত সামলাতেই হিমশিম খাচ্ছে। স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে সুলায়মানের বেকাবু অবস্থা। মুহাম্মদ বিন
কাসিম সুলায়মানকে প্রতিঘাত করার কোন সুযোগই দিচ্ছিল না। এক পর্যায়ে এমন এক শক্ত আঘাত হানলো বিন কাসিম সুলায়মান আঘাত ফেরাতে সক্ষম হলো বটে; কিন্তু তরবারী তার হাত থেকে ছিটকে দূরে গিয়ে পড়লো। সে তরবারীর দিকে দৌড় দিলো বটে কিন্তু বিন কাসিম তাকে আর সেই সুযোগ দিলো না। সুলায়মান তখন খালি হাত। বিন কাসিম দুটি আঘাত করতেই ও পিছাতে পিছাতে পড়ে গেল। মুহাম্মদ বিন কাসিম তার একটি পা বুকের উপর রেখে তরবারী সুলায়মানের ঘাড়ে চেপে ধরলো।
মঞ্চ থেকে গর্জে উঠলেন হাজ্জাজ—“মুহাম্মদ তরবারী উঠিয়ে নাও।”
“ঠিক আছে আমি তোমাকে জীবন ভিক্ষা দিলাম।” দৃঢ় কণ্ঠে বলল বিন কাসিম। বনী ছাকিফের কসম করে বলছি— জীবনে আর কোনদিন তুমি তায়েফবাসীদের আত্মসম্মানে আঘাত করবে না।” “আমি জীবিত থাকলে তোর মতো হতভাগ্য আর কেউ দুনিয়াতে হবে না।
জমিন থেকে উঠতে উঠতে বলল সুলায়মান। সুলায়মান বিন আব্দুল মালিকের এ কথাগুলো কোন পরাজিতের আস্ফালন ছিল না। এ কথাগুলো ছিল তার জীবন-মরণ প্রতিজ্ঞা। এ প্রতিহিংসার প্রতিজ্ঞাই শেষ পর্যন্ত ভারতের বিজয় ইতিহাসের গতিপথ বদলে দিয়েছিল।
০২. ৭০০ খৃস্টাব্দ
৭০০ খৃস্টাব্দ মোতাবেক ৮১ হিজরী সন। মুহাম্মদ বিন কাসিমের বয়স তখন মাত্র সতের বছর। সিন্ধু অঞ্চলে দাহির নামের এক কট্টর হিন্দু রাজা মসনদে আসীন হলো। তখন সিন্ধু অববাহিকা ছিল দুটি রাজ্যে বিভক্ত। এক অংশের রাজধানী ছিল আরুঢ় অনেকে বলত আলোড়। আর অপর অংশের রাজধানী ছিল ব্রাহ্মণাবাদ। ব্রাহ্মণাবাদের রাজার নামই ছিল রাজ। ক্ষমতা দখলের এক বছরের মাথায় সে মারা গেল। রাজের মৃত্যুর পর ব্রাহ্মণাবাদের মসনদ অপর অংশের রাজা দাহিরের এক জ্ঞাতি ভাই দখল করে নেয়। এতে রাজা দাহির খুব খুশী হয় এই ভেবে যে, তারই এক জ্ঞাতি ভাই সিন্ধু অঞ্চলের অপর অংশের ক্ষমতায় আসীন হয়েছে। রাজা দাহির মসনদ দখল করার তিন চার বছর পরের ঘটনা। রাজা দাহিরের রাণী মায়ারাণী হরিণ শিকার করতে গেল। তখন সিন্ধু অববাহিকা যেমন ছিল ঘন জঙ্গলাপূর্ণ; দ্রুপ জংলী পশু পাখিতে ছিল ভরা। তখনকার রাজা-রাণীদের হরিণ শিকার ছিল একটি আভিজাত্যের প্রতীক। ছুটন্ত হরিণের পিছে তাজি ঘোড়া হাঁকিয়ে বিষাক্ত তীর ছুড়ে হরিণকে ঘায়েল করা ছিল শাসকদের একটি অন্যতম খেলা। এ কাজে বেশীর ভাগ পুরুষরা অংশ নিলেও কোন কোন রাজ বংশের সাহসী মেয়েরাও রীতিমতো বন্যপ্রাণী শিকার করত। তাদের শিকার কাজে সহযোগিতা করতে অনুগত ভৃত্য ও দেহরক্ষী সৈন্যসান্ত্রী।
মাত্র এক বছর হলো বিয়ে হয়েছে রাণীর। বয়স উনিশ কিংবা বিশের বেশী নয়। মায়ারাণী ছিল খুবই সুন্দরী, সেই সাথে শিকার প্রেমী। বংশগতভাবে মায়ারাণী রাজবংশের মেয়ে হওয়ায় অশ্বারোহণ ও তীর নিক্ষেপে পুরুষের চেয়ে কোন অংশে কম ছিল না। সেদিন সে দুটি ঘোড়া ও দু’চাকার রথ নিয়ে শিকার করতে বের হলো। রথচালক ছিল শাহী নিরাপত্তাবাহিনীর সদস্য। সে
যুদ্ধক্ষেত্রে রাজাকে বহনকারী ঘোড়ার গাড়ি চালাতো। যদ্দরুন ঘোড়ার গাড়ি চালনায় তার পারদর্শিতা ছিল কিংবদন্তিতুল্য।
শিকারের জায়গায় পৌছেই চার পাঁচটি হরিণ চোখে পড়লো রাণীর। মায়ার নির্দেশে রথচালক ঘোড়া দৌড়িয়ে দিলো। শিকারীর তাড়া খেয়ে হরিণ উর্ধ্বশ্বাসে পালাতে লাগল। পলায়নরত হরিণের পিছনে ঘোড়ার গাড়িও ছুটতে লাগলো তীরবেগে। কিছুদূর গিয়ে হরিণগুলো বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। এদের একটির পিছনে ছুটতে লাগলো মায়ারাণী। শাহী আস্তাবলের প্রশিক্ষিত ঘোড়াও দৌড়াতে লাগলো হরিণের পিছু পিছু। দৌড়াতে দৌড়াতে এমন জায়গায় এসে গেল যে, জমিন কোথাও পাথুরে টিলাময় আবার কোথাও বালুময়। হরিণ জীবন বাঁচাতে এমন জোরে জোরে লম্ফ দিচ্ছিল যে, এক একটি লাফে ত্রিশ চল্লিশ হাত দূরত্ব অতিক্রম করত। এমতাবস্থায় মায়ারাণী চার-পাঁচটি তীর নিক্ষেপ করেছিল কিন্তু কোনটিই লক্ষভেদ করতে পারেনি। হরিণের ডানে বামে গিয়ে পড়েছে মায়ারাণীর ছোড়া তীর। এমন সময় হরিণ দৌড়ে পৌছে যায় টিলা ও জঙ্গলাকীর্ণ জায়গায়। নাগালের বাইরে চলে যায় হরিণ। তবুও দ্রুত হাঁকাতে শুরু করলো রথচালক ঘোড়ার গাড়ি। উঁচু নীচু জমিনে আঘাত লেগে ঘোড়ার গাড়ি উল্টে যাওয়ার উপক্রম। কয়েকবার এমন হয়েছে যে, পড়তে পড়তে নিজেকে সামলে নিয়েছে মায়া।