দুদিন পরের ঘটনা। সারা আরবের মানুষ যেনো জমা হয়েছে সামরিক উৎসবে। বহু দূর দূরান্ত থেকে লোকজন এসে জমা হয়েছে। ময়দানে থাকার জন্য তাঁবু ফেলেছে দলে দলে। যেদিকেই চোখ যায় শুধু মানুষ আর মানুষ। সারা ময়দান ভরে গেছে তাঁবু, ঘোড়া আর উটে। শহরের রাস্তা দিয়ে লোকের ভীড়ে পথ চলা দায়। বিশাল ময়দান। একদিক থেকে তাকালে অপর দিকের সীমানা খুঁটি দেখা যায় না। ময়দানের মাঝখানে বৃত্তাকারে চিহ্ন দেয়া। এ বৃত্তের বাইরে আগত লোকজন অবস্থান নিয়েছে। বৃত্তের এক পাশে সুদৃশ্য প্যান্ডেল। নানা রংয়ের জড়িদার ঝালর ও বাহারী শামিয়ানা লটকানো এক মঞ্চ। মঞ্চের মাঝখানে শাহী সিংহাসন। এর পাশে দামী দামী কুরছি। এসব কুরছিতে বসবে খলিফার বেগম সাহেবাগণ। তাদের ডানে বামে উজির, সেনাপতি ও খেলাফতের পদস্থ কর্মকর্তাবৃন্দ। সেই সাথে বিভিন্ন কবিলা ও গোত্রের সর্দার ও গোত্রপতিদের বসার ব্যবস্থা।
সবার সামনে খলিফা ওয়ালিদ বিন মালিকের সিংহাসন। তার একপাশে প্রধান গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফের বসার আসন। হাজ্জাজের সাথেই তার একমাত্র কন্যা যুবায়দা উপবিষ্ট।
অগণিত দর্শক ময়দানের চারপাশে। কেউ বসা, কেউ দাঁড়ানো, কেউ নিজের বাহনের পিঠে আরোহী।
খলিফার ইঙ্গিতে প্রতিক্ষার প্রহর শেষে শুরু হলো সামরিক উৎসব। বাৎসরিক প্রতিযোগিতা। সেনাবাহিনীর বিভিন্ন ইউনিটের প্রতিযোগিরা পালাক্রমে ময়দানে প্রবেশ করে প্রতিপক্ষকে হারিয়ে দেয়ার হুমকি দিয়ে অতিক্রম করছে। ঘোড়দৌড়, তরবারী চালনা, তীর নিক্ষেপ ইত্যাদির প্রতিযোগিতা একের পর এক ঘটে চলছে। তরবারী প্রতিযোগিদের এক হাতে ছিল চামড়ার তৈরী ঢাল, অন্য হাতে তলোয়ার। এই খেলায় বেশ কয়েকজন প্রতিযোগী মারাত্মকভাবে আহত হলো। সবচেয়ে দর্শনীয় ছিল অশ্বারোহী যোদ্ধাদের প্রতিযোগিতা। প্রথমে অশ্বচালনায় বিভিন্ন নৈপুণ্য প্রদর্শনের পর আরোহীদের মধ্যে তরবারী চালনার প্রতিযোগিতা হলো। মুহাম্মদ বিন কাসিম না ছিল প্যান্ডেলের অতিথিদের মধ্যে, না ছিল সাধারণ দর্শক সারিতে। সুলায়মানকেও কোথাও দেখা যাচ্ছিল না। দর্শনার্থীরা প্রতিযোগিদের উৎসাহিত করতে আনন্দ ধ্বনিতে ময়দান মুখরিত করে রাখছিল। শোরগোল এতোটাই তীব্র ছিল যে, কারো কথাই শোনা
যাচ্ছিল না। ময়দানের ধাবমান ঘোড়া ও উটগুলো এতো ধুলোবালি উড়াচ্ছিল যে, ধুলোর অন্ধকারেই ওরা হারিয়ে যাচ্ছিল।
“এখন ময়দান খালি করে দাও, কেউ মাঠে থাকবে না।” হঠাৎ শাহী ঘোষকের কণ্ঠে শোনা গেল জলদগম্ভীর নির্দেশ।
কয়েকবার এ ঘোষণা দেয়ার পর মাঠ সম্পূর্ণ খালি হয়ে গেল। উড়ন্ত ধুলোবালিও হ্রাস পেতে পেতে মাঠ পরিষ্কার হয়ে গেল। হঠাৎ মাঠের এক কোণ থেকে একটি তাজি ঘোড়া মাঠে প্রবেশ করলো। দেখলেই বোঝা যায় এটি সেনাবাহিনীর শাহী নিরাপত্তা ইউনিটের বিশেষ ঘোড়া। গলার নীচ থেকে লেজ পর্যন্ত ঘোড়ার পিঠ মখমল কাপড়ে আবৃত। সুদৃশ্য ঝালর পেটের দিকে ঝুলছে। সোনালী বর্ণের ঝিকমিকে দু’টি পাদানী ঝুলছে অশ্বপিষ্ঠের দু’পাশে। এ অশ্বপৃষ্ঠে বসা এক সুদর্শন যুবক। তার মাথায় লোহার শিরস্ত্রাণ, হাতে বর্শা। কিন্তু বর্শার মাথা চামড়া দিয়ে আবৃত। কোমরে ঝুলছে তরবারী। মাঠে প্রবেশ করে অশ্বারোহী একটা চক্কর দিলো। দেখেই বোঝা যাচ্ছিল আরোহী শাহী খান্দানের বৈ-কি? আরোহী হাঁক দিলো- আছে কি তায়েফের কোন আরোহী যে আমার মোকাবেলা করার সাহস রাখে? আরোহী গলা ফাটিয়ে অজ্ঞাত প্রতিপক্ষের প্রতি হুমকি ছুড়ে দিলো। এ অশ্বারোহী আর কেউ নয়, খলিফা ওয়ালিদ বিন আব্দুল মালিকের ভাই শাহজাদা সুলায়মান। সে বিশেষ করে তায়েফের নাম উচ্চারণ করার দ্বারা মুহাম্মদ বিন কাসিমকে মোকাবেলায় প্রবৃত্ত হওয়ার আহবান করছে।
শাহজাদার এই হুমকিমূলক আহবানে ময়দান জুড়ে নেমে এলো নীরবতা। ভবিতব্য দেখার জন্য সকল দর্শনার্থী উৎকর্ণ ও অপলক নেত্রে মাঠের দিকে তাকিয়ে রইল। এমন সময় মাঠের এক কোণ থেকে প্রবেশ করলো এক অশ্বারোহী। এটিও সেনাবাহিনীর চৌকস সওয়ারী। এর আরোহীও যুবক। হাতে বর্শা আর কোমরে ঝুলন্ত তরবারী।
“ইবনে আব্দুল মালিক! তায়েফের কাসিম বিন ইউসুফের ছেলে তোমার। মোকাবেলা করতে এসেছে।” শাহজাদার হুমকির জবাবে পাল্টা হুমকি ছেড়ে দিলো যুবক। সারা ময়দান জুড়ে তখন পিনপতন নীরবতা।
কিছুক্ষণ পর মাঠের দু’প্রান্ত থেকে পরস্পরের প্রতি আক্রমণ শানিয়ে ঘোড়া হাঁকালো তারকা দুই প্রতিযোগী। উভয়েই পরস্পরের প্রতি বর্শা উদ্যত করলো। উভয়েই চাচ্ছিল বর্শার আঘাতে প্রতিপক্ষকে অশ্বপৃষ্ঠ থেকে ফেলে দিতে। মুখোমুখি এসে সুলায়মান বর্শা দিয়ে বিন কাসিমকে আঘাত করলো। বিন কাসিম আঘাত সামলে নিয়ে দূরে গিয়ে আবার মুখোমুখি উর্ধ্বশ্বাসে ঘোড়া হাঁকালো। দর্শনার্থীদের কারো চোখের পলক পড়ছে না। সবাই খলিফার আপন ভাই সুলায়মানকে চিনতো, প্রতিপক্ষ যুবককে অধিকাংশ লোক চিনতে না পারলেও এ মোকাবেলা যে বিশেষ তাৎপর্যবহ তা বুঝতে কারো বাকি রইল না।
এক পর্যায়ে পা-দানীতে দাঁড়িয়ে মুহাম্মদ বিন কাসিম সুলায়মানের দিকে বর্শার আঘাত হানলো। সুলায়মান নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করল বটে কিন্তু শেষ রক্ষা করতে পারল না। বর্শা তার পিঠে আঘাত হানলো। ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে যাওয়ার উপক্রম হলো। বহু চেষ্টা করেও ঘোড়ার পিঠে নিজেকে ধরে রাখার চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে নিজেই লাফ দিয়ে মাটিতে নেমে পড়ল। বর্শা পিঠে আঘাত হানলেও বিদ্ধ হলো না। কারণ বর্শার মুখে চামড়ার খোল ছিল।